বিরহে_মরণ পর্ব-০৪

0
619

#বিরহে_মরণ
পর্ব-০৪

৭.

নিয়াজ সাহেব আজ সকাল সকাল অনেক বাজার নিয়ে বাসায় ফিরলেন। নাসিমা খুব অবাক হলেও কোনো কিছু জিজ্ঞেস না করে কাজের মেয়েটাকে নিয়ে বাজার গুছাতে আরম্ভ করলেন। কিছু জিজ্ঞেস করলেই কুরুক্ষেত্র হয়ে যাবে।
খাবার ঘরের চেয়ারে নিয়াজ সাহেবকে বসতে দেখে নাসিমা হাত ধুয়ে খাবার ঘরে এসে দাঁড়ালেন।
-কিছু লাগবে আপনার? চা দিব?
-চা লাগবে না। তুমি বরং হাত চালিয়ে রান্না করে ফেল। মুরগির রোস্ট, খাসির রেজালা, গরুর মাংস ভুনা, সরসে ইলিশ, চিংড়ির মালাইকারী আর সবজি করবে। দই মিষ্টি আমি আনবো। আর পায়েস রান্না করে ফেল।
—এত কিছু? কেউ কি আসবে?
-ওহ তোমাকে বলা হয়নি। আমাদের অফিসের হুমায়ুন সাহেব আর তার পরিবার। উনার ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। দেশে এসেছে বিয়ে করবে বলে। আমার কাছে নিশিতার ছবি দেখেছিল। তো তারা আজ পাকা দেখা দেখতে চায়। আর ছেলে মেয়ের দুজনকে পছন্দ হলে বিয়ে রেজিস্ট্রি করে ফেলবো ইনশাআল্লাহ। আমি জুম্মার নামাযের পর আসতে বলেছি।
-কি বলছেন আপনি? একবার আমাকে জানালেন না? মেয়েটার মতও তো জানতে হবে। আজকালকার বাচ্চা কাচ্চারা নিজের পছন্দ ছাড়া বিয়ে করে নাকি?
-তোমাকে জানাতে হবে কেন? আমি যা বলবো তাই হবে। মেয়ের মত আবার কি? আর নিজের পছন্দ থাকলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বল।
-সব কিছুতে এমন করলে হয়?
-আমি কিছু শুনতে চাই না । আর একটা কথা মেয়েকে ভালো করে সাজাতে বলবে।

নাসিমা কাজের মেয়েটাকে মাছ কাটতে বলে নিশিতার ঘরে এল। মেয়েটাকে আজকাল মরা মাছের মতই লাগে তার। কোন সাড়া শব্দ করে না। ছুটি বলে এখনও বিছানায় শুয়ে ।

-কি রে উঠবি না?
-কেন কি হয়েছে? এখন তো আর ইউনিভার্সিটি নেই।
-আচ্ছা তাহলে আর একটু ঘুমিয়ে নে।
-কিছু বলবে?
নাজমা মশারির খুলে একপাশে রাখলেন। নিশিতার পাশে বসলেন।
-তোর কি কেউ পছন্দের আছে?
-সকাল সকাল এই প্রশ্ন কেন মা?
-তোকে আজ তোর বাবার কলিগের ছেলে দেখতে আসবে।
নিশিতা উঠে বসল।
-কি বলছো এসব? আমাকে একবার জিজ্ঞেসও করলে না? তুমি তো আগে জানাতে পারতে?
-আমি কি জানতাম নাকি? এক কাজ কর পছন্দের কেউ থাকলে পালিয়ে যা।
-মা তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
-আচ্ছা ওই যে তোর বান্ধবীর ভাই আছে না একটা। ওকে তো ভাল ছেলেই মনে হয়। বেশ দায়িত্ববান।
-মা এভাবে কোনো কিছু হয় না। সব কিছুর একটা নিয়ন আছে।
-আচ্ছা কি করবি চিন্তা করে আমাকে জানাস। আসলে সময় বড় কম।

নিশিতা ঝিম মেরে বসে থাকে কিছুক্ষন। এখন কি করবে? শান্ত কে কি ফোন করবে? কিন্তু তার সাথে তো সে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছিল। তারপর তো আর যোগাযোগও করেনি। টেবিলের উপর থেকে ফোনটা টেনে নেয়। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে নাম্বারটা বন্ধ। রাত্রিকে ফোন করে। নাহ সেও ফোন ধরছে না। ঘড়ির দিকে তাকায় কেবল নয়টা বাজে। মহারানী নিশ্চই ঘুমাচ্ছে।

রাগে দুঃখে কান্না চলে আসে। তার নিজের সমস্যা নিজেকেই সমাধান করতে হবে। বাবার সামনে গিয়ে দাড়ায়।
-বাবা আপনাকে কিছু বলার ছিল?
-বল।
-আমি এখন বিয়ে করতে পারবো না।
-তা কি করতে পারবে শুনি?
-রেজাল্ট হলেই চাকরী খুঁজবো।
-চাকরী কি ছেলের হাতের মোয়া? বেশি কথা বলবে না। বেশি বেশি করবে তো তোমাকে আর তোমার মাকে ঘাড় ধরে বের করে দেব। রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে। আছ তো সুখে।
-এইটাকে আপনি সুখ বলেন?
-নাসিমা এদিকে আস। এই মেয়েকে আমার সামনে থেকে নিয় যাও। বড় বড় কথা বলা শিখেছে। বাড়ি থেকে এক পাও বাহির হবে না। আজকেই আমি এই আপদ দূর করবো।
নাজমা দৌড়ে এসে নিশিতাকে তার ঘরে নিয়ে এলেন।
-কি দরকার ছিল বাবাকে রাগানোর?
-তোমার জন্যই এইসব হয় মা। তুমি যদি মুখ ফুটে কিছু বলতে তাহলে এই লোকটা এমন করতে পারতো না আমার সাথে।
-এখন সব আমার দোষ? সমাজের কথা, পরিবারের কথা চিন্তা করি বলেই সহ্য করি। নিজের সংসার হলে বুঝবি?
-আমার আর বুঝে কাজ নেই। আমি কিন্তু কিছুতেই এই বিয়ে করবো না।
-তুই তো বললি তোর কাউকে তেমন পছন্দ নেই। তাহলে ছেলেটাকে দেখ। তোর বাবার পরিচিত বলেই তো আর তোর বাবার মত নয়।
-তুমি তে পুরো উল্টো কথা বলছো। একটু আগেই তো অন্য কথা বলছিলে।
-তোর যা ভাল মনে হয় কর। আমি যাই রান্নার ব্যবস্থা করি।

৮.

কাজী সাহেব যেহেতু এসেছেন তাই বিয়ে পড়িয়ে দেয়া হল। বাবার উল্টা পাল্টা হুমকি আর মায়ের কান্না সব কিছু মিলিয়ে কবুল বলতে হল নিশিতাকে। বিয়ে পড়ানোর পর সবাই তার ঘর ছেড়ে চলে গেছে বেশ কিছুক্ষন হল। ফোনটা ভাইব্রেট করছে । কে ফোন করছে এসময়? সে উঠে এসে ফোনটা হাতে নিল। রাত্রি.. কেন যে এখন ফোন করেছে। এখন কি লাভ।
-কি খবর নিশিতা বেগম? সকাল সকাল ফোন?
নিশিতার কিছু বলার আগেই কান্না চলে আসে।
-আরে কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে বলবি তো?
-তুই ফোন ধরলি না কেন? তোর ভাইয়া কোথায়? ওনার ফোন বন্ধ কেন?
-পাগল নাকি? এই জন্য কাঁদছিস?
-আমার বিয়ে হয়ে গেছে আজ। তোদের কাউকেই পেলাম না আর বাবাকেও কিছুতেই আটকাতে পারলাম না।
-কি বলছিস। এমনও হয় নাকি। তুই এখুনি চলে আয়।
-এখন এসে কি হবে?
-কি হবে মানে? তোর বাবার নামে মামলা করবি? আর ডিভোর্স নিবি।
-এমন করা সম্ভব না রে। মা আর ভাইটার কি হবে?
-তাহলে আর কি? যা হয়েছে ভাল হয়েছে বলে থাক।

দরজায় নক শুনে সে ফোনটা রেখে দিল। নাজমা বেগম এসে ঢুকলেন।
-ওরা চলে যাবে একটু পরেই। জামাই তোর সাথে কথা বলতে চাচ্ছে।
-কেন?
-কেন মানে?
-বিয়ের আগে কথা বলার প্রয়োজন মনে করলো না। এখন আবার কি কথা।
-কি যে বলিস উল্টা পাল্টা। জামাইয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করিস না। মাথা ঠান্ডা কর।
-গাল ভরে জামাই বলতে লজ্জা লাগছে না মা।
-যথেষ্ট হয়েছে। চুপ করে বস। আমি ওকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

-আসবো?
-আসুন।
নিশিতা পড়ার টেবিলের চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে নিজে খাটে গিয়ে বসল।
-আপনার সাথে পরিচিত হবার আগেই বিয়ে পড়িয়ে দিল। এমন কিছু হবে আমি আশা করিনি।
-তো কি আশা করেছিলেন?
ইকবাল চট করে একবার নিশিতার মুখের দিকে তাকালো। আবার চোখ নামিয়ে নিয়ে হেসে ফেলল।
-আপনার কি বিয়েতে মত ছিলনা? কেউ কি পছন্দের আছে?
-থাকলেই বা কি? এখন কি কিছু করার আছে?
-আমি কিন্তু আপনার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম। আপনার বাবা বললেন আপনি রাজি আর আপনাদের পরিবারে এমন ভাবে কথা বলা কেউ পছন্দ করে না।
-আর আপনি সব বিশ্বাস করে কবুল বলে ফেললেন?
-আমি বা কি করব বলুন। আমাকেও তো আমার বাবা মার কথা চিন্তা করতে হয়। আমার আসলে ছুটি বেশিদিন নেই। আর দিন পনেরোর মত। তাই আমি চাইছিলাম সামনের সপ্তাহে ছোট করে একটা অনুষ্ঠান করে আপনাকে নিয়ে যেতে।
-আমার বাবাকেই জিজ্ঞেস করতেন এই কথা। আমাকে জিজ্ঞেস করার কোনো মানে হয় না।
-আপনি তো বেশ রাগি দেখি। আচ্ছা আঙ্কেলকেই জিজ্ঞেস করবো। আপনি মাথা ঠান্ডা করে বসেন। আমার ফোন নাম্বার আপনার ভাইয়ের কাছে দিয়ে গেলাম। কথা বলতে চাইলে ফোন করবেন। আমি আপনার ফোনের অপেক্ষায় থাকবো।

ইকবাল বেরিয়ে যেতেই নিশিতা হাফ ছেড়ে বাঁচলো। কি কেবলারে বাবা। সিনেমার ডায়লগ যেন। গা জ্বলে যায়।

গত দুই দিন থেকেই মন কেমন করছে শান্তর। কিছুই ভাল লাগছে না। বন্ধুরা হৈ হৈ করে ঘুরতে গেলেও সে তাদের ক্যাম্পের আসে পাশেই একা একা কাটিয়ে দিল দুটো দিন। আজ দুপুরে তাদের ফেরবার কথা। জিনিসপত্র গুছিয়ে তারা মোটামুটি রেডি। সবাই অস্থির হয়ে আছে কারো সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে। তাই তারা সকাল সকাল ফিরে এল তাদের বুকিং দেয়া রিসোর্টে । ফোন টা চার্জে দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো শান্ত।
-ওই ব্যাটা তাড়াতাড়ি বাহির হ।
-কেন? কি হয়েছে?
-তোর ফোন যে হারে বাজতেছে। দেখ কোন ইমার্জেন্সি কিনা?
বেরিয়ে এসে ফোন হাতে নিয়ে বিছানায় বসে পড়ে সে। অসংখ্য মিসড কল এলার্ট। নিশিতা এত বার ফোন করেছিল কেন? সাথে রাত্রিও। নিশিতাকেই ফোন করলো প্রথমে। ফোন বন্ধ। রাত্রিকে ফোন করল সাথে সাথেই।
-ভাইয়া তুই কই?
-কেন কি হয়েছে? মা ভাল আছে তো?
-হমম ভাল আছে। কবে আসবে?
-কাল রাতে।
-আচ্ছা আসো সাবধানে।
-কি হয়েছে বললি না? নিশিতা অনেক বার ফোন করেছিল। কোন সমস্যা হয়েছে?
-কিছু না।
-আচ্ছা ওর ফোন বন্ধ পেলাম। তোর সাথে কথা হলে ফোন করতে বলিস।
-আচ্ছা।
-কিছু লুকাচ্ছিস না তো? সত্যি করে বল?
-নিশিতার বিয়ে হয়ে গেছে ভাইয়া।
-সব কিছু নিয়ে মজা করবি না। তাহলে এমন মাইর খাবি।
-আমি মজা করছি না। গত শুক্রবারেওর বিয়ে হয়েছে। তুমি চেক করে দেখ ও কবে ফোন করেছিল তোমাকে?
শান্ত ফোনটা রেখে বারান্দায় এসে দাড়ায়। সব জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে। কেন তার সাথেই এমন হচ্ছে?

চলবে….

এমি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here