#বিভাবতীর_জীবন
#পর্বঃ৮,৯
#লেখিকাঃতামান্না
#পর্বঃ৮
–” মান সম্মান নিয়ে টানাটানি হবে এমন মেয়েকে বিয়ে করালে, মেয়ের অভাব পরে নাই। যে মেয়ে মা বাবারে না জানাইয়া অন্য ছেলের হাত ধরে পালিয়ে বিয়ে করে সে মেয়ে স্বামী সংসার ফালাইয়া পর পুরুষের সঙ্গে চলে যেতে দ্বিতীয়বার ভাববে না।”
বিভা চটকরে বারান্দা থেকে সরেগেল। ছি! কি একটা লজ্জা। কেউ যদি হঠাৎ উপরে দেখত, সায়েমের মা যা বলেছে তা নিয়ে বিভা খুব একটা মা ঘামালো না।
সব মাই তার ছেলের মঙ্গল চায়। ছেলের মঙ্গলের জন্য বিভাকে ঘরের বউ করতে রাজি হবে না।
সায়েম মায়ের এমন হুটকরে এমন আচরণে বিরক্ত হয়েগেল। তারপর সে গাড়িতে উঠে বসল, সবাই চলেগেল।
তারা যাওয়ার পরপরই বিভার বাবা মশিউর রহমান এলেন বাড়িতে। খানিকটা জিরিয়ে নিয়ে বসতেই বিভার মা বিভার ব্যাপারে বলেন তার স্বামীকে। মশিউর সাহেব অবাক হয়ে চেয়ে আছেন। এখন যেন তার রাগ চারগুণ বেড়েগেছে, এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরও তিনি সতর্ক না হয়ে আবার আরেক কান্ড করছেন। মশিউর সাহেব বলে উঠলেন –
–“তোমার যা মন চায় তাই করো, সারাজীবন যা ভেবেছো তাই করেছো। এখন ও তাই করবে আমাকে বলার কি আছে?”
মশিউর সাহেবের উত্তরে কিছুটা মন খারাপ হয়েগেল বিভার মায়ের।
________________________________
এনজিওর কাজে অভিজাত এলাকা ছেড়ে বিভাকে যেতে হয় অনেক বস্তি, প্রত্নত গ্রাম, বিভা যখনই গ্রামে তার দলবল নিয়ে আসে তখনই তার মনে পরে যায় আগের মুহূর্তের কথা। নিজেকে বহুকষ্টে দমিয়ে রেখে হাসিমুখে সবার সঙ্গে কথা বলে। সবাই খুব মিশুক, আরও ভালো যে বিভা ভুলেই যায় তার সব কষ্টকে। কয়েক সপ্তাহ পরপর বিভাকে উচুনিচু পাহাড় বেয়ে চলতে হয়, চলতে হয় কাদামাখা মেঠোপথ ধরে। কখনও বা যেতে হয় নৌকায় চড়ে এদিক সেদিক। এভাবে চলতে গিয়ে পুরোনো অনেক স্মৃতিই তার মনে পরে যায়। আবার ভুলেও যায়!
বিভা রংপুরের একটি প্রতন্ত গ্রামে এসেছে যেখানে তার এনজিও থেকে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য কিছু উপহার সামগ্রী ও খাবার আনার ব্যবস্থা করেছে। বিভাদের দলে প্রায় দশজন আছে, এদের মধ্যে অনেকেই বিভার থেকে বড় কয়েকজন খুব ছোট।
বিভা তাদের সঙ্গে হেসেখেলে কথা বলে, অনেক মানুষের সঙ্গে বিভার চলতে হয়, কত গরীব অসহায় মানুষ তার আসেপাশে আছে সে বুঝতেই পারতো না যদি সবুজ তার জীবনে না আসতো। বাবার বাড়িতে রাজকন্যার মত বেড়ে উঠা বিভা সবুজের ঘরে পা দিতেই বুঝেছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের জ্বালা। এখন এই অসহায় মানুষগুলোর সঙ্গে থাকতে থাকতে তাদের দুঃখের বানী শুনতে শুনতে আরও বুঝতে পারল জীবনটা সবার জন্য সুখের নয়। প্রত্যেকটা মানুষের জীবনেই সুখ আর দুঃখের মিশ্রণ।
বিভাদের এনজিওর পক্ষ থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি প্রতিযোগিতা হচ্ছে যেখানে খেলছে বাচ্চারা।
বিভার পাশেই এনজিও থেকে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ডাঃ আরাফাত রহমান ফাইয়াজ যিনি এই এলাকার নাম করা একজন ব্যাক্তিত্য। ডাঃফাইয়াজ এই গ্রামেরই ছেলে, ঢাকায় বসবাস করলেও ফাইয়াজ গ্রামে কয়েকদিন বাদে বাদে এসে ঘুরে যায়। আর মাঝে মাঝে স্কুল কলেজের তদারকি করে। ডাঃফাইয়াজ প্রতিযোগিতা মূলক অনুষ্ঠানের বিচারক হিসেবে খেলায় অংশ গ্রহনকারিদের পুরস্কার তুলে দিচ্ছে। ডাঃফাইয়াজের পিছনে বিভা বাচ্চাদের পুরস্কার একে একে তুলে দিচ্ছে।
ফাইয়াজ পুরস্কার বিতরন করে বসে পরল নিজের স্থানে।
বিভা ও কিছু বসল, এর মধ্যে সবাই যে যার মত বসে পরল কারন বাচ্চাদের মধ্যে অনেকে নাচ করবে। বিভার মধ্য থেকে একজন সিনিয়র দাড়িয়ে ডাঃ ফাইয়াজকে দেখিয়ে দিয়েছে তখন । বিভা আড়চোখে ডাঃফাইয়াজ সাহেবের দিকে তাকিয়ে দেখল। লোকটি খুব গম্ভীর একদম গম্ভীর।
সবাই কথা বলছে যে যার মত কিন্তু তিনি চুপচাপ বসে রয়েছেন। ফাইয়াজ সাহেব অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর সবার সঙ্গে আরেকবার দেখা করে নিলেন। তারপর চলেগেলেন সেখান থেকে।
পুরোদিন একটি রিসোর্টে থেকেছে বিভাদের দল।
সেখান থেকে বিভা ও তার দল মিলে ঢাকায় এসে পরল।
বাসায় আসার পর বিভা দেখল তার মা কারোর সাথে কথা বলছেন। দরজা লাগিয়ে পাশ কাটিয়ে নিজের রুমে চলে যেতে চাইলে একজন ডেকে বলল –
–” ভাবী কে এসেছে? বিভা নাকি?”
বিভার মা বিভাকে দেখেই ইশারা করলেন এখানে আসতে।
বিভা ক্লান্ত শরীর নিয়ে ভিতরে ঢুকে দেখল মহিলাটি সোফায় বসে আছে। বিভা রুমে ঢুকে সালাম দিয়ে বলল –
–” কেমন আছেন?”
–” খুব ভালো, তুমি কেমন আছো?”
–” জ্বী ভালো আন্টি,”
–” শুকিয়ে কেমন হয়েগেছে চেহারাটা। আহারে যত্ন নিতে পারো না? এত ইয়াং বয়সে চামড়া কেমন হয়েগেছে।
স্মার্ট হও, আগে কি হয়েছে তা মনে রেখো না, ভুলে যাও,
পাস্ট ইজ পাস্ট। এখন একটা কাজ করো মায়ের কথা শুনে চলতে চেষ্টা করো। যে ভুল করেছো তুমি, কেন যে তোমরা এমন করো বুঝি না। বিয়ে করেছো তো করেছো একদম নিচু পরিবারের ছেলেকে। এখন নিজের মত চলাফেরা বন্ধ করে একটু গুছিয়ে চলতে শেখো। মায়ের আর বাবার কথা শুনতে থাকো ক্ষতি হবে না। ”
বিভা চুপ করে শুনতে লাগল। কিছুই বলল না এইসব কথা তাকে উঠতে বসতে শুনতে হবেই, বিভা একদম নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে।
–” আচ্ছা, ও কি আবার ফিরে আসবে? ”
–” আন্টি ভুল আমি একবারই করেছি, আর করব না।
আমি আর কখনই তার কাছে ফিরে যাবো না।”
–” হুম ঠিক আছে, আর শুনো যতটা সম্ভব এখন এইসব ভুলে নিজেকে পুরোপুরি ঠিক রাখার চেষ্টা করো। ”
বিভা ওনার সাথে কথা বলে উঠে চলেগেল।
বিভা চলে যেতেই উনি বলে উঠলেন –
–” ভাবী ঐ দিনের ছেলেটির পরিবার বিভাকে পছন্দ করেছিল। কিন্তু মা টা রাজি হয়নি খুব রাগী মহিলা।
ছেলের বিয়ে ঠিক সব ঠিক এর মধ্যেই মেয়েটা তার পছন্দের ছেলের সঙ্গে বিয়ে করে নিয়েছে। সেই থেকে উনি আর ভরসা করতে পারেন না। চিন্তা করবেন না সব ঠিক হয়ে যাবে। ”
–” আমি যে কি করবো আপা, মেয়েটা আমার এমন বোকা, কি করে এমন ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল। কি ভাবে কি সামলাবো বুঝতে পারছিনা। আবার মেয়ের বাবা রেগে আছে, কেন আমি ঐ ঘটনার পর আবার বিয়ে দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি। অপেক্ষা না করেও তো উপায় নেই,
এই মেয়েকে আমি যদি ফেলে রাখি সামনে তো আর বিয়ের ঘর পাবো না।”
–” কি করবেন আর এখন।”
সায়েমের পরিবারে সবাই বিভাকে পছন্দ করেছে, বিভা দেখতে যথেষ্ট মার্জিত ও সুন্দর। ভদ্রই বুঝা যায় বিভাকে দেখে। বিভার পরিবার ও তাদের পছন্দ হয়েছে। কিন্তু বাদ সাধলো বিভার বিয়ের ঘটনা নিয়ে। বিভার বিয়ের পরবর্তী জীবনের কথা শুনেও তারা খুব আফসোস করেছে। যা বিভার শরীর দেখেই বুঝেছে। হয়তো মেয়েটার চোখের দিকে তাকালে খুব সহজে বুঝা যায় মেয়েটি খুবই দূর্বল।
কিন্তু বাদ সাধলেন সায়েমের মা। তিনি কোন ভাবেই এই মেয়েকে ঘরে তুলবেন না। এই নিয়ে সায়েম ও খুব ক্ষুদ্ধ।
মাকে বুঝিয়ে ও সে কিছুই করতে পারছেনা। অনেক সময় অনেক কিছুই চেয়ে করা যায় না, মেনে নিতে হয় সব।
বিভা ফ্রেশ হয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে শুয়ে পরল। বিছানায় শুতেই দেখল রায়হানের মায়ের কল। কিছুটা বিরক্ত হলো বিভা আবার কিসের জন্য ফোন করল।
ধরতেই অপর পাশ থেকে তিনি বলে উঠলেন –
–” কেমন আছো মা তুমি?”
–” জী ভালো, ”
–” ও, তোমার শরীর কেমন আছে?”
–” ভালোই আছে,”
–” ও, সবুজের মা বলতেছিলি সবুজরে নাকি বিয়ে করাইবো। মানি মানুষের লজ্জা শরম বলতে কিছু নাই।
কয়দিন হইছে তোমারে এমন কইরা বিদায় করলো এখন আবার বিয়ার জন্য চেষ্টা করতেছে। আর পোলাডারে ও ভালো মানুষ মনে করছিলাম, পোলাডা আরও খারাপ।”
–” চাচি এগুলো আমাকে বলে কি লাভ? আমি তার স্ত্রী এখন? না আমার বাচ্চা আছে? যে আমি তার কথা চিন্তা করবো? বাচ্চা থাকলেও হয়তো সেই চিহ্ন ও প্রমাণ স্বরূপ আমার বারবার তার কথা মনে পরতো। কিন্তু এখন আর মনে পরবে না চাচি।”
–” কি বলো এইগুলো, বাচ্চা থাকলে মানে?”
–” চাচি রাখছি, আমি আর এই বিষয়ে কোন কথা বলতে পারবো না।”
বিভা ফোন রেখে ভাবতে লাগল সবাই মানুষকে করুণা করতে ভালোবাসে। সহানুভূতির আড়ালে মানুষের কথা নিয়ে বেচাকেনা করা গ্রামের মানুষের স্বভাব। যেদিন রায়হানের মা তার সাথে কথা বলে সেদিন সবুজ তাকে ফোন করে ডিস্টার্ব করে। নিশ্চয়ই উনি ও গিয়ে কথার তালে বলে ফেলেন বউ তো এটা বলেছে ওটা বলেছে।
বিভার মাথাটা খুব ধরেছে। সন্ধ্যা ধরেই বিরক্ত লাগছে তার। আবার এই মহিলার এইসব কথা, বিভা ফোন নাম্বার টা ব্লক করে দিয়ে ভাবলো যার সঙ্গে সম্পর্কই নেই তার গ্রামের লোকের সঙ্গে কথা বলে লাভ কি? নাম্বারটি ব্লক করে ফেলে রাখলো।
চলবে।
#বিভাবতীর_জীবন
#লেখিকাঃতামান্না
#পর্বঃ৯
সময় ফুরিয়ে যায়, এক এক ধাপ মানুষকে জীবনের নতুনত্ব আর জীবনের মানে শেখায় কিভাবে একজন মানুষ নিজের জীবনে সফলতার উচ্চ স্তরে পারি জমায়।
জীবনে আঘাত জিনিসটা খুব প্রয়োজন! দেয়ালে যখন একটা মানুষের পিঠ ঠেকে যায় তখন সেই মানুষ আর মুখ বুজে সহ্য করতে পারে না। তখন সেই মানুষ উঠে দাড়ায় আর লড়তে শুরু করে নিজের উল্টো পিঠে থাকা মানুষ গুলোর দিকে।
বিভার ও সেই সময় এসেগেছে, সাজানো স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে যাওয়ার পর বিভার সেই লড়াইয়ে সে আবার তার বাবাকে পেয়েছিল। এই তো বছর দুয়েক আগে শশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে আসা মেয়েটির এখন একটি ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরি হয়েছে। কথায় কথায় নাক-মুখ কুচকে থাকা পাড়া-প্রতিবেশিদের মুখ সে একাই বন্ধ করতে পারে।
হয়তো অতসব প্রতিবাদ করতে গিয়ে শুনতে হয় নানাধরনের মন্তব্য। তবুও বিভা আর চুপ করে থাকতে পারেনা।
_________________________________
ব্যাংকের দু নাম্বার কাউন্টারে এসেছে মনিকা। ভিড় ঠেলে দাড়াতে পারছেনা তবুও সবাইকে পিছনে চেপে সামনে এগুতে লাগল। এক নাম্বার কাউন্টারের লোকজন যেন নিজেদের মধ্যে হট্টগোল লাগিয়ে দিয়েছে। মনিকার খুব বিরক্ত লাগছে। একেতো প্রেগন্যান্সির প্রায় সাত মাস চলছে প্রায়। ক্লান্ত মনিকা দাড়াতে পারছেনা কিছুক্ষণ দাড়িয়ে সামনের লোকটিকে বলল –
–” আঙ্কেল আমাকে একটু তাড়াতাড়ি যেতে দিবেন? আমি আর দাড়াতে পারছিনা। আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আঙ্কেল।”
–” আপনাকে যদি আমি আগে সিরিয়াল দিয়ে দেই তাহলে তো আমি সময় পাবো না, আমার অফিস আছে, ছেলের বেতন দিতে এসেছি সময় মত না গেলে বস রেগে যাবে।”
–” আঙ্কেল যদি পাচঁটা মিনিট সময় দিতেন তাহলে আমি একটু দাড়াতে পারতাম। আমি দাড়াতে পারছিনা আঙ্কেল।
আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।”
–” এই অবস্থায় কেন আসেন? ঘরে জামাই নেই? কেউ নেই?”
হুটকরে কেদেঁ উঠলো মনিকা, এতগুলো লোকের সামনেও তার বাধ মানছে না চিৎকার করে কাদতেঁ কাদঁতে বলল –
–” আমাকে একটু বিষ দিন খেয়ে চিরজীবনের মত সবাইকে মুক্ত করে যাই! আমি আর পারছিনা! স্বামীর বাড়িতে আজ শশুর শাশুড়ি ভালো হওয়ার পর ও শুধু আমার স্বামীর জন্য ভালো থাকতে পারছিনা। দিনদিন তার অত্যাচার এখান থেকে ওখান থেকে টাকা নেওয়া। ঋণ করতে করতে আমার জমানো টাকা ও সে শেষ করে দিয়েছে। বাবার বাড়ি থেকে টাকা এনেছি বলে ভাবি আর বড় ভাই আমাকে ঐ বাড়িতে যেতে দেয় না। এই অবস্থায় আমাকে ঘুরতে হয় অথচ আমি আমার স্বামীকে কাছে পাইনি।” বিভা এসেছিল ভিতর থেকে এপ্লিকেশন ঠিক করে সিল নিতে, কিন্তু ক্লান্ত মনিকাকে চিৎকার করতে দেখে বিভা কাউন্টারে আর দাড়াতে পারল না কারন মনিকা ততক্ষণে পরে যাচ্ছিল প্রায়। বিভা মনিকাকে এভাবে রেগে যেতে দেখে অনেকটা নিজেকেই যেন দেখতে পেল। নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছে সে একেবারে।
মনিকাকে সেই ভীড় থেকে টেনে নিয়ে এসে চেম্বারে বসিয়ে দিল। পানির বোতল টা এগিয়ে দিয়ে বলল –
–” আপনার এই সময়ে এত হাইপার হওয়া উচিৎ নয়।
কয়মাস হয়েছে প্রেগন্যান্সির?”
–” সাত মাস,”
–” এভাবে ঘুরে বেরানোর কোন মানে হয় ? মাথায় পানি দিয়ে দিব?”
মনিকা চোখের পানিগুলোকে মুছতেও পারছেনা ঝরঝরিয়ে পরছে, মাথা নাড়িয়ে বহুকষ্টে বলল –
–” আমার মত জীবন যেন আর কারো হয় না গো আপু!”
–” এমন ভাবে বলবেন না আপু, জীবনে সুখ দুঃখ থাকবেই। নিজেকে শক্ত করুন, চেক কেন নিচ্ছেন? নিজের স্বামীর ঋণ শোধ করতে?”
মনিকা ডুকরে কেদেঁ উঠে মাথা নাড়ালো, বিভা তা দেখে বলে উঠলো –
–” কতদিন আপনি আপনার স্বামীর ঋণ শোধ করবেন?
আমি যতটুকু জানি যারা ঋণ করে তারা সারাজীবনে ও নিজের স্বভাব পাল্টাতে পারেনা। তো এভাবে কতদিন ঋণ শোধ করবেন? আপনার ব্যাংক একাউন্টে কত আছে এখন বর্তমানে?”
–” পনেরো লাখ, বাবা আমার নামে ব্যাংকে রেখেগেছেন।
আর একটা প্লট রেখেছেন।”
–” চাকুরীজীবি আপনি?”
–” না,”
–” তাহলে তো এগুলো আপনার ভবিষ্যৎ সম্বল, কেউ এভাবে নিজের সম্বলটুকু শেষ করে?”
–” আপু আমার স্বামী যদি ঋণমুক্ত না থাকতে পেরে মানুষের সাথে মাথা উচু করে বাচঁতে না পারে তাহলে আমার এই টাকা দিয়ে কি হবে?”
–” বোকার মত কথা বললেন আপনি, এত আত্মবিশ্বাস এত ভালোবাসেন আপনার স্বামীকে। আপনার স্বামী কি এমন ভাবে আপনাকে ভালোবাসে? এই যে এমন একটা মুহুর্ত সে পারতো নিজের স্ত্রীকে ছেড়ে দিতে?
এত আবেগী হয়ে থাকবেন না আপু, কিছু বুঝতে চেষ্টা করুন, যে টাকা আপনার বাবা দিয়ে গেছেন তা শেষ না করে কিছু করার চেষ্টা করুন। আপনার সেই অর্জিত অর্থগুলো আপনার স্বামীর পিছনে ব্যায় করুন। এতগুলো টাকা শেষ করবেন কেন আপনি? পনেরো লাখ আপনি শেষ না করে ছোটখাটো চাকরি করুন টাকার সংকট হলে। তবুও নিজের শেষ সম্বলটুকু শেষ করবেন না।
মনিকার সামনে আরেক গ্লাস পানি দিয়ে বলল –
–” পানিটা শেষ করুন, তো যেটা বলতে চাইছিলাম।
আপনি সংসার করবেন, স্বামীর ঋণ শোধ করবেন ঠিক আছে তাই বলে এমনটা করবেন না। আরেকটা কথা সংসার করলে কখনই মনের দুঃখ হোক বা যেকোন কষ্ট থেকেই হোক বাইরের মানুষের সঙ্গে আলোচনা করবেন না। এই যে আজ আপনি চিৎকার করে এত গুলো লোকের সামনে নিজের কষ্ট টাকে জাহির করেছেন একজন ও এগিয়ে আসেনি। আসবে ও না, আপনাকেই শক্ত হতে হবে।
আপনার স্বামীকে বলুন তার মধ্যাকার যত কথা সব আপনাকে বলতে। দুজন মিলে সিদ্ধান্ত নিন কিভাবে এই অর্থাভাব দূর করা যায় আর কিভাবে ওনার এই ঋণের স্বভাব বন্ধ করা যায়। এমন অন্ধের মত বিশ্বাসটা অন্তত করা বন্ধই করুন। এক সময়ে আমি ও আপনার মত বিশ্বাস করেছিলাম কাউকে। ঠকে ও ছিলাম আজ তার জন্য দেখুন সহ্য ও করে যাচ্ছি। তবে একদিক দিয়ে বেশ ভালো আছি আমি। নিজের মত বাচঁতে পারছি নিজের মত চলতে পারছি।”
বিভা মনিকার হাতে চেক বই ধরিয়ে দিল, মনিকা বিভার দিকে তাকিয়ে বলল –
–” আপনার কি সমস্যা ছিল?”
–” ঐ একই সমস্যা, ”
মনিকার সঙ্গে কথা বলেই বিভা তাকে তার পিয়ন দিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেদিল। মনিকার সঙ্গে কথা বলে নিজেকে খুব হালকা লাগছে তার। বেশ ভার ভার লাগছিল তার কারোর সঙ্গে কথা বলেই যেন তার ভালো লাগে না। একই দুঃখের সই না হলে নাকি দুঃখের গল্প বলে মজা পাওয়া যায় না বিভার ও ঠিক একই দশা।
বিকেল বেলায় কিছুটা ভীড় কম থাকে। বিভা কাজ শেষ করে হাত ঘড়ি দেখল সময় হয়েগেছে প্রায় এরপর বেড়িয়ে গেল সে। আজ উর্মির সঙ্গে দেখা করতে হবে তার কবে দেখা হয়েছিল তাদের। বিভা গাড়ি নিয়ে একটি রেস্টুরেন্টে আসল উর্মির ভাই বোন সবাই একসাথে। বিভা উর্মির সঙ্গে দেখা করতেই উর্মি তাকে জড়িয়ে ধরল। কথার মাঝে দুজনই কেদেঁ দিল স্কুল -কলেজ লাইফে তো দুজন একসঙ্গে থেকেছে। শেষকালে এসে এমন ঘটনা ঘটেছে যে দুজনই আলাদা হয়েগেছে। কিছুক্ষণ কথা বলার পরই উর্মিকে বিদায় নিয়ে এসে পরল।
ঘড়ির কাটায় ছয়টা বেজে পঞ্চান্ন মিনিট, বিভা গাড়ি থেকে নেমে বাসায় আসা মাত্রই দেখল ডাঃফাইয়াজ বসে আছেন, সঙ্গে একজন মহিলা । বিভা ওনাকে দেখে কিছুটা চমকে গেল, এই লোকটা এখানে কেন?
বিভা সৌজন্য মূলক ভাবে সালাম দিয়ে নিজের রুমে চলেগেল। কিছুক্ষণ পর বিভা রুম থেকে বের হয়ে দেখল ড্রয়িংরুমে এখনও কথা শুনা যাচ্ছে শব্দের উৎসের কারনে বুঝতে পারল ফাইয়াজ এখনও চলে যাননি।
বিভা কিছুটা অবাক হলো, সে অফিস করে এমনিতেই ক্লান্ত তাই আর কিছু ভাবলো না ফাইয়াজ সাহেব বিভার মায়ের সঙ্গে কথা বলছেন। কিছুক্ষণ কথা বলেই ফাইয়াজ সাহেব চলেগেলেন সেখান থেকে।
বিভা তখন রুমেই ছিল, বাবা আসার পর তার মা তাকে ডেকে বললেন বাবা তাকে ডাকছে সে যেন চলে আসে।
বিভা বাবার রুমে আসলে তিনি বসিয়ে দিলেন সামনে।
–” কিছু বলবে বাবা?”
–” হুম, একটা কথা বলতে চাই, ”
–” বল,”
–” তুমি ডাঃ ফাইয়াজ কে তো চেনো?”
–” হ্যা,”
–” ফাইয়াজকে তোমার কেমন মনে হয়?”
–” ভালোই তো, খুব ভালো মানুষ!”
–” অনেক কাজ করেছ, আমাকে এসে বলেছো,”
–” হ্যা বলেছি তো, আজ আবার জানতে চাইছো কেন?”
–” সে আজ তোমার জন্য বিয়ের প্রপজাল নিয়ে এসেছিল। সে তোমাকে বিয়ে করতে চায়, তোমার মায়ের খুব পছন্দ হয়েছে। আমি ও দেখেছি বাইরে।”
–‘হুম,”
–” তোমার কি মনে হয়, এখন এই মুহূর্তে তোমার একটা ভালো জায়গায় বিয়ে হওয়া প্রয়োজন নয় কি?
না দেখো অনেক তো হলো এভাবে থাকা, তোমার জীবনের দাগটা তো মুছে দিতে পারিনি। কিন্তু জীবনটাকে তো একটা ভালো মুহূর্তে নিয়ে যেতে পারি।”
বিভা বাবার মুগের দিকে তাকিয়ে মনেমনে বলল – এতটা খুশি হয়ে লাভ নেই বাবা। ফাইয়াজ সাহেব তো জানেনা আমার পুরো কথা তাই হয়তো বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। জানলে এমন প্রস্তাব করতো না।
–” তুমি কি বিয়ে করতে প্রস্তুত নও?”
–” বাবা সময় নিয়ে বলছি তোমাকে।”
____________________________________
ঘড়িতে রাত দশটা বেজে গেছে প্রায়। বিভা মনে থাকা হাজারো দিধা কাটিয়ে ডাঃফাইয়াজকে ফোন করল।
কিছুক্ষণ পরই ব্যাক করলেন ফাইয়াজ। বিভা সালাম দিয়ে কি কথা বলবে কিছুই বুঝতে পারছেনা।
বিভার নিরবতায় ফাইয়াজ বলে উঠলো –
–” বিভা আপনি কি কিছু বলতে চান?”
–” জ্বী, আপনি আজ কেন এসেছিলেন? ”
–” আপনাকে বলা হয়নি?”
–” হুম,”
–” তাহলে প্রশ্ন করছেন যে, কিছু জানতে চাইছেন নাকি?”
–” আমার সম্পর্কে আপনি কি কিছু জানেন?”
–” কি?”
–” আমার অতিত?”
–” অতিত ধুয়ে কি পানি খাবো আমি? বিয়ে করতে অতিত লাগে?”
বিভা চমকে গেল এই লোক কি কথা সব সময়ে এমন ভাবেই বলেন?
চলবে।