#ধারাবাহিকগল্প_পর্ব_৮
#বিয়ে_নামক_ছেলেখেলা
১.
মেহমানরা প্রায় সবাই চলে গিয়েছে। এমনিতেও খুব বেশি মানুষকে বলা হয়নি, একান্ত কাছের মানুষদেরই ডেকেছিল রাকিবের পরিবার। এই মুহূর্তে সোহানার সামনে রাকিবের পরিবার ছাড়া বাইরের মানুষ বলতে বাসায় আছেন রাকিবের মামা মামী। সোহানা ফ্রেশ হয়ে হালকা সুতি শাড়ি পরেছে, নতুন বৌ বলে হালকা গয়নাও পরেছে। গোসল করে ফ্রেশ হওয়ায় আগের চেয়ে শরীর অনেকটা ঝরঝরে লাগছে। এমনটা আগে কখনো হয়নি সোহানার, এত শরীর খারাপ তখন লাগছিল গাড়ির ভেতর। সম্ভবত মানসিক অবসাদ, রাতের পর রাত ঘুম কম হওয়া, তার উপর খাওয়ার অনিয়মের মাঝে কাল হঠাৎ করে বিয়ের রিচ ফুড খাওয়া, এসবই হয়তো কারণ ছিল ভাবে ও। এখন একটু রেস্ট নিতে পারলে ভালো লাগতো, বিছানায় এলিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে, কিন্তু রাকিবের আম্মু জেসমিন সুলতানা সোহানাকে ড্রয়িং রুমে নিয়ে এসেছেন।
“সোহানা তোমার শরীর কি আসলে খারাপ? না অন্য কোন কারণ আছে বলোতো? এভাবে পথে বমি-টমি করে অস্থির হলে?”
হঠাৎ করে মামী শাশুড়ির প্রশ্ন বুঝতে পারে না সোহানা।
“জ্বি মামী? এখন শরীর ভালো আছে। তখন ভারী শাড়ি গয়না, গরম সব মিলে শরীর খারাপ লাগছিল। ”
এবার জেসমিন সুলতানা নিজেই মুখ খুলেন,
“সোহানা সত্যি করে বলোতো তুমি কি প্রেগন্যান্ট? যদি প্রেগন্যান্ট হও তাহলে আর যাই হোক রাকিবের কথা বলো না। একদিন ছিল রাকিব তোমাদের বাড়িতে, পুরো দেড়মাসে ঐ একদিনই ও তোমাদের বাড়ি ছিল, আর এতেই তুমি প্রেগন্যান্ট হয়ে গেলে?”
জেসমিন সুলতানার কথায় হতভম্ব হয়ে গেল সোহানা, প্রেগন্যান্সির সম্ভবনা যে তার মাথায় আসেনি তা নয়, কিন্তু বাড়িতে টেস্ট করার সুযোগ পায়নি। তাছাড়া টেনশনে বিয়ের পর মাঝে মাঝে পিরিয়ড সাইকেলে পরিবর্তন হতে পারে, কিছুদিন লেট মানেই যে প্রেগন্যান্ট, তা নয়। এজন্য একটু আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করে টেস্ট করবে ভেবেছিল। কিন্তু এখন রাকিবের আম্মুর উত্তর তো দিতেই হবে। তাছাড়া প্রেগন্যান্ট হলে রাকিবের কথা না বললে কার কথা বলবে সোহানা!!!
কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে সোহানা, ভাবে জেসমিন সুলতানাকে কী বলে ডাকবে! আম্মু বলতে ইচ্ছে করছে না, আন্টি ডাকাটা শোভনীয় না।
“আন্টি, মানে আম্মু আপনি কী বলছেন এসব। আমি জানি না প্রেগন্যান্ট কিনা, টেস্ট করানো হয়নি। আর হলেও রাকিব ছাড়া আর কার কথা বলবো! ব্যাপারটা তো একদিন দুইদিন সাথে থাকার না, অনেক অনেক দম্পতির বছরের পর বছর একসাথে থেকেও কনসিভ হয় না। এটা তো সায়েন্টিফিক ব্যাপার।”
“সোহানা এসব সায়েন্সের ব্যাপারের বুঝ আমাকে দিতে এসো না। সায়েন্স আর্টস কমার্সের কথা ছাড়। প্রেগন্যান্সির টেস্ট না করলে কাল সকালে প্রেগন্যান্সি টেস্ট কীট দিয়ে করবে। পজেটিভ আসলে তোমার ফ্যামিলির সাথে ফাইনাল কথাবার্তা হবে। এত বড় চিটারি আমাদের সাথে, এইজন্য রাকিবকে একদিন বাসায় জোর করে রেখে দিয়েছে ওনারা তাই না!!! যেন রাকিবের উপর চাপানো যায়।”
সোহানার কানে যেন গরম সিসা ঢালছে কেউ। ওর মনে হচ্ছে, ‘আল্লাহ কী অপরাধে এত অপমান কপালে রেখেছেন।’ রাকিবের দিকে তাকায় সোহানা, আর সবার মতো রাকিবের চোখেও সন্দেহ আর দ্বিধা। অবশ্য এই কয়দিনে সোহানা বুঝে নিয়েছে রাকিবের কাছে আশা করা বৃথা। নিজের জন্য নিজেকেই লড়তে হবে।
“আমি সত্যি জানি না আমি প্রেগন্যান্ট কিনা, তবে যদি হয়েও থাকি, রাকিব ছাড়া অন্য কারো কথা আমি বলতে পারব না। কারণ অন্য কারো সাথেই আমার শারীরিক সম্পর্ক হয়নি।”
সোজা হয়ে বসে চোখে চোখ রেখেই উত্তর দেয় সোহানা। সোহানার দৃঢ়তায় রাকিবেরও মনে হয় হয়তো সোহানা ঠিক বলছে। বিষয়টা তো আসলেই একদিন দুইদিনের ব্যাপার নয়, উর্বর সময়ে কোন প্রটেকশন ছাড়া সঙ্গমে যখন শুক্রাণু ডিম্বানু নিষিক্ত হবে তখনই সন্তান আসবে। এটা একদিনের একবারের শারীরিক সম্পর্কেও কারও হতে পারে, কারও বছরের পর বছরও হয় না দৃশ্যত বড় কোন সমস্যা না থাকলেও। আচ্ছা তারপরও সন্দেহ যেহেতু আছে, সেক্ষেত্রে সোহানা প্রেগন্যান্ট হলে এবোরেশন করে নিলেই হবে, এত তাড়াতাড়ি বাবা হওয়ার ইচ্ছে এমনিও নেই। বিবাহিত জীবনই এখনো উপভোগ করা হলো না, তবো এখন কিছু বলবে না,ঠিক করে, কাল সোহানা টেস্ট করুক, মায়ের মাথা ঠান্ডা হোক, এরপর আস্তে ধীরে বলবে। ফিরিয়ে দিবে বললেও তো হয় না, সাত লাখ টাকা কাবিনও কী কম নাকি। সবার মাঝে বসে এমন নানা ভাবনা খেলা করে রাকিবের মাথায়।
সোহানা অবশ্য ভাবছে অন্য কথা, নিজেকে সেই ফুটন্ত পানির ব্যাঙের গল্পের মতো মনে হচ্ছে, যে ব্যাঙ শুরুতেই গরম পানি থেকে লাফ দিয়ে বাঁচার চেষ্টা না করে নিজের অভিযোজন ক্ষমতার ব্যবহার করতে শুরু করে, পানির তাপমাত্রা যত বাড়ে, তত নিজের শরীরে পরিবর্তন আনে, এক সময় পানি ফোটার সময় হলে লাফ দেওয়ার কথা চিন্তা করে, কিন্তু ততক্ষণে শরীরের সমস্ত শক্তি শেষ হয়ে যায়, আর লাফিয়ে পড়া হয় না, ফুটন্ত পানিতেই মৃত্যু হয়। সোহানার এখন লাফ দেওয়ার সময়, আর সহ্য করলে সম্পর্কের এই বদ্ধ চোরাগলিতেই তার মনের মৃত্যু হবে।
“আন্টি (এবার আর আম্মু বের হয় না মুখ দিয়ে) রাকিবের যদি নিজের পুরুষত্ব নিয়ে সন্দেহ থাকে, তবে কিছু বলার নেই। তবে ডিএনএ টেস্ট বলে একটা বিষয় আছেন জানেন তো? আচ্ছা আপনারা তো আপনাদের সিদ্ধান্ত জানালেন। তবে আমি আমার সিদ্ধান্ত কাল জানাব, আগে রেজাল্ট আসুক টেস্ট করে।”
কিছুক্ষণের জন্য ড্রয়িং রুমে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। সোহানা নিজেই আবার কথা বলে,
“আমাকে একটা আলাদা জায়গায় শোওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। আগে সব সমাধান হোক।”
“হ্যাঁ সেই ভালো। তুমি রাকিবের রুমেই ঘুমাও। রাকিব সাকিবের সাথে ঘুমাবে।”
জেসমিন সুলতানা যেন খুশিই হোন সোহানার কথায়। কিন্তু রাকিব মনে মনে ভীষণ বিরক্ত হয়, যদিও বরাবরের মতো সে কিছুই বলে না সবার সামনে।
২.
চুপচাপ রুমে ঢুকে দরজা লক করে দেয় সোহানা। গত দুই মাসে অনেক কেঁদেছে। নিজের পরিবারের অন্যায় আচরণ, রাকিবের পরিবারের তুচ্ছতাচ্ছিল্য সব সহ্য করেছে, আসলে কী এর কোন দরকার ছিল! আরও আগেই যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন ছিল, একটু দেরিতে হলেও তা নিতে হবে। আজ আর কাঁদবে না।
ল্যাগেজ থেকে বিয়েতে রাকিবের পরিবার থেকে পাওয়া শাড়ি, গয়না বের করে খাটের একপাশে রাখে। সাথে করে সকল কাগজপত্র নিয়ে এসেছিল, ইচ্ছে ছিল এখানে সব গুছানো হলে ফাইনাল ইয়ারের প্রস্তুতি নেবে। ফোনটা হাতে নিয়ে রুমমেট মিতুর নাম্বারে ফোন দেয় সোহানা।
৩.
রাত প্রায় একটা, ঠকঠক করে আস্তে আস্তে দরজায় নক হচ্ছে। এত রাতে কে এলো রুমে! একটু ভয়ই পায়। এত চিন্তার ভেতরও ক্লান্তিতে ঘুম নেমে এসেছিল চোখে। অনেকক্ষণ ধরে থেমে থেমে আসা এই শব্দে ঘুম ভেঙে যায়।
“কে? কে নক করে?”
“আমি, রাকিব। দরজা খুলে দেও।”
হঠাৎ প্রচন্ড রাগে সোহানার শরীর পুড়তে থাকে। এতরাতে চোরের মতো রাকিব বৌয়ের দরজায় নক কেন করছে বুঝতে পারছে সোহানা। ইচ্ছে করছে দরজা খুলে লোকটাকে জুতোপেটা করতে। কিন্তু লাভ নেই, সবাই উঠে ওকেই কথা শুনাবে। আর রাকিবের মতো কাপুরুষের বিশ্বাস নেই, হয়তো বলে বসবে সোহানাই ওকে ডেকে পাঠিয়েছে।
“রাকিব, এত রাতে কী চান? কিছু লাগলে সকালে রুমে এসে নিয়েন।”
“সোহানা দরজা খুলো প্লিজ। সবাই ঘুমাচ্ছে। ”
“সবাই ঘুমাচ্ছে দেখেই সকালে আসতে বললাম। যান এখন।”
রাগ আর অস্থিরতায় রাকিবের ভীষণ জিদ ওঠে। কিন্তু জোরে শব্দ করতে পারে না। কারও ঘুম ভেঙে গেলে কী জবাব দেবে। ভেবেছিল সবাই ঘুমিয়ে গেলে সোহানার কাছে এসে একটু স্বামীর আবদার ফলাবে, কাল যদি সোহানাকে মা পাঠিয়ে দেয়, তবে আজই শেষ সুযোগ ছিল। বাচ্চা পেটে হলে সেটা রাকিবের কিনা এটা রাকিবও নিশ্চিত নয়, একদিনের সম্পর্কে বললেই কী প্রেগন্যান্ট হয়! কিন্তু নারীদেহের লোভও আটকাতে পারছিল না। এখন সোহানা যে রুমেই ঢুকতে দেবে না, এটা রাকিব চিন্তাই করেনি। সাত লাখ টাকা কাবিনের বিনিময়ে মাত্র একটা রাত সাথে থাকা হলো!
“ঠিক আছে আমি যাচ্ছি। সকালেই কথা হবে। এসেছিলাম তোমার ভালোর জন্যই, আম্মুকে ম্যানেজ করার একটা পথ খুঁজতাম। তুমি প্রেগন্যান্ট হলে এবোরেশন করে নতুন করে শুরু করার কথা ভাবতাম। কিন্তু তুমি তো মনে হচ্ছে সেসব কিছুই চাও না।”
রাকিবের কথার উত্তর না দিয়েই চুপচাপ খাটে শুয়ে পড়ে সোহানা। শুষ্ক চোখজোড়া ভিজে উঠে জলে।
(চলবে)