বিবর্ণ_নীলাম্বরী,পর্বঃ সপ্তদশ
মম_সাহা
নীলা রেডি হচ্ছে ভার্সিটি যাওয়ার জন্য। শুধু শুধু ব্যাক্তিগত কারণে ভার্সিটি মিস দিয়ে লাভ নেই।আর কয়দিন পর এমনেতেও আপুর বিয়ে উপলক্ষে বন্ধ দিতে হবে।
বিয়ের কথা মনে পড়তেই এক রাশ চিন্তা হানা দিলো নীলার মনে।সে বাবাকে সকালে জানাবে বলেই বাবার সাথে গিয়েছিল কিন্তু হঠাৎ রাহাতকে দেখে সে আর কিছু বলে নি।রাহাত তাকে সর্বক্ষণ খেয়াল রাখছে তার একটা অসাবধনতায় সবার জীবনে ঝুঁকি নেমে আসবে।
নীলার মাথায় বাবার গাওয়া সকালের গানটা মনে পড়লো।বাবা কি বুঝাতে চাইলো তবে।সময় গেলে সাধন হবে না মানে বাবা হিন্টস দিতে চেয়েছে।কিন্তু কি হিন্টস।
এক ঝাঁক চিন্তা নিয়ে তৈরী হলো নীলা।আজও সাদা রঙের জামা পড়েছে। চুল গুলো বেনী করে একপাশে এনে মাথায় উরনা দিয়ে ঘর থেকে বের হলো।
কাল থেকেই রাহাতের ঘুম হচ্ছে না ভালো করে।নীলার ঐ মোহনীয় রূপ রাহাতকে এতই মুগ্ধ করেছে যে সে কল্পনাতেও এই রূপ দেখতে পায়।নীলাকে রুম থেকে বেরোতো দেখে রাহাত তাকালো। আজও শুভ্র রঙে মুগ্ধ হয়েছে রাহাত।সে এতদিন ঘৃণার কার্তুজ চোখে পড়ে ছিলো তাই এই মায়াবী নারীর সৌন্দর্য দেখতে পারে নি।
আজিজুর রহমান নিজেরে মেয়েকে বের হতে দেখে একটা সুন্দর হাসি উপহার দিয়ে বলল
-‘মা ভার্সিটিতে যাবে?’
নীলা রাহাতের দিকে একপলক তাকিয়ে বাবার কাছে গিয়ে বসলো।মাথা নাড়িয়ে বলল
-‘হ্যাঁ বাবা ভার্সিটিতে যাবো।’
রাহাত ওদের কথার মাঝেই বলে উঠলো
-‘চাচ্চু তাহলে আমিই দিয়ে আসি আজ নীলাকে।’
রাহাতের কথা শেষ হতেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় নীলা।রুক্ষ স্বরে বলে
-‘না রাহাত ভাইয়া আমি একাই যেতে পারবো।’
-‘একা যাওয়ার কি দরকার আপনি আমাদের সাথেই যেতে পারবেন।’ দরজায় দাঁড়িয়ে বর্ণ বলল।
নীলা রাহাতের হাত থেকে বাঁচতে বলে
-‘হ্যাঁ হ্যাঁ আমি তো ভুলেই গেছি আমি রঙের সাথে যাবো বাবা।’
আজিজুর রহমান হেসে বলল
-‘আচ্ছা যেও কিন্তু তুমি তো কিছু খাও নি মা।’
-‘ভার্সিটিতে গিয়ে খেয়ে নিবো।’বলেই উঠে দাঁড়ায় নীলা।মা আর বড়মাকে বলে বেড় হয়ে যায়।
রাহাত মনে মনে ফুঁসে ওঠে। সে তো আজ খারাপ মনোভাব নিয়ে কিছু বলে নি।তাও নীলার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এসে পড়লো।
ফ্লাট থেকে বের হতেই রঙও হাজির হয়।আর প্রতিদিনের মতন এসেই হাসিমুখে বলল
-‘মাশাল্লাহ আপু কি সুন্দর লাগছে তোমায়।’
নীলা কথার পিঠে মুচকি হাসে।বর্ণ আড়চোখে তাকায় নীলার দিকে।তারা লিফটের জন্য অপেক্ষা করছে।এমন সময় রঙ বলে উঠে
-‘আচ্ছা আপু তুমি সবসময় সাদা রঙের জামাকাপড় পড়ো কেনো?বেশিরভাগ সময়ই সাদা রঙটা পড়তে দেখি।’
রঙের প্রশ্নে মুচকি হাসে নীলা।মিহি কন্ঠে বলে
-‘সব প্রশ্নের উত্তর যে হয় না রঙ।’
রঙ আর কিছু বলে না শুধু হাসি দেয়।নীলার উত্তরে বেশ রহস্য বোধ করে বর্ণ।নীলাও চুপ করে যায়। সব রহস্য সবাইকে বলা উচিৎ না।কিছু লুকিয়ে থাক মনের কোনে।
লিফট তাদের ফ্লোরে আসতেই রঙ আর বর্ণ উঠে গেলো। নীলা উঠতেই তার উরণায় টান খেলো দরজায়।শরীরে মেলে রাখা পুরো উরনাটা লিফটের দরজা টেনে নিয়ে গেলো।লিফটে বর্ণরা ছাড়াও উপরের ফ্লোরে দুটো ছেলে ছিলো।নীলার আকষ্মিক ঘটনায় সবাই ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। বর্ণ তাড়াতাড়ি নীলাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিলো। লিফটের দরজা থেকে ওড়না টা টেনে বের করলো তারপর নীলার শরীরে জড়িয়ে দিলো।
নীলা এখনো বর্ণের দিকে ফিরে আছে।বর্ণের বাহু ধরে ঠকঠক কাঁপছে।বর্ণ নীলাকে শক্ত করে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করছে কিন্তু নীলার কাঁপা-কাঁপি থামছে না।রঙও নীলার হাত ধরে বলছে
-‘শান্ত হও আপুই।কিছু হয় নি।এত ভয় পাওয়ার কি আছে।ভাইয়া তো তোমাকে বাঁচিয়ে ফেলেছে।’
নীলার ভয় জেনো কমছে না।তার থেকে বেশি লজ্জা।ছেলে গুলোর সামনে ওড়না টা সরে গেলো।ভাগ্যিস বর্ণ তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়েছে নাহলে যে কি হতো।
বর্ণ নীলাকে ধরেই গাড়িতে বসালো।নীলা আতংকিত হয়ে আছে তবে আজ বর্নের আচরণে সে মুগ্ধ।
______
গাড়ি এসে ভার্সিটির গেইটের সামনে দাঁড়িয়েছে। নীলা এখন স্বাভাবিক।সারা পথ রঙ অনেক কথাবার্তা বলে তার ভয় দূর করেছে।
গাড়ি থামতেই বর্ণ নেমে গেলো।নীলার সাইটের ডোর খুলে দিলো।রঙ আর নীলা বের হতেই।বর্ণ গম্ভীর কন্ঠে বলল
-‘রঙ তোর আপুইকে ধরে রাখিস। ওনার যা বেখেয়ালি চলাফেরা আমার ভরসা হয় না।আর প্রথমেই ক্যান্টিনে গিয়ে কিছু খাবি।’
রঙ মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালো।বর্ণ নীলাকে “সাবধানে থাকবেন” বলে গাড়িতে উঠে গেলো।বর্ণের গাড়ি ভার্সিটির গেইট পাড় হতেই রঙ আর নীলা ভার্সিটিতে ঢুকলো।
নীলাদের ভার্সিটিতে ঢুকতে দেখেই নীলার বন্ধুরা ওদের কাছে আসলো।অহন এসেই বলল
-‘কিরে নীলু এখন কেমন আছিস?শরীর ঠিক আছে তো তোর?’
নীলা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালো।তারপর হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তে ভ্রু কুঁচকে বলল
-‘কিরে আমি অসুস্থ তুই কীভাবে জানলি?’
নীলার প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় অহন। আমতা আমতা করে বলে
-‘আসলে মানে রঙের কাছ থেকে শুনেছি।’
নীলা সন্দিহান দৃষ্টিতে রঙের দিকে তাকায়। রঙ বোঁকা বোঁকা হাসি দিয়ে মাথা নাড়ালো।যার অর্থ সে-ই বলেছে।নীলা দুজনের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে অহনের কান ধরে টান মারে।
তারপর সবাই মিলে যার যার ক্লাশে চলে যায়। দিয়া আর রাজকে ক্যাম্পাস বহিষ্কার করা হয়েছে।
শুভ্রম ক্লাশ নিতে এসে বেশ কয়েকবার নীলার দিকে তাকিয়েছে।কিন্তু লজ্জায় কথা বলতে পারে নি।নীলা সবটাই খেয়াল করেছে কিন্তু না দেখার ভান করে এড়িয়ে গেছে।
________
এখন রাত আট টা। নীলারা ভার্সিটি থেকে ফিরেছে সেই সন্ধ্যাবেলা।ফিরে দেখে সবাই বিয়ের শপিং করতে গেছে।এখান থেকে গিয়েই নাকি বিয়ের আয়োজন শুরু করবে।
এখন বাসায় শুধু নীলা আর রাহাত আছে।রাহাতের নাকি মাথা ধরেছে তাই যায় নি।
রাহাত বাসায় দেখে নীলা নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে বসে আছে।ভার্সিটি থেকে ফিরে এসে গোসল করায় তার চুল থেকে টপটপ পানি পড়ছে।
নীলা পড়ার টেবিলে বসে ঝিমচ্ছিল এমন সময় তার দরজায় কেউ কড়া নাড়ে।নীলা জানে এটা নিশ্চয় রাহাত।সে চুপ করে বসে থাকে। পর পর কয়েকবার কড়া নাড়ার পর নীলা বাধ্য হয়ে দরজা খুলে বারান্দায় চলে যায়।
রাহাত নীলার আচরণে বেশ ক্রুদ্ধ হয়।আবার সকালে নীলা আর বর্ণকে দেখেছে সেই রাগ আরও বেশি করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠে।বারান্দায় গিয়েই নীলার ভিজা চুল গুলোর পিছে মুঠ করে ধরে।পুরুষ নালী হাতের শক্ত থাবায় নীলা কুকিয়ে উঠে।রাহাত আগের ন্যায় হিংস্রতা বজায় রেখে বলে
-‘তুই কোন সাহসে আরেকটা ছেলের সাথে এত ঢলাঢলি করিস?কে ঐ বর্ন যার সাথে তোর এর সক্ষতা?কি হয় তোর?’
নীলা রাহাতের হাতে বেশ জোড়ে একটা খামচি লাগিয়ে দেয়।রাহাত ব্যাথায় হাতটা সড়িয়ে নিতেই নীলা ঠাস করে রাহাতের গালে চড় বসিয়ে দেয়।তারপর বেশ চিল্লিয়ে বলে
-‘আমি কার সাথে ঢলাঢলি করবো সেটা একান্তই আমার ব্যাপার।আপনি ভুলেও নাক গলাতে আসবেন না।সবসময় ছাড় দেই মানে ছেড়ে দেই না।যে হাতে একটা নারীর চুলে হাত দিয়েছেন সেই হাত না একদিন খসে পড়ে দেখবেন।’
নীলার চড় খেয়ে রাহাত জেনো হুঁশে ফিরে।সকালে বর্ণের সাথে নীলাকে দেখে এক পৈচাশিক রাগ মাথায় ভার করে ছিলো।হঠাৎ করেই নীলাকে তার নিজের সম্পদ মনে হচ্ছে।যার অধিকার কাউকে দিবে না সে।সেই রাগ থেকে এমন একটা কাজ করে ফেলেছে।
রাহাতকে চুপ থাকতে দেখে নীলা ঘৃণিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
-‘চলে যান আমার ঘর থেকে। আপনি এত নোংরা মন মানসিকতার মানুষ ছিঃ।আপনার সাথে একা ফ্লাটে থাকাই আমার ভুল হয়েছে।আপনি যে একা পেলে একটা মেয়েকে কি করতে পারেন সেটা আমি ভুলেই গেছি।’
রাহাত মাথা নিচু করে ফেলে।মাথা নত করে শান্ত স্বরেই বলে
-‘সকালে ঐ বর্ণের সাথে তোরে ঐ ভাবে দেখে আমার রাগ উঠে গেছিলো।সেই রাগ থেকে এমন একটা কাজ করে ফেলেছি। সরি নীলা।আর তুই সেদিনের কথা বলছিস তাই না?যেদিন আমি তোর সাথে অসভ্যতা করার চেষ্টা করেছিলাম।আমি নিজ ইচ্ছায় করি নি রে।হ্যাঁ এটা ঠিক তোরে আমি পছন্দ করতাম না তাই বলে তোর চরিত্রে কালি লেপন করার চেষ্টা করবো তত খারাপও আমি না।সেদিন আমাকে নেশা…..
আর কিছু বলতে পারলো না রাহাত তার আগেই কলিং বেল বাজালো কেউ।নীলা ছুটে চলে গেলো দরজার কাছে।এই মানুষটার সামনে দাঁড়াতে তার ঘৃণা করে।
দরজা খুলতেই শারমিন চৌধুরীর হাসি হাসি মুখটা ভেসে উঠে।নীলাকে দেখেই বলে
-‘চলো তো মা আমার ফ্লাটে।একা রুমে কি করছো।আসো আমার সাথে।’
নীলা জেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো।সে দ্রুত বর্ণদের রুমে চলে গেলো।
________
বর্ণের মা বর্ণের জন্য কফি দিয়ে নীলাকে বর্ণের রুমে পাঠালো।বর্ণ মাত্র ডিউটি থেকে এসে গোসলে গিয়েছে।
নীলা বর্ণের রুমের দরজার সামনে এসে দরজায় টোকা দিলো।ভিতর থেকে বর্ণ কামিং বললে সে ভিতরে যায়।
বর্ণ আজ নীলাকে দেখে মুচকি হাসি দিলো না বরং বেশ গম্ভীর রইল।নীলার জেনো খটকা লাগলো।বর্ণ নীলার হাত থেকে কফিটা নিয়ে সোফায় বসলো।নীলা বর্ণের আচরণে বেশ অবাক হলো।সে চলে যেতে নিলেই বর্ণ গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো
-‘আপনাকে আমি চলে যেতে বলেছি?তাহলে যাচ্ছেন কেনো?আপনার সাথে আমার কথা আছে দেখেই আপনাকে আমার ফ্লাটে আনালাম।আর আপনি চলে যাচ্ছেন।’
নীলা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। তারপর বলে
-‘আপনি আন্টিকে বলেছেন আমায় ডাকতে?’
বর্ণ সোজা উত্তর দিলো-“হ্যাঁ”।
নীলা ভ্রু কুঁচকে বলল
-‘কেনো?’
বর্ণ এবার বেশ শব্দ করে কফির মগটা টেবিলের উপর রাখলো।তারপর শক্ত কন্ঠে বলল
-‘আপনার হয়তো লম্বা চুল গুলো টান খেতে ভালো লেগেছিলো কিন্তু আমার দেখতে একদমই ভালো লাগে নি।বলেছি না এই লম্বা লম্বা চুল বিশেষ মানুষের কাছে বিশেষ কিছু।তাহলে আপনার থার্ড ক্লাশ মেন্টালিটি ভাইয়ের সাহস কীভাবে হলো চুলে হাত দেওয়ার? আন্সার মি।’
নীলার কলিজা মোচড় দিয়ে উঠে।তাহলে বর্ণ সবটা দেখেছে।কিন্তু কীভাবে?
চলবে