কবুল বলার ঠিক পরমুহূর্তেই বাহিরে শোরগোল উঠলো পাত্র বদল হয়ে গেছে। যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে এই সেই ছেলে না।
চন্দ্রর মুখের হাসি নিমিষেই বিষাদে রূপ নেয়,কাঁপা কাঁপা হাতে পার্স থেকে ফোন বের করে,” দ্যা গেম ইজ ওভার,আই হ্যাভ ওন”
মেসেজটি দেখেই “না” বলে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে মূর্ছা যায় চন্দ্র মুহুর্তেই।
মূর্ছা যেতে যেতে চন্দ্র শুনতে পায় বাহিরে আম গাছে কোকিলের কুহুতান শোনা যাচ্ছে,যেনো চন্দ্রের অজ্ঞান হয়ে যাওয়াতে কোকিল সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে।কোকিলের কুহুতানে উচ্ছ্বাস ঝরে পড়ছে যেনো।
কোকিলটা এতো বেশি আনন্দিত কেনো?
ভাটফুলের মাতাল করা ঘ্রাণ ভেসে আসছে বহুদূর থেকে,এই ইট-পাথরের রাজ্যে ভাটফুল আসবে কোথাথেকে?
ভাটফুল তো ফেলে এসেছে গ্রামের বাড়িতে।ফেলে এসেছে এক আনন্দিত শৈশব,সেই শৈশব অল্পকিছু দিনের যদিও,তবুও সেটা কেমন জ্বলজ্বল করছে স্মৃতির পাতায়।
ভাটফুলের ঘ্রাণ আস্তে আস্তে হারিয়ে যায়,চন্দ্র প্রবেশ করে যেনো এক হিমশীতল ঘরে,যেনো যুগের পর যুগ কেউ পরম যত্নে বরফ পুড়িয়ে পুড়িয়ে এই ঘরকে আরো শীতল করে তুলেছে।
কি সব ভাবছে চন্দ্র এসব?
বরফ কি পোড়ানো যায়?
এরকম অসংলগ্ন চিন্তাভাবনা কেনো জড় হচ্ছে মাথায় তার,সে কি মরে যাচ্ছে না-কি?
চন্দ্রর হাত পা সব ঠান্ডায় জমে আসাড় হয়ে গেছে।
আস্তে আস্তে চারদিক নিরব হয়ে যায়।
এয়ারকন্ডিশানারের শীতল হাওয়া বইছে রুমে,তারপরেও চন্দ্রর নানী হাতপাখা দিয়ে চন্দ্রকে বাতাস করছে,রাহেলা ছুটে গিয়ে তেল পানি নিয়ে এসেছে চন্দ্রর মাথায় দেয়ার জন্য।
চন্দ্রর খালা নাজনীন বেগম লাফিয়ে উঠলেন রাহেলার হাতে তেল পানি দেখে।
“তোর আক্কেল দিয়ে কি শরবত বানিয়ে খেয়ে নিয়েছিস না-কি রাহেলা?
মেয়েটা এতো সুন্দর করে সেজেগুজে এসেছে পার্লার থেকে,তুই কি-না ওর মাথায় সরিষার তেল দিতে এসেছিস,বলি ওর সাজগোজের কি অবস্থা হবে এখন,চুলের শেপ নষ্ট হয়ে যাবে যে এই সহজ বিষয় টা কি তোর মোটামাথায় ঢুকে না?”
“খালাম্মা,এইডা আপনে কি কইলেন?
আমি কি ২ লম্বরি তেল আনছি আপার লাইগা?
এই তেল আমাগো গেরামের সফুরা বুড়ির পড়া তেল,এককোষ তেল মাতাত দিলেই দেখবেন চন্দ্র আপা শোয়া থাইকা উইঠ্যা খারাইয়া যাইবো,এই রাহেলা অরজিনাল জিনিস ব্যবহার করে,গরিপ অইতে পারি কিন্তু রুচি নিচু না, বুইঝলেন খালাম্মা?”
নাজনীন বেগমের দুই চোখ বড় বড় হয়ে গেছে,তিনি বসা থেকে উঠে দাড়ালেন,ঝগড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন মনে মনে।
চন্দ্রর নানী আনোয়ারা বেগম অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে দেখে উঠে দাঁড়ালেন,তারপর রাহেলা কে বললেন,”রাহেলা,তেল নিয়ে যা এখান থেকে,তোর কোনো তেলতুল দিতে হবে না যা,শুধু পানি আন তুই।”
“মিনারেল ওয়াটার আনবি বুঝলি?”
নাজনীন বেগম মনে করিয়ে দেয় আবার।
রাহেলার ইচ্ছে ছিলো নাজনীন বেগমের সাথে আরো একদফা ঝগড়া করতে,কিন্তু এখন চন্দ্র আপার শরীর অসুস্থ তাই রাহেলা আর কথা না বাড়িয়ে চলে যায়,এই বাসায় এই একটা মানুষ আছে যাকে রাহেলা অসম্ভব ভালোবাসে,শ্রদ্ধা করে।
নাজনীন বেগম রাহেলার দুই চোখের বিষ,সুযোগ পেলেই এই মহিলা ক্যাটক্যাট করে কথা শোনায় বাসার সব মানুষকে,চন্দ্র আপার মতো একটা পরীর মতো মেয়েরেও ছাড় দেয় না।
রাহেলার ইচ্ছে করে মাঝেমাঝে সফুরা বুড়ির একটা পালা জ্বিন নাজনীন বেগমের উপর ছাইড়া দিয়া তামাশা দেখতে।
রাহেলা পানি নিয়ে আসতেই নাজনীন বেগম জিজ্ঞেস করে,”মিনারেল ওয়াটার এনেছিস তো?”
“না,ডিস্টিল ওয়াটার আনছি।”
নাজনীন বেগম আরো রেগে যায়,বিরসবদনে রাহেলা জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকায়,বাহিরে পাশের বিল্ডিংয়ের বাথরুমের পাইপ ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
খুব একটা আকর্ষণীয় দৃশ্য না এটা,তবুও রাহেলা গভীর মনোযোগ দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
বাথরুমের একটা পাইপে ছিদ্র হয়েছে,ঝিরঝির করে পানি পড়ছে সেখান থেকে,সেই পানি সাদা দেয়ালে পড়তে পড়তে কালচে বর্ণ ধারণ করেছে সাদা দেয়াল।
মুখে পানিই ছিটকা দিতেই চন্দ্রর জ্ঞান ফিরে আসে। হতভম্ব হয়ে তাকায় চন্দ্র উপস্থিত সবার দিকে।
নানী,খালা,চাচী আরো অনেক মেহমান উপস্থিত রুমে,এক মুহূর্ত লাগে চন্দ্রর মনে করতে সবকিছু।
“চন্দ্র রে,কি জামাই পাইলি রে তুই,সোনার টুকরা জামাই,একেবারে রাজকুমার যেনো বুঝলি,আমি তো পাত্রবদলের কথা শুনে কোমরে আঁচল গুঁজে গেছি ছাঁদে ঝগড়ার প্রস্তুতি নিয়ে,মামাবাড়ির আবদার নাকি যে ওরা পাত্র বদল করে দিবে,গিয়ে তো দেখি জামাই বাবাজী যেনো রাজকুমার,কি সুন্দর লম্বা লম্বা সিল্কি চুল,তোর আর জামাইয়ের দেখিস শ্যাম্পু কন্ডিশনার নিয়ে ঝগড়া হবে খুব।
হিরের টুকরো একটা ছেলে,যার সাথে তোর বিয়ে ঠিক হয়েছিলো সে তো একটা আলকাতরার ড্রাম ছিলো।আর তোর শ্বশুরের কথা কি বলবো,বুড়ো বয়সেও এতো স্মার্ট!
এবার তোদের ২জনকে খুব মানাবে বুঝলি।একদম হিরের খনি পেয়েছিস তুই রে চন্দ্র”
চন্দ্র হতাশ হয়ে তাকায় বাহিরের দিকে,দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে চন্দ্র কান্না রুখতে। ভিতরটা রাগে,ক্ষোভে ফেটে পড়ছে যেনো।হেরে গেলো সে!
কোকিলের কুহুতান আবারও শোনা যাচ্ছে।হঠাৎ করেই চন্দ্রর মনে হলো কোকিলের কুহুকুহুর চাইতে কাকের কা কা শব্দ আরো বেশি শ্রুতিমধুর।
মানে হয় কোনো এরকম উদ্ভট ভাবনার?
চন্দ্র বুঝতে পারে না।
——————-
হাসনাত সাহেব বসে আছে একটা চেয়ারে,হাতে কোল্ড ড্রিংকসের বোতল।এক চুমুক দিচ্ছেন আর চারপাশে তাকিয়ে দেখছেন,তিনি বেশ উত্তেজনা অনুভব করছেন ব্যাপার টা তে,একসময় তার ও ইচ্ছে ছিলো এভাবে বিয়ে করার,মনোয়ারা কে তুলে নিয়ে যাওয়ার,কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস,মনোয়ারার বাসায় প্রস্তাব দিতেই তারা মেনে নিলো,হাসনাত সাহেব আর পারলেন না এরকম কিছু করতে।
এখন ছেলের বিয়েতে সেই আনন্দ উপভোগ করছেন।
মনে মনে নিজেকে বার কয়েক বাহবা দিলেন তিনি।
কি ছেলে জন্ম দিয়েছেন দেখতে হবে না,এরকম সাহস আজকের দিনে কয়জন দেখাতে পারে?
জেলার রাজনৈতিক দলের সভাপতি হয়ে তার ছেলে কি সাহসের কাজটাই না করলো!
মনোয়ারা বেগম কে ভিডিও কল দিলেন হাসনাত সাহেব,মনোয়ারা বেগম রিসিভ করতেই হাসনাত সাহেব একগাল হেসে বলে উঠেন,”বুঝলে মনু,জীবনে আজকে একটা একসাইটিং কাজ করতে এসেছি বাপ-বেটা মিলে,আরেকজনের বউ চুরি করে নিয়ে আসছি নিষাদের জন্য,বুঝতে পারছো না তুমি কি থ্রিলিং ব্যাপারস্যাপার,তুমি বাসায় সব রেডি করো,বাসর সাজানোর ব্যবস্থা করো।”
মনোয়ারা বেগম বিরক্তিতে ব্রু কুঞ্চিত করে বলেন,”তোমাকে নিষেধ করেছি না আমাকে মনু বলে ডাকবে না যেখানে সেখানে?
বিয়ে করেছে আমার ছেলে,তুমি এতো খুশি কেনো?”
“আরে মনু,তুমি বুঝতে পারছো না কি পরিমাণ খুশি আমি আজ,এখানে এসে বউমার এক খালা কে দেখেছি,মহিলা দেখতে খুবই সুইট,আর ব্যবহার তো আরো অমায়িক,আমাকে কি সুন্দর করে বেয়াই সাহেব বলে পান বানিয়ে দিলো।”
মুহূর্তেই মনোয়ারা বেগমের ফর্সা গাল লাল হয়ে উঠলো,নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
হাসনাত সাহেব মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন,এই তেজস্বিনী চেহারায় প্রেমে তিনি হাজার বার পড়েছেন,আজীবন পড়তে চান।
মনোয়ারা বেগম খট করে কল কেটে দিলেন।
হাসনাত সাহেব আত্মতৃপ্তির হাসি হাসলেন।
বয়স বাড়লেও মনের বয়স বাড়ে না,সেখানে সে আজীবন যৌবনের অধিকারী,বুড়ো বয়সেও কোনো স্ত্রী স্বামীর ভাগ দিতে পারে না,স্বামীর মুখে পরনারীর কথা সহ্য করতে পারে না।
ভালোবাসা বিষয় টা কি অদ্ভুত!
ভাবতেই ভালো লাগছে হাসনাত সাহেবের।এতো সুখী কেনো তিনি!
সোফায় আরাম করে বসে আছে নিষাদ,হাঁটুতে পাগড়ি রাখা।নেভী ব্লু শেরওয়ানীতে নিষাদকে লাগছে রাজকুমারের মতো।একমাথা সিল্কি চুল নিষাদের যেকোনো মেয়ের জন্য ঈর্ষাজনক।
আপাতত বুকের উপর দুই হাত ভাঁজ করে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে নিষাদ,কপাল বেয়ে নাকে নেমে এসেছে রেশমের মতো কোমল চুলগুলো।
ভিতরে জয়ের আনন্দ,প্রাণখুলে হাসতে ইচ্ছে করছে নিষাদের,কিন্তু হাসছে না নিষাদ।আজ সে জিতে গেছে,নিষাদ এতোটা আনন্দ পায় নি কখনো আজ যতোটা পাচ্ছে।
নিষাদ কে কেউই কিছু বলছে না,সবাই কেমন শ্রদ্ধার চোখে তাকাচ্ছে তার দিকে।
বিশেষ করে নিষাদের শ্বশুর রশিদ সাহেব কেমন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বারবার তাকাচ্ছে নিষাদের দিকে,বারবার স্যার স্যার বলছে।
রশিদ সাহেব আবার এসে নিষাদের পাশে দাঁড়ালো,বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করে,”স্যার কিছু লাগবে আপনার?”
নিষাদ বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়,তারপর রশিদ সাহেবের দুইহাত চেপে ধরে বলে,”বাবা,আমাকে স্যার স্যার বলে কেনো লজ্জা দিচ্ছেন বলেন তো?
আমি আপনার মেয়ের জামাই,আপনার সন্তানের মতো,আমাকে আপনি নাম ধরে বলবেন,স্যার বলে ডেকে আমাকে লজ্জা দিবেন না প্লিজ।”
রশিদ সাহেব কিছুটা ইতস্তত করে বলেন,”আপনি এতো বড় একজন মানুষ,একজন রাজনীতিবিদ,ভবিষ্যতে আপনি আরো বড় পর্যায়ে যাবেন জেলার সভাপতি থেকে,আমার মতো ছাপোষা মানুষের মুখে আপনার নাম মানায় না।”
“আপনি আমার নাম ধরে না বললে আমি যে শান্তি পাবো না বাবা,আমার মনে হবে আপনি আমাকে মেনে নিতে পারেন নি বাবা,অন্য মানুষের কাছে আমি রাজনীতিবিদ হতে পারি,আপনার কাছে আপনার সন্তান হতে চাই আমি।”
গর্বে রশিদ সাহেবের বুক ভরে যায়,এরকম ভদ্র,নম্র,বিনয়ী আজকাল দেখা যায় না,যেখানে রাজনীতির সাথে জড়িত সবার চরিত্র কলুষিত সেখানে নিষাদ এক ভরসার নাম রশিদ সাহেবের কাছে,নিজের ছেলেকেও তিনি বলতেন সবসময়,মানুষ হলে নিষাদের মতো হও,যেমন মেধাবী তেমন দয়াবান।
সেই ছেলেটি আজ তার মেয়ের জামাই,কতোবড় পাওয়া এটা তার ভাবতেই আনন্দ লাগে।
ভয় ও হয় আবার রশিদ সাহেবের। চন্দ্র নিষাদের বিরোধী দল সাপোর্ট করে। সবসময় নিষাদের বিরুদ্ধে থাকে,কেমন যেনো একরোখা মেয়েটা,সবসময় নিষাদের দোষ খুঁজে বেড়ায়,নিষাদ চন্দ্রর সম্পর্ক সাপেনেউলে,এদের সংসার কি টিকবে?
নিষাদ যদি ভিতরের কোনো কোন্দল মেটানোর জন্য অথবা চন্দ্রকে শাস্তি দেয়ার জন্য বিয়ে করে তাহলে কি হবে?
করুণ চোখে তাকায় রশিদ সাহেব নিষাদের দিকে।নিষাদ রশিদ সাহেবের চোখের ভাষা বুঝতে পারে। ২হাত ধরে টেনে নেয় প্যান্ডেলের অন্যপাশে।
তারপর বলে,”আমি জানি আপনি হয়তো ভাবছেন আমি নিজের রাজনৈতিক পথ পরিস্কার রাখতে,চন্দ্রর মুখ আটকাতে ওকে বিয়ে করেছি,বাকীজীবন আপনার মেয়েকে অত্যাচার করবো তার কৃতকর্মের জন্য,আপনি ভুল বুঝবেন না আমাকে বাবা,এরকম কিছুই হবে না।
এটা শুধু মাত্র একটা চ্যালেঞ্জ ছিলো,চন্দ্রকে আমি কখনোই কোনোকিছুতে নিষেধ করবো না,ও চাইলে আগামীকাল থেকেই আমার বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশ করতে পারে,আমি ওর ব্যক্তিগত জীবনে কখনো হস্তক্ষেপ করবো না।”
বিষাদময়_নিষাদ
পর্বঃ ০১
জাহান আরা