বিবর্ণ_নীলাম্বরী,পর্বঃ ষষ্ঠাদশ
মম_সাহা
সন্ধ্যার নাস্তা দিচ্ছে সবাইকে।আড্ডার সাথে নাস্তাও খাচ্ছে সবাই।কিন্তু একজনের নাস্তার দিকে কোনো হুঁশ নেই।সে নীলাম্বরীর দিকে তাকিয়ে আছে মুগ্ধ দৃষ্টিতে। এই প্রথম নীলাম্বরীর উপর তার মুগদ্ধতা কাজ করছে।সে মানুষ টা আর কেউ না রাহাত।
নীলাম্বরী যখন সাদা জামার সাথে আকাশী রঙের উড়না মাথায় জড়িয়ে ড্রয়িং রুমে এসেছিলো ঠিক তখন থেকে রাহাতের দৃষ্টি যে আটকালো রমনীর দিকে এখনও দৃষ্টি ফেরানোর ইচ্ছে জাগছে না।
রাহাত মনে মনে নিজেই অবাক হয় নিজের মুগ্ধতা দেখে।তার সাথে এটা ভেবেও অবাক হয় সে কখনো নীলার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকায় নি বা নীলাকে এত গভীর ভাবে খেয়াল করেও নি।নীলার রূপ নিয়ে এতদিন যা বলতো তা মনের ক্ষোভ থেকে কিন্তু আসলে নীলা একেবারেই তেমন না।মেয়েটার গায়ের রঙ বেশ উজ্জ্বল শ্যামলা বললেও চলে।মুখটা গোলগাল,ছোট।বেশ সুন্দর বা মায়াবী বললেও চলে।
রাহাত এবার নিরুপমার দিকে তাকায়। বরাবরই সে সৌন্দর্যের পূজারী। সুন্দর মেয়েই তার দুর্বলতা। কিন্তু আজ জেনো ফর্সা নিরুপমার সৌন্দর্যও নীলার সৌন্দর্যের কাছে নগন্য মনে হচ্ছে।
রাহাতের এমন দৃষ্টি চোখ এড়ায় না দুজনের। একজন আরেকজনকে ইশারা দিয়ে কিছু একটা বোঝায়।
নীলা চা খাচ্ছিলো।এর মাঝেই নীড় এসে বলল
-‘ছোট আপু তোমার সাথে আমার একটু দরকারী কথা ছিলো।’
নীরা ভ্রু কুঁচকে তাকায়।তারপর বলে
-‘জ্বি ভাইয়া বলেন।’
নীড় হেসে বলে
-‘এটা সিক্রেট কথা।তুমি একটু এখানে আসো।’
নীলা নীড়ের সাথে ড্রয়িং রুম থেকে একটু কিনারে গিয়ে দাঁড়ায়।নীড় মাথা চুলাকে বলে
-‘ছোট আপুই ভাইয়া তো ঘরে একা আছে।তুমি যদি ভাইয়ার নাস্তাটা আমাদের রুমে নিয়ে দিয়ে আসো ভালো হতো।’
নীলা কতক্ষণ নীড়ের দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হেসে বলল
-‘ওহ্ এই কথা ভাইয়া।এটা বলার জন্য আড়ালে ডাকলেন!আমি ভাবলাম কি না কি।আচ্ছা আমি নিয়ে যাচ্ছি।’
নীড় মুচকি হেসে বলল
-‘ছোট আপু আরেকটা কথা ছিলো।’
নীলা মাথায় ইশারা করে বলল
-‘কি কথা ভাইয়া।’
নীড় মাথা নিচু করে বলল
-‘তুমি রাতের খাবার অব্দি আমাদের রুমে থাকবে প্লিজ।আমি রং আর তোমার আপুকে পাঠিয়ে দিবো আমাদের বাসায়। কেমন?’
নীলা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল
-‘কেনো ভাইয়া?’
নীড় শান্ত স্বরে বলল
-‘আসলে আমরা আড্ডা দিবো কেমন।তুমি যাও।’
নীলা মাথা নাড়িয়ে চলে যায়। নীড় কাউকে মাথা দিয়ে ইশারা করে কিছু একটা আশ্বাস দিলো।
_______
নীলা নাস্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বর্নের রুমের সামনে।ভিতর থেকে দরজা আটকানো।ফ্লাটের গেইট খোলা ছিলো বিধায় চলে আসতে পেরেছে।বর্ণদের বাসার সবাই তাদের বাসায় আড্ডা দিচ্ছে।
নীলার অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। নক দিবে কি না ভাবতে ভাবতে নক দিয়েই দিলো।ভিতর থেকে বর্ন বলল
-‘ইয়েস কামিং।’
নীলা গুটি গুটি পায়ে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো।তারমানে দরজা ভিরানো ছিলো।বর্ণ মোটা একটা বই নিয়ে পড়ছে।একবারও মুখ তুলে তাকায় নি।হয়তো বুঝতে পারে নি নীলা এসেছে।
নীলা খাবার টা ছোট সেন্টার টেবিলে রেখে দাঁড়াল। তারপর ছোট্ট স্বরে বলল
-‘আপনার বিকালের নাস্তা পাঠিয়েছে। খেয়ে নিন।’
পরিচিত মিষ্টি মেয়েলী স্বরে ভ্রু কুঁচকে তাকায় বর্ণ।সামনে তার বিবর্ন নীলাম্বরীকে দেখে আনন্দের মুচকি হাসি দেয়।বইটা বন্ধ করে বলে
-‘আরে নীলাম্বরী যে।তা কীভাবে এই অধমের উপর এত দয়া হলো?তার ঘরে আপনার পদ ধূলি ফেললেন।’
নীলা হালকা হেসে বলল
-‘অধম তো আর নীলাম্বরীকে আমন্ত্রণ জানায় নি আসার জন্য তাই আসে নি।’
বর্ণ মুচকি হাসে নীলাম্বরী যে তাকে স্বাভাবিক ভাবে নিচ্ছে সেটাই অনেক।বর্ণ খাটে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল
-‘এই অধম আর পুরো ঘর নীলাম্বরীর চরণ তলে রাখলাম।অধমের কি এত সাধ্য আছে যে আমন্ত্রণ করবে নীলাম্বরীকে।সে বরং নিজেকে সমর্পণ করলো নীলাম্বরীর কাছে।’
বর্ণের বলার ভঙিতে হেসে দেয় নীলাম্বর। হাসতে হাসতেই বলে
-‘হয়েছে হয়েছে আর ঢং করতে হবে না।বসে খাবার টা খান।’
বর্ণ মুগ্ধ হয়ে নীলার হাসির দিকে তাকিয়ে আনমনেই বলে
-‘আপনাকে হাসলে কি যে সুন্দর লাগে তবুও আপনি হাসেন না। কেন বলুন তো?’
নীলাম্বরীর হাসি থেমে যায়। মনে পড়ে যায় রাহাতের কথা। তার হাসি তো ঐ ছেলেটাই কেড়ে নিয়েছে।
নীলাম্বরীকে হঠাৎ চুপ হতে দেখে বর্ণ বলে উঠলো
-‘কার কথা মনে পড়ে গেলো আপনার?’
নীলা অবাক হয়।তার যে অন্য কারো কথা মনে পড়ে গেলো সেটা বর্ণ বুঝলো কীভাবে। নীলাকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে বর্ণ সোফায় বসতে বসতে বলল
-‘কাউকে ভালোবাসতেন তাই না?’
বর্ণের প্রশ্নে জেনো ঘাবড়ে গেলো নীলা।লোকটা বুঝলো কীভাবে? কোনো মতেই বুঝতে দেওয়া যাবে না যে সে যা বুজেছে তা ই ঠিক।আমতাআমতা করে নীলা বলল
-‘কি বলছেন এসব!’
-‘আপনাকে বড়াবড়ই আমি সত্যবাদী ভাবি নীলাম্বরী।আশা করি মিথ্যা কিছু আপনার মুখ থেকে শুনবো না।’
নীলা চুপ হয়ে যায়। এখানে আর মিথ্যা বলার কোনো স্কোপ নেই বুঝাই যাচ্ছে।নীলা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। বর্ন হা হা করে হেসে উঠে।নীলা ভ্রু কুঁচকে তাকায়।বর্ণ নীলার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতেই বলে
-‘আরে এত ঘাবড়ে গেলেন কেনো নীলাম্বরী? আ’ম জাস্ট জোকিং।’
নীলাম্বরী স্বস্তি পেলো।জোড়ে একটা শ্বাস ফেলল।বর্ণ খেতে খেতে বলল
-‘যে ভালোবাসার কথা মাথায় আসলে এক ঝাঁক অস্বস্তি মিলে আর যাই হোক সেটা ভালোবাসা না। জানেন তো নীলাম্বরী মোহ আর ভালোবাসাকে আমরা গুলিয়ে ফেলি।মোহ হলো যা একদিন কেটে যাবে।আর ভালোবাসা হলো যা চিরন্তন।আপনি না থাকলেও আপনার ভালোবাসা ঠিকই থেকে যাবে।আপনাকে এসব বলছি জেনো আপনি ভালোবাসা আর মোহ দুটিকে আলাদা করতে পারেন।’
নীলা জেনো এতটুকু কথায় অনেক কিছু জানতে পারলো।মনে মনে প্রশ্ন করলো তাহলে কি রাহাতের প্রতি যেটা ছিলো সেটা ভালোবাসা ছিলো না!!
____
সকাল বেলা আজিজুর রহমান হাঁটতে বের হন।আজ তার সাথে নীলাও বের হয়েছে।বাবার সাথে সময় কাটানো ও হয়ে যাবে সাথে দরকারি কথাও হয়ে যাবে।
হাঁটতে হাঁটতে তারা একটা পার্কে এসে বসে।আজিজুর রহমানের পাশে নীলা এসে বসে।
তাদের সামনে ছোট্ট একটা মেয়ে তার মাকে হাওয়াই মিঠাই কিনে দেওয়ার বায়না করছে।মা সযত্নে হাওয়াই মিঠাই কিনে মেয়ের হাতে তুলে দিচ্ছে।
নীলার ছোট বেলার স্মৃতি মনে পড়ে গেছে। সে হাসি মুখে বাবার দিকে ফিরে দেখে বাবা নেই।অবাক হয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই দেখে তার বাবা তার সামনে একটা হাওয়াই মিঠাই ধরে আছে।
নীলা হাসি মুখে বাবার থেকে মিঠাই টা নিলো।আজিজুর রহমান মেয়ের পাশে বসে বললেন
-‘পিচ্চি মেয়েটাকে দেখে আমারও ছোট বেলার নিরু আর নীলুর কথা মনে পড়লো।তারও কত বায়না করতো।এখন মেয়েরা বড় হয়েছে।বায়না করা ভুলে গেছে কিন্তু বাবা মা কি আর সন্তানের পছন্দ ভুলে যায়?’
নীলা হাসে।বাবার হাতটা আলতো করে জড়িয়ে ধরে। তারপর নিবিড় স্বরে বলে
-‘বাবা নিরু আপার বিয়েটা একটু তাড়াতাড়ি দিয়ে ফেলছো না?’
আজিজুর রহমান হাসি মুখেই বলে
-‘কেন মা?তোমার এমন কেন মনে হলো?’
নীলু কথা ঘুরিয়ে বলে
-‘আসলে বাবা আমরা তো তোমার দুটো মেয়ে।আমাদের এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিলে তোমরা কার সাথে থাকবে?’
আজিজুর রহমান হা হা করে হেসে ফেলেন।মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন
-‘সেই জন্যই তো ঘরের মেয়েকে ঘরে রাখছি।রাহাতের সাথে বিয়ে হলে নিরু তো ঘরেই থাকবে।’
নীলু আনমনেই বলে উঠে
-‘বাবা রাহাত ভাইয়ের সম্পর্কে আরেকটু ঘেটে দেখতে।’
আজিজুর রহমান ভ্রু কুঁচকে বলে
-‘মা ও তো আমাদের ঘরের ছেলে।কি আর ঘেটে দেখবো।’
নীলু ধ্যান ভাঙে। বাবাকে কিভাবে বুঝাবে সে রাহাত যে খারাপ।
নীলু কিছু ভেবে না পেয়ে উঠে দাঁড়ায়।বাবাকে বলে বাসায় যাওয়ার কথা।আজিজুর রহমান মেয়ের কথায় সাঁই দিয়ে হাটঁতে শুরু করলেন এবং বললেন
-‘মা একটা গান শুনেছো?’
নীলা মাথা নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে
-‘কি গান বাবা?’
আজিজুর রহমান হাঁটতে হাঁটতে গান ধরলেন
-‘সময় গেলে সাধন হবে না,,
দিন থাকতে দিনের সাধন কেনো করলে না,,
সময় গেলে সাধন হবে না।’
চলবে