বিবর্ণ_নীলাম্বরী,পর্বঃ সপ্তম

0
2625

বিবর্ণ_নীলাম্বরী,পর্বঃ সপ্তম
মম_সাহা

বর্ণ আর নীলা দুজনেই ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। বর্ণ পরিচয় দেওয়ার পর নীলা তাকে চিনতে পেরেছে।তারপর থেকেই দুজন চুপচাপ।নীলা এমনেতেই এক বোকামির জন্য লজ্জিত হয়েছে।সেদিন রাত্রে ছেলেটা তাদের এগিয়ে গিয়ে নিয়ে আসলো আর সে ছেলেটাকেই ভুলে গেলো।আবার যদি এখন এখান থেকে চলে যায় তাহলে তো আরো খারাপ দেখাবে।তাই সে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।

বর্ণ কথা কীভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছে না।মেয়েটা কেমন গম্ভীর। কী বললে কী মনে করে সেই ভেবেই ভয় লাগছে তার।

নিরবতা ঠেলে বর্ণই বলে উঠলো
-‘আচ্ছা আপনি এমন চুপচাপ থাকেন কেনো?’

হঠাৎ এমন প্রশ্নে নীলা বিভ্রান্তিতে পড়লো।নীলার বিভ্রান্তি বুঝতে সমস্যা হলো না বর্ণের।সে সাথে সাথেই বলল
-‘আরে ধূর আমি উল্টাপাল্টা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছি।কিছু মনে করবেন না।আসলে আপনাকে সবসময় গম্ভীর থাকতে দেখি তো তাই কৌতূহল বশত বলে ফেলেছি।রাগ করবেন না প্লিজ।’

নীলা সামনের ছেলেটার আচরণে মুগ্ধ হয়।কি সুন্দর একটা প্রশ্ন করলো এটা আবার নীলার খারাপ লাগবে ভেবে কত অনুনয়ও করলো।নীলা অবাক হয়।এ পর্যন্ত কেনো মানুষ নীলাকে কিছু বলার সময় ভাবে নি।আর এই ব্যাক্তি সামান্য কথা বলেও কতকিছু বলেছে জেনো রাগ না করে।

নীলা মুচকি হাসি দিয়ে বলল
-‘আরে না না রাগ করবো কেনো?আপনি তো খারাপ কিছু বলেন নি।’

বর্ণ নীলার হাসি দেখে মুগ্ধ। এত সুন্দর করে মেয়েটা হাসতে জেনেও হাসে না?কি সুন্দর গোলগাল মুখ।হাসলে বাম গালে একসাথে দুইটা টোল পড়ে।চুল গুলো মাশাল্লাহ কোমড় অব্দি।এ এক আধাঁরিয়া সৌন্দর্য।বর্ণকে চুপ থাকতে দেখে নীলা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো
-‘কি হলো কি দেখছেন?’

বর্ণের জেনো হুঁশ ফিরে আসলো।সে মাথা নিচু করে মুচকি হাসি দিয়ে ডান হাতটা দিয়ে মাথার চুল গুলো পিছে ঠেলে বলল
-‘না কিছু না।’

নীলা কিছু একটা ভেবে আবারও চুপ হয়ে গেলো। বর্ণ নীলার চুপ হওয়াটাও বুঝতে পারলো। সে হেসে বলল
-‘আচ্ছা মিস. আমার মনে হয় আপনি কোনো কারণে মিশতে চান না সবার সাথে।কারণটা কি বলবেন?’

নীলা চুপ করে থাকে। কি ই বা বলবে।তার বলার কিছু নেই।নীলার ভাবনার মাঝেই বর্ণ বলল
-‘কারণ টা কি আমি বোধহয় আন্দাজ করতে পেরেছি।শুনেন আমি একটা কথা বলি।আপনি যে সবার থেকে নিজেকে এমন গুটিয়ে নেন,অচেনা মানুষের সামনে থাকতে সংকোচবোধ করেন, কেউ আপনাকে কিছু বলে না দেয় সে ভয়ে থাকেন এগুলো করে কখনোই আপনি আপনার আত্মসম্মান রক্ষা করতে পারবেন না।বরং এগুলো করা মানে আপনি আপনার দুর্বলতা সবার সামনে প্রকাশ করছেন।সবাইকে বুজাচ্ছেন আপনি পালিয়ে বাঁচতে চান কিন্তু আপনার ব্যাক্তিত্ব তো এটা না নীলাম্বরী সরি নীলা।’

একমনে চুপ করে সবটা কথা শুনলো নীলা।বর্ণ নীলাকে চুপ থাকতে দেখে আবার বলল
-‘এভাবে থাকলে হবে না নীলা।আপনাকে সবার সামনে যেতে হবে।সবার সাথে মুক্ত মনে মিশতে হবে।সবার মাঝে যখন একজন আপনাকে নিয়ে বাজে একটা কথা বলবে তখন আপনি একটা দৃঢ় হাসি দিয়ে সেই কথার তীব্র প্রতিবাদ জানাতে হবে।তবেই না সবাই আপনার ব্যাক্তিত্বের প্রখরতা বুঝবে মেডাম।’

নীলা বেশ মুগ্ধ হচ্ছে তার সামনে দাঁড়ানো ছেলেটার কথায়।শরীর কাটা দিয়ে উঠছে।ছেলেটার কথার ধরন একজনের সাথে মিলে যায়।

নীলার ভাবনার মাঝে নীলার শরীরে একটা চাদর জড়িয়ে দেয় কেউ।নীলা ভাবে তার পুরোনো পরিচিত মানুষটাই হয়তো চাদর জড়িয়েছে।নীলা তাকিয়ে দেখে আজ তার ভাবনা ভুল।তার শরীরে বর্ণ আলগোছে চাদর টা জড়িয়ে দিয়েছে।নীলার মনে পড়ে কথার ধরণ টা কার মতন।তার বাবাও তো এত সুন্দর করে তাকে বুঝাতো।এভাবে শীত কালে তার বাবাই তো তাকে এভাবে চাদর জড়িয়ে দিয়েছে।নীলার বুকটা ছ্যাত করে উঠে।আর কাউকে সে বিশ্বাস করবে না।সবাই খারাপ সবাই।নীলা ছুটে ছাদ থেকে নেমে যায়।

বর্ণ কিছু বুঝে উঠার আগেই নীলার এমন আচরণে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। সে কয়েকবার নীলাকে পিছু ডাকে।নীলা শুনে না সেই ডাক।বর্ণ ভাবে তার চাদর জড়িয়ে দেওয়াতে আধাঁরিয়া রমনী রাগ করেছে।বর্ণ ‘ও শীট’ বলে ছাদের রেলিং এ ঘুষি লাগায়। ঘুষি দিয়ে সে আশ্চর্য হয়ে যায় কারণ এত জোড়ে ঘুষি দেওয়ার পরও সে ব্যাথা পায় নি।সে তাকিয়ে দেখে কারো একটা শক্ত পোক্ত হাতের উপর ঘুষিটা পড়েছে।

হাতের অধিকারী মানুষটাকে দেখে বর্ণ আরও অবাক হয়ে যায়। কারণ সে আর কেউ না বর্ণের স্যার আজিজুর রহমান। বর্ণ তাড়াতাড়ি করে বলে উঠে
-‘স্যার আমি দুঃখিত। আপনার হাতে লেগে যাবে আমি ভাবি নি সরি স্যার।আপনি আমাকে শাস্তি দেন আমি সত্যিই বুঝি নি।’

আজিজুর রহমান বরাবরই বর্ণের আচরণ দেখে বিমোহিত। এখানে ছেলেটার কোনো দোষ নেই।সেই এসে হাতটা রেখেছে জেনো ছেলেটা ব্যাথা না পায়। আজিজুর রহমান মুচকি হাসি দিয়ে বর্ণের বাহুতে হালকা চড় দিয়ে বললেন
-‘তুমি তো ইচ্ছে করে দেও নি।আমি নিজেই হাতটা রেখেছি তাহলে শাস্তি কিসের?’

বর্ণ অবাক হয় স্যারের ব্যবহারে।এই জন্যই এ মানুষটাকে তার এত প্রিয়। বর্ণ মাথা নত করে বলে
-‘তবুও স্যার আমার খেয়াল রাখা উচিত ছিলো।দুঃখিত স্যার।’

আজিজুর রহমান দীর্ঘশ্বাস নেয়।তারপর রেলিং এ ভর করে নিচের দিকে তাকিয়ে বলে
-‘তোমরা আজকাল কার ছেলে মেয়েরা বড্ড অধৈর্য কোনো কিছু না জেনেই অধৈর্য হয়ে পরো।আমি তোমাকে ভরসা করি।আমি জানি তুমি অনেক বুদ্ধিমান তাই ধৈর্য হারা হওয়াটা তোমায় মানায় না।’

বর্ণ বুঝতে পারে না তার স্যার হঠাৎ এই কথা বলছে কেনো? প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে সে তাকায় আজিজুর রহমানের দিকে।আজিজুর রহমান বর্ণের দৃষ্টির অর্থ বুঝে। মুচকি হেসে বলে
-‘আমার মেয়ে তোমার উপর রাগ করে এখান থেকে যায় নি।গিয়েছে অন্য কারণে।’

বর্ণ চমকায়।তবে স্যার সবটা দেখেছে? স্যার কি তাহলে তাকে ভুল বুঝবে?

আজিজুর রহমান বর্ণকে চুপ থাকতে দেখে বলে
-‘আমি কখনোই তোমাকে ভুল বুঝি নি বর্ণ।যদি ভুল বোঝারই হতো তাহলে একবছর আগে থেকেই ভুল বুঝতাম।যখন দেখে ছিলাম তুমি আমার বাসায় গিয়ে আমারই ছোট মেয়ের রুম থেকে সবার অবর্তমানে আমার ছোট মেয়ের ছবি মুগ্ধ চোখে দেখে পকেটে ভরে নিয়েছিলে।’

বর্ণ আশ্চর্যের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। সাথে লজ্জাও পায় কারণ তার স্যার সবটাই এত দিন জানতো।

বর্ণকে লজ্জা পেতে দেখে আজিজুর রহমান বলল
-‘লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই মাই সান।আমি জানি তুমি একবছর আগেই আমার ছোট মেয়েকে ছবি দেখেই পছন্দ করেছো।তারপর আরও দুবার আমার বাসায় গিয়ে আমার ছোট মেয়ের ছবি লুকিয়ে নিয়ে এসেছো।আমি সবটাই জানি।কিন্তু আমি বাঁধা দেই নি।হ্যাঁ নীলা আমার মেয়ে তেমন তুমিও তো আমারই সন্তান।আর আমি জানি তুমি অনেক যোগ্য। কিন্তু সেটা যে নীলার কাছে তোমাকে প্রমাণ করতে হবে সান।’

বর্ণ মুচকি হেসে মাথা নাড়ায়। সামনের মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধা আরও বেড়ে যায়।

আজিজুর রহমান বর্ণের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন
-‘আমি তোমাকে ভুল চিনি নাই তা একটু আগে আবার প্রমাণ হলো। আমার মেয়ের শীতে গরম কাপড় মনে করে পড়ার অভ্যাস নেই।বরাবরই আমাকে পড়িয়ে দিতে হয়।আজ দেখলাম আমার কাজটা অন্য কেউ নিজের হাতে তুলে নিয়েছে।নিশ্চিত হলাম মানুষ চিনতে আমার সত্যিই ভুল হয় নি।’

বর্ণ প্রাণভরে শ্বাস নেই।যাক একবছর পর তার মনের খবর কেউ জানলো এতেই শান্তি।তখনই বর্ণ ফিল করলো তার শরীরে কেউ চাদর জড়িয়ে দিচ্ছে।সেটা আর কেউ না আজিজুর রহমান।

আজিজুর রহমান বর্ণের গায়ে চাদর জড়াতে জড়াতে বলল
-‘তুমি তো তোমার চাদরটা আমার মেয়েকে দিয়ে দিলে।তাই আমার মেয়ের জন্য যেটা এনেছি সেটা তুমি নেও।আমার মেয়ের খেয়াল তুমি তখনই রাখতে পারবে যখন তুমি নিজে সুস্থ থাকবে।তাই না?’

বর্ণ উপর নিচ মাথা নাড়ায়। তারপর বলে
-‘স্যার তাহলে নীলাম্বরী রাগ কেনো করলো সেটা বললেন না।’

আজিজুর রহমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে।আকাশ পানে চেয়ে বলে
-‘শামুক দেখেছো কখনো? তার উপরের খোলশ শক্ত ভিতরেরটা নরম।আমার মেয়েও ঠিক এমনই।সে আগে এমন ছিলো না তবে কোনো এক কারণে হয়ে গেছে।আমার যতটুকু মনে হয় তোমার কাজ তাকে মুগ্ধ করেছে কিন্তু সে চায় না কারো উপর মুগ্ধ হতে বা বিশ্বাস করতে।তাই সে পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে গেলো।’

বর্ণ এবার বুঝতে পারে নীলার আচরণের কারণ।হঠাৎ করেই আজিজুর রহমান বর্ণের দুহাত আকড়ে ধরে বলে
-‘বলো তো আমার মেয়েটা আমার কাছে কী?’

বর্ণ মুচকি হেসে বলে
-‘আপনার প্রাণ।’

আজিজুর রহমান ছলছল নয়নে তাকিয়ে বর্ণকে বলল
-‘তাহলে মনে রেখো এক নিরুপায় বাবা তার প্রাণ তোমার ভরসায় রেখে যাচ্ছে।ভরসা রেখো সে হতভাগা বাবার।’

আজিজুর রহমান এক সেকেন্ড ও দাঁড়াল না চলে গেলো।বর্ণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আজিজুর রহমানের দিকে।বরাবরই দেখে আসছে এই মানুষটার ব্যাক্তিত্বে পাহাড়ের মতন প্রখর তালগাছের মতন উচুঁ।আজ সে মানুষটারও চোখ ছলছল করছে!

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here