বিবাহনামা পর্ব ৫

0
448

বিবাহনামা পর্ব ৫
———————-
“দেখেছিস কবুল বলার জন্য একেবারে মুখিয়ে আছে শুভ্রটা”

পাশ থেকে খিল খিল করে হাসতে হাসতে বললো লুনা আপা।

সম্পর্কে উনি শুভ্রর খালাতো বোন। চারপাশ ঘিরে অজস্র চেনা অচেনা মানুষে গিজ গিজ করছে হলরুম।

আমিও একপাশে নাফিজকে সাথে নিয়েই বসেছি।

সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগে বিয়ে পড়ানো হোক। তারপর খাওয়া দাওয়ার আয়োজন।

মৌরিও শুভ্রদের পাশেই বসেছে, টুসিকে নিয়ে।

স্টেজে বসা শুভ্রকে নিয়ে সবার হাসি তামাশা দেখতে বেশ লাগছে আমার। আগেকার দিনের মতো মুখে রুমাল দিয়ে না রাখলেও স্ফীত একটা হাসি ছুঁয়ে আছে ওকে।

তবে শুভ্র খুব বেশি সময় নিলোনা। এক ঝটকায় তিন কবুল বলে ফেললো।

মর্জিয়া কবুল বলার সময় তেমন একটা কান্নাকাটি না করলেও। অনেক লম্বা সময় নিলো।

এক মুহুর্তেই ঠিকানা বদল হবে। পরিচয় বদল হবে। বদল হবে মাথার নিচের নরম বালিশটাও। এই কর্কশ সত্য মেনে নিতে। সব মেয়েদেরই কিছুটা সময় লাগা স্বাভাবিক।

বউ সাজে মর্জিয়াকে দেখে আমার মৌরির কথা মনে পড়লো। কবুল বলার পরই দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলো। সারা রাত আমি সেই দরজার অন্যপাশে বসে ছিলাম। বাড়িভর্তি মানুষ সবাই নির্ঘুম। এদিকে আমি নতুন বর, সেদিন রাতে ঘন্টায় ঘন্টায় কাপের পর কাপ চা খেয়ে যাচ্ছি। উপায় না দেখে মৌরির বাবা আমার হাত চেপে বললেন।

“ছাব্বির, আমি কি ভুল করলাম? আমি ভেবেছিলাম, বিয়ে ভাঙা মেয়ের জীবনের চাইতে বিবাহিত মেয়ের জীবনে শান্তি সম্মান প্রাপ্তি এই তিন জিনিসের কমতি হয়না। আমার ধারনা কি তাহলে মিথ্যা?

“না স্যার আপনার ধারনা মিথ্যা না। একশত ভাগ সত্যি। কিন্তু অনেক সময় জীবনের গতিপথের ওপর আমাদের
কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকেনা।”

তার পরদিন হঠাৎ করেই স্যার স্ট্রোক করলেন। জলজ্যান্ত মানুষটাকে আধঘণ্টা পর হাসপাতাল থেকে লাশ হয়ে ফিরলেন। মৌরি বিয়ে ভাঙার আঘাত সামলে নিতে পারলেও বাবার অকাল মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। মানসিকভাবে প্রচন্ড ভেঙে পড়েছিলো।

মৌরি এখনো ভাবে, নাফিজের সাথে সেদিন ওর বিয়ে হলে, আজ ওর বাবা বেঁচে থাকতো!

মোনাজাতে নতুন দম্পতির জন্য দোয়া শেষে ঝটপট খেতে বসে পড়লাম। আর অপেক্ষা করার ধৈর্য্যও নেই।

তার ওপর বিশাল আয়োজন করেছে মর্জিয়ার বাড়ির মানুষজন।

নাফিজকে চুপচাপ খেতে দেখে বললাম,

” রান্না কেমন হয়েছে? আরেকটু খাসির মাংশ নিন না। বিদেশ বাড়িতে তো আর এই খাবার সহজে পাবেন না।”

” না না আর দিবেন না প্লীজ। আমার কোলষ্টরল হাই। খুব মেপে খেতে হয়।”

বুঝে নিলাম নাফিজ আমার আপ্যায়নের আন্তরিকতা পছন্দ করছেন না। না করলে না করবেন। আমি ঠিক করেছি তবুও আপ্যায়ন চালিয়ে যাবো। মৌরি কেনো উনাকে এতো ভালোবাসে সেটা একটা বিরাট রহস্য। অবশ্য মৌরির মতো বদরাগী মেয়েকে আমি কেনো ভালোবাসি সেটা আরো বিরাট রহস্য।

তবে কেনো যেনো মনে হচ্ছে নাফিজ নামী মানুষটা ভেতর থেকে সুখী না। আমার মতো সুখী হবার মিথ্যে ভাণ করে যাচ্ছেন। অবশ্য সদ্য বিবাহ বিচ্ছেদ হলে কেইবা সুখে থাকে। একতরফা ভালোবাসলেও মৌরির সাথে এখনো অন্তত এক ছাদের নিচে তো আছি। এই অনেক।

নাফিজ খাওয়া শেষ করে ঝটপট উঠে পড়লেন। উনি মিষ্টি জাতীয় কিছুই খাবেন না। কিন্তু মালপোয়া দেয়া জর্দা না খেয়ে যদি এই মুহুর্তে উঠে যাই। তাহলে নির্ঘাত আমার পাপ হবে।

আমি জর্দার বাটি হাতে নিয়েই উঠলাম। খেতে খেতেই দু’চারটা কথা বলবো। নিশ্চই এতে কিছু মনে করবেন না উনি।

” এই জিনিস আমার খুব পছন্দ। লোভ সংবরণ করতে পারলাম না।”

আমার লাজুক হাসিতে উনি কি ভাবলেন জানিনা। তবে বিরক্তি দেখালেন না।

দু’জন আলাদা করে হলের একপাশে কিছুটা ফাঁকা জায়গা পেয়ে, চেয়ার পেতে বসলাম।

হাত পা ছড়িয়ে বসে, রয়ে সয়ে জর্দা খেতে হবে। এটা আবার তাড়াহুড়ো করে খাওয়ার জিনিস না। চামচে অল্প অল্প করে তুলে মুখে পুরতে হয়। ধীরেধীরে মুখের স্বাদগ্রন্থিগুলো উজ্জীবিত হয়ে ওঠে জর্দার রসনা মাধুর্য্যে।

আমি বেশ আরাম করেই খাচ্ছি। তখনই দেখলাম শুভ্র আর মর্জিয়াকে নিয়ে ওরা আলাদা করে খেতে বসেছে। মৌরি আর টুসিও ওদের সাথে। টেবিলে সাজানো আস্ত খাসীর রোস্ট। সেটা আবার এমন ভাবে সাজিয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে একটা ভীত সন্ত্রস্ত হরিণ শাবক।

খাবেই যখন তখন ছাগলকে হরিণ বানিয়ে এই চাতুরী করার কী অর্থ আমি বুঝিনা।

সামনে হরিণ নাকি দুম্বা নিয়ে বসেছে সেদিকে আপাতত কারোরই খেয়াল নেই। সবার সব মনযোগ কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে চকচকে কালো ক্যামেরার দামী।লেন্সে। কেউ ভিডিও করছে তো কেউ বিজলি চমকের মতো আলোর বিদ্যুৎ খেলিয়ে ক্রমাগত ছবি খিঁচে যাচ্ছে।

আমার স্ত্রী মৌরিও পিছিয়ে নেই। খাবার মুখে না তুলেই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে একেকজন। কী অদ্ভুদ!

” আমাদের বিয়েতে অবশ্য অত আয়োজন ছিলোনা। আপনি তো জানেন সেসব। আসলে আপনি না আসায় সব কিছু ভন্ডুল হয়ে গেছিলো। মাঝরাতে আমাকে ঘুম থেকে তুলে দিয়ে আমার স্যার মানে মৌরির আব্বা বললেন পাঞ্জাবি পর। তখন অব্দি জানতাম না আজকে আমার বিবাহ।”

নাফিজ আমার কথা শুনছেন কিনা বুঝতে পারছিনা। লক্ষ্য করলাম উনি মন্ত্রমুগ্ধের মতো মৌরির দিকে তাকিয়ে আছেন। লাইটম্যানের হাতে থাকা লাইটের আলো ঠিকরে গিয়ে পড়ছে মৌরীর ধবধবে গালে। কচুরীপানা ফুলের মতই নরম মসলিনের সাথে রুপার গয়না মিলিয়ে পড়েছে ও। পূর্ণ চাঁদের মতো গোলাকার টিকলি নির্বিগ্নে ওর কপাল ছুঁয়ে লেপ্টে আছে। আমি অবশ্য রোজই বিস্মিত হই ওর সৌন্দর্য্যে।

সৃষ্টিকর্তা এই একটি জিনিস ওকে একেবারে উজাড় করে দিয়েছেন।

কিন্তু পরস্ত্রীর দিকে এভাবে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকাটা যে ঘোরতর অন্যায়। এটা কি কেউ কখনো নাফিজকে বলেনি। তাও কিনা বরের পাশের চেয়ারে বসে থেকে।

অগত্যা উনার ধ্যান ভাঙাবার জন্য আমি আমি মৃদু কাশি দিলাম। উনি খেয়াল করলেন না। তারপর জোরে কেশে এমন ভান করলাম যেনো আমি জর্দা গলায় বিষম খেয়েছি।

এবার ওনার তিব্বতি ধ্যান ভংগ হলো। ত্রস্তস্বরে বললেন,

” বিষম খেয়েছেন দেখছি। দাড়ান দাড়ান আমি পানি নিয়ে আসছি।”

উনি সত্যি সত্যিই এক গ্লাস ভর্তি পানি এনে মুখের সামনে ধরলেন। ইচ্ছে না করলেও, আমি এক নিমিষেই ঢক ঢক করে সব পানি শেষ করলাম। অভিনয়ে বিলকুল ত্রুটি থাকা চলবেনা।

” আসলে নাফিজ ভাই, আপনি যেভাবে মৌরির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আমার তো বিষম খাওয়া ছাড়া উপায় ছিলো না”

উনি বোধকরি আমার কথায় লজ্জা পেলেন। চাপা দাঁড়ির ফর্সা মুখে প্রচ্ছন্ন অস্বস্তি গাঢ় হয়ে ফুটলো।

” না না সেরকম কিছু নয়। আসলে সত্যি কথা বলতে মৌরিকে দেখে আমি প্রচন্ড বিস্মিত। আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি ও এতোটা স্বাভাবিক ভংগীতে আমার সাথে কথা বলবে। যে অন্যায় আমি ওর সাথে করেছি। তারপর তো আমার মুখ দর্শন করারও কথা নয়। কিন্তু ও হঠাৎ নিজে ফোন করে আমাকে আসতে বলেছে। কাল ভোর রাতে আমার ফ্লাইট। শুভ্রর বৌভাতে থাকার ইচ্ছে থাকলেও কিছুতেই থাকতে পারবোনা। তাছাড়া আবার কবে দেশে ফিরি তারও ঠিক নেই। তাই ভাবলাম একবার দেখে যাই ওকে।”

এক দমে কথাগুলো বলে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন নাফিজ।

” তারপর বলুন, কেমন দেখলেন ওকে? ভালো?”

আমি আসলে পরিষ্কার করে জানতে চাইছি উনি মৌরিকে নিয়ে কি ভাবছেন । যদি সেরকম কোন প্ল্যান থাকতোই তাহলেতো কাল চলে যাবার কথা বলতেন না। ক্রমশ আমার সংশয় বাড়ছে।

” অবশ্যই ভালো। এবং আরেকটা বিষয় আপনাকে না বলে থাকতে পারছিনা ছাব্বির সাহেব। আপনি খুব সৌভাগ্যবান। ”

ওনার কথার আগাগোড়া কিছুই স্পষ্ট নয় আমার কাছে। মনে মনে আবার কোনো ছঁক আকছে না তো ওরা দু’জন? এমন যদি হয় আমার সাথে ভালোমানুষি কথা বলে হুট করে মৌরিকে নিয়ে ভীনদেশী উড়াল দিলেন। বলা যায় না। হতেও তো পারে।

” কী ভাবছেন অত? আমি আপনার মৌরিকে নিয়ে যেতে আসিনি।”

জর্দার খালি বাটি এখনো আমার হাতে ধরা। রাখতেও ভুলে গিয়েছি। তবে একটা বিষয় বেশ পরিষ্কার। ভদ্রলোক দারুন বুদ্ধিমান। কিভাবে এক সেকেন্ডেই আমার মনের অবস্থা আঁচ করে ফেলেছেন।

আমি বাটি টেবিলে রেখেই হাসিমুখে উত্তর দিলাম,

” যদি চান, পারবেন নিয়ে যেতে?”

কথাটা বলে নিজেই অন্তর্দ্বন্দে পড়লাম। মৌরি যেতে চাইলে আমি কিসের জোরে ওকে আটকে রাখবো?

শুধুমাত্র নীল কাগজের অধিকারে একটা মানুষকে কি আটকে রাখা যায়? যদি সেখানে ভালোবাসাই না থাকে!

ভদ্রলোক হাসছেন।

” না পারবোনা। কারন একই ভুল দ্বিতীয়বার করবে। এতোটা নির্বোধ মেয়ে মৌরি না।”

” তাহলে? এতোদিন পর শুধু ওর একটা ফোন পেয়েই কেনো এসেছেন৷ ওকে দেখতে? কিসের জন্য? ক্ষমা চাইতে নিশ্চই না?”

” ক্ষমা? এই অন্যায়ের ক্ষমা হয় বলেও আপনার মনেহয়? অবশ্য ক্ষমা না পেলেও যথার্থ শাস্তি আমি ঠিক পেয়েছি বলেন। অনি মানে আমার স্ত্রী অনিমাও দু’মাস আগে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। যেমন আমি মৌরিকে।”

নাফিজ সাহেবের গলা কেমন ধরে এসেছে। চেহারায় যেনো প্রচন্ড হাহাকার বাসা বেঁধে আছে।

এতোদিন পৃথিবীতে নিজেকেই একমাত্র নিঃস্ব মানুষ মনে হতো আমার। কিন্তু আজ উনাকে সামনে দেখে আবার একবার নিজের দিকে তাকালাম। আমার মতো জন্ম পরিচয়হীন এতিম একটা ছেলে। যে কিনা এক রাতেই মৌরির মতো মেয়ের বর হয়ে গেলো। যে কিনা বিয়ের কিছুক্ষন আগ পর্যন্ত জানতোই না। আগামী কাল সকালে কি দিয়ে ভাত খাবে। কোর্ট থেকে ফেরার পথে পটল কিনবে নাকি পুঁই শাক। সে মানুষটা আচমকা বাসর ঘরে ঢুকে পড়লো!

সেদিন রাতে মৌরির বাবা কি ভেবে আমার ঘরে এসেছিলেন। আমি আজো জানিনা। আমি মৌরিদের চিলেকোঠার একটা ঘরে তখন একমাস হলো এসেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক স্যারের সাথে সুসম্পর্কের সুবাদে এই বাড়িতে ভাড়াতে হিসেবে জায়গা পেয়েছিলাম। আমার সেই স্যার ছিলেন মৌরির বাবার খুব ভালো বন্ধু।

তাই মৌরির বাবাকেও আমি স্যার বলে সম্বোধন করতাম।

অর্থ-বিত্তহীন আমার হাতে মৌরির দ্বায়িত্ব তুলে দেবার আগে উনি আমার ভেতর ঠিক কি দেখেছিলেন। সেটা আজো বিরাট এক ধাঁধাঁ।

” এভাবে বলছেন কেনো? জীবন তার নিজস্ব গতিতেই চলে। সে গতি পরিবর্তন করার ক্ষমতা কারো নেই। যদি সেটা নাই হতো তাহলে আজ যে ছবিতে আপনার থাকার কথা, সেখানে আমি কিভাবে ফ্রেমবন্দী হলাম বলুন!”

” এইজন্যই তো বলেছি, আপনি ভাগ্যবান!”

উত্তরে নাফিজকে আমার বলতে ইচ্ছে করে।

মৌরি যদি সত্যিই ভালোবাসতো। তাহলে হয়তো আমি ভাগ্যবানদের দলেই থাকতাম।

কিন্তু আমি সেসব না বলে উল্টো বললাম,

” এখনো ভালোবাসেন মৌরিকে?”

(চলবে)

লেখা : Noor Helen
১৯/০৪/২০২১

(আগের পর্বগুলো কমেন্টে পাবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here