বিরহে_মরণ পর্ব-০৩

0
621

#বিরহে_মরণ
পর্ব-০৩

৫.

কেসটার রায় যে এত দ্রুত হবে শান্ত তা আশাও করেনি। এই কয়েকটা সপ্তাহ পুরো দৌড়ের উপর ছিল সে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে শয়তানটার ফাঁসির রায় হয়েছে তাতেই সে অনেক খুশি। তবে নিজে দোষ স্বীকার করে নেয়ায় অনেক সুবিধা হয়েছে। দেশের বাইরে যেতে দেবে না বলেই মনমালিন্য আর সেখান থেকেই কলহ। ঘুমের মধ্যে বালিশ চাপা দিয়ে মেরে পরে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছে।

তার ডিউটির টাইম শেষের দিকে। অনেকদিন ঢাকার রাস্তাগুলোয় ঘুরে বেড়ানো হয় না। আচ্ছা রাত্রির ইউনিভার্সিটিতে গেলে কেমন হয়। চমকে দেয়া যাবে। সেদিনের পর আর নিশিতার খোঁজও নেয়া হয়নি। কিন্তু রাত্রি যদি বাসায় থাকে? আগে বাসায় ফেরা যাক।

বাসায় এসে গোসল করে একে বারে রেডি হয়ে মায়ের ঘরে এসে বসল শান্ত।
-কিরে কিছু বলবি?
-মা রাত্রি আসে নি?
-না বাবা। দেরি হবে বলেছিল।
-কেন?
-কোথায় নাকি ট্যুর আছে।
-আচ্ছা আমি দেখছি।

প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে এখানে দাড়িয়ে আছে শান্ত। রাত্রিকে ফোন করেছিল। বলেছে আর পনেরো মিনিটের মত লাগবে। কারো জন্য অপেক্ষা করা যে এতটা কষ্টের কে জানতো? এই বয়সে এসে যে তার অনুভূতিগুলো টিনএজদের মত হবে সেটাই বা সে বুঝবে কি করে? বাস থেকে নেমেই রাত্রি তার ভাইয়ের কাছে ছুটে আসে।

-আজ কোন দিকে সূর্য উঠেছে ভাইয়া?
-কেন বলতো?
-আমাকে নিতে চলে এলি যে?
-মা বলল তোর দেরি হবে। আর আমিও তো বাসায় ছিলাম।
-ওহ্, তাই বুঝি। কিন্তু যাকে খুঁজছিস সে তো আজ আসেনি।
-কেন? কিছু হয়েছে?
-হি হি হি। ধরা পড়ে গেলে তো? ওর বাবা যেতে দেয়নি। তুমি কি ফোন করেছিলে ওকে?
– না তো।
-সেদিনের পর থেকে কেমন যেন হয়ে গেছে। কারো সাথে তেমন কথা বলে না। ক্লাস শেষ করেই চলে যায়। এত করে বলার পরও আজ এল না।
-চল ফেরা যাক।
-চল।

মানুষের পরিবর্তণ কি এত দ্রুত হয় নাকি? তার ভাই তো এমন ছিল না। সবসময় ধীর স্হির একাগ্র ছিল। আজ কেমন যেন অস্থির। এর জন্য কি সেই দায়ী। সে তো ভেবেছিল নিশিতা তার ভাইয়ের জন্য পারফেক্ট ম্যাচ। এই কারণেই ইচ্ছা করে ইউনিভার্সিটির কাজগুলো বাসায় করত। কথায় কথায় ভাইয়াকে ডেকে আনতো। যাতে ভাইয়ার সাথে ওর পরিচয় হয়। কিন্তু সে যা ভেবেছিল তা মনে হয় ভুল ছিল। কে জানতো সামাজিক ব্যাবধানগুলো এত বিশাল হয়ে পথ আগলে দাড়ায়।
-কি রে চুপ কেন। অন্য সময় তো কথার খই ফোটে।
-মাথা ব্যাথা করছে।
-সারাদিন ধেই ধেই করে বেড়ালে মাথা তো ধরবেই।

বাবার বেঁধে দেয়া বিধি নিষেধের চাপে নিশিতার দমবন্ধ হয়ে আসে। ক্লাস শেষ হলেই বাসায় ফিরতে হয়। কোথাও যাওয়া পর্যন্ত বন্ধ। কারও সাথে কথা বলতেও ইচ্ছা করে না আজকাল। মাঝে মাঝে মনে হয় ছাদে উঠে লাফিয়ে পড়ে। সে কি পাগল হয়ে হয়ে যাচ্ছে? আজ নিশ্চই সবাই খুব মজা করছে। রাত্রি তাকে কত করে বলল যাবার জন্য। কিন্তু বাবাকে কিছুতেই রাজি করানো গেল না। মেয়ে হয়ে জন্মানোটাই যেন বিশাল বড় অপরাধ।

-“আজ তোর ইউনিভার্সিটি গিয়েছিলাম। তোকে পেলাম না। কেমন আছিস তুই?”

ম্যাসেজটা দেখলো নিশিতা। সেদিনের পর আর কথা হয়নি লোকটার সাথে। তবে খবর আর খবরের কাগজে কেসটার আপডেট দেখেছে। এতদিন পরে আবার কি মনে করে আজ হঠাৎ? কি বলবে সে। কি বা বলার আছে? যদি থাকেও অল্প কিছু দুর্বলতা সেটা কেটে যাওয়াই ভাল। কিছু লিখবে না লিখবে না করেও লিখে,

-“ভাল।”
-“আমি কেমন আছি জানতে চাইলি না?”
-“ভাল আছেন নিশ্চই।”
-“দেখা করতে পারবি?”
-“না।”
-“একবারের জন্য প্লিজ।”
-“না।”

না কথাটা লিখতে এত কষ্ট ? সে কি তবে এই লোকটাকে ভালবাসে? কই কখনও তার জন্য তেমন কিছু মনে হয়নি। তবে আজ কেন এমন লাগছে। লোকটা নিজে থেকে দেখা করতে চেয়েছে বলে? না সে কিছুতেই আর যোগাযোগ করবে না।

ছাদে আসে শান্ত। চারিদিকে এত আলো যে রাতের অন্ধকারও ফিকে। একটার পর একটা সিগারেট পুড়তে থাকে। সব বাদ দিয়ে দূরে কোথাও চলে গেলে কেমন হয়। এই শহর ছেড়ে তো পালানো যায় কিন্তু নিজের কাছ থেকে পালাবে কি করে? একজনের অনুপস্থিতি, উপেক্ষা কি আসলেই জীবনের মানে বদলে দিতে পারে? কবিতাটা মাথায় আসতেই সে আবৃতি করে….

তোমায় ছাড়া পৃথিবী বর্ণহীন,
আলো ঝলমলে দিনগুলি পানশে লাগে…
মনের আকাশে মেঘ জমে যায়।
তোমায় ছাড়া সব অসম্পূর্ণ,
মন বসে না কোন কাজে…
সময় থেমে যায়।
তোমায় ছাড়া প্রকৃতি কুয়াশার চাদর জড়ানো,
আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে অলসতা …
আলো নিভে যায়।
তোমায় ছাড়া জীবন বিস্বাদ,
স্বপ্নগুলো ভয়ঙ্কর হতে থাকে…
জীবন প্রদীপ নিভে আসে,
অন্ধকারে ঢেকে যায়।
তোমায় ছাড়া মরণও স্হবির,
শ্বাস চলতে থাকে…
নিভুনিভু জীবন প্রদীপ…
দমকা বাতাসের অপেক্ষায় থেকে যায়।

৬.

এই চাকরিটা আর আজকাল শান্তর ভাল লাগে না। তবুও সে করতে চায়। যদি কিছু মানুষকে ন্যায় বিচার পাইয়ে দেয়া যায়। ইচ্ছা থাকলেও অনেক কিছুই করা যায় না। আইনের ফাঁক ফোকর, পলিটিকাল পাওয়ার আর টাকার জোরে অনেকেই বেরিয়ে যায়। ডিউটির সময়টুকু যে সে কিভাবে পার করে। বদলির জন্য চেষ্টাও করেছে যদি ঢাকার বাইরে গেলে একটু ভাল লাগে । কিন্তু সেটাও হচ্ছে না।

আজকাল বেশিরভাগ সময় নাইট ডিউটি করে সে। রাতের ঢাকা অনেকটা স্বস্তি দেয়। বিকেলে বাহির হবে এমন সময় মা ডেকে পাঠালেন।
-কিছু বলবে মা? আমার এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে।
-এখানে এসে বস। তোকে তো আজকাল পাওয়াই যায় না।
-বল কি বলবে?
-ভেবেছিলাম রাত্রির পড়া শেষ হলে ওকে বিয়ে দিয়ে তারপর তোর বিয়ে দেব।
-রাত্রির তো পড়া শেষের দিকে মা। আর একটা সেমিস্টার। এখন থেকে ছেলে দেখা শুরু কর। তার আগে জেনে নিও ওর কোন পছন্দ আছে নাকি?
-সেটা তুই জেনে নে। অনেক তো করলাম। এক হাতে তোদের দেখা শোনা।
-ঠিক আছে মা। কিছু লাগলে কি?
-কিছু লাগবে না। কিন্ত বাবা আমার তো আজকাল তোকে নিয়ে অনেক চিন্তা হয়। রাতের পর রাত ডিউটি করছিস। দিনে হয় ঘুমিয়ে থাকিস আর তা না হলে বাউন্ডুলের মত ঘুরিস। কি হয়েছে বল আমাকে? তুই তো আমার এমন ছেলে ছিলি না কখনই?
-চাকরিটা করতে ভাল লাগছে না মা।
-তাহলে ছেড়ে দে। তোর বাবার বিজনেস দেখার জন্য তো চাচারা কবে থেকে বলছে। আর আমারও এইসব পুলিশের চাকরী করা পছন্দ না। তুই তখন জেদ করলি বলেই করতে দিলাম।
-ওরে বাবা ওই ঝামেলার বিজনেস আমি দেখতে পারবো না। সারাদিন কে ঘুরবে তোমার ওই গারমেন্টস আর ওয়ার্কার দের পেছনে।
-এখনই বা কি করছিস? চোর ডাকাতের পিছে পিছে ঘুরছিস।
-এখন যাই মা। পরে কথা বলবো। সময় নেই একেবারে।

থানায় এসে নিজের চেয়ারে বসেই টেবিলে রাখা নতুন কেস ফাইলটা টেনে নিল সে। মানুষ যে কত রকম হয়। পরকিয়ার কারণে নিজের বাচ্চাকে মেরে ফেলেছে। পরে লাশ সরাতে গিয়ে ধরা পড়েছে। পঁচে যাওয়া একটা সমাজ। জানোয়ারেরাও এর থেকে ভাল।
-স্যার বড় স্যার আপনাকে ডাকে।
-স্যার এই সময়?
-আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন ।

ফাইলটা বন্ধ করে সে উঠে আসে। এমন কি হল?
-স্যার আসবো?
-আসো। বদলির জন্য চেষ্টা করছ বোধহয়।
-জ্বি স্যার।
-তোমাকে কিছু কথা বলি কিছু মনে করো না। নিজের ভাইয়ের মত মনে করি বলেই বলছি। সবাই যেখানে ঢাকায় থাকতে চায় সেখানে তুমি বাইরে যেতে চাইছো কি কারণে জানি না। তবে না গেলেই মনে হয় ভাল করবে। আর ওই সব এলাকাকে অনেক নিরিবিলি মনে হলেও ওদের অপরাধগুলো অন্যরকম। সেখানে তো অনেক সময় পুলিশই অপরাধের সাথে যুক্ত থাকে। কক্সবাজারের কেসটা তো দেখলে। সেখানে পুলিশেরাই সবচেয়ে বড় অপরাধী। তুমি একজন সৎ আর সাহসী ছেলে। ওইদিকে গেলে হয় মারা পড়বে নয়ত আরও অবসাদগ্রস্থ হবে। তুমি ভেবে দেখ বিষয়টা। আর তোমার মা আর বোনের কথাও মাথায় রেখ।

-আসলে স্যার এত কিছু ভেবে দেখি নি।
-ভাবো, সময় আছে এখনও। আমাকে জানিও। আর কিছুদিনের ছুটি নিয়ে ঘুরে আস রাঙ্গামাটি অথবা বান্দরবন। ওসব জায়গায় ঘুরতেই ভাল লাগে। থাকতে নয়।
-আমাকে কয়েকদিন সময় দিন স্যার।
-আচ্ছা যাও।

নিজের চেয়ারে এসে ধপ করে বসে পড়ে। আসলেই সে এত কিছু ভেবে দেখেনি। তার কিছু হলে মা আর রাত্রির কে দেখবে? মনের টিকটিকিটা তখনই টিকটিক করে বলে আর নিশিতার কি হবে? আসলেই কদিন ছুটি নেয়া উচিত ।

কয়েকজন বন্ধু রাজি হয়ে গেল তার সাথে যেতে। ভালই হয়েছে সবাই মিলে অনেকদিন পর বেশ মজা করা যাবে। ক্যাম্পিং এর জিনিসপত্র ষ্টোর রুমে খুঁজে পেলেও শান্ত দেখলো বেশিরভাগই পুরোনো হয়ে গেছে। নতুন করে কিনতে হল সব। সব গুছিয়ে সে মোটামুটি রেডি। টিকেটও কাটা হয়ে গেছে। পুরো সাত দিনের ট্যুর। ড্রাইভারকে জিনিসপত্র তুলতে বলে সে খাবার ঘরের দিকে এল। মনোয়ারা রান্নাঘর ছেলের জন্য খাবার প্যাক করছিলেন।
-মা আমি বাহির হব।
রাত্রি বেরিয়ে এল তার ঘর থেকে।
-ভাইয়া আমাকে নিয়ে গেলেও পারতে?
-তুই যাবি? একঘন্টার ইন্টারনেট না থাকলেই প্যানপ্যান শুরু হয়। আমরা যেখানে যাব সেখানে তো ফোনের নেটওয়ার্ক নেই।
-তাহলে যোগাযোগ করব কি করে?
-রিসোর্টে আসব যখন তখন ফোন করবো।
বিশাল এক ব্যাগ নিয়ে মাকে আসতে দেখে শান্ত হেসে ফেলল।
-এত কি দিয়েছ?
-সবাই মিলে খাবি।
-তুমি যে কি কর না মা।
মনোয়ারা শান্তর মাথায় হাত রেখে দোয়া পড়ে ফু দিয়ে দিলেন।
-সাবধানে থাকিস।
বলেই কান্না শুরু করলেন। সাথে রাত্রিও কাঁদতে লাগলো।
-তোমরা কি শুরু করলে। যেতে দেবে না নাকি।

দুজনেই শান্তর সাথে বাড়ির বাইরে পর্যন্ত এল।

চলবে……

এমি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here