বিবর্ণ_নীলাম্বরী,পর্বঃ বিংশ
মম_সাহা
মাঝে কেটে গেছে দু’দিন। নীলার সময় যাচ্ছে বেশ দ্রুত।সকালে উঠে ভার্সিটি সেখান থেকে আসতে আসতে বিকেল তারপর বর্ণদের রুমে গিয়ে কথাবার্তা বলে নাহয় রঙের সাথে ছাদে যায়। রাত নামে আকাশের বুকে ক্লান্ত পাখির মতন নীড়ে ফিরে শান্তির ঘুম দেয় সে।
একয়েকদিনে বর্ণের সাথে বেশ ভাব হয়েছে নীলার।আজকাল নীলা বর্ণের সান্নিধ্য পছন্দ করে। বর্ণ আশেপাশে থাকলে তার ভালো লাগে।
প্রতিদিনের ন্যায় আজও সকালে ঘুম থেকে উঠেছে নীলা।কিন্তু আজ তার শরীর চলছে না। ইদানীং অতিরিক্ত শীত পড়েছে আর নীলার গরম কাপড়ের প্রতি অনীহা তাই ঠান্ডা টা লেগেছে বেশ জোরদার ভাবে।
তবুও কোনো মতে তৈরী হলো নীলা।ঠান্ডায় শরীর ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।আজ ক্লাশ গুলো গুরুত্বপূর্ণ তাই যেতেই হবে।বেশ আঁটসাঁট করে গরম কাপড় পড়ে নিলো সে।এই কয়েকদিন প্রতিদিনই বের হওয়ার পর বর্ণ শীতের কাপড়ের জন্য জোড় করতো তারপর সে শীতের কাপড় পড়তো।
আজ নীলা সকালে কোনো খাবার তৈরী করে নি।তার শরীর ধীরে ধীরে বেশ অসুস্থ হচ্ছে।সে বাহিরে বের হয়ে ফ্লাটে তালা দিতেই বর্ণ আর রঙ বের হয়েছে।
নীলা তার ফ্লাটের চাবি বর্ণের মায়ের হাতে দিতেই বর্ণ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। নীলার চালচলন কেমন ধীর।শরীরে বল পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।বর্ণ সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করল
-‘নীলা আপনি ঠিক আছেন তো? কেমন অসুস্থ লাগছে আপনাকে?’
নীলা চমকে উঠে। এই ছেলেটা সব বুঝে যায় কীভাবে ভেবে অবাক হয় সে।বর্ণকে বুঝতে দিতে চায় না সে যে অসুস্থ। তাই কোনো মতে মাথা নাড়িয়ে “না” জানালো।
বর্ণ আর রঙ ওরা আসছি বলে লিফটের কাছে দাঁড়ালো। ওদের পিছে পিছে নীলাও আসলো।লিফটের দরজা খুলতেই রঙ ভিতরে চলে গেলো।বর্ণ নীলার পিছে দাঁড়িয়ে নীলাকে ঢুকতে বলল।নীলা ভিতরে যেতেই বর্ণ ওর পিছে পিছে গেলো।
রঙ প্রতিদিনের ন্যায় বকবক করছে।নীলা কেবল মাথা নাড়াচ্ছে।কোনো কথা বলছে না।কারণ তার কন্ঠস্বরের অবস্থা খুবই বাজে হয়ে গেছে ঠান্ডায়। কথা বললেই বুঝে যাবে ওরা।তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে মাথা নাড়াচ্ছে।
বর্ণ ফোনে অফিসের কিছু ফাইলের কাজ দেখছিলো।অনবরত রঙের কথা শুনে সে পিছে তাকায়। নীলা শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে মাথা নাড়াচ্ছে।
লিফট নিচে নামতেই তিনজন গাড়িতে গিয়ে বসলো।বর্ণ এবার গলা পরিষ্কার করে বলল
-‘নীলা আপনি কথা বলছেন না কেনো?’
নীলা চোখ বড় বড় করে তাকায়।বর্ণ খেয়াল করেছে তাহলে সবটা।রঙও এবার প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
-‘হ্যাঁ আপু দাভাই ঠিকই বলছে।তুমি এতক্ষণ খালি মাথা নাড়ালে।হু হাও করলে না আজ।ব্যাপার কি?’
নীলা অনেক কষ্টে উচ্চারণ করল
-‘কিছু না।’
নীলার এতটুকু উচ্চারণে বর্ণ গাড়ি ব্রেক কষে। রঙ অবাক হয়ে বলে
-‘আপু তোমার কন্ঠ এমন মর্মান্তিক হলো কীভাবে?’
নীলা করুন দৃষ্টিতে তাকায়। শব্দ উচ্চারণ করলেই গলা ব্যাথা শুরু হয়। বর্ণ গম্ভীর কন্ঠে বলল
-‘তাহলে তখন আমি ঠিকই ধরে ছিলাম।আপনি অসুস্থ। শুধু অসুস্থ না ভীষন রকমের অসুস্থ। কথা অব্দি বলতে পারছেন না।’
নীলা মাথা নিচু করে ফেলল।বর্ণ নীলাকে চুপ থাকতে দেখে বলল
-‘এখন চুপ করে আছেন যে? নিশ্চয়ই গলা ব্যাথার জন্য কথা বলতে পারছেন না?’
নীলা উপর-নীচ মাথা নাড়ায়। বর্ণ ওর গাড়ির ড্রয়ার থেকে কত গুলো ওষুধের থেকে দুটো ওষুধ নীলার দিকে বাড়িয়ে দেয়। পানির বোতল নীলার হাতে দিয়ে ওষুধ খেতে বলে।
নীলা বর্ণের ভিতর নিজের বাবার প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়।চোখ ছলছল করে উঠে তার।বাবা তার জীবতে বট গাছের মতন।বাবা না থাকলে কি হতো ভেবেই কলিজা মোচড় দিয়ে উঠে তার।বাবার অবর্তমানে এ লোকটাও তার বেশ খেয়াল রাখছে। লোকটার এসব আচরণে সে লোকটার প্রতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।
এসব ভাবতে ভাবতে ক্যাম্পাসের সামনে চলে আসে ওরা।বর্ণ নিতে আসবে বলে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যায়। আর নীলার খেয়াল রাখতে বলেছে রঙকে।
_______
আজ ক্যাম্পাস বেশ গরম। রাজনৈতিক ঝামেলা চলছে।নীলা আর ওর বন্ধুরা ক্লাশ রুমে গিয়ে বসলো।রঙকে ওর ক্লাশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ক্যাম্পাসে ঘুরাঘুরি করাটা বেশ বিপজ্জনক এখন।সবাই বসে কথা বলছে এর মাঝেই নীলাকে এক জুনিয়র মেয়ে এসে বলল
-‘আপু আপনি নীলা না?’
নীলা অবাক হয়ে মাথা উপর নীচ করলো। মানে সে ই নীলা।মেয়েটা নীলাকে বিপরীতের বিল্ডিং এর করিডোর দেখিয়ে বলল
-‘আপনাকে ওখানে একজন ডাকছে।’
নীলা অবাক হয়ে বলল
-‘কে ডাকছে?’
মেয়েটি হেসে বলল
-‘তা তো আপনি গেলেই দেখতে পারবেন আপু।চলুন আমার সাথে।’
নীলা সবাইকে বসতে বলে মেয়েটার সাথে গেলো।অহন আসতে চেয়েছিলো কিন্তু নীলা না করে দেয়।
নীলা মেয়েটার পিছে পিছে করিডোরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।মেয়েটা নীলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে চলে গেলো। মেয়েটা চলে গেলেই পিছন থেকে একটা শক্ত পুরুষ নালী কণ্ঠ ভেসে আসলো
-‘আমি ডেকেছি তোমায় নীলা।’
পরিচিত কন্ঠ শুনে পিছে ঘুরে তাকায় নীলা।পিছে শুভ্রমকে দেখে ভ্র কুঁচকে তাকায় সে।শুভ্রম নীলার দিকে কয়েকটা শুভ্র গোলাপ এগিয়ে দিয়ে বলল
-‘এটা তোমার জন্য এনে ছিলাম।রাস্তায় হঠাৎ সাদা গোলাপে চোখ আটকিয়ে গিয়েছিলো তখনই তোমার কথা মনে পড়লো তাই নিয়ে আসলাম। সবার সামনে তো দেওয়া যাবে না তাই এখানে ডেকেছি।’
নীলা নিজের দু’হাত বুকের মাঝে গুঁজে ভ্রু উঁচু করে জিজ্ঞেস করল
-‘আচ্ছা কালো গোলাপ দেখেন নি?’
নীলার এমন প্রশ্নে অবাক হয় শুভ্রম মাথা নাড়িয়ে বলল
-‘হ্যাঁ ছিলো তো কিন্তু কালো গোলাপ টা কেনো জেনো ভালো লাগে নি।কেমন বিদঘুটে লাগে।গোলাপ তো সাদা’ই সুন্দর।’
নীলা হেসে বলল
-‘আসলে ঐ কালো গোলাপ টাই আমি ছিলাম।আপনি বরাবরেরই মতন রঙে মন ভুলালেন সৌন্দর্য চিনলেন না।শুভ্র মানেই যে সুন্দর তা তো না।হ্যাঁ জানি সব ফুল সুন্দর।আপনি কি জানেন ঐ ফুল হলো মেয়ে।যেমন সব ফুল সুন্দর তেমনই সব মেয়ে সুন্দর।কিন্তু আমরা মানে আমরা সবাই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে এটা মানি না।আমরা শুভ্র মানে সুন্দর কালো মানে বিদঘুটে ভেবেই বসে থাকি।
নীলার কথা আচ্ছা মতন লজ্জা পেলো শুভ্রম।মাথা নিচু করে বলল
-‘আমারই ভুল নীলা।তুমি কি আরেকবার আমাকে নীলা থেকে নীলাম্বরী ডাকার অধিকার দিবে?আমি সব ভুল শুধরে নিবো।’
নীলা আগের ন্যায় হাসি বজায় রেখেই বলল
-‘আমি তো কখনোই নীলাম্বরী ডাকার অধিকার আপনাকে দেই নি।আপনি নিজেই ডেকে ছিলেন। তারপর আপনি নিজেই বুজে ছিলেন আসলে আপনি এই নামটা ডাকার যোগ্য না তাই ডাকেন না।সব তো আপনিই করলেন তাহলে আবার নতুন করে জিজ্ঞেস করছেন কেন?’
শুভ্রম ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে। তারপর বলে
-‘তোমার সব কথা যুক্তিযুক্ত। তবে তুমি শুভ্র রাঙা জামা কেন পড়ো? কালো পড়লেই পারো।’
নীলা “কিছু না” বলে চলে আসতে নিলে পিছন থেকে শুভ্রম বলল
-‘আমাকে পছন্দ করো না কিন্তু আমার ইচ্ছেই রাখছো নীলা? রিফিউজের দিন আমার আকুতি তবে একটু হলেও তোমার মনে লেগে ছিলো।এতটুকুতেই ধন্য আমি।’
নীলা কথা পাত্তা না দিয়ে নিচে নেমে আসে।হ্যাঁ যেদিন শুভ্রমের প্রপোজাল রিফিউজড করে ছিলো সেদিনই শুভ্রম বলে ছিলো অন্তত তার প্রিয় রঙটা জেনো সবসময় জড়িয়ে রাখে।এটাই তার প্রাপ্তি হবে।নীলা শুভ্রমের প্রতি এক পুরোনো কৃতজ্ঞতা থেকে এই কথা টা রেখে ছিলো।
______
কলেজের ঝামেলা বেশ গুরুতর। আজ কোনো ক্লাশই হয় নি।সবাইকে আটকিয়ে রাখা হয়েছে ক্যাম্পাসে জেনো ঝামেলাতে কেউ আঘাতপ্রাপ্ত না হয়।
বর্ণকে রঙ কল দিয়ে কলেজের সামনে আসতে বলেছে।মেইন গেইট এখনি খোলা হবে তখন সব শিক্ষার্থীদের কলেজ ক্যাম্পাস ছাড়তে হবে।
সবাই গেইটের পাশে পাশে ঘুরঘুর করছে। হঠাৎ রঙের চোখ গেলো দিয়ার দিকে।সে নীলাকে খোঁচা দিয়ে দিয়াকে দেখালো।নীলা ভ্রু কুঁচকে বলল
-‘দিয়া কখন আসলো ক্যাম্পাসে? ওরে না ক্যাম্পাস বহিষ্কার করা হয়েছিলো?’
রঙ মুখ গোমড়া করে বলল
-‘রাজনৈতিক দলের সাথে ওর সম্পর্ক আছে।আজ ঝামেলা না সেই জন্য হয়তো এসেছে।’
ওদের কথার মাঝেই গেইট খুলে দেয়। গেইটের সামনে বর্ণের গাড়ি দেখে রঙ দৌড়ে চলে যায় বর্ণের কাছে।নীলা যেতে নিলেই দেখে এক ছেলে তার হাতে কাচের বোতলে কোনো একটা তরল পদার্থ নিয়ে দিয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।তরল পদার্থ টা কি সেটা নীলার বুঝতে বাকি রইল না।
নীলা দৌড়ে দিয়াকে সরাতে সরাতে তরল পদার্থ টা ছুঁড়ে মারল ছেলেটা।গগণ বিদারক আত্ম চিৎকারে ভারী হয়ে যায় জায়গা সবাই হা হয়ে তাকিয়ে রইল।বর্ণ কেবল চিৎকার দিয়ে বলল
-‘নীলাম্বরী!!’
চলবে