বিবাহনামা পর্ব ৩
————————
“জি আম্মা, অবশ্যই বলতে দিবো। আপনি না বললে কে বলবে বলেন?”
মনে মনে ঠিক করলাম আম্মার কথা শেষ হওয়া পর্যন্ত মুখে তালা ঝুলিয়ে রাখবো। উনার বিরক্তি বাড়ানো মোটেই ঠিক হবেনা।
” নাফিজ ফোন করছে আমার নাম্বারে। এই তো আধাঘন্টা আগে। ও কাল আসবে এ বাড়িতে।”
আমি মুখবন্ধ রাখলাম। যদিও খুব কৌতুহল হচ্ছে। নাফিজের বউ বাচ্চা সস্পর্কে জানতে। কিন্তু আগ বাড়িয়ে কিছুই জিজ্ঞেস করা ঠিক হবেনা।
আম্মা একটু দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন।
” ও অবশ্য একাই আসবে। ছ’মাস আগে নাকি ওর ডিভোর্স হয়ে গেছে। তখনই ইংল্যান্ড থেকে দেশে এসেছে। বাচ্চা- কাচ্চা নাই। তবে ডিভোর্সের খবর এখনো তেমন কেউ জানেনা। তোমার ডাকার কারন কিন্তু এটা না ছাব্বির।”
নফিজ ভাইয়ের বৃত্তান্ত শুনিয়ে যে আম্মা কি বোঝাতে চাইছেন আসলে। আমি এর মর্মোদ্ধার করতে পারছিনা।
” ছাব্বির তুমি আর শুভ্র আমার কাছে এক। আমার মেয়েটা বদ রাগী। কিন্তু ওর অন্তরটা পরিষ্কার। নাফিজের সাথে যখন ওর সম্পর্কের ব্যাপারটা আমরা জানলাম। আমিই জাহানারার সাথে কথা বলে বিয়ের ব্যাবস্থা করছি। কিন্তু কে তখন জানতো যে, নাফিজের জায়গায় আমার মেয়ের জামাই হবে তুমি। কেউ জানতো না।”
আম্মার কথাগুলো শুনে আমার বুকটা নতুন জাগা চরের মতো খাঁ খাঁ করে ওঠে। আমি নিজেকে আর চুপ করিয়ে রাখতে না পেরে বললাম,
“আম্মা এখন আপনার আর চিন্তা করার দরকার নাই কিন্তু। আমি সব সময় মৌরিকে ভালো রাখার চেষ্টা করি।”
“বিনা কারনে আমি চিন্তা করিনা ছাব্বির। আমার মেয়েকে তো আমি চিনি। সে তোমার সন্তানের মা। কিন্তু এই পাঁচ বছরেও ও এক দিনের জন্যও নাফিজকে ভুলে নাই। আজকে নাফিজ আমাকে কি বলছে জানো? বলছে মৌরি নিজে ওকে ফোন দিয়ে দাওয়াত করেছে। তাই সে আসবে। আমার চোখের সামনে আমার মেয়েটার সংসার ভেঙে যাবে। এটা আমি সহ্য করতে পারবোনা ছাব্বির। কিছুতেই পারবোনা।”
আমার প্রতি মৌরির উদাসীনতা আমি টের পাই। তীব্রভাবেই টের পাই। কিন্তু ওর প্রতি আমার কারনহীন ভালোবাসাটা ও হয়তো কোনও দিনই টের পাবেনা।
এই মুহুর্তে আম্মাকে আশ্বস্ত করাটা জরুরী। কারন মানসিকভাবে উনি খুব ভেঙে পড়েছে।
” আমি আছিতো আম্মা। ভরসা রাখেন।”
আমার ক্ষুদ্র বাক্য শুনে আম্মার কি হলো জানিনা। আমি দেখলাম উনার চেহারা থেকে দুশ্চিন্তার রেখাগুলো ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে।
আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। গেটে মৌরীদের গাড়ি হর্ণ দিচ্ছে। এগিয়ে গেলাম সেদিকে। ধুপধাপ করে গাড়ি থেকে নামছে একেক জন। টুসি ভারী নীল আর গনগনে লালের মিশেলে চমৎকার একটা লেহেঙ্গা পরেছে। এ মুহুর্তে চার বছর বয়েসি আমার মেয়েটিকে একটা টুকটুকে মাছরাঙ্গার মতো দেখাচ্ছে।
দৌড়ে এসে আমার কোলে ঝাপ দিয়ে বললো,
” বাবা, আমিও চুলে ফুল পরেছি দেখো।”
সত্যই তো টুসি কানের এক পাশে ছোট্ট একটা লাল গোলাপ গুঁজেছে। আর কপালে ঝিকমিক করছে লাল নীল পাথর বসানো রুপালী টিকলি।
” এখানে এখনো বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছো? ইশ গা থেকে ভুসভুস করে ঘামের গন্ধ বের হচ্ছে। এখনো রেডি হলেনা কেনো? কোন রাজকাজ করিছিলে?”
মৌরির গলা শুনে ওর দিকে তাকাতেই চোখ দুটো যেনো ঝলসে যাবার যোগাড়। কে বলেছিলো মৌরিকে এত রুপ নিয়ে জন্মাতে।
কিন্তু কেনো যেনো ওকে দেখে মনে হলো। ওর চেহারা থেকে অচেনা এক দ্যুতি ছড়াচ্ছে। তাছাড়া ওর পরনে আসমানী নীল শাড়ি কেনো? ও তো বলতো এই আসমানী নীল ওর খুব অপছন্দ।
” কি কানে যাচ্ছেনা আমার কথা? মুখ ভোতা করে দাঁড়িয়ে রইলে কেনো, যাও এক্ষুনি যাও বলছি?”
“যাচ্ছি কিন্তু আগে বলো ভাইয়ের হলুদে নিজের অপছন্দের রঙ কেনো পরলে? সেবার এই রঙের একটা কুর্তি কিনে এনেছিলাম বলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলে। মনে নাই?”
” অপছন্দের রঙ পরা যাবেনা। এরকম নিয়ম কি কোনও বিশেষ বইয়ে লেখা আছে? থাকলে আগে দেখাও। লেখা থাকলে আমি সাথে সাথেই শাড়ি পাল্টে ফেলবো।”
অযথাই রেগে যাচ্ছে মৌরি। আমি সামলে নিয়ে বললাম,
” না মৌরি শাড়ি পাল্টাতে হবেনা। থাক, তোমাকে সুন্দর দেখাচ্ছে।”
আমার কথায় ও খুশি হলো কিনা জানিনা। কিন্তু টুসিকে নিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করলো।
হলুদের রান্নার আয়োজন প্রায় শেষ। আমি ফ্রেশ হয়ে মৌরির রেখে যাওয়া পাঞ্জাবী পরলাম। সরু দাঁতের চিরনী দিয়ে হালজা তেল দেয়া ভেজা চুলটাই আঁচড়ে নিলাম। ঠোঁটের ওপর গোঁফটা ভীষন পছন্দ আমার। মৌরি যদিও বলে ওটা রাখায় আমাকে আঁতেলের মতো দেখায়। তবুও আমি এই গোঁফের মায়া ছাড়তে পারিনা।
সবাই এক এক করে সার করে রাখা চেয়ারে বসছে। হলুদের সাথে উপটান মিশিয়ে রাখা হয়েছে স্টেজের ওপর। সরাসরি কাঁচা হলুদ এখন আর কেউই মাখায়না।
হলুদ লাগানো, কেক কাটা, নাচের অনুষ্ঠানের পর খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করতে অনেক রাত হয়ে গেলো। অবশ্য আজ রাতে তেমন কেউই ঘুমোবেনা। প্রায় সবাই ই রাতভর গল্প করবে।
তবে আজ দারুন এক ঘটনার সাক্ষি হলাম আমি নিজে। যে মৌরিকে এই পাঁচ বছরের সংসার জীবনে ভুল করেও কখনো হাত পা দুলিয়ে নাচতে দেখেনি। সে কিনা আজ সর্বাঙ্গ দুলিয়ে “বুকে চিন চিন করছে হায়” এই গানের সংগে উদ্দাম নেচেছে।
আচমকা এতো আনন্দ ওর মনে কোত্থেকে আসে?
আমি চেয়ারে বসে কোল্ডড্রিংস খেতে খেতে ওর নাচ দেখছিলাম। কখন এতো সময় পেলো রিহার্সেল করার। সারাদিন আমাকে ঝাড়ি দিয়েইতো সময় করে উঠতে পারেনা। এত নিখুঁত ভাবে ওকে নাচতে দেখে আমি রীতিমতো বিস্মিত। কিন্ত মনে মনে রাগে ভিসুভিয়াসের মতো ফুঁসছিলাম। ওকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিতে ইচ্ছে করিছিলো।
কার জন্য যে ওর বুকে চিন চিন করে, আমি জানি। ভালো করেই জানি।
এ মুহুর্তে সবাই ব্যাস্ত শুভ্রর হাতে মেহেদী দেয়া নিয়ে। আত্নীয় স্বজনের মধ্য থেকেও কয়েকজন সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে হাতে মেহেদী পরবে বলে। এই আয়োজন সবটাই চলছে মৌরির ত্বত্তাবধানে। ওই মেহেদী পরানোর জন্য পার্লার থেকে লোক নিয়ে এসেছে। শুভ্র অবশ্য হাতের তেলোয় মর্জিয়ার নাম ছাড়া আর কিছুই লিখেনি।তবে মৌরি আমাকে অতি আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো। হাতে কিছু লিখতে চাই কিনা। আমি একবাক্যে না করে দিয়েছি। কিন্তু মৌরিও মেহেদী দিয়ে কি যেনো লিখিয়েছে হাতে। আমার ভীষন কৌতুহল হচ্ছে। কেনো যেনো বার বার মনে হচ্ছে ও নাফিজের নামই লিখিয়েছে
“আমার হাতে তো মেহেদী। টুসিকে খাইয়ে দিয়েছি। কোলে নিয়ে হেঁটে ঘুম পাড়াও তো।”
মৌরির মুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ।
ঘুমে ঢুলু ঢুলু মেয়েকে কোলে নিয়ে আমি বাড়ির সামনে করা প্যান্ডেলে হাঁটাহাঁটি করছি। এখান থেকে বাবুর্চিদের কাজকর্ম ভালোভাবে দেখা যায়। আজকের মোরগ পোলাও সবাই মন প্রাণ ভরে খেয়েছে। এতো সুন্দর ঝরঝরে পোলাও অনেক দিন বাদে পেটে পড়লো। সাথে খাঁটি গাওয়া ঘিঁয়ের ঘ্রান পেলাম মুফ্তে। ভালো রান্নার জন্য কিছু বকশিশ বাবুর্চি সাহেবের প্রাপ্য।
টুসিকে বিছানায় শুইয়ে আবার এলাম স্টেজের কাছে। মর্জিয়াদের বাড়িতে আজ আর যাওয়া হবেনা। ওর শরীর খারাপের কারনে অনুষ্ঠান বেশিক্ষন টানেনি ওই পক্ষ। তাই শুভ্রর মুখটা পাংশু বর্ণ হয়ে আছে। আর মৌরি?
এই গভীর রাতে হেসে হেসে ফোনালাপে ব্যস্ত। এতো রাতে আবার কাকে ফোন দিয়েছে ও? হাজারটা সংশয়ে বুকটা ভার হয়ে আছে।
তবুও কিছুই জিজ্ঞেস করিনা ওকে।
আমার তো কেউ ছিলোনা। মা বাবা ভাই বোন প্রিয় মানুষ। মৌরিকে বিয়ে করে আমি সব পেয়েছি, সব। জন্ম থেকেই এতিমখানায় একেকটা দিন পার করেছি। এক বেলা খেতে পেলে অন্য বেলা পাইনি। এক হাতে স্নেহ পেলে অন্য হাতে দু’চোখ মুছেছি। অথচ,এখন আমার সব আছে। ফ্রীজ ভর্তী পর্যাপ্ত খাবার, আপনজন, সম্মানের জায়গা। সেই সাথে এক কন্যা সন্তানের পিতা আমি।
তবুও মনের গভীরে ক্ষুদ্র একটা না পাওয়ার কাঁটা নিত্য আমার হ্রদপিন্ডটা এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়।
আমি বুঝতে পারি। মৌরি আমার সাথে সংসার করলেও কখনোই মন থেকে আমাকে মেনে নিতে পারেনি।
কিন্তু কাল যদি নাফিজ ভাই সত্যি সত্যই আসে।
কি করবে মৌরি?
( চলবে)
লেখা : Noor Helen
১৩/০৪/২০২১
পর্ব ১,
https://www.facebook.com/groups/canvasbd/permalink/4252053098173184/