#বিভাবতীর_জীবন,পর্বঃ২
#লেখিকাঃতামান্না
” যারে এত ভালোবাসো, যারে কর দেহ দান!”
দিন শেষে সে কি চায় তোমারে, ইহকাল?
“যারে এত দেও সুখ, যারে কর তৃপ্ত!
দিন শেষে সে ঠিকই তোমাতে হয়েছে, অসন্তুষ্ট!
কে রইলো স্বামী? কে হইলো কার?
দিন শেষে তুমি শুধুই তোমার!
“এই জগৎ জুড়ে নামেই সম্পর্কের জাল!”
~তামান্না~
বিভা তার মায়ের কাছে কথা না বলতে পেরে, কিছুক্ষণ পর সবুজকে ফোন করল। সবুজের কাছে সে প্রশ্ন করবে সবুজ কেন এমন করছে? কি দোষে সবুজ তার উপর রেগে আছে? কেন তার সন্তানের প্রতি তার কোন মায়া নেই? সে ভুলেগেছে তাদের বিয়ের প্রথম রাত্রিরে সেই প্রতিজ্ঞা? কত ভালোবাসা আর কত ত্যাগের পর দুজন দুজনকে কাছে পেয়েছিল তারা। মনে পরে গেল সবুজ সেদিন তাকে বুকে জড়িয়ে কাধেঁ মাথা রেখে বলেছিল –
–” বিভাবতি আজ থেকে আমি শপথ করলাম, তোমার এই ত্যাগ আমি বিফলে যেতে দিব না। তুমি শুধু আমায় ভালোবাসো বলে নিজের পরিবারকে ছেড়ে এসেছো। কথা দিচ্ছি তোমাকে হাজারো ঝড় আর আছড়ে পরা সমুদ্রের ঢেউ থেকে আমি রক্ষা করবো! তোমার আমার ছোট্ট সংসারে হবে না কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঝড় যা হবে শুধুই অভিমান। তোমার মান ভাঙ্গাবো আমি,আর তুমি আমার!”
সময়ের তালে তালে সম্পর্কটা আর মান ভাঙ্গানোর রইল না হয়েগেল পুরোপুরি ভেঙ্গে যাওয়ার। বিভা কয়েকবার চেষ্টা করল সবুজকে ফোন করার তারপরই দেখতে পারল ফোনটা সুইচড অফ! বাহ! সবুজ কতটা নির্দয় হয়েগেলে তুমি! এতটা নির্দয় হলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে কথা রাখতে পারলে না। আবার আমার ফোনটাও ধরলে না। সত্যিই তুমি আমাকে মারতে প্ল্যান করলে? বিভা নিজের মনের প্রশ্নগুলো করতে করতে ঘরের ভিতর নিজের জমানো কষ্টগুলোকে চেপে কাদঁতে লাগল।
সন্ধ্যেবেলায় অনেকটা কষ্টকরেই মুখে কাপড় প্যাচিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল সে। আশপাশ ভালো করে দেখতে লাগল। এই গ্রামে প্রথম পা দেওয়া সবুজের সঙ্গে, সবুজ কত হাসিখুশি ছিল সেদিন। সারাগ্রাম সে বিভার হাত ধরে দেখিয়ে দিচ্ছিল কোথায় কোন বাড়ি, কোথায় তাদের জায়গা। আজ সেই সবুজের ঠিকানাই কিনা তাকে ছাড়তে হচ্ছে চিরজীবনের জন্য।
বাসের সামনের সীটে বসেছে বিভা, খুব কষ্ট হচ্ছে তার।
পুরোটা পথ হেটে এসেছে সে। গলা শুকিয়ে কাঠ, গা গুলিয়ে আসছে তার। বাসের ভিতর নানালোকের ভীড়। সবাই যে যার মত তাদের গন্তব্যে পৌছাবে। সে কোথায় যাবে? কোথায় কি করবে? গাড়ি চলতে শুরু করল।
গফরগাঁও গ্রাম থেকে এসে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকাগামী বাসে সে রওনা দিয়েছে। ভীড় আর লোকসমাগমের কারনে বাসেই হড়হড় করে বমি করে দিল সে। পাশের সীটে বসা বৃদ্ধা মহিলা তার সামনে দাড়িয়ে বলল-
–” নাও মা পানি খাও, বমি করে একদম শরীর দূর্বল হয়েগেছে। এই সময়ে এভাবে চলাচল করা উচিৎ না।
ঢাকায় কেউ আছে তোমার? একা একা যাচ্ছো!”
বিভার বড় কষ্ট হচ্ছে কথা বলতে, কোনরকমে শ্বাস ফেলে সে বলল-
–” আমার কেউ নেই আন্টি,”
–” মা কোন সমস্যা হয়েছে তোমার? না মানে কিছু মনে করো না মা। আমি ও মা, তোমার বয়সি আমার ও একটা মেয়ে আছে দুটো ছেলে আছে, তুমি নিশ্চিন্তে বলতে পারো এমন কিছু হলে । ”
–” কিছু হয়নি,”
–“আচ্ছা ঠিক আছে বুঝলাম কিছু হয়নি, সেই কখন থেকে দেখছি তুমি বমি করছো, শরীর তো দূর্বল হয়ে পরবে তোমার। এই নাও পানিটা নিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলো। ”
বিভা মুখ ধুয়ে নিলে উনি বিভাকে ওনার ব্যাগে থাকা রুটি আর সবজি দিলেন খেতে।
–” আমি সুগারের রুগী, দুবেলায় রুটি খেয়ে থাকি। ব্যাগে করে নিয়ে এসেছি রুটিগুলো। ঢাকায় বড় ছেলের বাসায় যাচ্ছি। ভাবলাম তুমিও আছো এক সঙ্গে খেয়েনি কি বলো? ”
বলতে বলতে ভদ্রমহিলা তাকে খেতে দিলেন রুটিগুলো। বিভা রুটি মুখে দিয়ে খেতে পারছেনা। গলা দিয়ে এই খাবার যে তার রুচবে না। বিভা একটি রুটি ছিড়ে সবজি দিয়ে খেয়ে আর খেতে পারল না। চোখের সামনে ভাসতে লাগল তার মায়ের চেহারা। মা ও তো সে খেতে না চাইলে রুটি ছিড়ে ছিড়ে খাইয়ে দিত। স্কুলে বা কলেজর সময় গুলোতে বিভার ব্যাস্ততম দিন গুলোতে নিজ হাতে খাইয়ে দিতেন তিনি। সেই মা কিনা আজ আর মায়ের জায়গায় নেই। মা আজ তাকে অভিশাপ দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
বাসের সীটে হেলান দিয়ে বসেছে বিভা, বসে তো আছে কিন্তু ঘুম আসছে না তার।
ক্ষনেক্ষনে মনে পরে যায় প্রাণ প্রিয়র মুখখানি, কত সুন্দর অনূভুতি ছিল দুজনার! এসএসসির জন্য মা তাকে কোচিং সেন্টারে ভর্তি করিয়েছিলেন, সেখানে সবুজ ছিল পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক। খুব একটা কথা হতো না বিভার কিন্তু সবুজের মায়ায় পরে গিয়েছিল সে ছেলেটা কখনও কোন মেয়ের দিকে মাথা তুলে তাকাতো না। কথা বলার সময় মুখে মুচকি হাসি হাসি ভাবটা তার রয়ে যেত সব সময়।
সবুজকে বিভা তখন থেকেই কিছুটা পছন্দ করতো।
এই বয়সটা খুব কাল! এই বয়সের আবেগ নাকি প্রত্যেকটি মেয়ের জীবনেই ধংস বয়ে আনে বিভা সব ভুলে সত্যিই সবুজের সেই মায়াময় মুখে আর চালচলনে ডুবে গিয়েছিল। মনে পরে যায় বান্ধবী উর্মির কথা, উর্মি বলেছিল-
–” প্রেম করিতে প্রেমিক পুরুষ যেমন তেমন হয়! ”
সংসারেতে স্বামী শুধু কাছের পুরুষ হয়!
বিভা উর্মির কথায় কিছুটা অবাক হয়ে বলেছিল এই ছন্দ তুই কোথায় পেলি?”
উর্মির উত্তর ছিল –” প্রেম যার তার সাথে করতে পারিস। কিন্তু মনে রাখবি ঘর বাধাঁর মানুষটি মানে তোর স্বামী যেন সারা জীবন তোর কাছের পুরুষ হয়, এমন একজন মানুষকেই তুই তোর জীবনে জায়গা দিবি। যে তোকে সব সময় নিজের মত আগলে রাখবে ঢাল হয়ে তোর পাশে থাকবে।”
বিভা চোখের পানিগুলোকে নিরবে মুছতে লাগল। বুকের ভিতরটা ফাকা ফাকা লাগছে। যার সাথে সারাজীবনের প্রতিজ্ঞা করেছিল থাকার জন্য তার হাত ছেড়ে আসতে হলো তাকে।
দীর্ঘযাত্রার পর রাত দশটা পনেরোর সময় ঢাকায় এসে পৌছাল বিভা। হাতের মোবাইলে চেনার পরিচিত মানুষদের নাম্বার খুজঁতে লাগল। কিন্তু বিশ্বাস যোগ্য আর কাউকে সে পেলো না যেখানে ঠাই নিতে পারবে। অবশেষে বারংবার ভেবে মামাতো বোন মিলির বাসায় এলো বিভা।
কলিংবেল চাপার পরপরই মিলির স্বামী রেজওয়ান দরজা খুলে দিল। সামনে দাড়ানো আগন্তুককে হঠাৎ দেখে চমকে গেলো, রেজওয়ান বিভাকে দেখেই বলে উঠলো –
–” বিভা তুমি এখানে? আর এই অবস্থা কেন তোমার?”
স্ত্রী মিলিকে ডেকে উঠলো রেজওয়ান।
রেজওয়ানের ডাকে মিলি তার তিনবছরের মেয়েকে নিয়ে সামনে দাড়িয়ে অবাক চোখে চেয়ে আছে বিভার দিকে।
কি অবস্থা মেয়েটার, এমন সুন্দর শরীরটা কেমন ভেঙ্গে গিয়েছে। বিভার শরীরটা শুকিয়ে যাওয়াতে শুধু পেটের অংশটাই নজরে পরে। চোখের নিচে কালো হয়েগেছে।
মিলি আর দাড়াতে না পেরে বিভাকে জড়িয়ে ধরে কেদেঁ দিল। কত আদরের এই বোনটা তার। কত খুজেঁছে আর আজ মেয়েটা এসেছে। মিলি বিভাকে নিয়ে তার ড্রয়িংরুমে বসিয়ে দিল। দুবোন মিলে অনেক কথা বলতে লাগল।
নিজেদের জমা কথাগুলো বলতে লাগল।
মিলি সব শুনে একদম স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। বিভার সঙ্গে এমন কিছু হবে সে কল্পনাও করতে পারছেনা। রেজওয়ান মিলিকে বিভার সঙ্গে রাতে থাকতে দিয়েছে। বিভার যা মানসিক আর শারীরিক অবস্থা এই অবস্থায় মেয়েটার কষ্ট হতে পারে।
ঐদিকে পাড়ায় পাড়ায় রটেগেছে বিভা পেটের বাচ্চাকে নিয়ে প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়েছে। বিভার শাশুড়ি সবার সঙ্গে এই কথাগুলো বলে সবুজকে ফোন করে জানিয়ে দিলেন বিভা পালিয়েছে। সবুজ যেন আরও তেতেঁ গিয়েছে, সবুজ তৎক্ষণাৎ ফোনটা কেটে দিয়ে বিভাকে ফোন করল। বিভা তখন মাথা ধুয়ে বসেছে মাত্র খাটে মাথা ব্যাথা আর শরীরের দূর্বলতায় সে যেন পরে যাচ্ছে।
পাশে তাকিয়ে দেখে সবুজের কল। ধরতেই সবুজ বলে উঠল –
–“এই ***,কি প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে গেলে শেষমেশ !
এতই জ্বালা শরীরের? এত খারাপ তুই? তোকে তো আমি এত খারাপ ভাবিনি, তুই এত নিকৃষ্ট কি করে? এতদিন মা আর মিনা বলতো আমি বিশ্বাস করতাম না। মা আমাকে আগেই বলেছে তোদের জাতই খারাপ। তোদের শুধু টাকা আর চাহিদা বেশি!”
বিভা সবুজের কথা শুনে অবাক হয়েগেল সবুজ তাকে ফোন দিয়ে এইসব কথা শুনাচ্ছে? আবার বলছে তাদের জাত খারাপ। বিভা নিজেকে শক্ত করে বলল-
–“মুখ সামলে কথা বলো, সবুজ! তুমি না শিক্ষিত? এই তুমি একজন শিক্ষক হয়ে এমন ভাষায় কথা বলছো কেমন করে? রুচিতে বাধে না তোমার এমন কথা বলতে?”
–” রাখ তো শিক্ষা, কি শিক্ষার কথা বলছিস তুই? আমার অবর্তমানে অন্যপরুষের সঙ্গে থেকে…., এই বাচ্চা যে হলো এই বাচ্চা না তোকে নষ্ট করতে বললাম! তুই ঐ রহিম ( রহিম বাদ দিয়ে রায়হান ) রায়হানের সঙ্গে পালিয়ে যাসনি? রায়হানকে আর মনে ধরে না? আমি জানতাম তো এইগুলোই তোরা করিস। আমি এখন তোর সামনে থাকলে কি করতাম জানিস? তোকে আমি খুন করতাম!”
–” খুনের ভয় আমাকে আর দেখাতে এসো না সবুজ, আমার আর কেউ নেই! আমি বুঝেগেছি দুনিয়াতে চলতে হলে তোমাদের মত আপনজন লাগে না। আমি নিজেই বাচঁবো আমার সন্তান নিয়ে বাচঁবো। পস্তাবে তুমি তোমার মা! আল্লাহ না করুক এমন একদিন হয়তো আসবে। পথে পথে ঘুরে বেড়াবে একদিনের সুখের জন্য হয়তো আল্লাহ তোমাকে একদিনের ও সুখ তোমার কপালে দিবেনা।
হয়তো বললাম অভিশাপ দিলাম না। কারন তুমি আমাকে ভুলে গেলেও আমি তোমাকে স্বামী হিসেবে মেনে নিয়েছিলাম।”
বিভা কাদঁতে কাদঁতে দেখল সবুজের ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন। ফোনটাকে আছড়ে ফেলে সে কাদঁতে লাগল।
এই জীবনটা রেখেই কি লাভ? কিছু নেই তার, কিছুই নেই!
চলবে।
[আমি আব্দুর রহিম নামের বদলে রায়হান দিলাম। আমার মনে হলো আসলেই নামটা মিলছে না। গল্পের দ্বিতীয় পর্ব পরে বিবেচনা আগেই করবেন না। গল্পের মধ্যাংশেও অনেক সুন্দর হয়। একটু পড়ে দেখবেন। ]