বিরহে_মরণ পর্ব-০৮

0
600

#বিরহে_মরণ
পর্ব-০৮
১৪.

এলিটার আজকাল শান্তকে বিরক্ত করতে খুব মজা লাগে। একটা মানুষ এমন হুতুম পেঁচা হয় কি করে। সব বিষয়ে এত সিরিয়াস আর এত কম কথা বলে। যতক্ষন ল্যাবে থাকে কম্পিউটারে মুখ গুঁজে থাকে। মেয়েদের এভয়েডও করে বোধহয়। তা না হলে তার দিকে চোখ তুলে তাকিয়েও কথা বলে না। তবে লোকটার আশেপাশে থাকতে তার বেশ ভাল লাগে। এই জীবনটা এই লোকটার সাথে কাটিয়ে দিতে পারলে খারাপ হত না। এই লোকটা কি তার মনের কথা কখনও বুঝবে। তার কি নিজেরই বলে দেয়া উচিত?
কিন্তু কিভাবে বলবে? আর বললে যদি না বলে তাহলে দিনের পর দিন এক ল্যাবে কাজ করবে কেমন করে?
-শান্ত ভাইয়া।
-আপনাকে না বলেছি একটু পর পর শান্ত ভাইয়া শান্ত ভাইয়া করবেন না।
-একটু পর পর কই করলাম। আজকে সকাল থেকে তো একবারও বলিনি।
-কি বলবেন বলেন।
-আজ ডিনারে আপনার আমার বাসায় দাওয়াত। স্পেশাল খাওয়া খাওয়াব।
-আমার সময় নেই ।
-প্লিজ। আজ আমার জন্মদিন। অনেক একা একা লাগছে। আপনি এলে ভাল লাগবে।
-তাহলে চলেন বাইরে কোথাও ডিনার করি। বাসায় যাওয়াটাই ঠিক হবে না।
-নাহ। অন্যদিন বাইরে খাব। আজকে পুরোপুরি বাংলাদেশী খাবার খাব। কতদিন খাইনা বলেন তো।

একগুচ্ছ হলুদ গোলাপ নিয়ে শান্ত সন্ধ্যায় এলিটার বাড়ির সামনে এসে গাড়ি রাখতেই এলিটা বেরিয়ে এল। ওকি তার জন্য অপেক্ষা করছিল নাকি?
-শুভ জন্মদিন। তখন আসলে বলা হয়নি।
-অনেক ধন্যবাদ। আপনি এসেছেন তাতেই আমি খুশি।
শান্ত লিভিং রুমে চুপচাপ বসে। তেমন কিছু নেই ঘরটায়। শুধু একটা সোফা। এলিটা কিচেনে কি যেন করছে।
-আসুন খাবার রেডি।
খাবার ঘরে এসে শান্ত অবাক হয়ে গেল রোস্ট, রেজালা, চিংড়ি ভুনা, সালাদ, গরুর কালা ভুনা, পোলাও।
-আপনি এত রান্না করতে পারেন নাকি?
-খেয়ে বলেন কেমন হয়েছে। তারপর বলবো রান্নার গোপন রহস্য।

খাওয়া শেষ করে দুজনে বাইরে এল। আজ গরম নেই তেমন আর বাতাসও আছে। হাটতে ভালই লাগছে। অনেকটা পথ তারা চুপচাপ এল। কথা শান্তই শুরু করল।
-রান্না বেশ ভাল হয়েছে।
এলিটা হেসে ফেলল।
-হাসছেন কেন?
-রান্নাটা কিন্তু আমার না। কদিন আগে একটা বাসায় দাওয়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে এমন সব মজার খাবার খেলাম। পরে জানতে পারলাম এক আপু আছেন এখানে। একটা ওল্ডহোমে জব করেন। পাশাপাশি কেউ বললে রান্না করে দেন। ওনাকেই বলেছিলাম।
-তাই বলেন। আমি তো অবাক হয়ে গিয়েছি।
-আপনি চাইলে আপনাকে ফোন নাম্বার দিয়ে দেব।
-আচ্ছা লাগলে আমি চেয়ে নেব। নিজে রান্না করা শিখে নিলেই তো পারেন।
-আপনি চাইলে শিখে নেব।
-মানে?
-কিছু না।
-অনেকটা চলে এসেছি। চলেন ফেরা যাক।
-ভালই তো লাগছিল।
-ভাল লাগলেই সব কিছু করতে নেই।
-আচ্ছা এই যে প্রায় ছয় মাস ধরে আমরা একি ল্যাবে কাজ করি। কিন্তু আমি আপনার সম্পর্কে কিছুই প্রায় জানি না।
-জেনে কি হবে?
-আমি জানতে চাই।
এলিটা রাস্তার মাঝে দাড়িয়ে পড়ল।
-আপনার সাথে আমার অনেক জরুরী কথা আছে।
-কি কথা?
-আমি আপনাকে পছন্দ করি।
শান্ত রাস্তার পাশের সারিবদ্ধ হয়ে দাড়িয়ে থাকা একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো।
-এভাবে হঠাৎ করে কোনো কিছুর সিদ্ধান্তে নেয়া যায় না।
-কেন যাবে না। আমাদের নিজস্ব মতামত একে অপরকে জানানোর মত যথেষ্ঠ বয়স হয়েছে। আর আমি আমার ভাল লাগার কথা বলেছি। এভাবে মনের সাথে যুদ্ধ করে থাকতে পারছিলাম না।
-আমার কিছু বলার নেই এলিটা।
-কেন নেই? আমি কি এতটা খারাপ?
-আমি এসব কিছু বলছি না। চলেন আপনাকে পৌছে দিই।

এলিটা কে পৌছে দিয়ে সে এলোমেলো ভাবে কিছুক্ষন হাটলো। আসলেই তো একজন সঙ্গী তারও দরকার। নিশিতার জন্য কেনই বা তার এই অপেক্ষা। তার নিশ্চই সুখের সংসার। প্রায় চার বছর হয়ে গেছে। আচ্ছা সে কি একবার খুঁজবে নিশিতাকে? নিশিতার ভাইয়ের কাছে ঠিকানা নিশ্চই পাওয়া যাবে। কিন্ত তাতেই বা কি লাভ?

“হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে-উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে!
তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে;
পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চ’লে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;
আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে
বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!”

তার জীবনের অবিচ্ছেদ্দ্য অংশ যেন জীবনানন্দ দাসের কবিতা। বাসায় ফিরে রাত্রিকে ফোন করে নিশিতার কথা জানবে বলে। কিন্তু কেন যেন আর জিজ্ঞেস করা হয় না।

পরের দুদিন এলিটা ল্যাবে এলনা। শান্তর এতদিন মনে হত মেয়েটা একটা যন্ত্রনা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সব ফাঁকা হয়ে গেছে। সে বিকেলে ল্যাব থেকে বেরিয়েই এলিটার বাসার সামনে এসে দাঁড়ালো। ফোনে কল করলো দুবার। নাহ ফোন ধরছে না। পরে ডোর বেল বাজালো কয়েকবার। শেষ পর্যন্ত দরজা খুলল। এলিটাকে দেখে শান্ত অবাক হয়ে গেল। চোখ মুখ ফোলা, টকটকে লাল হয়ে আছে চেঁহারা। সে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই এলিটা সোফায় গিয়ে বসে পড়ল।
-কি হয়েছে?
-তেমন কিছু না। আমার ডাস্টে এলার্জি। সেদিন রাতে হাটতে গিয়ে এলার্জির এ্যাটাক হয়েছে। সাথে ঠান্ডা আর জ্বর।
-চল ডাক্তারের কাছে যাবে।
-ঔষধ খেয়েছি। আমার এমনিতেই এমন হয়। ঠিক হয়ে যাবে।
শান্ত এলিটার পাশে বসলো। কাপালে হাত রাখতেই মনে হল ছ্যাকা খেল।
-অনেক টেম্পারেচার। চল হাসপাতালে যাবে।
-আমি কোথাও যাব না।
-বাচ্চাদের মত কেন করছ?
এলিটার হাতটা ধরল সে।
-এমন করনা প্লিজ। তুমি রেডি হয়ে নাও। আমি গাড়িটা নিয়ে আসি। পাঁচ মিনিট লাগবে।
শান্ত দৌড়ে বেরিয়ে গেল। অসুস্হতার মাঝেও এলিটার মনটা এত ভাল হল। তার জন্য ছুটে এসেছে। সবচেয়ে বড় কথা তার কপালে হাত রেঁখেছে। তার হাত ধরেছে। এজীবনে তো আর তার কিছু চাই না।

শান্ত গাড়ী নিয়ে ফিরে এসে দেখে এলিটা মেঝেতে পড়ে আছে। কোনো উপায় না দেখে সে ৯১১ এ ফোন করল। ওদের সাথে এ্যম্বুলেন্সে উঠে বসল। হাসপাতালেও বেশ ছুটাঁছুটি করতে হল। আগে থেকেই অ্যাজমার সমস্যা ছিল, এলার্জির কারণে লাংসে ইনফেকশন হয়েছে আর সাথে জ্বর। নেবুলাইজার দিতে হল। আই ভি দেয়া হয়েছে সাথে মেডিসিন। জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষন আগে। হাসপাতালে তাকে থাকতে দেবে না। তাই সে দেখা করে ফিরে এল এলিটার বাসায়। ঘরে ঢুকে সব জানালা বন্ধ করল। জিনিসপত্র গুছিয়ে দরজা লক করে সে ফিরে এল নিজের জায়গায়। সুপারভাজারকে ইমেইল করে এলিটার কথা জানালো। তারপর রান্নাঘরে এসে একটা নুডুলস মাইক্রোওয়েভে দিল।

এলিটা আজ বাসায় এসেছে। এখন সে বেশ ভাল আছে। বেশ ভালই ভুগেছে এক সপ্তাহ। তবে এই কদিনে শান্তর সাথে তার যে দুরত্ব ছিল তা অনেকটাই চলে গেছে। এখন তার মনে হয় অসুখটা হয়ে ভালই হয়েছে। তা না হলে হুতুম পেঁচাটাকে কিছুতেই বাগে আনা যেত না। শান্ত রান্না ঘরে। সে নাকি আজ রান্না করে রেখে যাবে। সে পেছন থেকে শান্তকে জড়িয়ে ধরল।
-কি করছো?
-কিছু না।
-তোমার কি মাথা খারাপ।
-তুমি তো করলে।
-তোমাকে আমার অনেক কথা বলার আছে।
-আমি এখন কিছু শুনব না।
-আজ না হলেও তোমাকে শুনতে হবে।
-আচ্ছা ঠিক আছে শুনবো । এবার হয়েছে।
-আচ্ছা এখন যেয়ে চুপচাপ নিজের ঘরে শুয়ে থাক।এই সব রান্নার গন্ধের মাঝে থাকতে হবে না। রান্না হলে আমি ডেকে আনবো।
-তুমি আজ এখানে থাকো প্লিজ। আমার খুব ভয় করবে।
-বাচ্চাদের মত করলে তো হবে না। তুমি নিজে বল সেটা কি ঠিক হবে? আমাদের এখানে আসার তো একটা উদ্দেশ্য আছে তাই না। সেটাও তো শেষ করতে হবে। কত কাজ জমে গেছে জানো?
-হুঁকোমুখো হ্যাংলা একটা।
-সেটা হতেও আপত্তি নেই। আপাতত আমাকে ছেড়ে দাও।
সে এলিটাকে তা শোবার ঘরে পাঠিয়ে মুরগির মাংস আর ভাত বসিয়ে দেয়। এলিটার খাওয়া হলে ঔষধ খাইয়ে সে বাসায় ফিরবে।

বাসায় কথা বলতে হবে মায়ের সাথে। তারপর এলিটার বাবা মার সাথে। অনেক তো একা থাকলে। এবার তোমার আরামের দিন শেষ হতে চলল শান্ত সাহেব। হুকোমুখো হ্যংলা লিখি গুগলে সার্চ দিল।

হুঁকোমুখো হ্যাংলা বাড়ী তার বাংলা
মুখে তার হাসি নাই দেখেছ ?
নাই তার মানে কি ? কেউ তাহা জানে কি ?
কেউ কভু কাছে তার থেকেছ ?

এমন হাসি পেল। হা হা করে হেসে নিল অনেক্ষন। জীবন থেকে আনন্দ হারিয়ে গিয়েছিল। সেটা ফিরে আসছে।

চলবে……

এমি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here