#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ১৩,১৪
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
১৩
রাত পেরিয়ে শুরু হলো সকাল। সেই সাথে শুরু হলো বাড়িভর্তি সমগ্র মানুষের ব্যস্ততা! আন্টি সকাল থেকে রান্নাঘরে রান্না করছেন আর একটু পর পর একটা করে আইটেম বানিয়ে আংকেল বা রায়হান ভাইয়াকে খাইয়ে টেস্ট করে নিচ্ছেন যে কেমন হয়েছে! আমিও টুকটাক সাহায্য করছিলাম আন্টিকে। আর দাদি বরাবরের মতোই বসে বসে তদারকি করছিলেন সবকিছুর। সবাই মিলে ঘর গুছিয়ে সবকিছু রেডি করে নিজেরা গোসল করে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম।
এখন আর তেমন কাজ বাকি নেই, শুধু রাইসার শশশুড়বাড়ির লোকজনদের আসার অপেক্ষা!
দুপুর হতেই আমাদের বাসায় পৌঁছে গেলেন প্রান্ত ভাইয়ার পরিবার। গেইট খুলে সবাইকে হাসিমুখে বরণ করলেন আংকেল-আন্টি। ছোট বড় সবাই মিলে কিছুক্ষণ আড্ডা হলো। তারপর খাবার খেতে বসলেন সবাই। খাওয়া শেষে রেস্ট নিয়ে আরও কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে গলা ঝেড়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন পূর্ণ ভাইয়ার বাবা। হাসিখুশি পরিবেশ হঠাৎ করেই গম্ভীর হয়ে গেলো। সবাই মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থাকলেন উনার দিকে।
—দেখুন বেয়াইন, এখন যে কথাটা বলতে যাচ্ছি এটা একটু গুরুত্বপূর্ণ।
“গুরুত্বপূর্ণ” শুনে সবাই একটু নড়েচড়ে বসলো। আমিও কান পেতে রইলাম আংকেল কি বলেন শুনার জন্য। জানার আগ্রহ তো আমার কাল থেকেই হচ্ছিলো! শুনলাম আংকেল বলছেন,
—আপনাদের সাথে তো এখন আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক। এখানে তো লুকোনোর কিছু নেই তাইনা?
—জি ভাই। কি হয়েছে বলেন।
—আপনাদের সম্পর্কে সব জেনেশুনেই আমরা বিয়ের ব্যাপারে অগ্রসর হয়েছি। আপনারা ফ্যামিলি ভালো, কালচার আমাদের সাথে মিলে। তবে আপনাদের একটা বিষয়ে আমরা এখনও স্পষ্টভাবে কিছু জানিনা।
আংকেল এর কথায় ভ্রু কুচকে গেলো সবার। কি এমন কথা তাদের বলা হয়নি? রাইসার বাবা একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলেন,
—বলছেন কি ভাই? কি এমন বিষয় আছে যেটা আপনারা জানেন না? আমাদের বলুন। আশা করছি কিছু গোপন রাখবো নাহ।
—আপনাদের বাসার সবার সম্পর্কেই আমরা জানি কিন্তু তুরফা মামনির ব্যাপারে তো কিছু জানিনা। সেদিন ইংগেজমেন্ট এর দিন ভাবীকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম কিন্তু কথা শেষ হওয়ার আগেই থেমে যেতে হয়েছিলো তাই শুনতে পারিনি আর!
হঠাৎ করে আলোচনার মধ্যে আমার নাম আসায় চমকে উঠে তাকাই আমি। খেয়াল করি ইতোমধ্যে সবাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে! বেশ অসস্তি হচ্ছে আমার এমন পরিস্থিতিতে। মনে মনে ভাবলাম আংকেল এর আবার কি দরকার পড়লো আমার কথা শুনার। আমাকে আলোচনা থেকে দূরে রাখলেই কি নয়? তবুও জানার আগ্রহ আমার পিছু ছাড়ছিলো না তাই চুপচাপ শ্বাস আটকে পরবর্তী কথাগুলো শুনার অপেক্ষা করতে লাগলাম আমি।
—তুরফা আমাদের সাথে ছোট থেকেই থাকে। ও আমার নিজের রক্তসম্পর্কের কেউ না হলেও আমার কাছে কোন অংশেই সে রাইসার থেকে কম নয়। তুরফা আমার মেয়ের মতোই বলতে পারেন।
আস্তেধীরে বললেন আন্টি। তার কথায় যেন কৌতুহল বেড়ে গেলো পূর্ণ ভাইয়ার পরিবারের। পূর্ণ ভাইয়ার মা জিজ্ঞেস করলেন,
—আচ্ছা বেয়াইন, তুরফার পরিবার কোথায়? আর বললেন যে ও ছোট থেকেই আপনাদের সাথে থাকে। এর মানে? ওর পরিবারে কি কেউ নেই??
নিজের পরিবারের কথায় মনটা খারাপ হয়ে গেলো আমার। না জানি আর কতবার এই কথাটা শুনতে হবে? যারাই শুনে আমি আন্টির নিজের মেয়ে না তারা সবাই এসব প্রশ্ন করে আমাকে ও আমার পরিবারকে নিয়ে! পূর্ণ ভাইয়ার মায়ের কথায় আন্টি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সব বলতে লাগলেন। আর যতই হোক মেয়ের শশুড়বাড়ীর লোকজন বলে কথা! তাদের থেকে এই মুহুর্তে কিছু লুকানো ঠিক হবেনা।
—তুরফা আমার বান্ধবীর মেয়ে। অবশ্য শুধু বান্ধবী বললে ভুল হবে আমার সবচেয়ে কাছের মানুষদের মধ্যে একজন ছিলো ওর মা। ওর বাবাও ছিলেন অমায়িক একজন মানুষ। রাইসার বাবার ব্যবসা দাড় করাতে খুব সাহায্য করেছিলেন ভাই। দিনকাল ভালোই যাচ্ছিলো। কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। তুরফা আমাদের বাসায় রাইসার সাথে খেলতে এসেছিলো। ওকে নিতে এখানে আসছিলো ওর মা-বাবা। পথিমধ্যেই সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন উনারা। রাস্তার মানুষ ওর মায়ের ফোন থেকে আমাদের ফোন দিলে আমরা তৎক্ষণাৎ ছুটে যাই। কিন্তু আমরা যতক্ষণে হসপিটালে পৌঁছাই তুরফার বাবা ইতিমধ্যেই পরলোক গমন করেছিলেন। ওর মায়ের অবস্থাও ছিলো খুব খারাপ। ওটিতে নিয়ে যাওয়ার আগে বারবার আমার হাত ধরে বলছিলো ওর কিছু হলে যেন আমি তুরফাকে দেখে রাখি, ওকে আমার সাথে করে নিয়ে যাই। কারণ তুরফার দাদারবাড়ির লোকজনদের সাথে ওর মা-বাবার সম্পর্ক তেমন ভালো ছিলোনা। তাছাড়া আমরাও ওর পরিবারের কারও কথা জানতাম না এজন্য ওর মা-বাবার মৃতুর পর তুরফাকে আমাদের সাথেই নিয়ে আসি। রাইসা আর তুরফা প্রায় সমবয়সী হওয়ায় ওকেও রাইসার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেই। এভাবেই চলছে সবকিছু তখন থেকে।
এতদিন পর আমার অতীত সম্পর্কে সবকিছু শুনে আমি আর ধরে রাখতে পারলাম না আজ নিজেকে। ঠোঁট উল্টিয়ে বিনাশব্দে কাদতে লাগলাম চুপচাপ। এদিকে কথা বলতে বলতে চোখ দিয়ে পানি পড়েছে আন্টিরও। পূর্ণ ভাইয়ার মায়ের চোখেও এসেছে জল। আন্টি নিজের চোখের পানি মুছে বললেন,
—মেয়েটা অনেক ভালো, বেয়াইন। কিন্তু ওর কপালটা বড্ড খারাপ। এইটুকুন একটা মেয়ের সাথে ভাগ্য এত নিষ্ঠুর না হলেও পারতো। ওর ভবিষ্যত নিয়ে আমার খুব চিন্তা হয়। যতদিন না ওকে যোগ্য ছেলের হাতে তুলে দিয়েছি ততদিন ওর মায়ের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারবোনা আমি।
এতক্ষণ ধরে আন্টির কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন পূর্ণ ভাইয়ার বাবা। উনি হঠাৎ বললেন,
—আচ্ছা ভাবী, ওর মা-বাবার নাম কি আপনি বলতে পারবেন? এমন যদি হয় যে ওর পরিবারকে কোনভাবে খুজে বের করা যায়?
—ওর পরিবারকে খুজে বের করার চেস্টা করেছিলাম, বেয়াইন সাহেব। কিন্তু শুনেছিলাম তারা নাকি আর দেশে থাকেন না৷ তাই এরপর আর তাদের সাথে যোগাযোগ করা যায়নি।
—ওর বাবার নামটা আমাকে বলেন। দীর্ঘদিন ধরে পারিবারিক ব্যবসার সূত্রে বহু ব্যবসায়ীকেই চিনি আমি। আপনি যেহেতু বললেন ওর বাবার ব্যবসা ছিলো তাই হতেও পারে আমি উনাকে চিনতাম।
—হ্যাঁ, তাই তো। এটা এতক্ষণ মাথায় আসেনি আমার! অবশ্য আপনি আরেকটা কারণেও চিনতে পারেন কারণ তুরফার বাবাও চৌধুরী বংশের ছিলেন৷ কে জানে আপনাদের দূরের কোন আত্মীয়ও হতে পারেন তারা। ওর বাবার নাম ছিলো …
—ইরফান চৌধুরী?
আন্টির বলার আগেই পূর্ণ ভাইয়ার বাবা বলে উঠলেন কথাটা। নিজের বাবার নাম উনার মুখে শুনে অবাক হয়ে গেলাম আমি। একিসাথে অবাক হলেন রাইসার মা-বাবা সহ পুরো পরিবার! আন্টি কোনরকম নিজেকে সামলিয়ে বললেন,
—হ্যাঁ, ভাই। কিন্তু আপনি কি চিনতেন উনাকে?
আন্টির মুখে “হ্যাঁ” শুনে মুহুর্তেই চকচক করে উঠলো পূর্ণ ভাইয়ার বাবার চোখ। একটু পর আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে কাদতে লাগলেন পূর্ণ ভাইয়ার বাবা। একের পর অদ্ভুত ব্যাপার ঘটতে দেখে আমার মনের মধ্যে উশখুশ করতে লাগলো! আংকেল কিভাবে জানেন আমার বাবার কথা? তাহলে উনি নিশ্চয়ই চিনবেন আমার পরিবারকে? আর না চিনলে কাদবেনই বা কেন?? আজ কি তবে এতদিনের খোজ পূরণ হবে আমার?!
দুরুদুরু বুকে আংকেলের দিকে চেয়ে রইলাম আমি।
হঠাৎ দেখি চোখের পানি পূর্ণ ভাইয়ার বাবা এগিয়ে আসছেন আমার দিকে। সবার উৎসুক দৃষ্টি এখন আংকেল আর আমার দিকে। আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে আলতোভাবে উনি হাত রাখলেন আমার গালে। অশ্রুমিশ্রিত কণ্ঠে বলে উঠলেন,
—তুমিই আমাদের তুরফা?
“আমাদের তুরফা” শব্দটা বিদ্যুৎ এর মতো খেলে গেলো আমার মাথায়। হৃদস্পন্দন দ্রুত হতে লাগলো! তবে কি উনারা আমার পরিবারের মানুষ? চোখ বড় বড় করেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম আংকেলের দিকে। আমার চোখের ভাষা হয়তো বুঝতে পেলেন উনি, তাইতো বলে উঠলেন,
—মা রে,সম্পর্কে আমি তোর বড় চাচা হই। তোর বাবার একমাত্র বড় ভাই। তোর বড়আব্বু।
পূর্ণ ভাইয়ার বাবার কথা শুনে যেন বাজ পড়লো রুমের মধ্যে! হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছেন সবাই যেন কেউই ভাবেননি তিনি এমন কথা বলবেন! আংকেল এর কথা কানে আসতেই মুহুর্তেই চোখ ঝাপসা হয়ে গেলো আমার। টলমলে পানিগুলো টাল সামলাতে না পেরে বেয়েই পড়লো দুচোখ গড়িয়ে। কিছু বলার জন্য মুখ খুললেও কথাগুলো যেন দলা পাকিয়ে রয়েছে ভেতরে। এ অঅনুভূতি ভাষায় ব্যক্ত করার মতো নয়! কোনরকম অস্পষ্ট গলায় বললাম,
—আ-আপনারা আমার পরিবার?
বড়াব্বু হালকা হেসে মাথা নাড়লেন। এতক্ষণ ধরে বুকের ভেতর চেপে রাখা শ্বাস ছাড়লাম আমি! সত্যকে অনুধাবন করে অনুভুতি প্রখর হয়ে উঠলো আমার! এদিকে আমার চোখ দিয়ে বইছে হাজার প্রশ্নের জোয়ার। কোথায় ছিলেন উনারা এতদিন? কেন নিতে আসেননি আমায়? আর অপরদিকে, বড়াব্বু মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিচ্ছেন আমায়। যেন এত বছর পর মন ভরে দেখছেন!
প্রায় সাথে সাথেই পূর্ণ ভাইয়ার মা অর্থাৎ বড়মা এলেন আমার কাছে। দুই গালে হাত রেখে কপালে চুমু খেলেন আমার। এতক্ষণে হুহু করে কান্না শুরু করে দিয়েছি আমি! নিজের আবেগকে কোনভাবেই আর কন্ট্রোলে রাখতে পাচ্ছিনা আজ!! এতদিনের পরিবারের প্রতি জমানো সব মান-অভিমান, আক্ষেপ, ভালোবাসা সব যেন তাদের ফিরে পেয়ে একসাথে ভীড় জমিয়েছে আমার কাছে।
বড়মাকে জড়িয়ে ধরেই কাদতে কাদতেই মাথা ঘুরে উঠলো আমার। হঠাৎ করেই এত আবেগের ধাক্কা সইতে পারলো না আমার ছোট্ট মন। আর কোনকিছু বুঝে উঠার আগেই জ্ঞান হারালাম আমি…
#চলবে
#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ১৪
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
বৃষ্টির পানি চোখের উপর পড়তেই অবচেতন মন চেতনা ফিরে পেলো আমার। কিন্তু এই অসময়ে বৃষ্টি কেন হচ্ছে বুঝলাম না। আর আমিও বা ভিজছি কিভাবে ঘরের ভেতর? বন্ধ চোখেই চিন্তাভাবনা করতে করতে আস্তে করে চোখ মেলে তাকালাম আমি। শুরুতে প্রখর আলোর ঝলকানি সহ্য করতে না পেরে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করেই থাকলাম। এতক্ষণে বৃষ্টি পড়াও বন্ধ হয়ে গেছে! পুনরায় চোখ খুলে আস্তে-ধীরে চারপাশে তাকালাম।
আন্টি আমার পাশে বিছানায় বসে আছেন, আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন বাকি সবাই। রাইসা পাশে পানির গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে আছে, ওর হাত ভেজা। বুঝলাম তখন ওটা বৃষ্টি ছিলোনা। তাহলে রাইসাই আমার উপর পানি ছিটিয়েছে! নিজের বোকামিতে নিজেরই হাসি পেলো আমার!!
এতক্ষণ চারপাশে কি হচ্ছে মাথায় না আসলেও একটু পর প্রায় সাথে সাথেই মনে পড়লো আজকে কি ঘটেছে! এখন যে প্রান্ত ভাইয়ার মা আমার পাশে বসে আছেন উনি আমার বড়মা, পাশে উদবিগ্ন মুখে যে প্রান্ত ভাইয়ার বাবা দাঁড়িয়ে আছেন উনি আমার বড়াব্বু। প্রান্ত ভাইয়া শুধুই আমার দুলাভাই নন, উনি এখন আমার চাচাতো ভাইও বটে!! আর পূর্ণ ভাইয়া? উনার কথা মনে হতেই আমার চোখদুটো আনমনে খুজতে লাগলো উনাকে! একটু আশেপাশে তাকাতেই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম তাকে। সবাই এখানে আমার পাশেই আছেন তবে উনি কেন এত দূরে? নিজের মনে নিজেই ভাবলাম আমি তবে উত্তর পেলাম না কোন!
—তুরফা, তুই কি ঠিক আছিস মা?
বড়মার গলা শুনে তার দিকে তাকালাম আমি। আস্তে করে উঠে বসলাম নিজে থেকেই। তারপর শান্ত গলায় বললাম,
—আমি ঠিক আছি বড়মা। কিন্তু আমার মন ঠিক নেই। মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে হাজারো প্রশ্ন৷ সেগুলোর উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত আমি ঠিক হতে পারবো নাহ।
—বল মা, কি প্রশ্ন তোর? আমরা সব প্রশ্নের উত্তর দিবো। তুই চিন্তা করিস নাহ।
—তোমরা প্রথমে আমাকে এটা বলো যে এতদিন তোমরা কোথায় ছিলে? আর আমাকে নিতেই বা আসোনি কেন? তোমাদের জন্য আমি কতদিন অপেক্ষা করেছি তোমরা জানো?
অশ্রুসিক্ত চোখে একবুক অভিমান নিয়ে প্রশ্ন ছুড়লাম তাদের দিকে! আজকে তাদের পেয়ে যতটা না খুশি লাগছে তার চেয়েও বেশি কস্ট লাগছে এটা ভেবে যে তারা আমার এত কাছে ছিলো তবুও আমি আগে তাদের পেলাম না কেন এটা ভেবে!! বড়াব্বু বোধহয় আমার অভিমান বুঝতে পেলেন তাই আমার কাছে এগিয়ে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
—আমরা জানি এতদিন তুই পরিবার থেকেও পরিবারছাড়া অনেক কস্টে বড় হয়েছিস। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমরাও তোকে ভুলে যাইনি! তোকে আমরা কতভাবে খুজেছি এটা যদি তোকে বুঝাতে পারতাম রে মা। কিন্তু হয়তো আমাদের ভাগ্যে এতদিন পর দেখা হওয়াই লেখা ছিলো এজন্যই আজ তোর সাথে আমাদের পরিচয় হলো!
—তা না হয় বুঝলাম কিন্তু আন্টি যে বললো তোমরা বিদেশ গিয়েছিলে, কবে এসেছো তোমরা দেশে?
—আমরা ওই বছরই দেশে ফিরে এসেছি মা। তুই তো জানিস তোর বাবার সাথে আমাদের পরিবারের সম্পর্ক কেমন ছিলো? কিন্তু এটা তো জানিস না যে সম্পর্ক খারাপ কিজন্য ছিলো??
বড়াব্বুর প্রশ্নে না-বোধক ভাবে মাথা নাড়লাম আমি! আমি আসলেও জানিনা কিজন্য বাবার সাথে বাকি পরিবারের বিরোধ ছিলো? আমার থেকে জবাব পেয়ে বড়াব্বু আবার বলতে শুরু করলেন,
—তাহলে শোন, তোর বাবা ছিলো অনেক দেশপ্রেমিক মানুষ। তোর বাবা ছাড়া আমাদের বাকি পরিবারের সবার ইচ্ছা ছিলো দেশে নিজেদের পারিবারিক জমি-জমা বিক্রি করে দিয়ে বিদেশে সেটেল হতে। এজন্য আমরা আমাদের দেশের বাড়িতে সব জমিজমা বিক্রির উদ্দেশ্যে আলাদা থাকতাম আর তোরা তোর বাবার সাথে এখানে থাকতি। যেবছর তোর বাবা মারা যায় ওই বছর আমরা তোর দাদি মানে আমাদের মাকে নিয়েই বিদেশ পাড়ি দেই। মা যেতে চাইছিলো না, তারও তোর বাবার মতো দেশেই থাকার ইচ্ছা ছিলো কিন্তু আমরা তার চিকিৎসার কথা বলে তাকেও বিদেশ নিয়ে যাই, কিন্তু উদ্দেশ্য ছিলো সেখানে সেটেল হওয়ার। মা ছাড়া সবাইকে সেটাই বলে গিয়েছিলাম আমরা। এজন্যই হয়তো যখন বেয়াইনরা আমাদের খোঁজ নিয়েছিলেন তখন শুনেছিলেন আমরা বিদেশ গিয়েছি। তবে বিশ্বাস কর মা, নিজের ভাইকে ছেড়ে পুরো পরিবার বিদেশ এসেও কোন শান্তি পাচ্ছিলাম না আমরা, বারবার মনে কু ডাকছিলো। এক অজানা অপরাধবোধ হচ্ছিলো মনের ভেতর। তাই পাসপোর্ট-ভিসা ঠিক করে আমরা আবার দেশে ফিরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।
এটুক বলেই বড়াব্বু আবেগপ্রবণ হয়ে গেলেন। তারপর নিজেকে সামলিয়ে আবার বলতে লাগলেন,
—কিন্তু আমাদের দূর্ভাগ্য যে যেদিন তোর বাবা-মার এক্সিডেন্ট হয়, তার তিনদিন পরে আমরা জানতে পারি। তড়িঘড়ি করে কোনরকম দেশে ফিরার পর জানতে পারি এতদিনে তাদের দাফন হয়ে গেছে। এমনি অভাগা আমরা যে নিজের আপন ভাইকে শেষবারের মতোও দেখতে পারলাম নাহ! হয়তো এটাই আমাদের জন্য শাস্তি ছিলো!!
কথাগুলো বলে চোখের পানি মুছতে লাগলেন বড়াব্বু। রুমের বাকি সবাইও বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে গেছে! সবার চোখেই পানি। এদিকে কাদতে কাদতে হিচকি উঠে গেছে আমার।
একটি হাত পানি এগিয়ে দিলো আমাকে, রাইসা মনে করে পানি নেওয়ার জন্য তাকাতেই দেখি এটা পূর্ণ ভাইয়া। শান্তচোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি অশ্রুতে টুইটম্বুর হয়ে কোনরকম উনার থেকে পানি নিয়ে খেয়ে ফিরিয়ে দিলাম গ্লাস উনার হাতে। উনি চুপচাপ গ্লাস রেখে আমার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকলেন। এবার আর দূরে চলে গেলেন নাহ। বড়াম্মুর কথায় তার দিকে দৃষ্টি ফিরালাম আমি,
—জানিস তুর, তোকে আমরা দেশে আসার পর কত হন্য হয়ে খুজেছি? আমরা তোর স্কুলেও খোজ নিয়েছিলাম কিন্তু পরে জানি তুই ট্রান্সফার নিয়ে চলে গেছিস। তাদের এত রিকিয়েস্ট করেছিলাম তোর ঠিকানা আমাদের দেওয়ার জন্য কিন্তু তাও পাইনি। তাও আমরা হাল ছেড়ে দেইনি! কত দোয়া করেছি আমরা আল্লাহর কাছে তোকে ফিরে পাওয়ার জন্য সেটা শুধু আমরাই জানি। আজ হয়তো আমাদের সেই দোয়ার কল্যাণেই এত বছর পর প্রান্তের শশুড়বাড়িতে এসে তোকে পেলাম। জানিস সেইদিন ইংগেজমেন্ট এর দিন তোকে এখানে দেখেই তোর বড়াব্বু আমাকে বলছিলো “দেখো, আজ যদি আমাদের তুরফা আমাদের সাথে থাকতো তবে সে নিশ্চয়ই এত বড়ই হতো”। পরে যখন বিয়ের দিন জানতে পারি যে তোর নাম তুরফা আর তুই রাইসার নিজের বোন না তখনই আমাদের সন্দেহ হয়। এজন্যই আজকে আমাদের এখানে আসা!
এতক্ষণ ধরে বড়মার সব কথা শুনে আমার সব কনফিউশান দূর হয়ে গেলো। আমি চোখের পানি মুছে জড়িয়ে ধরলাম উনাকে! সবাই আমাকে কিছুক্ষণ রেস্ট করতে বলে চলে গেলেন আমার রুম থেকে। কাথা মুড়ি দিয়ে উল্টোদিক হয়ে শুয়ে থাকলাম আমি। অবশেষে আজ সকল প্রশ্নের উত্তর পেলাম আমি! এতদিনের বিক্ষিপ্ত মন শান্ত হলো আজ। কিছুক্ষণ পর গেট খুলার শব্দ শুনে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলাম আমি। ভাবলাম বড়মা এসেছে।
কিন্তু উনি কিছু না বলেই আলতো হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন আমার। মায়ের স্নেহের পরশ পেয়ে মন প্রশান্ত হয়ে উঠলো আমার! মুচকি হাসির রেখা ধরা দিলো আমার ঠোঁটে!
একটু পর ফোন বেজে উঠায় চলে গেলেন উনি। বড়মা চলে যেতেই পাশ ফিরলাম আমি। আর পাশ ফিরতেই নাকে প্রখর হলো পুরুষালি পারফিউমের গন্ধ! তবে বড়মা কেন এই পারফিউম লাগাবে হিসাবটা বুঝলাম না আমি? তবে কি অন্য কেউ এসেছিলো? অবাক হয়ে ভাবলাম আমি!
আপনা-আপনিই ভ্রু কুচকে গেলো আমার।
__________
আধঘণ্টা খানেক রেস্ট নিয়ে রুম থেকে বের হলাম আমি। ডাইনিং এর কাছে পানি নিতে এসেই দূরে দেখতে পেলাম পূর্ণ ভাইয়াকে। ফোনে কথা বলছেন কারো সাথে। উফ! এই লোকটা এতই কথা বলে ফোনে!! চোখ কুচকে পানি খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম আমি। পানি খেয়ে চলে যাচ্ছিলাম এমন সময় পূর্ণ ভাইয়ার আওয়াজে পা থমকে গেলো আমার,
—তুরফা?
এই প্রথম উনার মুখে নিজের নাম শুনে এক মুহুর্তের জন্য চমকে গেলাম আমি। মনের মধ্যে এক অদ্ভুত শিহরণ জাগলো। এতদিন ধরেই উনার সাথে কথা হয়েছে তবুও একবারো উনি আমার নাম ধরে ডাকেন নি, আজকে এভাবে ডাকবেন আমি আশাও করিনি। আস্তে করে পিছন ফিরে উনার দিকে তাকালাম আমি,
—জি বলেন।
—এখন কেমন লাগছে?
দূরে দাঁড়িয়েই ধীর গলায় নরম সুরে বললেন উনি। উনার গলায় এমন নরম সুর শুনে আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। কোনমতে বললাম,
—কার কেমন লাগবে?
অবাক হয়ে বললাম আমি। কিছুই বুঝলাম না উনি কি বলছেন। তবে আমার প্রশ্নটা তার বোধহয় পছন্দ হলোনা কারণ দেখলাম উনি চোখ পাকিয়ে মুখ পুনরায় গম্ভীর করে নিলেন। অতঃপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
—একটু আগে নিজেই অজ্ঞান হয়ে সবাইকে টেনশনে ফেলে দিয়েছিলো, এখন আবার জিজ্ঞেস করছে কার কেমন লাগছে! স্টুপিড কি এমনি বলি!
কথাগুলো বলেই হনহন করে ড্রয়িংরুমে চলে গেলেন উনি। তার কথা শুনে লজ্জা পেলাম আমি! উনি তাহলে আমার খোজ নিচ্ছিলেন যে আমি কেমন আছি? এতটা সদয় উনি কবে থেকে হলেন আমার প্রতি? ভ্রু কুচকে ভাবতে লাগলাম আমি।
ভাবতে ভাবতেই নাকে আবার লাগলো পারফিউমের গন্ধ! সেই পারফিউমের গন্ধ আবার কই থেকে আসছে এখানে? পূর্ণ ভাইয়ার থেকে আসছিলো কি? তবে কি তখন আমার রুমে পূর্ণ ভাইয়া ছিলেন?
ভাবতেই গাল লাল হয়ে গেলো আমার! ছি ছি!! কিসব ভাবছি! উনি কোন দুঃখে যাবেন আমার রুমে!! হতে পারে অন্য কোথাও থেকে স্মেলটা আসছে!! নিজের মনকে বুঝালাম আমি!
তবে স্টুপিড বলায় আবারো তার উপর রাগ উঠলো আমার। তাই দূর থেকেই মুখ ভেংচি দিলাম উনাকে! তারপর হেটে হেটে ড্রয়িংরুমে চলে গেলাম। উদ্দেশ্য আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে সবার সাথে কথা বলা!!
#চলবে