#বিরহে_মরণ
পর্ব-০৫
৯.
একটা লোক কতটা গায়ে পড়া হলে মেয়ের বিদায় দেবার আগেই শশুরবাড়ি বসে থাকতে পারে তা নিশিতা কল্পনাও করতে পারে না। এত বেহায়া কেন কে জানে বাপু। তার সাথে নাকি এখন শপিংয়ে যেতে হবে। মামা বাড়ির আবদার।
নাসিমা বেগম সকাল থেকে দম ফেলবার সময় পাচ্ছেন না। একে তো বিয়ে বাড়ির প্রস্তুতি অন্যদিকে জামাই এসে বসে আছে। মেয়েটাও হয়েছে আজব। ছেলেটার সাথে একটু কথা বলবে তা না নিজের ঘরে বসে আছ। বিয়ের শপিংয়ে নিয়ে যেতে এসেছে। তাতেও তার আপত্তি। মহারাণী যাবেন না।
আর দুই দিন পরেই অনুষ্ঠান। একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ছোট্ট আয়োজন করা হয়েছে। গায়ে হলুদ বাসাতেই হবে। শুধু নিজেদের অল্প কিছু আত্মীয়কে জানানো হয়েছে। সব কিছু কিভাবে এত তাড়াতাড়ি ব্যবস্হা হবে আল্লাহ জানেন। তিনি নিশিতার ঘরে ঢুকলেন।
-এখনও রেডি হসনাই?
-আমি তো বলেছি যাব না।
-বেশি বাড়াবাড়ি করিস না। এখন এসব করে কি হবে? এমন করলে সংসার করবি কিভাবে?
-সংসার করবার দরকার কি?
-সেটা তোর বাবাকে বল। আর ছেলেটাকে এভাবে ছোট করিস না । পরে দেখবি আম ছালা সব গেছে।
-মানে?
-মানে যা বোঝার বুঝে নে। আর তাড়াতাড়ি কর। তোর বাবা যদি দেখে জামাই এখনও একা বসে তাহলে কিন্তু মাথা খারাপ করবে।
-সারাজীবন এই ভয় নিজে পাইলা। আমাকেও সেই ভয়ই দেখাচ্ছো।
ইকবাল নিজে গাড়ি নিয়ে এসেছে। নিশিতাকে তাই সামনে বসতে হল।
-কোন শপিং মলে যাব বলেন তো?
-আপনি কোথায় যাবেন তা আমি কি করে বলবো?
-আমি তাহলে বসুন্ধরায় গেলাম।
-সে আপনার ইচ্ছা।
গাড়ি পার্ক করে ফার্স্ট ফ্লোরে এসে দাঁড়ালো দুজনে।
-এখন বলেন কোন দিকে যাব?
-মানে?
-মানে আপনার কি পছন্দ ? শাড়ী নাকি লেহেঙ্গা। শাড়ীর ও অনেক ধরণ এই যেমন বেনারসী নাকি কাঞ্চীপুরম। আবার ডিজাইনার শাড়ীর হতে পারে। আবার দেশী শাড়ীও হতে পারে। মেয়েদের কত রকম স্বপ্ন থাকে বিয়ের শাড়ী নিয়ে।
এই লোক তো দেখি শাড়ী এক্সপার্ট। কত মেয়ের সাথে যে রিলেশন ছিল।
-কি ভাবছেন? আমার কতগুলো এক্সগার্ল ফ্রেন্ড ছিল। এই সব শাড়ীর কথা মা বলে দিয়েছে। এবং এটাও বলেছে সবচেয়ে বেস্ট শাড়ীটা কিনতে।
-চলেন আড়ংয়ে যাই। আমার মনে হয় জামদানীতেই আপনাকে বেশি ভাল লাগবে।
নিশিতার আসলে এই ব্যাপারে কিছু বলার নেই। সে শুধু মানুষটাকে ফলো করলো। অনেকটা সময় ধরে লোকটা শাড়ী দেখলো। মেয়েদেরও এত ধৈর্য্য হয় কিনা সন্দেহ। শেষ পর্যন্ত অফহোয়াইট আর গোল্ডেন মেশানো একটা শাড়ী পছন্দ করে তার দিকে তাকালো?
-ঠিক আছে এটা? নাকি মেরুনটা ভাল লাগছে?
-আমি ঠিক জানি না। দুইটাই ভাল।
-দুইটাই নিয়ে নেই তবে?
-মাথা খারাপ? এত দামী শাড়ী।
-আচ্ছা তাহলে আমার পছন্দেই পর। লাল, মেরুন পরে অনেক পরতে পারবে।
গয়নাও কেনা হল আড়ং থেকে। রাইস পার্ল আর গোল্ডের শীতা হার আর কানের ঝুমকা, হাতের জন্য গোলাপ বালা। আরও কিছু শাড়ী আর সালওয়ার কামিজ কিনে ফেলল চট করে। এই লোকটার পছন্দ তো বেশ ভাল। শপিং করিয়েই তো মেয়ে পটিয়ে ফেলবে।
-কসমেটিকস আমি কিছু আসার সময় এনেছি। তুমি সেগুলো দেখে আর কি কি লাগবে আমাকে লিস্ট করে দিও।
লোকটা দেখি এখন তাকে তুমি তুমি করে বলছে। একটা সম্পর্ক তৈরী হওয়া কি এতটাই সহজ। আর সব কিছু ভুলে যাওয়াও কি এত সহজ নাকি? এইতো কিছুদিন আগে পুলিশের গাড়ী করে এখান থেকে গেল।
-কিছু বলছো না যে?
-কিছু লাগবে না।
-তুমি কি একটু স্বাভাবিক ব্যাবহার করবে?
-অস্বাভাবাবিক কিছু করছি কি?
-সেটা তুমি ভাল জান। কি কারণে এমন করছ সেটা আমাকে বললে হয়তো সমাধান করতে পারতাম।
-কোন কারণ নেই।
-তাহলে আর কি? জুতা কিনতে হবে। তাহলেই শেষ। চল।
১০.
আসার পর থেকেই নিশিতার ফোনে চেষ্টা করছিল শান্ত। বন্ধ বন্ধ বন্ধ। প্রথমে ভেবেছিল রাত্রিকে পাঠাবে কিন্তু ওদের বাড়ির অবস্হা কেমন তা তো জানে না। রাত্রিকে যদি ওর বাবা অপমান করে। কোন উপায় না পেয়ে শেষে ফোন নাম্বারটা ট্রাক করতে বলেছিল । ফোনটা এল দুপুরের দিকে।
-বলুন মেহেদী।
-স্যার নাম্বারটা অন হয়েছে। লোকেশন বসুন্ধরা শপিং মল।
কথাটা শোনার সাথে সাথেই শান্ত চলে এসেছিল মলে। খুঁজে পেতে অবশ্য সময় লেগেছিল। কিন্তু সঙ্গের ছেলেটাক্ দেখে সে এগিয়ে গেল না। পেছন থেকেই ফলো করতে লাগলো। ছেলেটা এভারেজ বাঙ্গালি ছেলেদের থেকে বেশ লম্বা। দেখতেও বেশ। হাঁটা চলা দেখে বেশ স্মার্ট মনে হচ্ছে। এপেক্স এ নিশিতা জুতা পায়ে দিয়ে দেখছে। তেমন একটা লোক নেই। জুতা পরে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই সে আয়নায় শান্তকে দেখতে পেল। চমকে পেছনে ফিরে তাকিয়ে শান্তকে খুঁজতে লাগল। শান্ত ততক্ষনে আড়ালে চলে গেছে। আর একটু হলেই ধরা পড়ে যেত।
-কি হল?
-কিছু না।
-তাহলে এই দুইটাই নিয়ে নাও।
-আচ্ছা।
আশেপাশে দেখতে লাগলো নিশিতা। সে কি তবে ভুল দেখলো।
-কাউকে খুঁজছো?
-না তো।
-তাহলে চল কিছু খেয়ে নেই।
-আমি বাসায় যাব।
-কি বলছো? সবাই কি ভাববে?
-কেউ কিছু ভাববে না।
জুতা কিনে বাহির হবার পর থেকেই নিশিতার মনে হচ্ছে শান্ত হয়তো কাছেই কোথাও আছে। কিন্তু এভাবে ফলো করার কারণ কি? ফোনটা বাহির করে দেখলো। না কোনো ফোন বা মেসেজও আসে নাই।
-কিছু একটা হয়েছে তোমার? কেমন যেন উদভ্রান্ত দেখাচ্ছে।
-কিছু না।
-সমস্যা হলে সেটা সমাধান করবার চেষ্টা করা উচিৎ নয়কি? লুকিয়ে রাখলে সেটা আরও বেশি হবে। তোমার কি মনে হয়? আমি তোমাকে বোঝার চেষ্টা করবো না?
-সমাধান নিজে না করতে পারলে অবশ্যই আপনাকে জানাবো।
নিশিতা পুরো সময়টাই চুপ করে থাকলো। ইকবাল তাকে নামিয়ে দিয়ে চলে যেতেই সে নিজের ঘরে চলে এল। ফোনটা বাজলো ঘরে আসার পরে। যা ভেবেছিল তাই। শান্তর ফোন।
-হ্যালো।
-কি খবর তোর?
-ভাল।
-ভাল তো দেখতেই পেলাম।
-এমন পিছু পিছু ঘুরতে আপনার লজ্জা করলো না?
-আসলে ঘুরতে চাই নি। তোকে ফোনে পচ্ছিলাম না। যখন পেলাম ভাবলাম গিয়ে দেখা করি। কিন্তু তোর সাথের মানুষকে দেখে সাহস পেলাম না।
-কেন? সে কি বাঘ?
-তা হবে কেন?
-এসে কথা বলে যেতেন। পরিচয় করিয়ে দিতাম।
-কি পরিচয় দিতি?
-কি আর? আপনি আমার বান্ধবীর ভাই। আপনাকে খুব পছন্দ করি কিন্তু অনেক রকম কারনে বলা হয়নি। আর আমার বিয়ের দিন শত চেষ্টা করেও আপনাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
-বলতে পারতি এত কথা?
-পারবো না কেন?
-তোর জামাই কিন্তু বেশ ভাল দেখতে।
-এক কাজ করেন আপনিও একটা বেশ ভাল দেখতে মেয়ে বিয়ে করে ফেলেন। তাহলেই কাটাকাটি।
নিশিতা হাসতে লাগলো। তারপর এমনিতেই কান্না চলে এল।
-নিশিতা…
-কি?
-চলে আয় সব ফেলে। আমি তোর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তুই তোর বারান্দায় এলেই দেখতে পাবি।
-অনেক কিছু চাইলেই করা যায় না। আপনি চলে যান প্লিজ।
-আচ্ছা যাচ্ছি। তবে যদি কখনো তোর মনে হয় তুই আমার কাছে আসতে চাস। তাহলে চলে আসিস। আমি তোর জন্য অপেক্ষা করবো।
-কেন করবেন? আপনার সাথে তো আমার কোন রিলেশন ছিল না। তবে কেন শুধু শুধু সময় নষ্ট করবেন?
-ওই যে একটু আগে বললি না যে চাইলেই অনেক কিছু করা যায় না। তেমন শুধু ভালবাসি বললেই ভালবাসা হয়ে যায় না। অনেক কিছু না বলেই অনেক সময় একে অন্যের মনে পাহাড় পরিমান জায়গা করে নেয়া যায়। আমরা তে আসলে লোক দেখানো ব্যাপারগুলিকে প্রাধান্য দেই। কার মন কি বলছে বা চাইছে তা অনুভব করবার চেষ্টাও করি না। যাক বাদ দে। অনেক কিছু বলে ফেললাম। ভাল থাকিস।
ফোনটা কেটে দিয়ে নিশিতা বারান্দার দরজার পর্দার আড়ালে দাঁড়ালো। ঐ তো মানুষটাক্ দেখা যাচ্ছে। বাইকের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো। সে কি শান্তর সাথে চলে যাবে? কিন্তু ইকবাল ? তার কারণে সেই মানুষটার জীবনটাও তো এলোমেলো হবে?
চলবে…
এমি..