#ধারাবাহিকগল্প_পর্ব_৫
#বিয়ে_নামক_ছেলেখেলা
১.
“আসসালামু আলাইকুম মামা। কেমন আছেন?”
“ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আর থাকবো, এই টেনশন যাওয়ার আগে কোন মুক্তি নেই। শোন রাকিব তোমার সাথে কথা আছে।”
“জ্বি মামা?”
“আমি আর দুলাভাই আজ উকিলের কাছে গিয়েছিলাম, জোরপূর্বক বা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে বিয়ে দিলে তা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় আছে। আর তা হলো আদালতে আমাদের ক্রিমিনাল মামলা দায়ের করতে হবে, পাশাপাশি এই বিয়ে অস্বীকার বা চ্যালেঞ্জ করে দেওয়ানী মামলাও করতে হবে। আমরা তাই করবো ভাবছি। তুমি কী বলো?”
রাকিব কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে। সোহানার পরিবারের উপর সে বিরক্ত, সোহানাকে নিয়ে তার মনে অবিশ্বাস সবই ঠিক আছে, আবার মনে হয় এই বিয়েটাই স্বাভাবিক ভাবে হলে সোহানার সাথে সে খুশি মনেই সংসার করতো, মেয়েটা সুন্দরী, মেধাবী। একসাথে কাটানো বিয়ের রাত রাকিব এখনো ভুলতে পারে না।
“রাকিব কথা বলছো না যে?”
রাকিবের আম্মু মিসেস জেসমিনর তীক্ষ্ণ কন্ঠে রাকিবের চমক ভাঙে।
“না আম্মু চিন্তা করছিলাম।”
“কী চিন্তা করো তুমি। তুমি জানো এই মেয়ের এই অন্য ধর্মের ছেলের সাথে গভীর সম্পর্ক ছিল, তারা একসাথে থাকতো, বিদেশে পালিয়ে যাওয়ারও পরিকল্পনা ছিল।।তাইতো মেয়ের পরিবার ধরে বেঁধে বিয়ে দিলো। কোন ভদ্র পরিবারের মানুষ এই মেয়েকে বিয়ে করিয়ে নেবে না জানে মেয়ের বাপ মা, এই জন্য এমন ছলচাতুরীর আশ্রয় নিল।”
“কী বলো আম্মু, এসব তো জানতাম না। কিভাবে জানলে?”
“তোমার মামা খোঁজ এনেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই জানে এই ঘটনা, এইজন্যই তো মেয়েকে ক্যাম্পাসে ফিরতে দিচ্ছে না।”
এবার রাকিব সত্যি চিন্তায় পড়ে যায়, এক দুই দিনের মায়া যাই হোক, তার টানে সে চরিত্রহীন কারো সাথে সংসার করতে পারবে না।
“মামা তাহলে আপনারা যা ভালো মনে করেন। ক্রিমিনাল মামলা করবেন আগেই? না কথা বলে মীমাংসা করবেন?”
“মামলাই করে দেব। বুঝুক সহজ সরল মানুষ পেয়ে প্রতারণা করার ফলাফল। তবে রাকিব বিয়ে অস্বীকার করার জন্য কিন্তু কোন সম্পর্কে জড়ানো যাবে না।”
“মানে মামা?”
“মানে একদিনের ভেতর তোমার আর সোহানার কোন সম্পর্ক নিশ্চয়ই হয়নি? একবার শারীরিক সম্পর্ক হয়ে যাওয়া মানে বিয়ে মেনে নিয়েছ। শারীরিক সম্পর্ক থেকে বিরত থেকে যতদ্রুত সম্ভব বিয়ে অস্বীকার করে মামলা দিতে হয়।”
ঢোক গিলে রাকিব, শারীরিক সম্পর্কে তো সে জড়িয়েছে, সোহানার ইচ্ছা অনিচ্ছাও তোয়াক্কা করেনি, ঐ একদিনে সুযোগ পেলেই নিজের অধিকার ফলিয়েছে। বিয়ে যেন অস্বীকার করতে না পারে এইজন্যই সোহানার পরিবার একদিন মেয়ে জামাইকে বাড়িতে রেখে দিয়েছে। আর ও বোকার মতো সেই জালেই পড়েছে। কিন্তু এখন বাবা, মা আর মামার সামনে এই কথা সে কিছুতেই স্বীকার করতে পারে না।
“না না হাবিব, রাকিবের কোন সম্পর্ক হয়নি। ঐ একদিনে ছেলে আমার টেনশন আর ভয়েই অস্থির ছিল। সেসময় এসব কার মাথায় আসে। ঠিক না রাকিব?”
রাকিব গলা দিয়ে ঘ্যোত টাইপের একটা শব্দ বের করে মাথা নাড়ে। হ্যাঁ, না না বললো বোঝা যায় না। তবে তাতে রাকিবের আব্বা আম্মা, মামা কারো মাথাব্যথা হয় না। তারা মামলার পরিকল্পনা করতে ব্যস্ত হয়ে যান।
২.
“এই সাকিব বেল বাজায় কে দ্যাখ তো বাবা। আগে দেখে তারপর দরজা খুলবি।”
সাকিব দরজার ফুটোয় চোখ রেখে ভড়কে যায়। সোহানার বাবা, চাচা, আর চাচীকে চিনতে ভুল হয় না।
“আম্মু ভাবির পরিবারের মানুষজন এসেছেন। পাঁচ ছয়জন। পুলিশ ডাকবা?”
বসার ঘরের সবাই হতভম্ব হয়ে যায়। রাকিব আর সাকিবকে তাদের রুমে পাঠিয়ে, মিসেস জেসমিনও ওনার রুমে চলে যান। মেহমানের সাথে যা বলার রাকিবের বাবা আর মামা বলুক শুরুতে। প্রয়োজন পড়লে তখন পুলিশ ডাকা যাবে।
“আসসালামু আলাইকুম বেয়াই সাহেব। মিষ্টিগুলো কই রাখবো?”
রাকিবের বাবা উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করলেন না। সোহানার বাবা দুই হাতে প্রায় দশ কেজি মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে ঢুকেছেন, চাচার হাতে আছে ফলমূল। প্রথম নতুন বেয়াইয়ের বাড়িতে আসলেন, কোন কিছু কম হওয়া যাবে না। রাকিবের বাবার উত্তর বা সাদর আমন্ত্রণ না পেয়ে কিছুটা দমে যান সোহানার বাবা আহসান সাহেব। তবে পরিস্থিতি সামলে নেন চাচা।
“ভাইজান, প্যাকেট টেবিলে রাখেন। বেয়াইন অসুস্থ তাই বেয়াইয়ের মন মেজাজ ভালো নেই।
আরে হাবিব সাহেবও আছেন দেখি, আসসালামু আলাইকুম। যাক ভালো হলো, আপনার সাথেও দেখা হয়ে গেল।”
মেহমানদের বসার ঘরে বসিয়ে রাকিবের বাবা হায়দার সাহেব আর মামা হাবিব সাহেব চুপচাপ বসে থাকেন। সবাই বিব্রত, কে কিভাবে কথা শুরু করবে বুঝতে পারেন না। কাজের মেয়েটা এসে চা বিস্কুট দিয়ে যায়, নতুন কুটুমদের আপ্যায়ন বলতে এতটুকুই। কেন জানি অপমান আর তাচ্ছিল্যে সোহানার বাবা আহসান সাহেবের চোখে পানি এসে যায়। চাচা চাচীও বিব্রত, ওনাদের এই হঠাৎ আগমনে কেউ যে বিন্দুমাত্র খুশি নয়, তা বোঝার কারণ নেই।
“ভাইজান আমার সাথেও কথা বলবেন না? গতবার আসলাম কত কথা বললেন, আদর যত্ন করলেন। ভাবি কি বেশি অসুস্থ, সামনেও আসলেন না দেখি এখনো?”
“আলেয়া কথা বলার মুখ কী রাখছ? মামাতো বোনের সম্পর্ক বলে কত বিশ্বাস করে ছেলেদের তোমার শ্বশুরবাড়ি পাঠালাম। আর তুমি কী করলা, ছেলেধরাদের সাথে হাত মিলিয়ে আমার ছেলেটাকে এভাবে আটকে ফেললা, জোর করে বিয়ে দিলা।”
সোহানার মেজো চাচা এমনিও রগচটা মানুষ, দ্রুত মাথাগরম হয়ে যায়। শুধু বাড়ির মেয়ে আর ভাই জানের দিকে তাকিয়ে এখনো চুপচাপ আছেন। তবে উত্তর দিতে ভুললেন না।
“ভাই সাহেব, এসব কী বলেন। কে ছেলেধরা, আমরা?
রাকিব নিজের মুখে বলেছে সোহানাকে পছন্দ হয়েছে, আপনি আপনার শালাকে জিজ্ঞেস করে দেখেন। পছন্দ হওয়ায় আমরা কাবিন করিয়ে দেই। আমাদের ঐদিকে এটাই নিয়ম।”
“আপনি আমাকে আর শেখাবেন না। আলেয়ার স্বামী, আমার বোনজামাই হিসেবে যথেষ্ট সম্মান রেখে বলছি, আমরা ছোট মানুষ না যে এসব বলে আমাদের বুঝ দিবেন। ফোন কেড়ে নেওয়া, ছেলেকে আলাদা করে আটকে রাখা, সাধ্যের বাইরে বিশাল অঙ্কের কাবিন ধরা আপনি নিয়ম বলছেন?”
আহসান সাহেব বেয়াইয়ের হাত জড়িয়ে ধরেন। তিনি কথা কাটাকাটিতে যেতে চান না। কেন জানি মেয়ের জন্য ওনার ভীষণ অপরাধবোধ হচ্ছে, মেয়েটার সহজ সরল জীবনটা তিনি আত্মীয় স্বজনের কান পড়ায় জটিল করে দিলেন।
“ভাই সাহেব, যা হয়েছে, ভুল হয়েছে। ক্ষমা করে দেন। আমরা না বুঝে ভুল করেছি। এখন এসব মনে পুষে রেখে বাচ্চাদের জীবনটা জটিল না করি। আমি ক্ষমা চাইছি। আপনারা চাইলে কাবিনের টাকার পরিমাণ কমিয়ে দেব। এখনো রেজিস্ট্রি হয়নি। এত টাকা কাবিন রাখবো না।”
৩.
গুটিগুটি পায়ে শোয়া থেকে উঠে এসেছেন মিসেস জেসমিন, এসব আলোচনার বাইরে রুমে অসুখের ভান করে আর শুয়ে থাকতে পারছিলেন না।
“আরে বেয়াইন সাহেবা যে। আসসালামু আলাইকুম। এখন শরীর কেমন আপনার।”
“আমার শরীরের কথা বাদ দেন। আপনারা নিজের চিন্তা করেন। আপনাদের নামে আমি মামলা করবো। আদালতে যাব।”
“এসব কী বলেন আপা! মামলা কেন করবেন। দেখেন যা হয়েছে সব ভুল বোঝাবুঝি। আমরা এসব ভুলে নতুন করে শুরু করি। ছেলেমেয়েদের জীবন কেন নষ্ট করবো বলেন।”
“নষ্ট তো করেছেনই। নিজের চরিত্রহীন মেয়ে আমার ছেলের কাঁধে ঝুলিয়ে দিয়েছেন। ভাবছেন আমরা জানতে পারব না, এসব জিনিস চাপা থাকে?”
“আপা এসব বেশিরভাগ মানুষের বানেয়াট কথা। হ্যাঁ স্বীকার যাই, অল্প বয়সের আবেগে একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক হয়েছিল, তবে তা শেষ, সেখানে গভীর কিছু ছিল না। সোহানা মন দিয়েই সংসার করবে।”
“কিসের গভীর ছিল না, আর কত গভীর হবে, একসাথে থাকতো, ঘুরতো, বিদেশেও নাকি যাওয়ার কথা ছিল। আল্লাহই জানে পেটে কোন পাপ আছে কি না।”
মিসেস জেসমিনের কথায় আহসান সাহেবের গা গুলিয়ে আসে, যতই হোক কেন কোন পিতার পক্ষে মেয়ের নামে এসব কথা শোনার বা সহ্য করার ক্ষমতা নেই।
এক কথায় দুই কথায় বসার ঘর উতপ্ত হয়ে যায়। সোহানার পরিবারও ছেড়ে দেওয়ার মতো নয়। তারা মেয়ের সংসারের নিশ্চয়তা চান, এভাবে ডিভোর্স নিতে দিবেন না, আর না হলে কাবিনের পনের লাখ টাকা নগদ শোধ করতে হবে।
“কিসের কাবিনের টাকা, যতসব জোচ্চুরি। আমরা এই বিয়ে স্বীকারই করি না। তাছাড়া রাকিব আর সোহানার কোন শারীরিক সম্পর্ক হয়নি।”
এতক্ষণে মুখ খোলেন সেহানার চাচী এবং রাকিবের ফুপু আলেয়া,
“কী বলেন ভাবি, অবশ্যই সম্পর্ক হয়েছে। বিয়ের পরদিন সকালে উঠে সোহানা গোসল করলো, একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েও হেঁটেছে। এসব কী আমরা না বুঝি? রাকিব মিথ্যা বলছে। ”
“আচ্ছা সকালে গোসল করলেই হলো? আর পায়ে হয়তো মেয়ের খুঁত আছে, তাই খুড়িয়ে হাঁটে।”
“সোহানার পায়ে কোন সমস্যা নেই আপা। এই আলেয়া তুমি এখনি সোহানাকে ফোন দেও সবার সামনে। ওকে জিজ্ঞেস করো।”
সোহানার কাছে চাচীর ফোন আসতেই, সোহানার আগে তার আম্মা আগে আগে রিসিভ করে ফেলেন।
“হ্যালো আলেয়া, কী অবস্থা ওখানে?”
“পরে বলছি ভাবি, আপনি সোহানাকে দেন।”
সোহানার আম্মা ফোন লাউড স্পিকারে দিয়ে দেন।
“হ্যালো চাচী, বলো।”
“সোহানা তোর আর রাকিবের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হয় নাই? সত্যি করে বল।”
“এসব কী প্রশ্ন করো চাচী।”
“দরকার আছে, তুই বল। রাকিব তো অস্বীকার করতেছে। তোর সাথে নাকি ওর কোন শারীরিক সম্পর্ক হয়নি।”
অপমান আর লজ্জায় সোহানার গায়ে কাঁটা দেয়। যতবার সুযোগ পেয়েছে রাকিব ওর ইচ্ছে অনিচ্ছের তোয়াক্কা না করেই সম্পর্ক করেছে, আর এখন অস্বীকার করছে। একবার মনে হলো না করে দেয়, যে হ্যাঁ সম্পর্ক হয়নি। কিন্তু পারে না। কোন প্রটেকশন ছাড়াই হঠাৎ বিয়েতে রাকিব ওর কাছে এসেছে, এখন নিজের শরীরেই অন্য রকম এক পরিবর্তন টের পাচ্ছে সোহানা, যদিও এত তাড়াতাড়ি কিছু বোঝা যাবে না, আরও কিছুদিন গেলে টেস্ট করবে।
“চাচী তিনি যদি অস্বীকার করেন, কিছু বলার নেই। তবে আমাদের মাঝে একবার না কয়েকবার সম্পর্ক হয়েছে। ”
ফোন টা কেটে দিয়েই কান্নায় ভেঙে পড়ে সোহানা। মেয়ের কেঁপে কেঁপে ওঠা পিঠে হাত বুলিয়ে নিঃশব্দে কাঁদেন সোহানার আম্মাও। ওনাদের হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলাফলই যেন আজ সোহানার এই কান্নার কারণ।
(চলবে)