#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ২৩,২৪
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
২৩
মুখ ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছি৷ আমার সামনে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন পূর্ণ। এতক্ষণ ধরে ভেবেও আমি বুঝতে পারলাম না আসলে আমার কি করা উচিত এই মুহুর্তে। কেননা আমি তো ইচ্ছা করে উনাকে মারিনি, ভুলবশত লেগে গেছে তাই আমি কেন সরি বলতে যাবো অযথা! এজন্যই আর কোন কিছু না ভেবে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি তখন থেকে। কিন্তু আমার চুপ থাকাটা বোধহয় পূর্ণর ভালো লাগছেনা। আমাকে চুপ থাকতে দেখে পূর্ণ অস্থির কন্ঠে বললেন,
—কি হয়েছে? কথা বলছোনা কেন তুমি??
উনার কথা শুনে আড়চোখে তার দিকে তাকালাম। মনে মনে ভাবলাম আমার কথা বলা না বলায় উনার আবার কিছু আসেও যায়? তবুও মুখ ফুটে কিছু বললাম নাহ। চুপ করেই থাকলাম উনার আরও কিছু রিয়েকশন দেখার জন্য। আমার চুপ থাকা কাজে দিলো। হঠাৎই পূর্ণ ভ্রু কুচকে আমার বাহু আলতো করে ঝাকিয়ে বললেন,
—তুরফা? তোমাকে কিছু বলতে বলেছি আমি। কথা বলছোনা কেন? কি সমস্যা তোমার??
—কি বলবো?
আস্তে করে বললাম। আমার কথায় ভ্রু কুচকে গেলো উনার। বিরক্তি নিয়ে রাগী গলায় বললেন,
—কি বলবে মানে? একটু আগেই কি করলে ভুলে গেছো? সেটা কেন করলে জিজ্ঞেস করেছি আমি!
উনার কথায় মন বিষিয়ে গেলো আমার। শুরুতে ভয় পেলেও পরক্ষণেই মাথায় এলো যে ভয় পেলে চলবেনা! আমি তো ইচ্ছা করে কিছু করিনি তাই ভয়কে কনফিডেন্স দিয়েই জয় করতে হবে! এজন্য চোখ ছোট ছোট করে ড্যামকেয়ার ভাবে গম্ভীর কন্ঠে উত্তর দিলাম,
—ওহ ওটার কথা বলছেন! দেখুন আমি আসলেও খেয়াল করিনি ওটা আপনার গাল ছিলো। আপনার কাছে অবাস্তব লাগলেও এটাই সত্যি যে আমি মশার দিকে এতটাই মনোযোগ দিয়ে ছুটছিলাম যে সে কোথায় বসেছে খেয়াল করার আগেই মেরে দিয়েছি। এরপরেও আপনার কিছু বলার থাকলে বলে ফেলুন।
আমার গম্ভীর গলা শুনে উনি যেন খানিকটা থমকে গেলেন। কিছু বলতে যেয়েও আর বললেন না। আমিও উনাকে স্বাভাবিকভাবেই ইগ্নোর করে চলে যাচ্ছিলাম। কেন যেন ভালো লাগছেনা আমার! উনার আমার সম্পর্কটা খুব অগোছালো মনে হচ্ছে, আমাদের এই অদ্ভুত সম্পর্কের পরিণতি কি হবে বুঝতে পাচ্ছিনা। একবার উনি আমাকে ইগ্নোর করছেন তো একবার আমি। না জানে এভাবে আর কতদিন চলবে? ভাবতে ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো মন থেকে। বিষাদ মনে চলে যেতে নিলেই পূর্ণ খানিকটা রসিকতার সুরে বললেন,
—তাও ভালো। আমি ভাবলাম সকালে খাবার টেবিলে তোমার প্রশংসা না করার জন্য হয়তো রাগ ঝাড়লে আমার উপর!
উনার কথায় পেছন ফিরে তাকালাম। তার ঠোঁটে ব্যাঙ্গাত্বক হাসি। বুঝলাম পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চাইছেন উনি। তবুও আমার মন গললো নাহ। বারবার উনার ইগ্নোর করার কথা মনে পড়তেই অভিমানের পাল্লা ক্রমশ ভারী হতে ধরেছে হৃদয়জুড়ে। তাই তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম,
—আপনার সাথে কি আমার সেই সম্পর্ক আছে যে আমি রাগ ঝাড়বো আপনার উপর?
আমার কথায় পূর্ণর হাসি মিলিয়ে গেলো। গভীর কালো চোখজোড়া যেন অদ্ভুত রকমের শান্ত হয়ে গেলো। কিছু বলতে চেয়েও তবু কিছু বললেন না উনি। তার চোখের দৃষ্টি আমাকে কিছু বুঝাতে চাইছিলো তবে সে চোখের ভাষা পড়ার ইচ্ছে আজ আমার নেই। আমি ক্লান্ত উনার এই অদ্ভুত গম্ভীরতা দেখতে দেখতে। তাই পুনরায় চলে যাচ্ছিলাম বিছানায় ঘুমাতে। আচমকা হাতে পুরুষালি শক্ত হাতের টান পড়ায় থেমে যেতে বাধ্য হলাম আমি। কিছুক্ষণ হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেস্টা করেও উনার শক্তির সাথে পেরে উঠলাম নাহ। উনি কোমল গলায় বললেন,
—চুড়িগুলো পছন্দ হয়েছে??
উনার প্রশ্নে চমকে গেলাম আমি। ভাবলাম যাক, জনাব তাহলে একটু একটু করে লাইনে আসছেন। তবে এত সহজেই গলে গেলে হবেনা আমার। উনাকে উনার ভাষায়ই বুঝিয়ে দিতে হবে যে আমাকে ইগ্নোর করলে আমার কেমন লাগে। তাই উনার মতোই গম্ভীরভাবে ছোট্ট করে বললাম,
—হুম, সুন্দর।
আমার এত ছোট উত্তরে যেন খানিকটা হতাশই হলেন উনি, যা উনার চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছিলো। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তবে আমার হাত ছাড়লেন নাহ এখনও। আমি হাত ঝাকিয়ে ইশারায় বুঝালাম হাত ছাড়তে তবুও উনার শক্ত বন্ধনের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হলোনা। একিভাবেই ধরে রেখেছেন আমার হাত। শেষে আমি কথা বলতে বাধ্য হলাম। বলেই ফেললাম,
—হাতটা ছাড়ুন। আমি ঘুমাবো।
—সারারাত ঘোড়ার মতো বেঘোরে ঘুমিয়ে এখনই ঘুম ধরছে তোমার? এত ঘুম আসে কই থেকে?
ভ্রু কুচকে বললেন উনি। এবার উনাকে কথা শুনানোর সুযোগ পেয়ে গেলাম যেন আমি! সুযোগমতো বলেই ফেললাম,
—ঘুম না ধরার তো কোন কারণ দেখছিনা আমি। আর আপনার মতো বোরিং লোকের সাথে থাকলে যে কারও ঘুম ধরবে, বুঝেছেন! প্রান্ত ভাইয়াকে দেখেন, আপনার চেয়ে ছোট হলেও উনার দায়িত্বজ্ঞান বেশি। বউকে যখন পারে সময় দেয় কিন্তু আপনি কি করেন? যেটুক সময় বাসায় থাকেন হয় চুপচাপ থাকেন না হয় ল্যাপটপে কাজ করেন। আমি যে একটা মানুষ রুমে থাকি সেটা হয়তো ভুলেই যান আপনি। এমন লোকের বউয়ের তো বোর হতে হতে মরে যাওয়া উচিত!!
—তুরফা…
আহত গলায় বললেন উনি। হাতের বাধনও হালকা হয়ে গেলো। যেন আমার কথাগুলো ভালো লাগেনি উনার। অবশ্য ভালো না লাগারও কথা, সত্যি কথা শুনতে তিতা-ই লাগে। এক নিশ্বাসে এতকিছু বলে আমিও ক্লান্ত হয়ে গেছি তাই চুপচাপ উনার আলগা হাত থেকে হাতের বাধন ছাড়িয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম উল্টোদিক হয়ে। পূর্ণকে এভাবে কথাগুলো বলতে ভালো লাগেনি আমার নিজেরও তবুও উনাকে বুঝানো দরকার যে আমিও মানুষ, আমারও ভালো লাগা খারাপ লাগা আছে।
উনার কাছে একটা সঙ্গ ব্যতীত আর কিছু আশা করিনাই আমি, যদি উনার সেটাও দেওয়ার আকাংক্ষা না থাকে তবে বিয়ে করার তো দরকারই ছিলোনা আমায়! এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখের কোণে জল গড়িয়ে পড়েছে টেরই পাইনি আমি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলাম ঘুম আসার অপেক্ষায়!
______________
মাঝরাতে প্রচন্ড পানির পিপাসায় ঘুম ভেঙে গেলো আমার। ঘড়িতে বাজে ২টা। ঘুমু ঘুমু চোখে উঠে সাইড টেবিলে তাকিয়ে দেখি জগে পানি নেই। এখন ডাইনিং পর্যন্ত হেটে যেতে হবে! ধুর!! তাও পিপাসা তো মেটাতেই হবে! তাই ঘুমের রেশ কাটিয়ে এগিয়ে চললাম রুম ছেড়ে। পানি খেয়ে আসতে আসতেই প্রান্ত ভাইয়ার রুমের সামনে কথার আওয়াজ ভেসে আসছে। প্রান্ত ভাইয়া কিছু বলছেন আর রাইসা খিলখিলিয়ে হাসছে। এই মাঝরাতেও কি সুন্দর গল্প করছে দুজন! ভাবতেই মনটা ভালো হয়ে গেল আমার! রাইসার জন্য মনে মনে ভীষণ খুশি হলাম আমি। এরকম জীবনসঙ্গীই তো দরকার জীবনে! ভালো থাকুক সকলের ভালোবাসা।
নিজরুমে ফিরে এসে দেখি পূর্ণ বিছানার এক প্রান্তে নিশব্দে ঘুমাচ্ছেন। রুমের ড্রিমলাইটের আলো পড়ায় উনার ফর্সা মুখটায় হলুদ আভা এসে অনন্য সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। ঘুমের মাঝেও কেন যেন বিষন্ন দেখাচ্ছে উনাকে। হয়তো তখনকার আমার বলা কথাগুলোর জন্য আনমনেই ভাবলাম আমি!
বিছানায় গিয়ে নিজ জায়গায় বসে হেলান দিতেই চোখ গেলো তার গালের লালচে জায়গার দিকে। যদিও খোচা খোচা দাড়ির জন্য তেমন বুঝা যাচ্ছেনা তবুও সামান্য লালচে দাগটা চোখের আড়াল হলোনা আমার। আপনাআপনিই হাত চলে গেলো সেখানে। আলতো হাতে হাত বুলিয়ে দিলাম তার গালে। এই মারাত্মক সুন্দর লোকটা আমার বর, আমার একান্তই আপন মানুষ। এটা ভাবতেই মনের মধ্যে অদ্ভুত শিহরণ জাগে! না চাইতেও যেন উনার প্রতি খানিকটা দূর্বল হয়ে গেছি আমি। তবে উনার মনে আমার জন্য কি আছে আমি এখনও জানিনা। উনার অনুভুতিগুলো যেন ধোঁয়াশে, ঠিক উনারই মতো!!
নিজের চিন্তাভাবনা শেষে আমি সরে যাচ্ছিলাম উনার কাছ থেকে। ঠিক তখনি পূর্ণ হাত চেপে ধরলেন উনি আমার! উনার ঘুম ভেঙে গেছে ভেবে লজ্জায়-ভয়ে শ্বাস আটকে তাকালাম তার দিকে তবে তিনি এখনও চোখ বন্ধ করে আছেন দেখে সস্তিও পেলাম একি সাথে!! যাক ভালো হবে উনি ঘুমাচ্ছেন নয়তো আমাকে এভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফেললে বেশ লজ্জায় পড়তে হতো আমার!! আলতো হাতে নিজের থেকে উনার হাত সরানোর চেস্টা করতেই দৃঢ় হলো উনার হাতের বন্ধন। ভ্রু কুচকে গেলো আমার! লোকটা ঘুমের মধ্যেও এভাবে শক্ত করে হাত চেপে ধরেছে? আজকে হাত ধরার কি হয়েছে উনার!! আড়চোখে উনার দিকে তাকিয়ে হাত ছাড়ানোর ব্যর্থ চেস্টা শেষে ক্লান্ত হয়ে ওভাবেই ঘুমিয়ে পড়লাম আমি!
________________
সকালবেলা বড়াম্মু আমাকে ও পূর্ণকে একসাথে ডেকে পাঠালেন উনার রুমে। আমরা দুজন যথারীতি ভদ্র ছেলেমেয়ের মতো চলে গেলাম সেখানে। গিয়ে দেখি বড়াব্বু ও বড়াম্মু বেশ সিরিয়াস মুখে বসে আছেন। আমাদের আসতে দেখেই বড়াম্মু বললেন,
—এসে গেছিস তোরা? যাক ভালো হলো। তোদের সাথে একটা জরুরি কথা ছিলো। বিশেষ করে পূর্ণ তোর সাথে।
পূর্ণর দিকে তাকিয়ে বললেন বড়াম্মু। ভ্রু তুলে বড়াম্মুর দিকে তাকালেন তার ছেলে। এদিকে উনাদের দুজনের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছি আমি। ভাবছি কি এমন কথা বলার জন্য আমাদের এভাবে একসাথে ডেকে পাঠিয়েছেন বড়াম্মু?
#চলবে
#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ২৪
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
পূর্ণ বড়াম্মুর দিকে চেয়ে আছেন কি বলবে শুনার অপেক্ষায়। গম্ভীর মুখে বললেন,
—কি বলার ছিলো, মা?? বলে ফেলো।
—ঠিক করেছি তোদেরকে কয়েকদিনের জন্য বের করে দিবো বাসা থেকে।
বড়াম্মুর কথা মাথার উপর দিয়ে গেলো আমার। তাই ভ্রু কুচকে বলে উঠলাম “কিহ?”। প্রায় একিসময় পূর্ণও বলে উঠলেন কথাটা। একসাথে দুজনের কথা বলায় চোখদ্বয় আপনাআপনিই মিলিত হলো আমাদের! আমাদের রিয়েকশন দেখে বড়াব্বু হেসে বড়াম্মুকে বললেন,
—তুমিও নাহ, জুই। ভড়কে দিলে বাচ্চাদের। আরে তোরা কিছু মনে করিস না তোদের মা মজা করছিলো। তোদেরকে বাসা থেকে বের করে দিলে তো আমাদের বাসাটাই ফাকা হয়ে যাবে।
বড়াব্বুর কথা শুনে হাসলাম আমি। বড়াম্মুকে জিজ্ঞেস করলাম,
—কোথায় যাবো আমরা, বড়াম্মু?
—আমাদের আম্মা অর্থাৎ তোর দাদি তোকে দেখতে চেয়েছেন। যেদিন থেকেই শুনেছেন তোকে আমরা ফিরে পেয়েছি সেদিন থেকেই মা ছটফট করছে তোকে গ্রামে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাই ভাবছিলাম তোদেরকে নিয়ে গ্রামে যাবো কয়েকদিনের জন্য। তোর ফুপিরাও আসবে। সবার সাথে দেখা হবে তুরফার একবারে! কি বলিস?
বড়াব্বুর কথা শুনে খুশিতে মনটা ভরে গেলো আমার! হাসোজ্জল মুখে রাজি হলাম বড়াম্মুর কথায়! পুরো পরিবারের সাথে একসাথে দেখা হবে ভেবে এখনি দৌড় দিয়ে দাদুবাড়ি যেতে মন চাচ্ছে! আমার খুশির মধ্যেই বড়াম্মু পূর্ণর দিকে চেয়ে বললেন,
—আশা করি তোর যেতে কোন আপত্তি নেই?
বড়াম্মুর কথায় আড়চোখে তাকালাম উনার দিকে। উনি একদৃষ্টিতে আমাকেই দেখছিলেন। বড়াম্মুর কথা শুনে পূর্ণ বড়াব্বুর দিকে চেয়ে কিছু একটা ভাবলেন। একটু পর বললেন,
—মা, আসলে…
—খবরদার মানা করবিনা, পূর্ণ। দিন দিন কাজ করতে করতে কিরকম ঘরকুনো হয়ে গেছিস তুই? কোথায় এই বয়সে বউ নিয়ে ঘুরে বেড়াবি তা না…
—আরে মা, থামো প্লিজ। পুরো কথাটা তো শুনো আমার। আমি কি বলেছি আমি যেতে চাইনা?
বড়াম্মুকে মাঝপথে থামিয়ে দিলেন পূর্ণ। উনার কথায় উৎসুক চোখে চাইলেন বড়াম্মু। বললেন,
—হ্যাঁ বাবা, বল। কি বলতে চাইছিলি তুই?
—বলছিলাম যে কাল তো আমার একটা জরুরি মিটিং ছিলো, কোম্পানিতে নতুন শিপমেন্ট আসছে তাই তবে ওটা আব্বু যদি ম্যানেজ করতে পারে তাহলে আমি যেতে পারবো। তারপর বড়াব্বুর দিকে চেয়ে বললেন, তুমি করতে পারবেনা আব্বু?
পূর্ণ ভাইয়ার কথা শুনে কিছুটা অবাক হয়েই মাথা নাড়লেন বড়াব্বু। তার কাজপাগল ছেলেটা কাজ ছেড়ে ঘুরতে যাওয়ায় আগ্রহ দেখাচ্ছে বিষয়টাও যেমন খুশি হয়েছেন তেমনি বিস্মিত হয়েছেন বটে! গলা ঝেড়ে বড়াব্বু বললেন,
—হ্যাঁ বাবা, অবশ্যই! আমি ঠিকই ম্যানেজ করে নিবো। তুই নিশ্চিন্তে যা!
বড়াব্বুর কথায় মাথা নাড়লেন পূর্ণ।
—প্রান্ত, রাইসাকেও নিয়ে চলো। ওদেরও ভালো লাগবে গ্রামে গেলে।
বড়াম্মুকে কথাটা বলে রুম ছাড়লেন পূর্ণ। যাওয়ার আগে আমার দিকে আড়চোখে উনার তাকানোটা দৃষ্টিগোচর হলোনা আমার! পূর্ণর যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলাম আমি। ভাবলাম যাক, ধীরে ধীরেই উনার একটু উন্নতি হচ্ছে। পূর্ণ যাওয়ার পর বড়াব্বু বিস্মিত গলায় বললেন,
—আমি তো ভাবতেই পারিনি আমার ছেলে এত সহজে রাজি হবে! ও তো গ্রামে যেতেই চায়না বেশিরভাগ সময়, আজকে হঠাৎ ওর কি হলো? তবে যাই হোক আমার সিরিয়াস ছেলেটা কাজের খোলস থেকে বের হয়ে জীবনকে উপভোগ করুক এটাই আমি চাই। তাই পূর্ণর উপর আজ বেশ খুশি হয়েছি আমি।
হেসে বললেন বড়াব্বু। উনার সাথে হাসলেন বড়াম্মুও। তাল মিলিয়ে বললেন,
—আরে বুঝোনা, তুরফার জন্যই এত সহজে রাজি হয়েছে পূর্ণ। নাহলে কি তোমার ছেলে কাজ ছেড়ে কোথায় যেতে চায়? তার মধ্যে ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং রেখে? যেখানে প্রান্ত আর রাইসার ডেট ও ক্যান্সেল করে দিয়েছিলো এক মিটিং এর জন্য! আমি জানতাম বিয়ের পর এরকম পরিবর্তন হবে। এজন্যই এতদিন উঠেপড়ে লেগেছিলাম পূর্ণর বিয়ের জন্য। ভাগ্য করে তুরফা ঠিক সে সময়েই এসেছিস আমাদের জীবনে। তোকে ফিরে পেয়ে আমরা যে কতটা খুশি আমরা বলে বুঝাতে পারবোনা, মা।
বড়াম্মু আমাকে তার দিকে ঘুরিয়ে আমার গালে হাত রেখে বললেন কথাটা। উনাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম আমি। আসলেই কি আমার কথার প্রভাব পড়ছে পূর্ণর উপর? উনি সত্যিই আমার ভালো লাগা-খারাপ লাগাকে গুরুত্ব দেন? ভাবতে ভাবতেই বড়াম্মু ঝাকালেন আমার বাহু ধরে। বললেন,
—কি রে, তুই না মাইন্ড ডাইভার্ট করার জন্য কিছু করতে চাইছিলি? এখন গ্রামে যেয়ে সবার সাথে দেখা করলে, ঘুরে আসলে দেখবি মাইন্ড ফ্রেশও হবে, দেখবি ভালোও লাগবে।
বড়াম্মুর কথায় মাথা নাড়িয়ে মুচকি হেসে উনাকে জড়িয়ে ধরলাম আমি। আসলেই মন ভালো করার জন্য কোথায় ঘুরে আসার চেয়ে ভালো প্ল্যান আর কিছুই হতে পারেনা! তার মধ্যে পুরো পরিবার একসাথে গেলে তো কথাই নেই!
—ঠিক আছে, বড়াম্মু। তোমরা রেস্ট নাও তাহলে। আমিও রুমে গিয়ে প্যাকিং শুরু করে দিই। আমার আর তর সইছেনা দাদিবাড়ি যাওয়ার জন্য!!
বড়াব্বু ও বড়াম্মুকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলেই মনের সুখে গুনগুন করতে করতে চলে এলাম তাদের রুমের বাইরে। খুশিমনে ভাবলাম, যাক সামনের কয়টা দিন ভালো কাটতে চলেছে তাহলে!
___________________
রুমের মাঝখানে বসে ফুরফুরে মনে কাপড় গোছাচ্ছি। পূর্ণ এখনও আসেননি রুমে, প্রান্ত ভাইয়ার সাথে কথা বলছেন বাইরে। কাপড় গোছানো শেষ করে ছোট ট্রাভেলব্যাগ খুজছি। কয়েকদিনের জন্যই যাওয়া। আমার ভারী সুটকেস টানতে পারবোনা! বড়াম্মু তো বলেছিলো ছোট ব্যাগটা রুমেই আছে। অথচ আলমারি ঘেটেও পেলাম নাহ কোথায়। আরেকবার ভালো করে চোখ ঘুরাতেই আলমারির উপরে দেখতে পেলাম ব্যাগটা। কাঠের আলমারির উপরের এক সাইডে যত্নে পলিথিনে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে ব্যাগটাকে। পা উচু করে হাত দিয়ে ধরার চেস্টা করলাম প্রথমে। কিন্তু হাইটে কম হওয়ায় ব্যাগটা লাফিয়ে ধরাও কঠিন আমার জন্য! হতাশ মনে ভাবছিলাম আমি।
হাতের পাশেই কারও শক্ত বাহু আলমারির উপরে হাত দেওয়ায় চমকে উঠলাম আমি। আপনাআপনিই পিছনে ফিরলো শরীর! পেছনে ফিরেতেই পূর্ণর শক্ত বুকের সাথে হালকা ধাক্কা খেয়ে খানিকটা পিছিয়ে আলমারির সাথে লেগে গেলাম আমি! উনার এক হাত আমার মাথার উপরে আলমারির উপরাংশে, আরেক হাতে আমার পাশে আলমারির গায়ে দিয়ে রেখেছেন। ভ্রু কুচকে আমার দিকে চেয়ে আছেন পূর্ণ। এদিকে উনি এত কাছে দাঁড়ানোয় লজ্জায়-অসস্তিতে ঠিকমতো উনার দিকে তাকাতেও পাচ্ছিনা আমি। পূর্ণ খানিকটা ঝুকে এসে ভারী গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
—এভাবে লাফালাফি করছিলে কেন আলমারির সাথে? কি চাই ??
উনার মুখে লাফালাফি শুনে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো আমার। হাইট কম দেখে একবার-আধবার একটু লাফিয়ে ধরার চেস্টা করেছি তাই বলে এভাবে বলবেন? রেগে একটা উত্তর দিতে যেয়েও মনে পড়লো আমি তো উনাকে ইগ্নোর করছি! তাই রাগটুকু গিলে কোন কথা না বলে, গোমড়া মুখ করে ইশারায় ব্যাগটা দেখিয়ে দিলাম উনাকে। আমার হাতের ইশারা বরাবর ব্যাগটা দেখে উনি খুব সহজভাবেই ব্যাগটা নামিয়ে রাখলেম মাটিতে। হাত থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন,
—যেটা করতে পারবেনা সেটা করার চেস্টাও করো কেন, পিচ্চি? খুব চালাক হয়ে গেছো?
উনার কথায় ভ্রু কুচকে গেলো আমার। একটা সামান্য ব্যাগ ধরতে পারিনি বলে এভাবে খোটা দিবেন? খারাপ লোক। দাত কিড়মিড় করে উনাকে কিছু বলতে যাবো ঠিক তখনি উনি বললেন,
—আমি কিন্তু শুধু ব্যাগ নেওয়ার ব্যাপারে বলিনি।
—তাহলে?
খানিকটা অবাক সুরেই কথাটা বেরিয়ে গেলো আমার মুখ থেকে। এবার পূর্ণ কিছুটা এগিয়ে এলেন আমার দিকে। উনার এগোনে দেখে আলমারির সাথে আরও কিছুটা লেপ্টে গেলাম আমি। উনি আবারও খানিকটা ঝুকে এসে বললেন,
—সারাক্ষণ যার পটপট করে কথা বলার অভ্যাস তার জন্য এভাবে চুপ করে থাকাটা সম্ভব নয়। তুমি আমাকে ইগ্নোর করছো বুঝতে পাচ্ছি কিন্তু এই যে কথা বলার জন্য তুমি মনে মনে ছটফট করছো এটাও কিন্তু আমি ঠিকি বুঝতে পারছি। তাই বেশি চালাকি না করে আবার আগের মতো কথা বলা শুরু করো। বুঝেছো, স্টুপিড?
উনার কথায় আমি অবাক হয়ে আড়চোখে তাকালাম তার দিকে। লোকটা কিভাবে বুঝে গেলো আমার মনের কথা? আমি আসলেই ভেতরে ভেতরে কথা বলার জন্য ছটফট করছিলাম কিন্তু উনার গম্ভীরতার কারণেই চুপ করে ছিলাম। এখন উনি যেহেতু নিজে থেকেই কথা বলছেন, আবার আমার সাথে কথা বলতে চাইছেন তাই এভাবে চুপ করে থেকে আর লাভ নেই। এজন্য অবশেষে মুখ খুললাম আমি। মুখ ভেংচিয়ে বললাম,
—আমাকে স্টুপিড বললে কিন্তু কথা বলবোনা আমি আপনার সাথে।
আমার কথায় বাকা হাসলেন উনি। চোখ টিপে বললেন,
—দেখা যাবে।
উনার চোখ টিপা দেখে ভ্রু কুচকে গেলো আমার। কথায় বলেনা ঠিকমতো আবার চোখ টিপ দিচ্ছে! ঢং যত্তসব!! “আনরোমান্টিক বোরিং লোক” ধীর আওয়াজে বিড়বিড় করলাম। আমার কথায় ভ্রু তুলে তাকালেন উনি। চোখ পাকিয়ে বললেন,
—কি বললে তুমি?
উনার প্রশ্ন শুনে আমি থতমত খেয়ে গেলাম। শুনে ফেললো নাকি আবার? কোনমতে বললাম,
—কিছুই নাহ।
—শুনেছি আমি।
রাগী গলায় বললেন উনি। উনার এক্সপ্রেশন দেখে হাসি পেলো আমার। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললাম,
—ভালো হয়েছে শুনেছেন। এখন সরুন আমার সামনে থেকে।
বলে উনাকে সরিয়ে সাইড কেটে যাওয়ার চেস্টা করলাম আমি। কিন্তু উনি বাহু আটকে থামিয়ে দিলেন আমায়। আমি ভ্রু কুচকে উনার দিকে চাইলাম তবে উনি আমার চাহনীকে পাত্তা দিলেন নাহ। আমাকে আলমারির সাথে ঠেশে ধরে এগিয়ে আসতে লাগলেন আমার দিকে। উনার চোখের চাহনী গভীর। যে চাহনীতে তাকিয়ে থাকার সাধ্য নেই আমার। চোখ নিচে নামিয়ে বললাম,
—কি চাই আপনার?
—বলবো?
উনার ধীর গলার গাম্ভীর্যপূর্ণ রহস্যময় আওয়াজে যেন ছিলো এক মাদকতা। আপনাআপনিই হ্যাঁসূচক মাথা নাড়লাম আমি। আমার মাথা নাড়া দেখে নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসলেন উনি। আমি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম সেদিকে। এভাবে কখনো হাসতে দেখিনি উনাকে! হাসতে খুব কমই দেখা যায় লোকটাকে! কিন্তু মাঝেমধ্যে যখন হাসেন তখন উনার থেকে চোখ ফেরানো দায় হয়ে যায়! উফ, এত্ত রহস্যময় কেন লোকটা?
এদিকে আমি তার উত্তরের অপেক্ষায় অস্থির হয়ে আছি আর অন্যদিকে উনি আমাকে আলমারির এক পাশে ধরে রাখা অবস্থায় অন্য পাশের পাল্লা খুলে শার্ট বের করলেন। চোখ পিটপিটিয়ে উনার কর্মকাণ্ড দেখে যাচ্ছি আমি। একটু পর আমাকে হঠাৎই ছেড়ে দিয়ে উনি বললেন,
—শার্ট চাই আমার। বুঝেছো? এখন সরো সামনে থেকে। স্টুপিড।
বলে উনি বাকা হেসে ভাব নিয়ে চুল ঠিক করতে করতে আমাকে সাইড দিয়ে চলে গেলেন ওয়াশরুমে। পুরো ঘটনা যেন মাথার উপর দিয়ে গেলো আমার! যখন বুঝে গেলাম উনি আমাকে বোকা বানিয়েছেন তখন রাগে উনার চুল ছিড়তে মন চাইলো আমার। হাতের কাছে থাকা একটি কাপড় গোল করে রেগে ছুড়ে মারলাম উনার দিকে। পূর্ণর গায়ে না লাগলেও পায়ের কাছে গিয়ে পড়লো কাপড়টা। উনি সেটা দেখে প্রথমে ভ্রু কুচকালেও একটু পর উচ্চস্বরে হেসে উঠে ওয়াশরুমে ঢুকলেন। এদিকে রাগে আমার গা জ্বলছে! লোকটা আসলেই খুব খারাপ। সবসময় এরকম করে আমার সাথে! ধান্দাবাজ লোক কোথাকার!!
__________________
পরেরদিন সকালবেলা বড়াব্বু বাদে আমরা সবাই রেডি হয়ে আছি দাদিবাড়ি যাওয়ার জন্য। বলতে গেলে সবাই অপেক্ষা করছি পূর্ণর জন্য কারণ মহাশয় অনেকক্ষন থেকে ফোনে কথা বলছেন অফিসের লোকদের সাথে। একটু পর উনি এগিয়ে এসে চিন্তিত মুখে বললেন,
—মা, তোমরা সবাই যাও। আমার একটু অফিস যেতে হবে। ওরা কাজটা ঠিকমতো বুঝতে পাচ্ছেনা। আমি জাস্ট বুঝিয়ে দিয়েই চলে আসবো। খুব বেশি টাইম লাগবেনা। আমি অফিস থেকেই ডিরেক্ট চলে যাবো দাদিবাড়ি। তুমি এখন প্রান্তদের সাথেই যাও।
উনার কথায় মনটা খারাপ হয়ে গেলো আমার। লোকটার এত কাজ কেন? একটাদিন অফিস যাবেন না বলেছিলেন তাও আবার ঘুরেফিরে সেখানেই যাচ্ছেন। বড়াম্মু চিন্তিত মুখে বললেন,
—কেন যে তোর এত কাজ বাবা। এসব আমার বুঝে আসেনা একদমই। তাড়াতাড়ি আসিস।
একটু পর থেমে বড়াম্মু বললেন,
—আচ্ছা পূর্ণ, তুই এক কাজ কর। তুরফাকে নিয়ে যা অফিসে। যেহেতু তোর বেশিক্ষণ সময় লাগবেনা তাহলে ওকে নিয়েই গ্রামে যাস একবারে। মেয়েটা অফিসে যায়ও নি কোনদিন, ঘুরাও হবে ওর।
বড়াম্মুর কথায় পূর্ণ ভ্রু কুচকে তাকালেন। বিস্মিত গলায় বললেন,
—ও যেয়ে কি করবে, মা? আমি অফিসে যাচ্ছি, পিকনিকে নয়। তুরফা একা একা বোর হয়ে যাবে বসে থেকে।
—কিচ্ছু বোর হবেনা তুরফা। তুই বেশি জানিস আমার থেকে? এখন কথা না বলে চুপচাপ বের হ নয়তো গ্রামে যেতে দেরি হয়ে যাবে তোর। যা তুরফা, তুইও বের হ পূর্ণর সাথে। আমরাও বের হচ্ছি এখন। আর কোন কথা হবেনা এখানে।
আমি চেয়ে চেয়ে মা-ছেলের কথা শুনছিলাম। তবে শেষের দিকে বড়াম্মুর কড়া গলার নির্দেশ অমান্য করতে পারলাম না আমি আর পূর্ণ। তাই চুপচাপ বের হয়ে গেলাম পূর্ণর সাথে উনার অফিসের উদ্দেশ্যে।
পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে ড্রাইভ করছেন। এদিকে উনার পাশে সিটে বসে বসে আমি মুখ ফুলিয়ে ভাবছি কোথায় ভেবেছিলাম যে একসাথে সবাই গল্প করতে করতে বাড়ি যাবো, এখন উনার সাথে বসে চুপচাপ যেতে হবে আমাকে। ভাবতে ভাবতেই ঘুম ধরেছিল আমার। একটু পর পূর্ণর ডাকে জেগে উঠলাম আমি। অফিসে পৌঁছে গেছি আমরা!
গাড়ি থেকে নেমে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে উনার পিছুপিছু হেটে চললাম অফিসের দিকে..!!
#চলবে