বিবাহনামা শেষ পর্ব
—————————
” কি বললেন না, ভালোবাসেন মৌরিকে?
” না, ভালোবাসলে দূরে যেতাম না হয়তো।”
নাফিজের উত্তরে আমার ভ্রুযুগল কিছুটা তির্যক হয়ে উঠলো। আমি আসলে ওদের উদ্দেশ্যটাই ধরতে পারছিনা।
নাফিজ সেটা ঠিকই লক্ষ্য করলেন।
” আমাকে নিয়ে ভয় পাবেন না। আমি বিশ্বাস ঘাতকতা করেছি একথা সত্য। কিন্তু ক্ষতি করবোনা।”
ওনার কথার পিঠে কি বলবো তাই হাঁতড়ে ফিরছি। মৌরিকে বিয়ে করে একটা ক্ষতি তো অবশ্যই হয়েছে আমার। আমার মন ভেঙেছে। কাঁচের টুকরোর মত শশব্দে না হলেও নির্জনে ঠিক ভেঙেছে। অসংখ্যবার ভেঙেছে।
কিন্তু পেশায় উকিল হলেও এরজন্য তো আর আদালতে যেতে পারবো না!
কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলতে পারবোনা,
” ইয়োর অনার, মৌরি নামধারী এই মেয়ে আসলে মেয়ে নয়। সে একজন নিষ্ঠুর ঘাতক। সে আমার মতো নিস্পাপ একজন মানুষের মন ভেঙে গূড়িয়ে দিয়েছে। ওকে শাস্তি দিন। শাস্তি দিন।”
কিন্তু তা কি আর সম্ভব!
আমার কষ্ট মৌরি দেখেও দেখেনি। আসলে ও দেখতেই চায়নি কখনো।
নিরুত্তর বসে রইলাম প্রায় আধমিনিট। পেছন থেকে টুসি এসে হাত ধরে টানাটানি শুরু করেছে। মৌরিও ওর সাথেই দাঁড়িয়ে।
খাওয়া সেরেও দেখছি মৌরির লিপ্সটিক এখনো অক্ষত।
অবশ্য এটা কোনো নতুন আবিষ্কার নয়।
মেয়েরা লিপ্সটিক অক্ষত রেখে দুনিয়ার সকল খাবার খাওয়ার দক্ষতা নিয়েই জন্মায়।
কিন্তু ওর চোখের কাজল এবড়ো থেবড়ো হয়ে আছে। কান্নাকাটি করেছে নাকি? এখন কাঁদলেই মুশকিল। ও কাঁদলে ওর চেয়ে আমারই বরং বেশি খারাপ লাগে।
“আজকে কি এখানেই থেকে যাবে? বালিশ এনে দিলে নিশ্চিত ঘুমিয়ে পড়তে।”
” আসলে খেয়ে দম নিতে পারছিনা। তুমি মর্জিয়াদের নিয়ে গাড়িতে ওঠো। আমি আসছি। নাফিজ ভাই তো আমাদের সাথেই যাবেন, নাকি?
ওনার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি মৌরিকে বলছেন,
“না আজ না। মামীকে বলো, উনার হাতের হাঁস ভুণা খেতে আসবো একদিন।”
আমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছি। মৌরির চোখ কি ছলছল? কোথাও কি জলের চিহ্ন আছে? থাকাটাই বরং স্বাভাবিক। না নেই। ও ঈষৎ হাসি মুখেই আছে দেখছি।
যাক বাবা, এই যাত্রায় বেঁচে গেছি মনে হচ্ছে।
“এই সাব্বির, এখনো দাঁড়িয়ে আছো তোমরা। মর্জিয়ার আর শুভ্রর পান চিনি হবে তো। সবাই ডাকছে।”
লুনা আপার ব্যাস্ত ভংগীতে বুঝলাম। বউ বিদায় হবে কিছুক্ষনের মধ্যেই। সেখানে যেতে হবে আমাদের।
” তোমরা এগোও। আমি আছি এখানে।”
নাফিজ ভাইয়ের কথা শুনে আমরা এবার স্টেজের দিকে এগোলাম। থাকুক উনি। না বলে নিশ্চই চলে যাবেন না। আজ আর উনার বিয়ের দিন নয় যে। না বলে কয়ে উড়াল দিবেন।
স্টেজে গিয়ে দেখলাম,
মর্জিয়ার মুখে আবছা কান্নার আবহ তৈরী হয়েছে ঠিকই। কিন্তু চোখে এক ফোঁটা পানি নেই। বিয়ে শাদিতে আগেকার দিনের মতো সেই কান্নার কালচার এখন আর নেই। গাঁদাগাঁদা টাকা খরচ করে সেজেগুজে এসে কে চায় যেঁচে নষ্ট করে ফেলতে?
তবুও এক আধজন আছে। এরা কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে গড়াগড়ি খায়। হেঁচকী তুলতে তুলতে এক আধবার জ্ঞ্যান হারিয়ে ফেলে। আবার কেউ কেউ বিলাপ করে পুরো বাড়ি মাথায় তোলে।
কিন্তু মর্জিয়া মোটেও তাদের মতো নয়। ও ধীর স্থিরভাবে ওর বাবা মায়ের সাথে ছবি তুললো। তাদের আপ্রাণে জড়িয়ে ধরলো কিন্তু আকুলি বিকুলি করে অশ্রু বিসর্জন দিলোনা।
বোঝাই যাচ্ছে, ইস্পাত কন্যা। সহজে নরম করা যাবেনা একে।
সন্ধ্যে হয়ে আসছে,
সব সামাজিক প্রক্রিয়াদি শেষ করে গাড়িতে উঠতে যাবো। বিয়ের ফুলেল গাড়িতে শুভ্র মর্জিয়ার সাথে মর্জিয়ার এক কাজিন উঠলো। আমাদের গাড়িতে আমি, মৌরি, টুসি, লুনা আপা। বাদ বাকিরা আলাদা আলাদা গাড়িতে করে ফিরবে।
জানলার কাছেই বসেছে মৌরি। টুসি ওর কোলের ওপরই ঘুমিয়ে পড়েছে। বাচ্চা মেয়ে দৌড় ঝাঁপ করে ভীষনরকম ক্লান্ত।
আমি সামনেই বসলাম।
গাড়িতে উঠেই মৌরি দ্বিগবিদিক তাকাতে শুরু করলো। কিছু খুঁজছে হয়তো।
“নাফিজ ভাই কোথায়?”
ওর কন্ঠের উৎকন্ঠা আমাকেও ভাবিয়ে তুললো।
আসলেই তো। উনাকে ফেলেই গাড়িতে উঠেছি আমরা।
“তোমার কাছে নাম্বার আছে? কল করে দেখি।”
মৌরি নাম্বার বের করে, ডায়ালে এনে ওর মোবাইল বাড়িয়ে দিয়েছে।
গাড়ি থামিয়ে বসে কল করছি। রিং বাজছে। কিন্তু উনি ধরছেন না।
কয়েকবার কল দিয়ে গেলাম। না ধরছেনইনা।
আবারো পালিয়ে গেলেন না তো?
একটু পর দেখি মেসেজ করেছেন।
মৌরিকেই পাঠিয়েছেন নিশ্চই।
আমি অধৈর্য্য মানুষ।
খুলে দেখার তর সইছে না আমার।
পুরোনো প্রেমিক কি লিখেছে। সেটা খুলে দেখা আমার দরকার। একশতবার দরকার।
“সেদিন অনিমার প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট পজিটিভ না আসলে হয়তো আমি তোমাদের দু’জনকেই ঠকাতাম। কিন্তু ভাগ্য নির্ধারক আমাদের নিয়ে অন্য কিছু ঠিক করে রেখেছিলেন।
সাব্বিরের মতো ভালো মানুষ এ জগতে দ্বিতীয়টি পাওয়া দুস্কর। শেষ পর্যন্ত দৌড়ে তুমিই জিতে গেলে মৌরি।”
মেসেজ পড়ে আমি থম মেরে দাঁড়িয়ে আছি। আমার মুখে ভাষা নেই। ভদ্রলোক দু’টো লাইন লিখে আমাকেও চুপ করিয়ে দিলেন।
” কই ফোন ধরলো? ”
” না ধরেনি। মেসেজ পাঠিয়েছে।”
“দেখি, দাও এদিকে।”
মৌরি টুসিকে কোলে রেখেই ফোন নিতে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
জানতাম, মনে মনে ও খুব দুশ্চিন্তা করছে।
আমার মাথায় যেনো এক হাজার ভোল্টের শক খেলে গেলো। বজ্রাহতের মতো অনড় হয়ে আছে দুই পা। দু’কানে শোঁ শোঁ করে বইছে ঝড়ো বাতাস। আমি যেনো শুকনো মাটিতে শশব্দে আছাড় খেয়ে পড়লাম।
মৌরির হাতের তালুতে লেখা নামটা আমার কাছে নতুন নয়।
বহুশ্রুত একটি শব্দ।
সাব্বির!
ওর রাগী মুখশ্রীর আড়ালে যে এমন মায়ার স্ফিতধারা। কে জানতো।
নাফিজ আজ না এভাবে না এলে আমি হয়তো কোনোও দিনই জানতে পারতাম না।
“মোবাইলটা দিবা না নাকি?”
মৌরির কড়া কন্ঠে আমার সম্বিৎ ফিরলো।
আমি মোহ গ্রস্থের মতো ওর মেহেদী আঁকা হাতের তালুতে চোখ নিবন্ধ করে রেখেছি।
শরীরি টানে আমি অনেকবারই পেয়েছি মৌরিকে। কিন্তু একান্ত আমার করে কখনো পাইনি। কখনো না। আজ ওর হাতে নিজের নাম দেখে কেনো বার বার মনে হচ্ছে, ও আমার। শুধু আমার।
সেখান থেকে চোখ সরিয়ে ওর খোলা হাতে মোবাইলটা ফিরিয়ে দিলাম।
থাক ও ই দেখে নিক।
নিয়েই একমনে মেসেজ পড়ছে মৌরি। কই ওর চোখের পাতা কেঁপে উঠছে না তো? মুখটাও ভার হয়ে নেই একদম।
বরং ঠোঁটের কোণে সরু হাসির মসৃন দাগ।
এই মেসেজ পড়েও মৌরি হাসছে!
কী করে সম্ভব!
তাহলে আমার কেনো এমন অস্থির লাগছে।
বেশি খেয়েছি এই জন্য অবশ্যই না।
মৌরি কি ইচ্ছে করেই নিজেকে কষ্টি পাথরে ঘষে পরখ করে নিলো এতদিন? কিন্তু আমাকে? আমাকে কেনো একবার ওর অনুভূতিগুলো স্পর্শ করতে দিলোনা! আমি বোকা বলে?
ড্রাইভারের পাশের সিটে উঠে বসেছি। হাঁশফাঁশ গরম কমে আকাশে গুড় গুড় করে মেঘ ডাকছে।
তপ্ত রোদ মুছে ঘন অন্ধকার ক্রমশ গিলে নিচ্ছে চারপাশ। এই বুঝি বৃষ্টি নামলো!
“বিয়ের দিন বৃষ্টি হওয়া শুভ লক্ষন বুঝলি মৌরি। আমাদের শুভ্রর ভাগ্যটা ভালো।”
লুনা আপার কথায় মনে পড়লো আমাদের বিয়ের দিন ভোর রাতে কী ঝুম বৃষ্টিটাই না হয়েছিলো। একেবারে ছাদ ভেঙে পড়ার উপক্রম। রাতভর বন্ধ দরজার বাইরে বসে আমি অপেক্ষা করেছি মৌরি কখন দরজা খুলবে।
না দরজা খুলেনি। শেষে দরজা ভেঙে সকাল বেলা যখন ওকে বাইরে বের করে আনা হলো। তখন ও রীতিমতো অজ্ঞ্যান। কোত্থেকে এক সাথে এতোগুলো ঘুমের ঔষধ যোগাড় করে রেখেছিলো কেউ জানেনা। মেয়েটা মরে গিয়ে বেঁচে যাবে ভেবেছিলো হয়তো।
আমিও কি কম।
বিয়ের পরের দিন রাত এক করে হাসপাতালে, ওর পাশে পড়ে ছিলাম। তবে সেদিনের মৌরির হতাশ মুখের সাথে আজকের মৌরির লক্ষ্যগূণ তফাত।
“কী সুন্দর বৃষ্টি নেমেছে দ্যাখ। যেতে যেতে একটা গান করনা শুনি। কী ভালো গানের গলা তোর।”
আমি ভাবলাম লুনা আপার অনুরোধ হয়তো রাখবেনা মৌরি। এই পাঁচ বছরে কখনো গাইতে দেখিনি ওকে। কিন্তু সবার কাছেই শুনে এসেছি। ও বেশ ভালো গায়।
কিন্তু না, ও গাইতে শুরু করেছে। নরম গলায় অদ্ভুদ সুন্দর করে গাইছে,
“যখন সবাই মগন ঘুমের ঘোরে
নিও গো, নিও গো
আমার ঘুম নিও গো হরন করে
একলা ঘরে চুপে চুপে, এসো কেবল
সুরে ডুবে
দিও গো, দিও গো, আমার চোখের
জলে দিও সাড়া
নিশিথ রাতের বাদল ধারা
আমার নিশিথ রাতের বাদল ধারা”
সন্ধ্যার আগমনী অন্ধকারে মিশেছে বৃষ্টির সুর। তার সাথে মৌরির গান।
আমার বুকের ভেতর বিধ্বংসী ঘুর্ণিপাক চুরমার করে দিচ্ছে চোখের দেয়াল। তা না হলে কেনো আমার চোখেও বৃষ্টি নামবে? আমি তো সাধারন একটা ছেলে। প্রেমিক পুরুষ যাকে বলে। মোটেও তেমন নই।
হয়তো, মৌরি ভালোবাসা নামী এ খেলায় আমাকে জেতাতে চায়।
কেনো চায়?
ভালোবাসে বলেই তাইতো!
আর আমি এই ছোট্ট শব্দটা ওকে বলেই উঠতে পারলাম না।
আমি কাঁদছি। মৌরির জন্য কাঁদছি।
এতোগুলো দিনের জমানো কান্নার সবখানি বরফ। আজ কেনো যেনো গলে নদী হয়ে যাচ্ছে। সে জলে ধুয়ে যাচ্ছে আমার না বলা হাজার আকুতি।
আমার কষ্ট!
কিন্তু কেউ কিছু বোঝার আগেই আমি দ্রুত চোখ দুটো মুছে নিলাম।
সাঁইত্রিশ বছর বয়েসি মোটাসোটা টাক মাথার কাওকে এভাবে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদতে দেখলে। লোকজন নির্ঘাত পাগল ভাববে।
আমি আসলে চাইই না মৌরি আমার এ কান্নাটুকু দেখুক।
আমার জলে ভেজা থলথলে মুখটা দেখুক।
সব কান্না কি আর দেখানো যায়?
কিছু কান্না মানুষের নিজস্ব। কাউকে দেখাতে নেই!
কাউকে না!
লেখা: Noor Helen
২১/০৪/২০২১
( এপ্রুভ হলে আগের পর্ব কমেন্টে দিয়ে দিবো।)