বিরহে_মরণ পর্ব-০৭

0
521

#বিরহে_মরণ
পর্ব-০৭

১২.

আজ সন্ধ্যায় শান্তর ফ্লাইট। অস্ট্রেলিয়ার একটা ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি এ্যাডমিশন নিয়ে যাচ্ছে। পুলিশের চাকরিটা সে ছেড়ে দিয়েছে। সেটাও প্রায় এক বছর হয়ে গেছে। রাত্রির বিয়ের জন্য কিছুটা দেরি করতে হল। ছেলে খোঁজাখুঁজি শুরু করতেই তার ছোট চাচা নিজের ছেলের জন্য প্রস্তাব দিলেন। একদিক থেকে ভালই হয়েছে। রাত্রি মায়ের দেখাশোনা করতে পারবে।

সেপ্টেম্বরে যাবার কথা ছিল তার কিন্ত এখন সে যাচ্ছে ডিসেম্বরে। সুপারভাইজার বেশ ভাল আর যেহেতু বাংলাদেশের সেহেতু অনেকটা সাহায্য করেছেন। তা না হলে সমস্যায় পড়তে হত। রাত্রি সেই দুপুর থেকে বাড়ি মাথায় তুলে রেখেছে। যাবার টেনশন আর পারিপার্শিক সব কিছু মিলিয়ে এমনিতেই ঘুম হচ্ছে না কদিন থেকে তার উপর শোরগোলে মাথা ধরে গেছে শান্তর। এই মেয়েটা কি কখনও বড় হবে না? রাত্রিকে চুপ করতে বলে সে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে পড়লো।

ঘুমিয়ে পড়েছিল বোধহয়। মাথায় ঠান্ডা হাতের স্পর্শে সে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলো মা।
-উঠে কিছু খেয়ে নে। আর তো বেশি সময় নেই।
শান্ত উঠে ওয়াশরুমে গেল। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে মা তখনও তার বিছানায় বসে। সে মার পাশে এসে বসে পড়লো।
-কিছু বলবে মা?
-তোরা দুই ভাইবোন যখন যা করতে চেয়েছিস অন্যায় কিছু না হলে আমি কখনও বাঁধা দেই নাই। তোদের নিয়েই তো আমার জীবন। ভেবেছিলাম তোকে বিয়ে দিয়ে লাল টুকটুকে একটা বউ আনবো। কিন্তু তুই সব রেখে এখন পড়তে ছুটলি।
-সব হবে মা। কেবল তো মেয়ের বিয়ে দিলে। কদিন আরাম কর।
-কবে আবার দেশে আসবি কে জানে?
-আসব মা। এমন করো না তো। চল খেতে দাও।
টেবিলে বসতেই রাত্রি পাশে এসে বসলো।
-ভাইয়া তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
-কি কথা?
-তোমার কি নিশিতার সাথে যোগাযোগ হয়েছে?
-না তো কেন?
-আমি ভেবেছি ওর সাথে যোগাযোগ করেই বুঝি তুমি অষ্ট্রেলিয়ায় যাচ্ছ। তা না হলে কেন তুমি হঠাৎ বাইরে যাবার প্ল্যান করলে।
-তোদের মেয়েদের মনে খালি এইসব কুটিল চিন্তা। ভাল কিছু চিন্তা করতে পারিস না?
-ওর সাথে যোগাযোগ করবে না কিন্তু।
-আমার কি কোনো কাজ নেই। আর আমি তো জানি না সে কোথায় থাকে।
-তবুও যদি দেখা হয়।
-ঢাকা শহরেই পরিচিতদের সাথে দেখা হয় না। আর ওটা কত বড় দেশ সেই বিষয়ে কি তোর ধারণা নেই। এই সব চিন্তা বাদ দে। মার খেয়াল রাখিস। প্রতিদিন তো কথা হবেই। আর ইমার্জেন্সি হলে সাথে সাথে জানাবি। যা এখন দেখ মা রান্না ঘরে কি করে ? আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।

এয়ারপোর্টে অনেকেই এসেছিল। মা আর রাত্রির সে কি কান্না। ইমিগ্রেশন পার করবার পর কষ্ট আরো বেশী হয়ে যায় যেন। সবাইকে চলে যেতে বলে সে চুপচাপ বসে থাকে। বোর্ডিং শুরু হবে ঘন্টাখানেক পরে। ফেসবুক ঘাটাঘাটি করলো কিছুক্ষন। নিশিতা নাম দিয়ে সার্চও করলো। অসংখ্য নিশিতার ভীড়ে আসল মানুষকে খুঁজে পেল না।

প্লেনে উঠে চোখ বন্ধ করতেই রাত্রির কথাগুলি মনে পড়তে লাগলো। আসলেই কি সে নিশিতার খোঁজে যাচ্ছে? তা না হলে কেন সে এত জায়গা থাকতে অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটিগুলোতে আবেদন করেছিল। কিন্তু সেদিনের পর তো সে একবারের জন্যও যোগাযোগ করেনি। না তার সাথে না রাত্রির সাথে। তবুও তার মন বলেছে সে ফিরে আসুক, সেটা যেভাবেই হোক।
“যাওয়া বলে কিছু নেই…
সবই ফিরে ফিরে আসা…
নদী সেও ফিরে আসে একদি মেঘ হয়ে…
ভালবাসা ফেরায়, ফেরাতে পারে।”
কার কবিতা এটা? মনে পড়ছে না শান্তর। কিন্তু আসলেই কি ভালবাসা সব ফিরিয়ে আনতে পারে? কি করে সম্ভব। হয়তো তার সুখের সংসার। হয়তো তার স্বামীকেই সে সবচেয়ে বেশী ভালবাসে।
শান্ত এইসব চিন্তা বাদ দাও। বয়স তো কম হল না। জীবনটাকে সুন্দর করবার চেষ্টা কর। বহুদিন তো এলোমেলো থাকলে।

১৩.

দুইটা বছর যে কেমন করে চলে গেল শান্ত বুঝতেই পারলো না। কোর্স ওয়ার্কের সাথে ল্যাবের কাজ সব মিলিয়ে তার বেহাল দশা। দিনের বেশির ভাগ সময় ইউনিভার্সিটিতেই কেটে যায়। খাওয়া দাওয়ার ঠিক নেই। দেশী খাবার কারো বাসায় দাওয়াত থাকলেই খাওয়া হয়। যদিও তার সাথে খুব অল্প কয়েকজনের পরিচয় হয়েছে। তার নিজেরও ভাল লাগে না বেশি মানুষের মাঝে যেতে। এখন অবশ্য সে অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে এই জীবনে। কাজও অনেকটা নিজের মত গুছিয়ে নিতে পেরেছে তাই আর আগের মত প্রেসার নিতে হয় না। রান্নাও শিখে ফেলেছে কিছু।

ছোট্ট একটা স্টুডিও এপার্টমেন্টে থাকে সে। ইউনিভার্সিটি থেকে বেশ কাছে। হেটে যেতে দশ মিনিটের মত লাগে। সে হেটেই যায়। পারতপক্ষে গাড়ি নেয় না। বাড়ি থেকে বের হবার কিছুক্ষন পর বৃষ্টি শুরু হল। একটা কফিশপে দৌড়ে এসে ঢুকল। এই সময়টা বেশ ভীড় হয়। কফির জন্য বিশাল লাইন। সেও লাইনে দাড়িয়ে পড়ল। আপাতত কিছু করার নেই।

নিজের রুমে এসে ব্যাকপ্যাক রেখে ওয়াশরুমে গিয়ে মাথাটা মুছে চুল ঠিক করে এল। জামা তেমন ভেজেনি। শুখিয়ে যাবে কিছুক্ষনের মধ্যে।
-মাহফুজ
তার প্রফেসরকে ঢুকতে দেখে সে উঠে দাঁড়ালো। স্যারের পেছনে আর একজন এসে দাঁড়ালো।
-আসসালামুয়ালাইকুম স্যার।
-ওয়ালাইকুম আস সালাম। মাহফুজ ও হচ্ছে এলিটা তোমাকে বলেছিলাম ওর কথা। গতকালকেই এসেছে। তোমার পাশের ডেস্কেই বসবে। ওর বাসা আমি ঠিক করে রেখেছিলাম আগেই। কিছু জিনিসপত্র কিনতে হবে, আর ব্যংকে যেতে হবে। তুমি এক কাজ কর তোমার কাজ শেষ হলে ওকে একটু নিয়ে যাও। আমার আজকে জরুরী মিটিং আছে তাই সাহায্য করতে পারছিনা। আর সবকিছু চিনিয়ে দিও। তাহলে পরের বার ও নিজেই সব করতে পারবে।
-আমি তিনটার পরে ফ্রি আছি কিছুক্ষনের জন্য তখন বের হই।
-এলিটা তোমার কোন সমস্যা আছে?
-জ্বি না স্যার।
-ঠিক আছে তাহলে। তুমি বরং বিশ্রাম কর তোমার বাসায় গিয়ে। ঠিকানা আর ফোন নাম্বার দিয়ে যাও।
-স্যার ফোন নাম্বার তো নেই।
-তাই তো। তাহলে ফোনের কানেকশনও নিয়ে নিও একটা। আচ্ছা ফেসবুকে এড করে নাও। তুমি ম্যাসেন্জারে নক দিয়ে যেও।
-ঠিক আছে স্যার।
-ঠিকানাটা লিখে দাও তাহলে।
-আমি ম্যাসেন্জারে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

দুজনে চলে যেতেই শান্ত নিজের ডেস্কে বসলো। আর জায়গা পেল না আসার। ধুর, এই সব মেয়ে মানুষের দায়িত্ব নিতে এখন আর ভাল লাগে না। আদরের দুলালী নিশ্চই। কথায় কথায় ন্যাকামী করবে। তাতে অবশ্য তার কিছু যায় আসে না। তাকে যতটুকু বলা হয়েছে সে সেটা করবে। ম্যাসেন্জার চেক করে দেখলো। বাড়িটা তার বাসা থেকে এক ব্লক পরে।

বাড়ির সামনে গাড়ি পার্ক করতেই এলিটা বেরিয়ে এল। মেয়েটাকে যেমন মনে হয়েছিল তেমনটা ঠিক না। সময়ের ব্যাপারে বেশ সিরিয়াস। পড়াশুনা আর ক্যারিয়ারের ব্যাপারে এমন সিরিয়াস হলেই হয়।
নিজের কাজগুলোও বেশ গুছিয়ে করতে পারে দেখা যাচ্ছে। ব্যংকে যেয়ে একাউন্ট করতে তাই কোনো ঝামেলা হল না। তারপর ফোনের সিম নিয়ে নিল আর তারপর ওয়ালমার্ট।
-কি কি কিনবেন?
হ্যান্ডব্যাগ থেকে লিস্ট বের করল এলিটা। কি কি লাগবে সে সব লিখে ফেলেছিল দুপুরে বসে। তা দেখে খুব তাড়াতাড়ি জিনিসপত্র কিনে ফেলল।
এলিটা বাসায় জিনিসপত্র তুলে দিয়ে শান্ত নিচে নেমে এল। আকাশ এখনও থমথম করছে। বেশ গরম। সে গাড়ির পাশে দাড়িয়ে সিগারেট ধরালো। অনেক কাজ পেন্ডিং হয়ে গেল। সেগুলো শেষ করতে হবে। এলিটা বেরিয়ে এল ।
-আপনি এলেন কেন?
-দেখলাম আপনি দাড়িয়ে আছেন। আর আপনাকে ধন্যবাদ দেয়া হয়নি। অনেক ধন্যবাদ। আমার জন্য আজ অনেক কষ্ট করলেন।
-এটা তো এখানে সবাই করে। আচ্ছা আসি।
-কাল দেখা হবে তাহলে।
-দেখা না হয়ে কি উপায় আছে। ল্যাব তো একি।
-আপনার ফোন নাম্বারটা যদি দিতেন?
নিজের ফোন নাম্বার দিয়ে শান্ত গাড়িতে উঠে বসলো।

চলবে…

এমি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here