বিষাদময়_নিষাদ
পর্বঃ ০২
জাহান আরা
চন্দ্র বিছানার একপাশে বসে আছে কাঠ হয়ে,নিষাদ ল্যাপটপে কাজ করছে।
নিষাদের রুমের দিকে ভালো করে তাকায় চন্দ্র,রুমের কোথাও কোনো অগোছালো নেই,কেমন সাজানো গোছানো শান্ত পরিবেশ।পুরো রুম গোলাপ ফুল দিয়ে সাজানো,সব সাদা গোলাপ।
বাহিরে কোকিল ডাকছে অনবরত,মেজাজ খারাপ হয়ে যায় চন্দ্রর,এই হতচ্ছাড়া কোকিল মজা নেয় তার দুরবস্থা দেখে।
খোলা জানালা দিয়ে দখিনা বাতাস আসছে,কি শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ। এই রাতটা চন্দ্রর একটা গুরুত্বপূর্ণ রাত হওয়ার কথা ছিলো অথচ চন্দ্র বসে আছে একপাশে আর নিষাদ অন্যপাশে।
ব্যাগ থেকে নিজের ফোন বের করে নেয় চন্দ্র,তারপর অনিককে কল দেয়,ভিতরের আগুন নেভে নি চন্দ্রর এখনো।আজ তার আর অনিকের বিয়ে হতো,চন্দ্র অনিকের কাছে থাকতো,তার ৪মাসের ভালোবাসা পূর্ণতা পেতো,অথচ কিছুই হয় নি।
কপালের রগ দপদপ করছে রাগে,জিদে।
এই একটা লোক তাকে সবকিছুতে টেক্কা দিয়ে যায়।সে ছাড়া সবার কাছে নিষাদ মহাপুরুষ যেনো।
অনিকের ফোন অফ।
চন্দ্র ফেসবুকে লগ ইন করে,অনিককে একটিভ পায়,সবচেয়ে বড় ধাক্কা খায় অনিকের রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস ম্যারিড দেওয়া দেখে।
মানে কি এসবের!
অনিক বিয়ে করেছে?
বুকের ভিতর প্রলয় নৃত্য শুরু হয়,চন্দ্র বুক চেপে ধরে কাত হয়ে শুয়ে পড়ে।
কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না চন্দ্রর,অনিক তাকে এতো বেশি ভালোবাসতো অথচ সেই অনিক কি-না বিয়ে করে নিয়েছে!
দ্রুত টেক্সট করে চন্দ্র অনিককে,”কেনো এরকম করেছো অনিক?”
সাথেসাথে রিপ্লে আসে অনিকের আইডি থেকে,”কেমন করেছি?”
“আমার ভালোবাসার সাথে বেঈমানী করেছো,বিয়ের কথা ছিলো আমাদের আজকে,অথচ তুমি আসো নি,আমার বিয়ে হয়েছে যাকে আমি সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি তার সাথে,কেনো এরকম নাটক করলে তুমি?
অন্তত তুমি তো জানতে আমি তোমাকে কতো ভালোবাসি অনিক।”
“তোমার ভালোবাসার মূল্য দিতেই আজ তোমার বিয়ে নিষাদের সাথে হয়েছে চন্দ্র,তুমি আসলে কাকে ভালোবাসো তাই বুঝোনি।”
“তোমাকে আমি খুন করে ফেলবো অনিক শুধু একবার সামনে পাই তোমায়।”
“চেষ্টা করে দেখতে পারো।আসছি এখন,আজ আমি ও বিয়ে করেছি,বাসর আজ আমারও।”
“একটা প্রশ্ন শুধু।”
“বলো?”
“তুমি কি আমাকে ভালোবাসো নি কখনো অনিক?
এই ৪মাসের সম্পর্কে আমার জন্য তোমার একটুও দয়া হয় নি?”
“আমার এখন গুছিয়ে বলার মতো সময় নেই চন্দ্র,একদিন সময় করে সব বলবো কেনো এরকম হলো,আজ থাকুক,গুড নাইট।”
চন্দ্র কিছু বলার আগেই অনিক চন্দ্রকে ব্লক দিয়ে দিলো।মুহুর্তেই পুরো পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেলো চন্দ্রর।অনিক তাকে ধোঁকা দিয়েছে!
বুকের ভিতর একটা চিনচিনে ব্যথা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না চন্দ্র যাকে ভালোবেসেছে সে এভাবে প্রতারণা করতে পারে তার সাথে।
চন্দ্রর মনে পড়ে যায় অনিকের কথা,ফেসবুকে কেমন হুট করে ওদের পরিচয় হয়,তারপর প্রেম।
একটা চ্যাট গ্রুপ থেকে অনিকের সাথে চন্দ্রর পরিচয় হয়,গ্রুপে সবচেয়ে বেশি কথা বলতো চন্দ্র,আর সবচেয়ে কম কথা বলতো অনিক।
গ্রুপ কলে অনিক একদিন ও কথা বলে নি সামান্য হায়,হ্যালো,হু,হা ছাড়া।
চন্দ্রর মনে পড়ে চন্দ্রর বকবকানি শুনতে শুনতে সবাই কল থেকে চলে যেতো,শুধুমাত্র মনোযোগী শ্রোতা হয়ে সব শুনতো অনিক।
বেশিরভাগ কথাই চন্দ্রর অপ্রয়োজনীয়,উদ্ভট,তাও অনিক শুনতো সব।
এই চুপচাপ থাকা ছেলেটাকে চন্দ্রর ভালো লাগতে শুরু করে,চন্দ্র নিজেই অনিকের প্রেমে পড়ে যায়।
অনিককে দেখার ও দরকার মনে করে না।
হুট করেই একদিন গ্রুপকলে সবার সামনে প্রপোজ করে বসে অনিককে চন্দ্র,সেদিন অনিক ভীষণ গম্ভীর হয়ে যায়,তারপর থমথমে গলায় বলে,”তোমার এরকম হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়া উচিৎ হয় নি চন্দ্রাবতী,বিশেষ করে আমাকে এখনো দেখোই নি তুমি,আমাকে আগে দেখো একবার। ”
সেদিনই অনিক তার ছবি পাঠায় চন্দ্রকে, ছিপছিপে গড়নের শ্যামলা ছেলেটি।চন্দ্র ভালো করে দেখেও না অনিককে,সে তো অনিকের চেহারার প্রেমে পড়ে নি,অনিকের ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়েছে।
একমাত্র অনিকই পারতো চন্দ্রকে প্রয়োজন অনুযায়ী শাসন করতে,আবার মিষ্টি করে কথা বলতে।
আকুল হয়ে প্রেম নিবেদন করে চন্দ্র অনিককে,সেদিন নিজের কাছে নিজেকেই অচেনা মনে হয়েছে চন্দ্রর,একটা ছেলেকে সে এভাবে চাইছে কেনো তা ভেবে ও অবাক হয়েছে চন্দ্র।
ফিরিয়ে দেয় নি অনিক সেদিন চন্দ্রকে,দেখা হতো খুব কম,৪মাসে ২বার দেখা করেছে দুজন।
হাজার ও স্বপ্ন দেখেছে চন্দ্র অনিককে নিয়ে,সব স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে অনিক শেষ সময়ে এসে হাত তুলে নিয়েছে সম্পর্ক থেকে।
কাকে বিশ্বাস করবে দুনিয়াতে?
সবাই তো ধোঁকা দেয়।
মাথায় যেনো আগুন জ্বলে উঠে চন্দ্রর,বিছানায় উঠে দাঁড়িয়ে টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে সব ফুল,নিষাদ তাকিয়ে থাকে চন্দ্রর দিকে।
চিৎকার করে কাঁদতে থাকে চন্দ্র,”সব মিথ্যে,সব ছলনা” চিৎকার করে বলতে থাকে চন্দ্র।
বুকের ভিতর ভীষণ জ্বালাপোড়া শুরু হয় চন্দ্রর,গতরাতে ও যেই ছেলেটা সারারাত তার সাথে চ্যাটিং করেছে,সেই ছেলেটা আজ অন্যকারো সাথে ব্যস্ত মধুর সময় কাটাতে,রোমাঞ্চ করতে।
বুকে ব্যথা শুরু হয় চন্দ্রর,ঠোঁট কামড়ে ব্যথা চাপা দেয়ার মিথ্যা চেষ্টা করে চন্দ্র।
ব্যাগ হাতড়ে দেখে স্প্রে টা রেখে এসেছে।
নিষাদের দিকে তাকায়,নিষাদ ফোন মুখের উপর নিয়ে বসে আছে।চন্দ্রর মনে হচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা বুঝি বুক ছিঁড়ে বের হয়ে আসবে,কি কষ্ট হচ্ছে তার কাকে বলবে?
এই অমানুষটা তার দিকে তাকানোর প্রয়োজন ও মনে করছে না একবার।বুকের ব্যথায় যে চন্দ্রর প্রাণ বেরর হয়ে যাওয়ার উপক্রম তাও দেখছে না এই পাষণ্ড লোক!
চন্দ্র ও ঠিক করে রাখে কিছুতেই নিষাদকে বলবে না,তাতে প্রাণ যায় তো যাক।
ফোনের ব্যাক ক্যামেরা অন করে নিষাদ চন্দ্রকে দেখছে,চন্দ্র দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে বসে আছে,কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নেয়।
বড় করে শ্বাস নিচ্ছে চন্দ্র,নিষাদ প্যান্টের পকেট থেকে স্প্রে বের করে,তারপর ছুঁড়ে মারে বিছানায়।
তারপর আবার ক্যামেরা দিয়ে চন্দ্রকে দেখে,সরাসরি চন্দ্রর দিকে তাকাতে নিষাদের কেমন যেনো বিব্রত লাগছে।
এই মেয়েটা অল্প একটু চাপ নিলেই কেমন অসুস্থ হয়ে যায় তা নিষাদের চাইতে ভালো কে জানে?
জিহবার নিচে স্প্রে করে চন্দ্র চুপ করে বসে থাকে,আস্তে আস্তে বুকের ব্যথাটা কমে আসে,চন্দ্র স্থির হয়ে বসে।তারপর আবার ফোন বের করে,নিষাদকে দেখিয়ে দেখিয়ে সেও ফোন টিপে।
হেরে যাওয়ার ব্যর্থতা চন্দ্রকে কেমন নিশ্চুপ করে দেয়।
নিষাদ এসে চন্দ্রর পাশে বসে।একটা বালিশ কোলে তুলে নিয়ে চন্দ্রকে বলে,”চন্দ্র,আমার প্রতি তোমার এতো ক্ষোভ কেনো?
আমি হাজারবার বলেছি তোমাকে,তুমি যা ভেবেছো তা আমি করি নি,তবু এরকম অহেতুক রাগ পুষে রেখে কি লাভ?
আমার বিরোধী দলে যোগদান করেছো তুমি তুচ্ছ একটা কারণে,বিষয়টা খুবই ছেলেমানুষীর হয়ে গেছে না চন্দ্র?”
চন্দ্রর চোখ বড়বড় হয়ে উঠে,দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,”তোর জন্য আমার এক্সাম খারাপ হয়েছে,আর তুই আমাকে বলছিস তুচ্ছ বিষয় এটা?
আমি ইন্টার এক্সামে ফেইল করেছি তোর কারণে,আর এখন আসছিস তুই আমার কাঁটা ঘায়ে লবণের ছিটা দিতে?”
নিষাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে,তারপর বিড়বিড় করে বলে,”এখনো বাচ্চা রয়ে গেছো তুমি,একদিন বুঝবে ঠিকই।”
তারপর পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে।
চন্দ্র বাকি রাত কাটায় জেগে থেকে,নিষাদকে সে একটুও বিশ্বাস করে না,যেকোনো সময় নিষাদ স্বামীর অধিকার দেখানোর চেষ্টা করতে পারে,এই ভয়ে চন্দ্র ঘুমাতে পারে না আর।
বারবার মনে পড়ছে চন্দ্রর অনিকের কথা,অনিক এখন কি করছে?
নতুন বউয়ের শরীরের ভাজে ভাজে ভালোবাসা ছড়িয়ে দিচ্ছে কি?
অন্যকারো চুলের ঘ্রাণে মাতাল হচ্ছে অনিক?
অন্যকারো ঠোঁটের সুধা পান করছে অনিক?
অনিক কিভাবে পারলো তাকে এভাবে ধোঁকা দিতে?
ভাবতেই চন্দ্রর চোখ জ্বালা করে,খামচে ধরে নিজের মাথার চুল,তারপর উপুড় হয়ে কাঁদতে থাকে ফুপিয়ে ফুপিয়ে।
একটা কালবৈশাখী তার জীবন এলোমেলো করে দিয়েছে।
চলবে….???