#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ১১,১২
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
১১
রাইসার রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে আসছিলাম আমি। বিদায়ের বেশি সময় নেই। এর মধ্যেই পূর্ণ ভাইয়াকে ধন্যবাদ জানাতে হবে। যদিও কিভাবে উনার সাথে কথা শুরু করবো তা এখনো ভাবিনি কিন্তু এটা নিশ্চিত যে আজকে উনার সাথে কথা বলতেই হবে আমার! কারণ এতকিছুর পরেও আজ উনাকে একটা ধন্যবাদ না দিলে এটা ভীষণ রকমের অনুচিত একটা কাজ হবে!!
পথিমধ্যে এক পাশে রাখা আমার কাপড়ের ব্যাগ দেখে ভাবনাচ্ছেদ হলো আমার! হঠাৎ মনে পড়লো আমি তো এই বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আবেগের বশে তখন ডিসিশন নিলেও ঠিক কোথায় যেয়ে কার বাসায় উঠতাম বিষয়টা ভাবিনি আমি। উঠবোই বা কোথায়? এই নিষ্ঠুর দুনিয়ায় আমার আছেই বা কে? যদিও এই বাসায় থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার মধ্যে এখন আর অবশিষ্ট নেই, তাই কিছুক্ষণ ভেবে ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিলাম যে উচ্চ-মাধ্যমিক রেজাল্টের পর ভার্সিটির কোচিং করার বাহানায় একবারে চলে যাবো এই বাড়ি ছেড়ে। এটা ছাড়া আপাতত হাতে উপায়ও নেই! দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলাম আমি। আজ যদি আমার নিজের পরিবার থাকতো তবে এতটা অসহায়ভাবে দিন কাটাতে হতোনা আমার! এত অপমান-লাঞ্চনার পরেও পড়ে থাকতো হতো না এখানে।
আজকের ঘটনা আমায় হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দিলো এই সমাজে একা টিকে থাকা কতটা কঠিন! পাশে যদি ফ্যামিলি সাপোর্ট না থাকে তবে মানুষ যতই ভালো হয়ে থাকুক না কেন, তাকে আঘাত করতে দুইবার ভাববে না মানুষ! ছোটবেলায় পরিবারের সাথের স্মৃতি তেমন একটা মনেও নেই আমার। আবছা আবছা মনে পড়ে আমার আব্বুর সাথে তার পরিবারের সম্পর্ক তেমন ভালো ছিলোনা। বাকি পরিবার যৌথভাবে অন্য জায়গায় থাকতেন আর আমি,আব্বু, আম্মু আলাদাভাবে থাকতাম ঢাকায়। শুধুমাত্র ঈদেই আমাদের দেখা হতো। সেই ঈদের এক-দুই দিন বছরের শ্রেষ্ঠ দিন হতো আমাদের কাছে! সকল ছোট-বড় কাজিনরা মিলে বেশ মজা করতাম আমরা। অথচ আফসোস, সময়ের পরিক্রমায় জীবনের কঠোর বাস্তবতায় এখন সেইসব কাজিনদের চেহারা তো দুরের কথা বেশিরভাগের নামও ভুলে গেছি আমি। অবশ্য অস্পষ্টভাবে মনে আছে একজনের নাম, যিনি প্রত্যেকবার আমার জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে চকলেট নিয়ে আসতেন। তাজওয়ার ভাইয়া! সবগুলো কাজিনদের মধ্যে তার সাথেই আমার বেশি খাতির ছিলো। ছোটবেলায় সবাইকে বোকার মতো বলতাম উনাকে বিয়ে করবো আমি। হাহাহা! ছোটবেলার আবছা কিছু স্মৃতি তাও কত মজার ছিলো!
আর এখন ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে তো তার কথা ভুলেই গিয়েছি আমি! এতবছর পর আজ হঠাৎ উনার কথা মনে পড়ায় উদাসীন হয়ে গেলাম আমি! না জানি এখন তিনি কই আছেন, কেমন আছেন? হয়তো বা বিয়েশাদিও করে ফেলেছেন এতদিনে! হতেই পারে, অসম্ভব কিছুই নয়। হওয়াটাই স্বাভাবিক। কোনদিন কি আমার আর দেখা হবে নিজের পরিবারের সাথে? হলেও তারা কি আমাকে মনে রাখবে?
পরিবারের কথা ভাবতে ভাবতে চোখ ঝাপসা হয়ে গেলো। নাহ, এখন এসব ভেবে লাভ নেই! তাই এগুলো চিন্তা-ভাবনা মাথায় থেকে ঝেড়ে ফেলে মাটি থেকে ব্যাগ হাতে নিয়ে রুমে রেখে আসতে যাচ্ছিলাম। তারপর পূর্ণ ভাইয়ার কাছে যাবো। রুমের ঠিক কাছে পৌঁছাতেই দেখি পূর্ণ ভাইয়া ফোনে কথা বলতে বলতে এদিকেই আসছেন। উনাকে দেখেই তড়িঘড়ি করে হাত থেকে ব্যাগ রেখে উনার সামনে গিয়ে দাড়ালাম। উনি ফোন কানে নিয়েই ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকালেন। উনার এভাবে তাকানো দেখে কি বলতে এসেছিলাম তা ভুলে গেলাম আমি।
জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে উনাকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য প্রস্তুতি নিলাম৷ এদিকে আমার কাছে থেকে কোন কথা না শুনে উনি আমাকে সাইড দিয়ে চলে যেতে লাগলেন। তার চলে যাওয়া দেখে বোকা বনে গেলাম আমি। এত কিসের তাড়া উনার? ১ মিনিট দেরি করা যায়না? আজব তো!! তাই উনার পিছে পিছে গিয়ে আর অপেক্ষা না করে বলেই ফেললাম শেষমেষ,
—থ্যাংক ইউ, পূর্ণ ভাইয়া।
আমার কণ্ঠ শুনে উনি এবার পিছনে ফিরে তাকালেন। কান থেকে ফোন পকেটে রেখে ঘুরে দাড়ালেন আমার দিকে। দু হাত বুকের সাথে ভাজ করে ভ্রু তুলে যেন ইশারা করলেন কি জন্য ধন্যবাদ দিলাম উনাকে। আমি ইতস্ততভাবে বললাম,
—ওই যে আমার আর রায়হান ভাইয়ার ব্যাপারটা সবার সামনে আনতে সাহায্য করেছেন এইজন্য…
—তোমাকে কে বলেছে এটা?
আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে উনি গম্ভীর গলায় বললেন। তার মুখ দেখে মনে হলো তিনি যেন চাচ্ছিলেন না আমি জানি এই সম্পর্কে।
—প্রিয়া বলেছে। (ধীর গলায় জবাব দিলাম আমি)
আমার কথা শুনে পূর্ণ ভাইয়া এমনভাবে বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুচকে ফেললেন যেন প্রিয়া আমাকে কথাটা বলে মহা অপরাধ করে ফেলেছে। উনার রিয়েকশন দেখে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলাম আমি। লোকটার আচরণ এত অদ্ভুত কেন? তিনি উপকার করেছেন এটা প্রিয়া আমাকে জানাতেই পারে। এই ছোট একটি বিষয়ে এত অস্বস্তিতে পড়ার কি আছে?
নিরবতা ভেঙে আমি বললাম,
—তো যা বলছিলাম। আপনি উপকার করেছেন তাই আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
হালকা হেসে বললাম আমি। উনি শুধু একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন আমার দিকে। এবারো তার উওর না পেয়ে হতাশ হয়ে চলে যাচ্ছিলাম আমি। পাশে থেকে ব্যাগ তুলে নিতেই উনার আওয়াজে থেমে গেলাম আমি,
—এই ব্যাগটা কার?
—আ-আমার।
পিছন ফিরে আস্তে করে বললাম আমি। আমার কথা শুনে উনি এগিয়ে আসতে লাগলেন আমার দিকে। তার এগিয়ে আসা দেখে অবাক হয়ে চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকলাম আমি। কিন্তু তিনি থামলেন না। উনার সাথে তাল মিলিয়ে পিছিয়ে গেলাম আমি, হাত থেকে মাটিতে পড়ে গেলো ব্যাগ। ঠিক তখন উনি থামলেন। ব্যাগটা এক হাতে তুলে আবার মাটিতে রেখে দিলেন উনি। তার কাজকর্ম বোকার মতো চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলাম আমি। এই লোকের মতিগতি আমার দ্বারা কখনোই বুঝা সম্ভব নাহ!
—ব্যাগের ওজন দেখে তো মনে হচ্ছে পুরো আলমারি তুলে নিয়ে যাচ্ছো। বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছিলে বুঝি?
এক ভ্রু তুলে জিজ্ঞেস করলেন উনি। তার প্রশ্ন শুনে হকচকিয়ে গেলাম আমি! বাপরে, লোকটা তো ভীষণ চালাক! তবে উনার প্রশ্নের কোন উত্তর দিলাম না আমি, মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম! উনি আমার কথার কোন জবাব দেন না তাহলে আমি কেন দিবো? আমাকে চুপ থাকতে দেখে উনি শক্ত গলায় বললেন,
—নিজের উপর এত বড় অপবাদ নিয়ে পালিয়ে যেতে লজ্জা লাগলোনা তোমার?
এবার উনার কথা শুনে মাথা তুলে তাকালাম আমি। এভাবে বলতে পারলেন উনি আমায়? আমি কি খুব শখ করে পালাচ্ছিলাম? মুহুর্তেই মনের ভেতরের অভিমানগুলো যেন চাঙা হয়ে উঠলো আমার! তাই উনার দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,
—আমি কি শখের বশে পালাচ্ছিলাম নাকি বলুন? যাদের বাসায় এতদিন থাকলাম, যারা আমাকে এত ভালো করে চিনে তারাও আমাকে ভুল বুঝলো, একটাবার আমার পক্ষে কোন কথা বললোনা তাদের সাথে আমি কিভাবে থাকবো? আমার কি চলে যাওয়া উচিত না?
প্রচন্ড অভিমানে কথাগুলো বলতে বলতে এক পর্যায়ে কাদতে শুরু করলাম আমি। আমার কান্না দেখে শান্তচোখে চেয়ে আছেন উনি। কিছুক্ষণ পর ইষৎ নরম সুরে বললেন,
—দেখো, আমি বুঝতে পারছি এইরকম পরিস্থিতিতে পড়লে যে কারোই কস্ট লাগবে। হয়তো তোমার অভিমানটা খুব বেশি কিন্তু শুধুমাত্র দাদির কথা শুনে বাকি সবার প্রতি একি ধারণা রাখা তোমার উচিত হয়নি।
উনার কথায় কিছু না বুঝে পিটপিট করে চেয়ে রইলাম আমি। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বললাম,
—মানে?
উনি ছোট একটি শ্বাস ফেলে বললেন,
—সবাই তোমাকে অবিশ্বাস করেনি। তুমি রুমে চলে যাওয়ার পর রাইসা এসে ওই মহিলাগুলোর সাথে ঝগড়া করেছে, ওর সাথে সায় দিয়েছেন আন্টিও। দাদি বাদে তোমার পরিবারের সবাই তোমার পক্ষে কথা বলছিলো কিন্তু তুমি এসব না জেনেই চোরের মতো পালিয়ে যেতে চাইছিলে? একবার ভেবেছো রাইসা যদি সঠিক সময়ে এসে তোমাকে ডেকে না নিয়ে যেত তবে কি হতো? আমাদের এত প্ল্যান সব নস্ট হয়ে যেতো। তখন মানুষ তোমাকে নিয়ে কথা বলার আরও সুযোগ পেতো যে নিশ্চয়ই তুমি অপরাধী যার কারণে তুমি এভাবে পালিয়ে গেছো।
পূর্ণ ভাইয়ার কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকলাম আমি। তাই তো! এভাবে তো ভেবে দেখিনি আমি!! পুরো বিষয় সম্পর্কে না জেনে বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়তো ঠিক ছিলো না আমার। কিন্তু আমার কাছে তো কোন প্রমাণও ছিলো না যে আমি নিজের নির্দোষিতা সবার সামনে তুলে ধরবো। তাই ধরা গলায় করুণ চোখে উনাকে বললাম,
—কিন্তু আমার কাছে তো কোন প্রমান ছিলো না আর আমি কি করবো বুঝতে পাচ্ছিলাম না। এজন্যই নিজের আত্মসম্মান রক্ষার্থে বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছিলাম।
উনি আমার কথা শুনে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন চুপচাপ। তারপর বললেন,
—নিজের জন্য স্ট্যান্ড নিতে শেখো, স্টুপিড। আর কি বললে তুমি? আত্মসম্মান? যে ব্যক্তির আত্মসম্মান এত প্রখর সে নিজের পক্ষে একাই কথা বলতে পারে অন্যের সামনে। তুমি বাড়ি ছেড়ে যেতে চাইছিলে ভালো কথা তবে চোরের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে কেন? সবার সামনে যেয়ে নিজের জন্য স্ট্যান্ড নিয়ে তোমার শক্ত ব্যক্তিত্বের পরিচয় দেখিয়ে দিয়ে যেতে পারতে? তবে কেউ তোমার বিরুদ্ধে কিছু বলার সাহস পেতোনা। তুমি এমন ভয়ে ভয়ে থাকো আর বোকার মতো কাজ করো বলেই মানুষ তোমার বিরুদ্ধে কথা বলার সুযোগ পেয়েছে, বুঝেছো?
এক নিশ্বাসে এত্তগুলো কথা বলে চুপ হয়ে গেলেন উনি। এদিকে তার কথা শুনে, তার কথার পেছনের লজিক দেখে অবাক হয়ে গেলাম আমি। আসলেই নিজের জন্য স্ট্যান্ড নেওয়া উচিত ছিলো আমার। লুকিয়ে লুকিয়ে পালানো ঠিক হয়নি। তাতে সবাই আরও দোষ দিতো আমায়! বাড়ি ছেড়ে যদি যেতেই হয় তবে সবার সামনে দিয়ে সবাইকে বলেই যাবো মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাকে সঠিকভাবে বুঝানোর জন্য পূর্ণ ভাইয়ার প্রতি আরেকবার কৃতজ্ঞ হয়ে উঠলো মন।
তবে এবার আর ধন্যবাদ দেওয়ার সুযোগ হলো না কারণ আমি কিছু বলার আগেই প্রিয়া দৌড়ে এসে বলতে লাগলো বিদায়ের সময় এসে গেছে। তাড়াতাড়ি যেতে হবে।
__________
অশ্রুসিক্ত নয়নে রাইসাকে বিদায় দিলাম সবাই। কেদেকেটে সবার খারাপ অবস্থা৷ রাইসার জন্য মন খারাপ হলেও অদ্ভুতভাবে আমার তেমন মন খারাপ হচ্ছেনা। একটু আগ পর্যন্ত মনের মধ্যে যত অশান্তি ছিলো সব যেন মিলিয়ে হালকা হয়ে গেছে মন। আকাশে তাকিয়ে দেখি পূর্নিমার চাদ উঠেছে। তার আলোয় আলোকিত হয়েছে পুরো আকাশ। ঠিক যেমনি পূর্ণ ভাইয়ার কথায় আজ আলোকিত হয়েছে আমার সমগ্র মন!
#চলবে
#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ১২
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
শ্রাবণের মেঘগুলো কয়েকদিনের বর্ষণে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছে। পুরো আকাশেজুড়ে আজ রোদকন্যার বিচরণ। পর্দার আড়াল থেকে রোদের আলো এসে পড়তেই কুচকে গেলো আমার চোখ। হাত আওড়ে বালিশের পাশ থেকে ফোন চালু করতেই নিমিষেই ঘুম কেটে গেলো আমার! সকাল ৯.৩০ টা বাজে। কাল রাতে বিদায়ের পর বেশ তাড়াতাড়িই ঘুমিয়েছিলাম। সারাদিনের ধকলে বিছানায় গা এলিয়েই রাজ্যের ঘুম চোখ এসেছিলো। ফোন রেখে আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে নামলাম আমি। ফ্রেশ হয়ে আস্তেধীরে নিজের রুম থেকে বের হলাম।
বাহিরে এসে দেখলাম আন্টি ডাইনিং টেবিলে খাবার রাখছিলেন। তাকে এসময় খাবার রাখতে দেখে অবাক হয়ে গেলাম আমি। কেউ কি খায়নি এখনও? সবাই কি আমার মতোই দেরি করে উঠেছে আজ? ভাবতে ভাবতে এগিয়ে গেলাম ডাইনিং এর দিকে। আমাকে আসতে দেখে আন্টি বললেন,
—আরে তুরফা, তুই উঠে গেছিস মা? আমি তোকেই ডাকতে যাচ্ছিলাম এখনি।
—তোমরা কেউ এখনও খাওনি, আন্টি? সবাই কি আজকে লেট করে উঠেছে আমার মতো?
—না রে। সবাই আগেই উঠেছে। খাওয়া-দাওয়াও শেষ। তুই বাকি আছিস এখন। আমি ইচ্ছা করেই ডাকিনি তোকে। তোর জন্য নাস্তা রেখেই ডাকতে যাচ্ছিলাম আমি তোকে। আয় এখন খেতে বস। অনেক লেট হয়ে গেছে।
মাথা নেড়ে চুপচাপ খেতে বসলাম আমি। খাওয়ার মাঝখানে আন্টির থেকে জানলাম আংকেল আর রায়হান ভাইয়া কোন একটা কাজে বাহিরে গেছেন। তারা রাতে বাসায় আসবেন। দাদি বাজার করতে গেছেন, কালকে রাইসার শশুরবাড়ির লোকজনকে বিয়ের পর প্রথম দাওয়াত দেওয়া হবে এ বাসা থেকে। এজন্য দাদি নিজ হাতে বাজার করতে গেছেন সব। খেতে খেতে এসব শুনছিলাম ঠিক তখনি আন্টি বলে উঠলেন,
—একটু পর রাইসার শশুড়বাড়ি যাবো আমি। সাথে কিন্তু তোকেও যেতে হবে।
রাইসার শশুড়বাড়ি যাওয়ার কথা শুনে আমার গলায় খাবার আটকে গেলো। আন্টি আমাকে পানি এগিয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
—আস্তে খা। এখনি যেতে বলছি না তোকে। ধীরে সুস্থে খেয়েই যাবি। চিন্তা করিস না।
আন্টির কথা শুনে আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম। না জানি কি ভাবলেন উনি। ছিঃ!!
—আন্টি আমি যাবোনা প্লিজ। তুমিই যাও। আমার ওখানে গিয়ে কোন কাজ নেই আর আমার ভালোও লাগছেনা। আমি আমার রুমেই থাকতে চাই।
ইতস্ততভাবে অন্যদিক তাকিয়ে বললাম আমি। আমার কথা শুনে আন্টি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
—দেখ মা, আমি জানি কালকের ঘটনার জন্য মনে অনেক কস্ট পেয়েছিস তুই। এজন্যই একা থাকতে চাচ্ছিস। জানি এটা স্বাভাবিক কিন্তু বিশ্বাস কর আমরা কেউ তোকে অবিশ্বাস করিনি। রায়হানের কথা শুনেই আমি বুঝেছি এটা একটা দূর্ঘটনা ছিলো মাত্র, কারণ তোকে ছোট থেকেই চোখের সামনে মানুষ হতে দেখেছি আমি। তুই কখনোই এমনটা করতে পারিস না। আর তুই তো জানিসই আমার শাশুড়ি কিরকম, উনি মানুষের কথায় তোকে ভালোমন্দ বললেও আমরা কেউ তার কথা গায়ে মাখিনি কারণ সবাই জানে উনার স্বভাবটাই এইরকম। তাই এটা নিয়ে আর মন খারাপ করিস না প্লিজ। বিশ্বাস কর তোকে এভাবে দেখতে আমার একটুও ভালো লাগছেনা।
আন্টির কথা শুনে আমি তার দিকে তাকালাম। তার কথার সত্যতা তার চোখের দিকে তাকালেই স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। অবিশ্বাস করার কোন উপায় নেই। মনে হয় যেন এখনি কেদে দিবেন। তাই হালকা হেসে উনাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
—খারাপ আমার অবশ্যই লেগেছে আন্টি কিন্তু আমি মানুষের উপর রাগ করলেও তোমাদের উপর করতে পারবোনা। আমি বিশ্বাদ করলাম তোমরা আমার পক্ষেই ছিলে।
আমার কথায় আন্টির মুখে হাসি ফুটলো। পরম মমতায় মাথা বুলিয়ে দিলেন উনি আমার। তারপর রাইসার শশুড়বাড়ি যাওয়ার জন্য জোর করতে লাগলেন। মেয়ের শশুড়বাড়ি একা একা যেতে উনার ভালো লাগবেনা, দাওয়াতটা নিজ মুখে দিতে চান বলেই তার যাওয়া নয়তো উনারও যাওয়ার ইচ্ছা ছিলোনা শুনলাম। বড়মানুষ এতক্ষণ ধরে সামান্য একটা বিষয়ে অনুরোধ করছেন দেখে সেটা আর ফেলতে পারলাম না আমি। অবশেষে রাজি হলাম তার সাথে প্রান্ত ভাইয়াদের বাসায় যেতে।
__________
চৌধুরী ভিলা। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি আন্টির সাথে। দাড়োয়ান আমাদের দেখে সালাম দিয়ে হাসিমুখে খুলে দিলেন গেইট। আস্তেধীরেই আন্টির সাথে ভেতরে প্রবেশ করলাম আমি। ভেতরে ঢুকে গ্যারেজ পার হয়ে সামনে এগোতেই এক পাশে ছোট্ট একটা বাগান দেখলাম। রং-বেরঙের সুন্দর সুন্দর ফুল ও মানিপ্ল্যান্ট গাছ লাগানো। পাশে একটি বেঞ্চের মতো আছে বসার জন্য। হয়তো বাগানে এলে এখানে বসে গল্প করে সবাই, ভাবলাম আমি। বাগান পেরিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতেই তাদের ডু-প্লেক্স বাড়িতে ঢুকলাম আমরা। সিড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে চারদিক দেখছিলাম। পুরো বাসাতেই রুচিশীলতার ছাপ স্পষ্ট। বেশ ভালো পরিবারেই বিয়ে হয়েছে রাইসার, খুশিমনে ভাবলাম আমি।
আন্টি কলিংবেল চাপতেই আমাদের জন্য গেইট খুলে দিলেন প্রান্ত ভাইয়ার মা। হাসিমুখে আমাদের ভেতরে আসার আমন্ত্রণ জানালেন উনি। আমরাও সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। ড্রয়িংরুমে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসতে বললেন আমাদের। সাথে তিনিও বসলেন। কিছুক্ষণ গল্প-গুজব করতেই রাইসা এলো আমাদের কাছে। মেরুন রঙের শাড়ি পরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে ওকে পুরো নতুন বউ নতুন বউ লাগছে। লাজুক হেসে আমাদের সাথে বসলো ও। আন্টির থেকে শুনলাম আংকেল অফিসে গেছেন, তাহলে অবশ্যই পূর্ণ ভাইয়াও গেছেন মনে মনে ভাবলাম আমি।
প্রান্ত ভাইয়াও এলেন একটু পরে। সালাম দিলেন আন্টিকে। কিছুক্ষণ সবার সাথে কথা-বার্তা বলে কালকে বাসায় দাওয়াত দিয়ে আন্টি চলে যেতে চাইলেন কিন্তু প্রান্ত ভাইয়ার মা কিছুতেই যেতে দিবেন না আমাদের। তার কথা, বেয়াইনরা প্রথমদিন বিয়ের পর বাড়ি এসেছে না খেয়ে তিনি যেতে দিতে পারবেন না। অবশেষে তার জেদের কাছে হেরে রাজি হলেন আন্টি, থাকতে হলো আমাকেও।
আন্টিরা গল্প করছিলেন নিজেদের মধ্যে, প্রান্ত ভাইয়াও রুমে চলে গেলেন তখন রাইসা আমাকে বললো ওর শশুড়বাড়ি ঘুরে দেখাবে। বসে বসে এমনিতেও বোর হচ্ছিলাম তাই ওর কথায় রাজি হলাম আমি। যদিও রাইসা নিজেও ঠিকমতো চেনেনা কারণ ও মাত্র নতুন বউ তাও দুইজন মিলে ঘুরে ঘুরেই দেখছিলাম সব। ডু-প্লেক্স এর সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে ঘুরছিলাম আমরা। তখনি প্রান্ত ভাইয়ার কল এলো রাইসার ফোনে, ভাইয়া ওকে নিচে ওদের রুমে ডাকছে। কোন একটা কাজ আছে তার। রাইসা আমাকে উপরে ঘুরতে বলে বললো ও দুই মিনিটেই আসবে। আমিও চুপচাপ মাথা নাড়লাম।
রাইসা চলে যাওয়ার পর একাই দোতলায় ঘুরতে লাগলাম আমি। দেয়ালে বিভিন্ন পেইন্টিং, দেয়ালের পাশে ফুলদানি দেখতে দেখতে হেটে যাচ্ছিলাম। কোণার একটা রুমের সামনে দিয়ে যেতেই রুম খোলার আওয়াজে ভড়কে গেলাম আমি। সবাই তো নিচে, তাহলে এখানে কে? আমার ভাবনা-চিন্তার মধ্যেই হঠাৎ রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন পূর্ণ ভাইয়া। উনাকে এই মুহুর্তে এখানে আশা করিনি আমি তাই চমকে উঠে বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকলাম তার দিকে। উনাকে দেখে মনে হলো যেন সদ্য ঘুম থেকে উঠেছেন! তার মানে অফিস যান নি উনি আজকে!
গাঢ় ধূসর রং এর গেঞ্জির সাথে কালো ট্রাউজার পড়নে উনার, সাথে ফোলা ফোলা চোখ। দেখে মনে হলো এখনও যেন ঘুমের রেশটুকু ঠিকমতো কাটেনি তার। আমাকে তার সামনে দেখে কিছুক্ষণ ভ্রু কুচকে ঘুমু ঘুমু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন উনি। তারপর আবার স্বাভাবিকভাবেই আমাকে ইগ্নোর করে অন্যদিকে চলে গেলেন। উনার চলে যাওয়ার দিকে বোকার মতো গোলগোল চোখে তাকিয়ে থাকলাম আমি! আজব তো! জলজ্যান্ত একটা মানুষ প্রথমবার তার বাসায় এসেছে, মানুষ তো মুখের কথাও কিছু একটা বলে নাকি?? আমাকে নিজের সামনে দেখেও এরকম করে চলে গেলো কেন উনি?
গাল ফুলিয়ে ভাবতে থাকলাম আমি।
আমার ভাবনার মধ্যেই রাইসা চলে এলো। পূর্ণ ভাইয়াকে যেতে দেখে বললো এদিকে মনে হয় উনার রুম। আমি কিছু না বলে মাথা নাড়লাম শুধু। আরও কিছুক্ষণ উপরে ঘুরে নিচে নেমে গেলাম আমরা দুজন। নিচে নেমে ড্রয়িংরুমে আসতেই সবাইকে বসা দেখলাম। পূর্ণ ভাইয়াও বসে ছিলেন ওখানে। আমাকে দেখে এমনভাবে চোখ বড় করে তাকিয়ে আছেন যেন এইমাত্র বাসায় দেখলেন আমাকে! এই লোকটার কোন রিয়েকশনের আগা-মাথা সত্যিই কিছু বুঝিনা আমি!!
উনার তাকিয়ে থাকা দেখে আমার অদ্ভুত লাগছিলো তাই আমি পানি খাওয়ার বাহানায় উঠে এলাম ড্রয়িংরুম থেকে। একগ্লাস পানি খেতেই আমার পিছনে এসে দাড়ালেন পূর্ণ ভাইয়া। তাকে হঠাৎ এভাবে নিজের পেছনে দেখে গলায় পানি আটকে গেলো আমার। আজকে বুঝি গলায় খাবার আটকানোর দিবস আমার! সকাল থেকে তাই হচ্ছে!! কোনরকম কাশতেই উনি অবাক চোখ মাথায় হাত দিয়ে থামানোর চেস্টা করলেন আমায়। আড়চোখে উনাকে পর্যবেক্ষণ করলাম আমি। আমি স্বাভাবিক হতেই দূরে সরে গেলেন তিনি। তারপর বরাবরের মতোই গম্ভীর আওয়াজে বললেন,
—একটু আগে কি তুমি দোতলায় গিয়েছিলে?
উনার প্রশ্ন শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম। বলে কি লোকটা? আমি যাবো না তো কি আমার ভুত যাবে? বিরক্ত হয়ে উনাকে বললাম,
—তো আপনার কি মনে হয় আপনি আমাকে স্বপ্নে দেখেছিলেন তখন? (চোখ পাকিয়ে)
তবে আমার কথায় উনার ভাবমূর্তির তেমন পরিবর্তন হলোনা। শুধু এক ভ্রু তুলে তাকিয়ে থাকলেন একদৃষ্টিতে আমার দিকে। এরপর বরাবরের মতোই কিছু না বলে হনহন করে হেটে গেলেন দোতলায়। আমিও উনার আচরণকে আর পাত্তা না দিয়ে চলে এলাম ড্রয়িংরুমে। এতদিনে উনার এসব অদ্ভুত ব্যবহারের অভ্যাস হয়ে গেছে আমার, তাই এখন আর বেশি অবাকও হইনা!
_________
প্রান্ত ভাইয়ার বাবা এসেছিলেন বাসায় দুপুরে। তারপর সকলে মিলে একসাথে দুপুরের খাবার খেয়ে উনাদের বাসার সবাইকে দাওয়াত দিয়ে আন্টির সাথে চলে আসছিলাম আমি। যাওয়ার আগ মুহুর্তে প্রান্ত ভাইয়ার বাবা আন্টিকে বললেন,
—কাল দাওয়াত হওয়ায় এক হিসেবে ভালোই হয়েছে, ভাবী। কালকে আমরা এমনিতেও একবার যেতে চেয়েছিলাম আপনাদের বাসায়।
—অবশ্যই আসবেন, ভাই। শুনে খুশি হলাম। তবে কোন কাজ ছিলো কি?
জিজ্ঞেস করলেন আন্টি।
—কাজ তো না তবে একটা কথা ছিলো যেটা না হয় কালকেই আলোচনা হবে।
আংকেল এর কথায় মাথা নেড়ে সায় দিলেন রাইসার মা। তারপর সেখান থেকে চলে এলাম আমরা। বাসায় যেতে যেতে ভাবতে লাগলাম আমি যে কি এমন আলোচনা করার জন্য কাল বাসায় আসতে চাইছিলেন তারা!
#চলবে