বিবাহনামা পর্ব ৪
————————-
” কি কাজ শেষ না করেই ঘুমুতে চলে এলে?”
আমাকে দেখা মাত্রই কর্কশ গলায় মৌরির প্রশ্ন।
সব কিছু গুছিয়ে মাত্র কিছুক্ষন বিশ্রাম নেবার জন্য নিজের ঘরে ঢুকেছি। সারাদিন দৌড় ঝাঁপ করে ভীষন ক্লান্ত লাগছে।
আচ্ছা, ও কি কখনো আমার সাথে একটু মায়া দিয়েও দু’টো কথা বলতে পারেনা!
পোষা প্রাণির জন্য মানুষের মায়া হয়। ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেলে কিংবা অসুস্থতায় মারা গেলে। মানুষ মাস কতক সেই শোক ভুলতে পারেনা। কাঁদে আহাজারি করে।
আর আমি? মৌরী কখনো হাসিমুখে আমার সাথে কথা বলেছে কিনা আমি স্পষ্টভাবে মনে করতে পারিনা।
আমি ওর কথার উত্তর না দিয়েই চুপচাপ মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙলো শুভ্রর চিৎকারে। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে ছেলেটা।
” দুলাভাই, বিয়ের ত্বত্তে কেউ ফিতাওয়ালা পাজামা পাঠায়? তাও আবার সাথে ফিতাও দেয়া নাই। এখন আমি করবো বলেনতো?”
হুট করে এ আবার কোন মুসিবত উদয় হলো। আমি শ্যালকের চিৎকারে ধড়মড় করে উঠে বসলাম। উঠে দেখি মৃদু আলোয় ঘর ভরা। সুর্য কি উঠে গেছে? আর আমি এতক্ষন ধরে কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমুচ্ছিলাম। টুসি মৌরি কেউ নেই এ ঘরে।
শালাবাবুকে আশ্বস্ত করতে বললাম,
“ফিতা তো নেই আমার কাছে। দেশীয় লেদারের বেল্ট আছে। চেষ্টা কিরে দেখবে নাকি একবার?”
” আপনি কি কোনো কথা সিরিয়াসলি নিবেন না বলে ঠিক করেছেন দুলাভাই? এটা একটা জটিল সমস্যা। এই মুহুর্তে আমি পাজামা পাবো কোথায়?
আমার ছ’ফিট লম্বা সুদর্শন শ্যালকের মুখটা দুশ্চিন্তায় ছোট খাটো আলুর মতো দেখাচ্ছে এখন।
” চিন্তা নট। আমি একটা কিছু ব্যাবস্থা করছি।”
চোখ ডলতে ডলতেই বিছানা ছেড়ে করে গিয়ে আলমারির কপাট খুললাম।
একটা নতুন পাজামা ছিলো আমার। পরাই হয়নি। রঙ ধবধবে সাদা। শুভ্রর ঘিয়ে রঙা শেরওয়ানির সাথে বরাবর মিলে যাবে।
” এই নাও দেখো তো ট্রায়াল দিয়ে। লম্বায় আমি তোমার চেয়ে এক আধ ইঞ্চি খাটো হবো। ঠিকঠাক হয়ে যাবার কথা।”
আমার হাতের দিকে তাকিয়ে, শুভ্রর মুখে রাজ্য জয়ের হাসি খেলে গেলো। এই ছেলেটার কিছুটা সরল হলেও। মনটা একদম স্বচ্ছ পানির দীঘির মতই টলটলে।
” দুলাভাই, কালকের ঘটনায় মনে রাগ রাখবেন না। জীবনে প্রথমবার বিয়ে করতেছি। দুশ্চিন্তায় কি করি কি বলি। কিচ্ছু ঠিক থাকেনা।”
” আমি কিছু মনে রাখিনা শুভ্র। আমার মনে অত জায়গা নেই।”
বলেই আমি মৃদু হাসলাম। শুভ্রও হাসি ফিরিয়ে দিলো।
চলে গেলো নিজের কাজে। আমি ভাবছি নাফিজের কথা। উনার সাথে দেখা হলে কি বলবো।
বাইরে বের হতেই মৌরী এগিয়ে এলো।
” বিয়ে বাড়িতে কেউ এতো বেলা পর্যবেক্ষবে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমায়?”
“বেলা কোথায়? ভোর সাড়ে পাঁচটায় শুয়েছি। এখন বাজে সাতটা দশ। ”
” বেলা নয়তো কি? সবাই উঠে পড়েছে দেখো। তোমার আর কোনোদিন দ্বায়িত্বজ্ঞ্যান হলোনা।”
বলতে বলতেই মৌরি প্যান্ডেলের দিকে হাঁটা দিলো। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছুঁড়লাম। আমার সব কিছুতেই তো ওর সমস্যা।
কিন্তু এসব নিয়ে ভাবার সময় এটা নয়।
নাস্তায় পরোটা ভাজি করার কথা ছিলো। দেখি ওদের কাজ কতদূর এগোলো।
হেড বাবুর্চি মানুষটা ভীষন করিতকর্মা। এতো মানুষের জন্য অল্প তেলে পাতলা করে পরোটা ভেজেছে। সাথে ভাজি। কম কথা নয়। ভাজিটাও হয়েছে চমৎকার। সবগুলো সবজি একই আকারে কাঁটা। বেশি ছোটও নয় আবার বেশি বড়ও নয়। মনে হচ্ছে হাত দিয়ে ধরে মাপলে এক আধ ইঞ্চিও এদিক সেদিক হবেনা।
” আপনারা খেয়েছেন?”
” না দুলাভাই। সবার খাওয়া হোক।
” সবারটা সবাই খাবেই। আপনারা খেয়ে নিন আগে। আর আমাকেও এখানেই দিন। একসাথে খাই।”
বাবুর্চি আমার কথায় খুশিই হলো মনে হয়। বয় ছেলেগুলোর চেহারাও চনমনে হয়ে উঠলো।
কেমন পরিবারে জন্ম হয়েছিলো আমার। আমি জানিনা। তারা ধনী ছিলো নাকি দরিদ্র তাও আমি জানিনা। কিন্তু ভালো মানুষ ছিলোনা এটা নিশ্চিত। তা না হলে এগারো মাসের দুধের বাচ্চাকে কেউ এতিম খানায় রেখে যায়!
হয়তো এই কারনেই আমি চেষ্টা করি মানুষের কষ্টের মুল্য দিতে।
কষ্ট তো কম বেশি সবাই দিতে পারে। কিন্তু বিনাশর্তে ভালোবাসতে পারে ক’জন।
নাস্তা শেষ করে বসে আছি। আজ আর এদের কাজ নেই। মর্জিয়ারা বিয়ের আয়োজন করেছে বড় কনভেনশন হলে। আর্থিক অবস্থায় ওরা শুভদের চেয়ে খানিকটা এগিয়ে।
সবাই দুপুরের আগেই ধোপদুরস্ত হয়ে রওনা হলো। গেটে এসেই ফিতে কাটা নিয়ে শুরু হলো তুমুল তর্কাতর্কি। যেহেতু আমি বরপক্ষ এবং বরের বোন জামাই। সুতরাং শুভ্রকে এ হেন হেনস্থা থেকে উদ্ধার করার পুরো দায়িত্ব আমার ওপরই বর্তায়।
বড় মাপের অর্থ সংখ্যা দফারফা করে ভেতরে ঢুকেছি। শীতাতপনিয়নন্ত্রিত হল গরমে দারুন স্বস্তি দিচ্ছে। মৌরিকে খুঁজলাম আসে পাশে। ও গেট দিয়ে ঢুকে কোথায় উধাও হয়ে গেলো। টুসিটাও নেই।
সবার সাথে করমর্দন শেষে খেয়াল করলাম মৌরী কার সাথে যেনো কথা বলছে। ছাই রঙা ব্লেজার আর কুচকুচে কালো পলিশড শু তে দারুন চৌকশ দেখাচ্ছে তাকে।
মৌরী আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাত ইশারায় কাছে ডাকলো।
” টুসির বাবা, এই যে নাফিজ। আমার কাজিন। ওনার কথাতো সবই জানো। শুধু আগে দেখা হয়নি তোমাদের।”
এতোটুকু অস্বস্তি নেই কন্ঠে। যে প্রেমিক বিয়ের আসরে না এসে পালিয়ে যায়। তার প্রতি কোনো অভিযোগ নেই এই মেয়ের। কী আশ্চর্য্য!
অতচ কিছু না করেও দিন রাত আমি ওর অযৌক্তিক ক্রোধের নিচে পিষ্ট হচ্ছি।
আমি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
” আমি ছাব্বির, মৌরির হাসব্যান্ড। আপনার কথা অনেক শুনেছি। আজ দেখা হয়ে ভালো লাগছে।”
ভদ্রলোক চোখে থাকা রিমলেস চশমাটা নাকের ওপর ঠিক করে বসাতে বসাতে বললেন,
” আপনাকে দেখেও বেশ তৃপ্তি পেলাম। তা কি করছেন এখন? মানে প্রফেশন। ”
বলেই আমার দিকে আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে নিলেন এক ফাঁকে।
” আমি এডভোকেট। এখানকার স্থানীয় কোর্টে আছি। আর প্রাইভেট চেম্বারও আছে একটা। কোর্টের পাশেই।”
উনি ঠোঁট বাঁকিয়ে কিছুটা হাসার চেষ্টা করলেন। খেয়াল করে দেখলাম ওনার পোশাক আসাকে কোনো ত্রুটি নেই।
চুলগুলো পর্যন্ত জেল দিয়ে ব্যাক ব্রাশ করা। হাতে নামী ব্র্যান্ডের ঘড়ি।
এরকম নায়কোচিত জীবন সংগী কে না চায়। উনাকে ভালোবেসে মৌরিতো কোনো অপরাধ করেনি। কিন্তু পরক্ষনের নিজের গজ কাপড় কিনে সেলাই করা শার্ট প্যান্ট আর তেল দেয়া চুল দেখে বরং মৌরির জন্য আফসোসই হচ্ছে আমার। তাছাড়া মৌরির আর আমার বয়সের ব্যাবধানটাও কারো চোখ এড়ায় না।
মৌরি পাশ থেকে বলে উঠলো,
“তোমার বউ বাচ্চাকেও সাথে আনতে। যার জন্য এতো কিছু করলে। তাকে দেখার ইচ্ছেটা রয়েই গেলো, মিটলো না!”
মুহুর্তেই ম্লান হয়ে গেলো নাফিসের চেহারা। তার মানে বিচ্ছেদের খবরটা এখনো কেউ জানায়নি মৌরিকে।
নিজেকে সামলে নিয়ে নাফিজ উত্তর দিলো,
” এবার একাই এসেছি। বাচ্চার স্কুল খোলা। সামনের বার সাথে করে নিয়ে আসবো।”
মৌরি খুব স্বাভাবিক গলায় নাফিসের স্ত্রীর সম্পর্কে জানতে চাইছে দেখে আমি খুব অবাক হলাম। ওর মনে আসলে কি চলছে? আসলে ঠিক কি চাইছে ও?
বিয়ের প্রথম দিকে অনেক কান্নাকাটি করতো মৌরি। ঠিক মতো খেতো না। ঘুমাতো না। কত রাতে ব্যালকনিতে গিয়ে দেখতাম কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। আমি ওকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেছি। শুভ্র আম্মা সবাই মৌরিকে বোঝাতো। যে এটা একটা দুর্ঘটনা। ও কিছুতেই মেনে নিতে চাইতোনা। এক সময় প্রচন্ড ক্ষ্যাপাটে হয়ে গেলো ও। আত্নহত্যা করতেও চেষ্টা করেছিলো দুইবার। আমার জন্যেই পারেনি। আমি আগেই টের পেয়ে গিয়েছিলাম।
শেষ পর্যন্ত ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয়েছিলো। দু’বছর ধরে চিকিৎসা করানোর পর এখন অনেকটাই সেরে উঠেছে। কিন্তু এতো বছরে ভুল করেও নাফিজের সাথে
যোগাযোগের চেষ্টা করেনি।
তাহলে এখন কেনো যেঁচে ফোন করে আসতে বললো?
আমি এক দৃষ্টিতে মৌরির দিকে তাকিয়ে আছি। ওর চেহারার এই ঔজ্জ্বল্য আগে তো কখনো দেখিনি!
“এই টুসির বাবা এদিকে এসো। নাফিজকে নিয়ে টেবিলে বসাও। ছেলেদের ব্যাচ বোধহয় ডানদিকে বসবে। আর মেয়েদের বা’দিকে। আমি স্টেজ থেকে টুসিকে নিয়ে আসছি।”
মৌরি দ্রুত পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। এতোক্ষন ধরে ও চোখের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলো অতচ খেয়ালই করিনি। এলো খোঁপায় রজনীর লতা জড়িয়েছে ও।
ও কি জানে রজনী গন্ধা আমার প্রিয় ফুল।
জানেনা বোধহয়।
কখনো অবশ্য জানতেও চায়নি।
মনে মনে ভেবে রাখলাম আজ বাড়ি ফিরে মৌরিকে কিছু কঠিন কথা বলবো। ও যতোই রাগ দেখাক। তবুও বলবো।
( চলবে)
লেখা : Noor Helen
১৬/০৪/২০২১
(আগের তিন পর্বের লিংক কমেন্টে)