#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ২৫,২৬
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
২৫
অফিসে আমরা দুজন প্রবেশ করতেই আমাদের সালাম দিলেন গার্ডরা। অফিসের সবাই পূর্ণকে দেখে দাঁড়িয়ে “গুড মর্নিং স্যার” বললো। উনিও জবাব দিলেন। যেহেতু সময় বেশি নেই তাই পূর্ণ তখনি আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন সবার সাথে।
—হ্যালো এভরিওয়ান। মিট মাই ওয়াইফ, তুরফা।
সবাই আমাকে সালাম দিয়ে আমায় আর পূর্ণকে কংগ্রেটস জানালো। এরপর পূর্ণ সবাইকে কাজ করতে নির্দেশ দিয়ে আমায় হাত ধরে নিয়ে এগিয়ে চললেন উনার কেবিনের দিকে। সবাই আবার নিজের মতো কাজ করতে লাগলো। এখানে সবাই যে উনাকে অনেক শ্রদ্ধা-সম্মান করে ও মেনে চলে, বিষয়টা বুঝতে পারলাম। আশেপাশে দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম আমি। একটি কেবিনের সামনে গিয়ে দরজা খুলে পূর্ণ ভেতরে প্রবেশ করলেন। এরপর আমার দিকে ঘুরে বললেন,
—এসো।
আমিও চুপচাপ ভদ্র মেয়ের মতো প্রবেশ করলাম সে রুমে। পূর্ণ হাতঘড়িতে সময় দেখলেন এরপর কোন একজনকে ফোন দিয়ে বললেন,
—হ্যালো, আমি ওকে আমার কেবিনে রেখে যাচ্ছি। তুমি একটু এসে চেক করবে ওর কিছু লাগবে নাকি। আর একটু টাইম দিবে ওকে। গট ইট??
ওপাশ থেকে কি জবাব এলো শুনতে পেলাম না তবে পূর্ণ আর কোন কিছু না বলেই ফোনটা কেটে দিলেন। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উনার কর্মকান্ড দেখছিলাম। হঠাৎ উনি আমার হাত ধরে নিয়ে গিয়ে উনার চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। একটু পর কোমল গলায় বললেন,
—কিছু খাবে?
আমি কিছুটা অন্যমনস্কভাবেই “না-বোধক” মাথা নাড়লাম। উনি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেলেন। উনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,
—একটু তাড়াতাড়ি আসবেন, প্লিজ?
পূর্ণ থেমে পেছন ঘুরে এক পলক আমার দিকে চাইলেন। মাথা হেলিয়ে বললেন,
—আমি যতদ্রুত সম্ভব আসার চেস্টা করব। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে দিবোনা তোমায়।
পূর্ণ চলে যাওয়ার পর আমি কেবিনটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। সাজানো পরিপাটি কেবিনটায় কোনকিছু একচুল পরিমাণও অগোছালো নেই। লোকটা বড্ড গোছালো স্বভাবের। নিজে যেমন সুন্দর ফিটফাট, ঠিক তেমনি উনার বাকি সবকিছুই পরিপাটি হওয়া চাই। উনার মতো পরিপাটি লোকের কপালে পড়ে গিয়েছি অগোছালো স্বভাবের এলোমেলো আমি! বলতে গেলে সবদিক দিয়েই আমি পুরোটাই উনার উল্টো স্বভাবের! উনার সাথে আমি কি কোনদিক দিয়েও যাই? আচ্ছা, এজন্যই কি উনি আমাকে ইগ্নোর করেন? আনমনেই হঠাৎ প্রশ্ন উঠলো আমার মনে!
আমার চিন্তায় ছেদ ঘটলো কেবিনের দরজায় নক পড়ার শব্দে। একটি মেয়েলি শব্দ শুনতে পেলাম,
—ভেতরে আসতে পারি?
—আসুন।
একটি ছিমছাম গড়নের উজ্জ্বল বর্ণের মেয়ে প্রবেশ করলো রুমে। আমাকে দেখে মিস্টি হাসি হাসলো, বিনিময়ে আমিও হাসলাম। মেয়েটি বললো,
—আপনিই তুরফা ম্যাম?
নিজের নামের সাথে ম্যাম শুনে সামান্য লজ্জা পেলাম আমি। আলতো গলায় বললাম,
—জি। আপনি?
—আমাকে তুমি করে বলুন, ম্যাম। আমি রিয়া। এখানে কাজ করি। স্যার বলেছিলো আপনি তার কেবিনে বসে আছেন একা। আপনাকে অফিস ঘুরিয়ে দেখাতে বলেছেন।
রিয়ার কথা শুনে আমি উঠে দাড়ালাম চেয়ার থেকে।
—হ্যাঁ চলো। একটু পর থেমে বললাম, আচ্ছা রিয়া। তুমি কি উনার সেক্রেটারি?
ওর দিকে আড়চোখে চেয়ে বললাম আমি। আমার কথায় হেসে ফেললো মেয়েটি। মাথা নাড়িয়ে বললো,
—না ম্যাম, আমি স্যারের সেক্রেটারি নই। উনার সেক্রেটারি রিমন, যে এখন স্যারের সাথে মিটিংরুমে আছে। আমি তো অফিসের স্টাফ, আমার এখন কাজ নেই দেখে স্যার আপনাকে টাইম দেওয়ার জন্য আমায় পাঠিয়েছেন।
রিয়ার কথায় স্তিমিত হাসলাম আমি। মনে মনে খানিকটা স্বস্তি পেলাম মেয়েটা উনার সেক্রেটারি নয় শুনে। পরক্ষণেই নিজের চিন্তাভাবনায় নিজেই বিরক্ত হলাম। মেয়েটা উনার সেক্রেটারি হলেও বা কি হতো? উনার উপর সন্দেহ করিনা আমি। যত্তোসব উটকো ভাবনাচিন্তা আমার! ভাবনার পাল্লা শেষ করে রিয়ার সাথে বের হলাম অফিস দেখতে। ও আমাকে বিভিন্ন কেবিন ও স্টাফরুম দেখাচ্ছিলো। যেহেতু সবাই জানে আমি পূর্ণর স্ত্রী তাই সবাই আমাকে ম্যাম ম্যাম বলে কথা বলা শুরু করে দিয়েছে। কেউ কেউ আমাদের জুটির প্রশংসা করছে। আমিও আর কি করবো, হালকা হেসে সবার সাথে পরিচিত হতে লাগলাম, কথা বললাম।
মিটিংরুমের সামনে দিয়ে হেটে যাচ্ছিলাম রিয়ার সাথে! যেতে যেতেই শুনলাম এক লোক ভারি গলায় বলছে, এবার আপনাদের সামনে প্রেজেন্ট করতে আসবেন আমাদের এমডি “মিস্টার তাজওয়ার চৌধুরী”। হঠাৎ করেই তাজওয়ার নামটা শুনে বুকের মধ্যে ধক করে উঠলো আমার। ছোটবেলার প্রিয় সেই নাম! এতদিন পর? পা-জোড়া যেন আপনাআপনিই থেমে গেলো আমার। এই অফিসে তাজওয়ার ভাইয়াও আছেন? কিন্তু পূর্ণ একদিনও বললেন না যে! পরে ভাবলাম অবশ্য উনার সাথে আমার অফিসের ব্যাপারে কথাই তো হয়নি যে উনি কিছু বলবে!
উৎসুক চোখে মিটিংরুমের দরজার সামান্য ফা-ক দিয়ে উঁকি দিলাম আমি। হালকা অন্ধকার রুমে প্রোজেক্টরের আলোতে পিছন হতে উঠে উনি হেটে গেলেন সামনে। উনি সামনের দিকে ফিরতেই প্রোজেক্টরের উজ্জ্বল আলোতে জ্বলজ্বল করে উঠলো তার সুন্দর চেহারা! পূর্ণকে প্রেজেন্টেশন দিতে দেখে হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো আমার! বিস্মিত নয়নে উনার দিকে চেয়ে রইলাম আমি! পূর্ণই কি তবে আমার সেই তাজওয়ার ভাইয়া? তাহলে উনি কোনদিন আমায় বলেননি কেন?
রিয়ার ডাকে ধ্যান ভেঙে গেলো আমার! কাপা কাপা হাতে মিটিংরুমের দরজাটা কোনমতে লাগিয়ে পাশ ফিরলাম আমি। এ বিস্ময়ের রেশ কাটিয়ে উঠা দায় আমার জন্য!! হৃদয়ের মধ্যে হাতুড়ি পিটছে যেন। মাথার মধ্যে বিভিন্ন প্রশ্নের সমাহার! এদিকে রিয়া আমায় বারবার জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছে এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছি, সামনে যেতে বলছে। আমি কোনরকম ঘোর কাটিয়ে উঠে এগিয়ে চললাম ওর সাথে। মাথার মধ্যে সমীকরণ মিলানোর চেস্টা করতে করতেই আবার পূর্ণর কেবিনের সামনে চলে আসলাম। এবার আমি পূর্নদৃষ্টিতে লক্ষ্য করলাম কেবিনের দরজায়। যার সামনে স্পষ্ট লেখা আছে “এমডি তাজওয়ার চৌধুরী”। বুঝলাম তখন পূর্ণ সামনে দাঁড়িয়ে থাকায় আমি দেখতে পারিনি দরজায় উনার নাম। আনমনেই উনার নামের অক্ষাংশের উপর হাত বুলিয়ে গেলাম আমি।
রিয়া আমাকে ভেতরে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলো কিছু খাবো কি না। আমি আবারও না করলাম কেননা আমার মন এখন অন্য চিন্তায় মগ্ন। এরই মধ্যে রিয়ার ফোন আসায় ও কাজের জন্য চলে গেলো। একা একা বসে ভাবতে লাগলাম পূর্ণর কথা। উনি বড় হওয়ার সাথে সাথে বেশ পরিবর্তন হয়েছেন! ছোটবেলায় সেই তাজওয়ার ভাইয়ার সাথে এখনকার পূর্ণর কোন মিলই পাইনা আমি। তখন কতসুন্দর হাসিখুশি থাকতেন, ভালোভাবে কথা বলতেন আমার সাথে। এখন এরকম চুপচাপ, গম্ভীর কিভাবে হলেন? কি কারণ থাকতে পারে?
অবশ্য একটা বিষয়ে উনার মধ্যে কোন পরিবর্তন ঘটেনি। উনি তখনো আড়াল থেকে আমার কেয়ার করতেন, খানিকটা এখনও করেন। যা উনি প্রকাশ করতে না চাইলেও মাঝেমধ্যে উনার আচরণে প্রকাশ পায়!! মাথা নিচু করেই নিজমনে হালকা হেসে ভাবলাম আমি!
মাথায় টোকা পড়তেই চমকে উঠে উপরে তাকালাম। মাথা তুলে উপরে তাকিয়ে দেখি পূর্ণ দাঁড়িয়ে রয়েছেন আমার সামনে। এক ভ্রু তুলে চেয়ে আছেন আমার দিকে। উনাকে ভালোভাবে খেয়াল করলাম। ফর্সা কপালে মুক্তোর মতো বিন্দু বিন্দু ঘাম। এই ক্লান্ত পরিশ্রান্ত চেহারায়ও কি ভীষণ সুন্দর লাগছে তাকে!! ছোটবেলা থেকেই তাকে প্রচন্ড ভাল্লাগতো আমার। এজন্যই তো উনাকে বিয়ে করতে চাইতাম! আর আজ ভাগ্যের অপরুপ খেলায় আমি ঠিকই তার সাথেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি! ভাবতেই শরীর শিউরে উঠলো আমার! হঠাৎই লজ্জায় গাল দুটো লাল হয়ে উঠলো। তার দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারলাম নাহ আমি! চাহনী ঘুরিয়ে অন্যদিকে ফিরলাম।
—কি হয়েছে তোমার?
বাহু ঝাকিয়ে বললেন উনি আমার। আমি আড়চোখে তার দিকে চেয়ে বললাম,
—কিছু নাহ।
—তাহলে গাল দুটো এভাবে লাল হয়ে আছে কেন? গরম লাগছে?? এসির পাওয়ার কমিয়ে দিবো?
উনার কথায় আমি হাসবো না কাদবো বুঝলাম নাহ। পাগল লোকটা ভাবছে আমার গরম লাগছে! না চাইতেও হেসে ফেললাম আমি! এদিকে আমার হাসির দিকে অবাকচোখে তাকিয়ে আছেন উনি। আমি উনার হাত টেনে বললাম,
—কাজ হয়েছেনা আপনার? এখন চলুন আমরা বের হবো। বড়াম্মুরা পৌঁছেও গিয়েছে এতক্ষণে হয়তো!!
পূর্ণ কিছু না বলে শান্তভাবে মাথা নাড়লেন আমার কথায়। তবে তার প্রশ্নবোধক দৃষ্টি এখনও আমার চেহারার দিকে নিক্ষিপ্ত! সেটা জেনেও বিশেষ পাত্তা দিলাম নাহ উনি! এ বিষয়ে উনার সাথে পরে আলাপ করবো। আপাতত গ্রামে যাওয়া বেশি জরুরি।
_____________
অফিস থেকে বের হয়ে রাস্তার পাশে দাড়িয়ে আছি। পূর্ণ পার্কিং থেকে গাড়ি বের করতে গেছেন। এখান থেকে খানিকটা দূরে রাস্তার অপর সাইডে হাওয়াইমিঠাই বিক্রি করছেন এক লোক। এক কপোত-কপোতী একসাথে হাওয়াইমিঠাই খাচ্ছে। ছেলেটা মেয়েটাকে খাইয়ে দিচ্ছে আর খুব হাসাহাসি করছে দুজনে। সেদিকে একমনে চেয়ে আছি আমি। ছেলেটার জায়গায় পূর্ণকে আর মেয়েটার জায়গায় আমায় কল্পনা করতেই আনমনেই কিটকিটিয়ে হেসে উঠলাম আমি। গাড়ির হর্ণ কানে যেতেই তাকিয়ে দেখি পূর্ণ এসে গেছেন।
উনি গাড়ি থেকে নেমে আমার জন্য অপরপাশের দরজা খুলে দিলেন আমার জন্য। আমিও হেটে গিয়ে বসলাম গাড়িতে। উনি কিছু একটা ভেবে বললেন,
—আমি এক মিনিটে আসছি। বসো একটু।
আমি প্রথমে গোলগোল চোখে তাকালেও একটু পরে মাথা নেড়ে সায় দিলাম। উনি গাড়ি লক করে বের হয়ে চলে গেলেন। চোখটা একটু লেগেছিলো ঠিক এমন সময় পূর্ণ ফিরে এলেন গাড়িতে। উনার দিকে তাকানোর আগেই হাতে দুটো হাওয়াই মিঠাই ধরিয়ে দিলেন আমার! খানিকটা অবাক হয়েই একবার উনার দিকে একবার উনার হাতে রাখা হাওয়াইমিঠাই এর দিকে তাকালাম আমি! উনি ঠিক কখন খেয়াল করলেন আমি হাওয়াই মিঠাই এর দিকে তাকিয়ে ছিলাম জানিনা তবে তাকে কোনকিছু না বলতেই তার করা ছোট ছোট কাজগুলো মনে দাগ কাটে আমার!! একগাল হেসে হাওয়াই মিঠাই নিলাম উনার থেকে। উনিও হালকা হেসে সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালু করলেন।
আজ কেন জানি উনার দিকে আড়চোখে তাকাতেও লজ্জা লাগছে আমার! ফাকা রাস্তায় উঠতেই জানালার কাচ অর্ধেক খুলে দিলাম আমি। সাই-সাই করে শরতের স্নিগ্ধ বাতাস প্রবেশ করলো গাড়ির ভেতরে। ছুয়ে দিয়ে গেলো আমায় আর পূর্ণকে। যে বাতাসে জুড়িয়ে গেলো মন, প্রাণ সব। সকালবেলা উনার সাথে আসতে আসতে যতটা বোর ফিল করবো ভেবেছিলাম আমার, এখন মনের অজান্তেই উনার সাথে বসে রাস্তাটা উপভোগ করছি।
আরেকবার আড়চোখে উনার দিকে তাকাতেই তার চোখে চোখ আটকে গেলো আমার! যে দৃষ্টিতে আজ ছিলোনা কোন গাম্ভীর্য, ছিলোনা কোন রাগ, ছিলো শুধুই একরাশ মুগ্ধতা!!
#চলবে
#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ২৬
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
গ্রামের ফাঁকা রাস্তা দিয়ে সাই-সাই করে ছুটে চলছে গাড়ি। কিছুক্ষণের মধ্যেই দাদিবাড়ি পৌঁছে যাবো আমরা। গ্রামের খোলা পরিবেশ আর সবুজ ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে যেতে যেতে অনুভব করলাম নির্মল ঠান্ডা বাতাসের ছড়াছড়ি। সেই বাতাসকে পুরোপুরি উপভোগ করতে জানালার কাচ পুরোটুকুন নামিয়ে দিয়েছি আমি! বাতাসের তোড়ে আমার খোলা চুলগুলো উড়ে চলছে আপন গতিতে, এমনকি আমার কাছে সীমাবদ্ধ না থেকে ছুয়ে দিচ্ছে পূর্ণকেও! আড়চোখে উনার দিকে তাকালাম আমি। একমনে সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভ করছেন উনি। আমার চুলগুলো যে উনার চোখে-মুখে লেগে ডিস্টার্ব দিচ্ছে সেদিকে যেন কোন ভ্রুক্ষেপই নেই তার!!
লোকটা বড্ড চাপা! বিরক্ত হলেও তো বলবেনা। এজন্য আমি নিজে থেকেই চুলগুলো টেনে নিয়ে হাতখোপা করতে লাগলাম যাতে উনার সমস্যা না হয়। একমনে খোপা করতে করতেই উনার কণ্ঠ শুনতে পেলাম,
—কি ব্যাপার? চুল বাধছো কেন? খোলা চুলে থাকতে কোন সমস্যা হচ্ছে?
উনার কথায় থতমত খেয়ে গেলাম আমি! খোলা চুলে থাকতে আবার আমার সমস্যা হবে কেন? উনার যাতে সমস্যা না হয় এজন্যই তো আমি চুল বাধছিলাম! অবাক হয়ে বললাম,
—আমার কেন সমস্যা হবে বলুন তো? চুলগুলো উড়ে গিয়ে তো আপনার চোখেমুখে বাজছিলো। আপনার যাতে ড্রাইভ করতে ডিস্টার্ব না হয় এজন্যই তো আমি চুল বাধছিলাম!
—আমি তোমাকে একবারও একবারো বলেছি আমার কোন ডিস্টার্ব হচ্ছে?
উনার শান্ত স্বরের প্রশ্ন শুনে আপনাআপনিই চোখ গেলো আমার তার দিকে! উনি গভীর চোখের চাহনী নিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। তার প্রশ্নের কোন জবাব আমি দিতে পারলাম নাহ! আসলেই উনি তো কিছু বলেননি!
চুলগুলো ছেড়ে চুপচাপ মুখ ফিরিয়ে নিলাম আমি। এবার উনিও সামনের দিকে তাকিয়ে পুনরায় ড্রাইভ করায় মনোযোগ দিলেন। দেখতে দেখতেই আমরা পৌঁছে গেলাম দাদিবাড়ি। উঠোনের পাশে খোলা জায়গায় আরেকটি গাড়ি দেখে বুঝলাম বড়াম্মুরা এসেছেন। পূর্ণ গাড়ি থেকে নেমে আমার জন্য গাড়ির দরজা খুলে দিলেন। আমিও কথা না বলে বের হয়ে হাটতে শুরু করলাম ভেতরের দিকে। আচমকা হাতে টান পড়ায় পেছনে ফিরে তাকালাম আমি। পূর্ণ আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি দুই ভ্রু তুলে ইশারায় উনাকে জিজ্ঞেস করলাম “কি হয়েছে?”
পূর্ণ কোন জবাব না দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন আমার দিকে। তারপর আলতো হাতে আমার শাড়ির আঁচলটুকু নিয়ে মাথায় বসিয়ে দিয়ে খানিকটা পিছিয়ে গেলেন। আমি বিস্মিত নয়নে দেখছিলাম তাকে। উনি কয়েক মুহুর্ত আমাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলেন।
—এবার ঠিক আছে। এখন একদম নতুন বউ লাগছে!!
হঠাৎ করেই আমার গাল টেনে দিয়ে বললেন উনি। এদিকে উনার কথায় আর কাজে লজ্জায় লাল বর্ণ ধারণ করলো আমার গাল দুটো। মাথা নিচু করে রইলাম চুপচাপ। আমাকে চুপ থাকতে দেখে পূর্ণ কিঞ্চিৎ কেশে বললেন,
—কি ব্যাপার? এভাবে বাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে সময় নস্ট করছো কেন? সবাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ভেতরে চলো।
বলেই আমার হাত ধরে হনহন করে হেটে চললেন বাড়ির ভেতর। এদিকে আমি অবাক হয়ে চেয়ে আছি উনার দিকে! আমি নাকি সময় নস্ট করছিলাম?? বলে কি! এই লোকটার মুড কেমন মিনিটে মিনিটে চেঞ্জ হয় যেটা আমার পক্ষে ভাবা দায়!!
______________
বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতেই একটি মধ্যবয়সী মহিলা আমাদের হাসিমুখে বরণ করলেন। আমাদের ভেতরে আসতে দিয়ে আমার গালে হাত রেখে বললেন,
—তুই আমাদের তুরফা? আমায় চিনেছিস? আমি তোর কাকি হই। এত্ত বড় হয়ে গেছিস, বুড়ি? সেই যে ছোট্ট থাকতে দেখেছিলাম তোকে। একদম পুতুলের মতো ছিলি।
—আর এখন দেখতে ভালো নেই, কাকিমা?
দুঃখী দুঃখী মুখে প্রশ্ন করলাম আমি। আমার কথায় কাকি উত্তর দেওয়ার আগেই পাশ থেকে পূর্ণ বিরবির করে বললেন,
—নাহ, এখন দেখতে পেত্নীর মতো লাগে।
উনার কথা শুনে রেগে চোখ পাকিয়ে তাকালাম তার দিকে। উনি সেটা দেখেও দেখলেন না এমন ভাব করলেন। কাকিমা হেসে বললেন,
—আরে পাগলি এখন তো দেখতে আরও সুন্দর হয়েছিস। এটাও আবার বলা লাগে?
কাকিমার কথায় হেসে ফেললাম আমি। এক এক করে ফুপি, চাচুদের সাথে পরিচয় হলো আমার। এতদিন পর পরিবারের এত্তজনকে সাথে পেয়ে আমি আবেগাপ্লুত হয়ে সবার সাথে কথা বলছি আর কুশল বিনিময় করছি। দাদি নামাজ পড়ছেন বিধায় এখনও আসেননি। বাকি সবাই জিজ্ঞেস করছেন কেমন ছিলাম এতদিন, কত মিস করেছে সবাই আমায়! একিসাথে তারা আমায় আদর করছেন, আমায় কত খুজেছে এগলো বলছেন! আমিও সেসব মনোযোগ দিয়ে শুনছি, তাদের আদর উপভোগ করছি আর সবার সাথে কথা বলছি।
আড়চোখে চোখ গেলো পূর্ণর উপর, যিনি পারতপক্ষে সোফায় বসে বসে প্রান্ত ভাইয়ার সাথে কথা বললেও উনার চোখ আমার দিকে। যেটা দেখে একিসাথে লজ্জা ও অসস্তিতে পড়লাম আমি! হয়েছেটা কি উনার? সবার সামনে এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন লোকটা? কেউ দেখলে তো লজ্জায় আমাকেই পড়তে হবে!!
আমার ভাবনার মধ্যে চলে এলেন একজন বয়স্কা নারী। যাকে আমি না চিনেও এক দেখাতেই চিনে ফেলেছি। উনি হলেন আমার দাদি। উনাকে ধরে নিয়ে আসছিলেন বড়াম্মু। দাদি আমায় দেখেই কাদতে শুরু করলেন। আমায় দুহাতে জড়িয়ে ধরে অজস্র চুমোয় ভরে দিলেন আমার মুখ। এতদিন পর প্রিয়জনদের অঢেল ভালোবাসা পেয়ে চোখ দিয়ে আনন্দাশ্রু ঝরে পড়লো আমার নিজেরও! যেই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা দায়!
—আমার তুর, আমার বাচ্চাটা। আমার ছোটছেলের রেখে যাওয়া শেষ স্মৃতি। এতদিন কই ছিলি তুই? কত খুজেছে সবাই তোকে জানিস? যেদিন তোর বাপ-মা মরলো আর তুই হারায় গেছিলি সেদিন ছিলো আমাদের জন্য সবচেয়ে দুঃখের দিন। আর আজ তোকে ফিরে পেয়ে আমার চেয়ে খুশি কেউ নাই। আজ তোর খাতিরযত্নের কোন অভাব হবেনা। ওরে ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরেছে!! চল আমার সাথে।
বলেই দাদি আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন খাবার-টেবিলে। এদিকে টেবিলভরা খাবার দেখে আমার মাথা ঘুরে উঠলো। এত্ত এত্ত রান্না করেছে সবাই আমার জন্য, এত খাতিরযত্ন, আদর-ভালোবাসা দিয়েছে এখানে সবাই আমায়। এমন দিন আমার কপালে আসবে এটা কি আমি ভেবেছিলাম কখনো? হয়তো এজন্যই সৃষ্টিকর্তা বলেছেন দুঃখের পরেই সুখ আছে। আজ নিজের পরিবারকে ফিরে পেয়ে এত বছরের দুঃখের কথা একবারো মনেও পড়ছেনা আমার!
খেতে যেয়ে বসলো আরেক বিপত্তি। দাদির নির্দেশে বড়াম্মু-কাকিমারা আমায় একটার পর একটা খাবার তুলে দিচ্ছেন আর আমি মানাও করতে পাচ্ছিনা। মনে হলো যেন খেতে খেতে বেহুশ হয়ে যাবো। ভাবখানা এমন যেন মেয়েআদর না, জামাইআদর হচ্ছে এখানে। এদিকে আমি পরিবারের ভালোবাসার স্রোতে হাবুডুবু খাচ্ছি, অপরদিকে সোফায় বসে আমার বেহাল দশায় মজা লুটে নিচ্ছেন প্রিয়া, প্রান্ত ভাইয়া, রাইসারা। আমি করুণ চোখে চেয়ে রইলাম তাদের দিকে। ঠিক তখনি পূর্ণ ভাইয়া এসে বললেন,
—কাহিনি কি দাদি? তোমার কি একটাই নাতি এসেছে নাকি বাসায়? আমাদেরকে চোখে পড়েনা?
পূর্ণর কথায় দাদি একগাল হেসে বললেন,
—তোরে চোখে পড়বেনা এমন সাধ্য কারও আছে, বাপজান? তুরফা বড় হওয়ার পর এই প্রথম গ্রামের বাড়িত আসছে, তোরা তো মাঝেমধ্যেই আসিস। এত বছর ওর খেয়াল রাখতে পারিনি, একদিনে তো পোষাতে পারবোনা। তাও আজ আমাদের মন ভরে ওর যত্ন করতে দে।
—সোজাসুজি বললেই পারো ভাইয়া যে তোমার তুরফার থেকে হিং/সা হচ্ছে।
প্রান্ত ভাইয়াও উঠে এসেছেন সোফা ছেড়ে ততক্ষণে। পূর্ণ রাগী দৃষ্টি নিক্ষে/প করলেন সেদিকে। প্রান্ত ভাইয়া সেটাকে পাত্তা না দিয়ে আমায় বললেন,
—জানো তুরফা, এতদিন দাদুবাসায় সব কাজিনরা এলেও ভাইয়া সবচেয়ে বেশি এটেনশন পেতো। সবচেয়ে বেশি খাতিরযত্ন ওরই হতো। আর আজকে তুমি সেটা নিয়ে নিলে। এজন্যই ভাইয়ের খুব হিং/সা হচ্ছে। জ্ব/লছে বড় ভাইয়া তোমার থেকে।
প্রান্ত ভাইয়ার কথায় হেসে উঠলো সবাই। আমি খাচ্ছিলাম বিধায় কিছু বললাম না। মিটিমিটি হেসে শুনতে লাগলাম উনাদের কথা। পূর্ণ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন,
—আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই আমার যে তুরফার মতো পিচ্চির থেকে জ্ব/লবো। তোরা পারিসও বটে!
সবার সামনে পিচ্চি বলার রাগে গা জ্ব/লে গেলো আমার। মুখে খাবার নিয়েই চোখ পাকিয়ে তাকালাম উনার দিকে। বিনিময়ে পূর্ণ বাকা হাসি দিলেন। লোকটার ঢং দেখে বাচিনা। উনাকে ভেংচি কে/টে খাবার শেষ করে উঠলাম আমি। সবার সাথে গল্প-খু/নসুটি চলতে লাগলো আর অনেকক্ষণ!!
_______________
সন্ধ্যায় উঠোনে বসে আছি দাদির সাথে। শরতের বাতাস যেন গায়ে হিম ধরিয়ে দিচ্ছে কিছুটা। শরীরে-মাথায় ওড়না পেচিয়ে চুলোর কাছে বসে আছি আমি। বড়াম্মু-কাকিমা রা পিঠা বানাচ্ছে এক পাশে। অন্যপাশে আমি, রাইসা ও প্রিয়া বসে বসে দাদির গল্প শুনছি। বাহির থেকে ছেলেরা সবাই ফিরলো ঘরে। বিকেলে সবাই একসাথে বাজারের দিকে গিয়েছিলেন। পূর্ণ হাত-মুখ ধুয়ে আসতেই দাদি উনাকে বসার জন্য টুল দিলেন। উনি দাদির পাশে বসলেন, আমার মুখোমুখি। আড়চোখে চেয়ে রইলাম আমি উনার দিকে। আগুনের আলোয় চেহারায় অন্য সৌন্দর্য এসেছে সবার মধ্যে, আর আমার চোখ দুটো পূর্ণর দিকে আটকিয়ে। কেন হঠাৎ করে লোকটাকে এত ভালো লাগছে আমার??
আমার ভাবনাচ্ছে/দ হলো দাদির কথায়। পূর্ণর দিকে ঘুরে উনি বললেন,
—একটা কথা ভাবতেছিলাম, বাপজান। যদি তুমি রাজি থাকো তাইলে।
—কি কথা দাদি? বলে ফেলো।
—এতদিন পর তুরফা আমাদের কাছে আসছে। ওর সাথে মনভরে কথাই বলা হলোনা। আসলাই তো তোমরা দুইজন দুপুরে। তাই ভাবতেছিলাম রাতে তুরফা আমার সাথেই থাকবে। সব মেয়েরা একসাথে রাতভর গল্প করবো আমার রুমে। জানি নতুন নতুন বিয়ে তোদের, বর-বউরে আলাদা রাখা উচিত না। তাও মনে আসলো কথাটা এজন্য তোরে বললাম। তুই যা বলবি তাই হবে। এতে তোর কোন সমস্যা নাই তো?
পূর্ণর হাস্যোজ্জ্বল মুখটা হঠাৎ করেই গম্ভীর হয়ে গেলো। আগুনের তাপে যে মুখটা উজ্জ্বল হয়েছিলো তাতে হঠাৎ করেই অন্ধকার নামলো! এদিকে দাদির কথায় থম মে/রে আড়চোখে উনার দিকে চেয়ে রইলাম আমি। দাদির মতো আমিও বসে রইলাম উনার উত্তর জানার অপেক্ষায়..!!
#চলবে