বৃষ্টিময়_প্রেম #পর্বঃ২৭,২৮

0
1091

#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ২৭,২৮
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
২৭

দাদির কথায় চকিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন পূর্ণ। আড়চোখে একবার আমার দিকে তাকালেন, উনার দৃষ্টি নিজের দিকে পড়তে দেখেই চোখ সরিয়ে নিলাম আমি। পরক্ষণেই আবার এক পলক তার দিকে চাইলাম ঠিকই, তবে উনি ভেতরে ভেতরে কি ভাবছেন তা উনার মুখ দেখে খুব একটা বুঝার উপায় নেই! খানিকক্ষণ বাদে শুষ্ক কেশে বরাবরের ন্যায় গম্ভীর গলায় দাদিকে বললেন,

—তোমার নাতনি এতবছর পর এসেছে তুমি ওর সাথে থাকার ইচ্ছে করতেই পারো, দাদি। আমার এতে কোন আপত্তি নেই। তবে তুরফার ঘুমানো কিন্তু একদমই ভালো নয় আগেই বলছি। ও যেভাবে বিছানা দখল করে রাখে তা আর না-ই বলি। মাঝেমধ্যে মনে হয় আমিই পড়ে যাবো খাট থেকে। প্রতিদিন ভয়ে ভয়ে ঘুমাতে হয় আমায় ওর জন্য। তুমি বুড়ো মানুষ, এ বয়সে খাট থেকে পড়ে গেলে হাড়-হাড্ডি একটাও আস্ত থাকবেনা৷ তোমার জন্য চিন্তা হচ্ছে আমার! সাবধানে থেকো, দাদি।

পূর্ণর কথা শুনে হাসির রোল পরে গেলো উঠোনজুড়ে। এদিকে আমার চক্ষু চড়কগাছ! উনি যে আমার সম্পর্কে এমন কথা বলবেন সবার সামনে সেটা কখনো কল্পনায়ও আনিনি আমি! রাগে দাত কিড়মিড় করে তাকালাম উনার দিকে! আমি কবে উনার পুরো বিছানা দখল করলাম? অযথাই একটা বলে দিলেন সবার সামনে! এখন রাগের চোটে মনে হচ্ছে উনার মাথা ফাটিয়ে দিই! এদিকে বাকি সবাই হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে! আর পূর্ণ চেহারার এমন ভাব করে আছেন যেন এই মুহুর্তে উনার চেয়ে সত্যবাদী দুনিয়াতে আর কেউ নেই! উনার কথা বলার সিরিয়াস ভঙ্গিমা দেখে কারও বুঝারও জো নেই যে উনি ঠাট্টা করছেন নাকি সত্যি বলছেন। তাই বিষয়টা সত্য হোক আর মিথ্যা, সবাই এখন সেটার মজা নিতেই ব্যস্ত! মাঝখান থেকে শুধু আমার ইজ্জতের ফালুদা বানিয়ে দিলেন খারাপ লোকটা।

পূর্ণর থেকে চোখ সরিয়ে দেখি বাকি ছেলেরাও হাতমুখ ধুয়ে এসে পড়েছে। বড়াম্মু, কাকিমারা চুলো থেকে গরম গরম তেলপিঠা তুলে দিচ্ছেন সবাইকে।আমি একটা পিঠা চুলো থেকে তুলে এনে ফু দিয়ে দিয়ে ঠান্ডা করছিলাম মনোযোগের সাথে। কারণ আমি আবার একদম গরম গরম খাবার খেতে পাইনা। জিব পুড়ে যায় আমার। তাই কিছুক্ষণ পর এক কামড় যেই না মুখে দিয়ে দেখবো ঠান্ডা হয়েছে কি না এমন সময় হাত থেকে পিঠেটা কেড়ে নিলো কেউ। অবাক হয়ে সামনে চেয়ে দেখি পূর্ণ মহাশয় মহা আয়েশে নিজের জায়গায় বসে আমার ঠান্ডা করা পিঠা খাচ্ছেন। আরেকদফা উনার প্রতি রাগ হলো আমার। লোকটা কি শুরু করেছেন সন্ধ্যা থেকে? সকাল থেকে দাদুবাড়ি আসার আগ পর্যন্ত কত সুন্দর ব্যবহার করছিলেন আমার সাথে আর এখানে আসার পর আবার আগের মতো খাটাশ হয়ে গেলেন!

—আপনি আমার পিঠা নিলেন কেন? আপনার লাগলে আমি তো অন্য একটা তুলে দিতামই। ওটা আমি ঠান্ডা করেছিলাম, সেটাই নিতে হলো আপনার?

চোখ পাকিয়ে পূর্ণর দিকে তাকিয়ে বললাম আমি। উনি এক পলক আমায় দেখে আমার কথাকে পাত্তা না দিয়ে মনের সুখে পিঠা খেতে লাগলেন যেন তার জীবনে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কোন কাজ নেই!! এদিকে সবাই মিটিমিটি হাসছে আমাদের দেখে। অবশেষে ফোস করে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি নতুন করে আরেকটি গরম পিঠা আমার বাটিতে তুলে নিয়ে ঠান্ডা করতে লাগলাম। এরই মধ্যে দাদির আওয়াজ শুনে তার দিকে তাকালাম,

—কত বছর পর তোদের দুজনের খুনসুটি দেখছি! মনটাই ভরে গেলো আমার! ছোটবেলায় ঈদে দেখা হলেই তো একসাথেই থাকতি তোরা। এখন তোদের বিয়ে হওয়ায় বেশ হয়েছে। আমি অনেক খুশি হয়েছি। খুব মানিয়েছে আমার প্রিয় নাতি-নাতনিকে একসাথে। মাশাল্লাহ!!

দাদি হাসিমুখে বললেন। তার সাথে হেসে মাথা নাড়লো সবাই। এরই মাঝে ছোট চাচু বললেন,

—তবে পূর্ণ কাজটা ঠিক করলোনা, মা। তুমি আর যাই বলো এটা তো আমরা সবাই জানি যে ছোট থেকেই তুরফা মামনি গরম পিঠা খেতে পারেনা। বেচারি এতক্ষণ ধরে ফু দিয়ে ঠান্ডা করেছে আর পূর্ণ তখনি নিয়ে নিলো। অথচ ছোটবেলায় তো ও নিজেই তুরফার জন্য পিঠা ঠান্ডা করে দিতো আর …

ছোট চাচুর কথা শেষ না হতেই হঠাৎ করে বিষম খেলেন পূর্ণ। যার কারণে মাঝপথে থেমে গেলেন চাচু। কাকিমা পাশ থেকে পূর্ণকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললেন,

—আস্তে খা, বাবা। খাওয়ার সময় এত তাড়াহুড়ো করার কি আছে??

কোন উত্তর না দিয়ে চুপচাপ পানি খেতে লাগলেন উনি। এদিকে ছোট চাচুর পুরো কথা শুনার জন্য ছটফট করছে আমার মন! পূর্ণ ছোটবেলায় আমার জন্য পিঠা ঠান্ডা করে দিতো? আর কি কি করতেন উনি? এসব তো মনেই নেই আমার ঠিকমতো! আমি পিঠা খেতে খেতে চোখ গেলো পূর্ণর দিকে। উনি শান্তভাবে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। উনার থেকে চোখ সরিয়ে তাই ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে ছোট চাচুকে জিজ্ঞেস করলাম,

—কি বলছিলে যেন চাচু? শেষ করলে না যে!

চাচু পুনরায় কিছু বলার আগেই মুখ খুললেন পূর্ণ। চাচুর কথা এক প্রকার ছিনিয়ে নিয়ে নিজেই বললেন,

—আরে চাচু, আমি তো জানতাম না যে তোমাদের আদরের ভাস্তি এখনও আগের মতোই আছে। আমি ভেবেছিলাম হয়তো সময়ের সাথে বড় হয়ে গেছে ও। কিন্তু আমার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিলো তুরফা যে ও শরীরে বাড়লেও বাকি সব দিক থেকে এখনও সেই ছোটবেলার মতোই স্টুপিড আছে।

পূর্ণর কথায় চাপা পড়ে গেলো চাচ্চুর কথা। হেসে উঠলেন চাচু। একিসংগে আরেকদফা হাসির রোল পড়লো উঠানজুড়ে। লোকটা মনে হয় আজ আমাকে হেনস্তা করার জন্যই মুখ খুলছেন বারবার! উনার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভাবলাম আমি! এরই মাঝে পূর্ণ একটা শয়তানি হাসি দিলেন আমার দিকে তাকিয়ে। মুখ বেকিয়ে উনার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আমি দাদিকে বললাম,

—আচ্ছা দাদি, এসব বাদ দেও। আমি যাওয়ার পর কি কি মজার ঘটনা ঘটেছে ঈদে, আমি কি কি মিস করেছি সেগুলো বলো। কতদিন ধরে ইচ্ছে ছিলো পরিবারের সাথে আড্ডা দেওয়ার, গল্প করার। আজ পূরণ হবে! সব গল্প শুনতে চাই আমি!

আমার উচ্ছাসিত মুখ দেখে হেসে ফেললো সবাই। চাচু-কাকিমারাও যোগ দিলেন দাদির সাথে গল্প শুনাতে। মাঝেমধ্যে প্রান্ত ভাইয়া কিছু একটা বলছে যেটা নিয়ে পূর্ণর সাথে উনার কথা কাটাকাটি হচ্ছে, দুই ভাইয়ের খুনসুটি দেখতেও বেশ মজা লাগছে! এদিকে সবার গল্প শুনতে শুনতে হাসিঠাট্টায় মেতে উঠেছি আমি। এতক্ষণ হাসলেও আনমনেই চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু জলের উপস্থিতি টের পেলাম আমি! তবে কেউ দেখে ফেলার আগেই তা দ্রুত মুছে ফেললাম! এতবছর পর এই প্রথম কোন আড্ডায় নিজেকে ‘পর’ লাগছেনা। কেননা আশেপাশে যারা আছেন তারা সবাই আমার আপন মানুষ, আমার আপনজন। দাদুবাড়ির বিশাল উঠোনটা এই হালকা শীতের মধ্যেও সরগরম হয়ে গেছে এত প্রাণের উপস্থিতি পেয়ে! হাসিমুখে মাথার উপরের বিশাল আকাশের দিকে তাকালাম আমি। আকাশের কোণে ঝুলে থাকা চাঁদটাও যেন হাসছে আজ আমার খুশিতে!

______________

দাদির ছোট্ট রুমে গাদাগাদি করে শুয়ে-বসে আছি সব মেয়েরা। গভীর রাত পর্যন্ত পরিবারের সব ছেলেমেয়েরা মিলে আড্ডা দিয়ে চলে গিয়েছে যে যার ঘরে। যাওয়ার সময় পূর্ণ একটাবারও তাকালেন না আমার দিকে! আমিও চুপচাপ দাদির রুমে চলে এসেছি। অবশ্য পরে দাদির কথায় শুধু আমিই নয়, তার ঘরে থেকে গেছি আমরা সব মেয়েরা। বড়াম্মু-কাকিমারা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। রাইসা বেচারি প্রান্ত ভাইয়ার থেকে দূরে থাকার কস্টে উনার সাথে মেসেজে আলাপ করছে। প্রিয়া ফ্লোরে করা বিছানায় ইতোমধ্যে ঘুমিয়ে কাদা আর এদিকে আমি মাটিতে বসে আছি দাদির সামনে, যিনি আমার চুল আচড়ে দিয়ে বেনি করে দিচ্ছেন!

দাদির সাথে আমার শোয়ার কথা থাকলেও বড়াম্মুর কোমড়ে ব্যাথার সমস্যা থাকায় তাকেই খাটে থাকার জন্য জোর করলাম আমি। আর যাই হোক বড়াম্মুকে নিচে শুয়ে কস্ট পেতে দিয়ে দাদির সাথে খাটে ঘুমাতে পারবোনা আমি। আমার চুল বেনি করা শেষ হতেই দাদি বললেন,

—যা তুরফা। শুয়ে পড়। সবাই শুয়ে শুয়েই গল্প করবো, অনেকক্ষণ ধরেই তো বসে আছি।

দাদির বড়াম্মুদের রেস্ট লাগবে ভেবে আমিও মাথা নেড়ে শুয়ে পড়লাম। রাইসা খাটের একপাশে শুয়ে ফোনে মেসেজ করেই যাচ্ছে, অন্যপাশে কাকিমা ইতোমধ্যে নাক ডাকছেন। দরজার কাছে এক পাশে প্রিয়া ঘুমাচ্ছে তাই ওর পাশে জায়গা দেখে বালিশ-কাথা নিয়ে শুয়ে পড়লাম আমি। দাদি বলেছিলেন গল্প করবেন কিন্তু উনি নিজেও নাক ডাকা শুরু করেছেন বিছানায় গা এলিয়েই। কোথায় গল্প কোথায় কি, রুমের বেশিরভাগ মানুষই ঘুমাচ্ছে এখন ক্লান্তির চোটে। আমি নীরবে হাসলাম সেদিকে তাকিয়ে! চোখ বন্ধ করতেই ক্লান্ত শরীরে এসে ভর করলো রাজ্যের ঘুম! ঘুমের সাগরে তলিয়ে গেলাম আমি…

_______________

গায়ে হিম-বায়ু অনুভব হতেই ঘুমের রেশ কেটে গেলো আমার। গায়ের কাথাটা সরে গেছে বুঝে চোখ বন্ধ করেই কাথাটা খুজলাম। না পেয়ে চোখ খুলে পাশে তাকিয়ে দেখি প্রিয়া আমার কাথাটা টেনে কোলবালিশ বানিয়ে ঘুমাচ্ছে। এদিকে গায়ে ঠান্ডা লাগছে বেশ কিন্তু ওর থেকে কাথা টানলেও প্রিয়া দিচ্ছেনা, বেশ জোর দিয়েই চেপে ধরে ঘুমাচ্ছে। হতাশ হয়ে কাথা ছাড়াই ঘুমানোর চেস্টা করলাম আমি। ঠান্ডায় ঘুম তো ধরলোই না, উল্টো পিপাসা পেলো আমার। মনে করলাম পানির তৃষ্ণায়ই ঘুম ধরছেনা তাই রুমের দরজা খুলে পানি খাওয়ার জন্য ডাইনিংরুমের এর দিকে গেলাম আমি।

পানি খেয়ে গ্লাসটা টেবিলে রাখতেই মনে হলো আমার পেছনে যেন কেউ আছে। যেহেতু ঠান্ডা লাগছিলো তাই ঘাড়ের কাছে গরম নিশ্বাস অনুভব করতেই মানুষটার উপস্থিতি টের পেলাম আমি! কিন্তু এ সময় কে আসবে? সবাই তো ঘুমিয়ে থাকারই কথা! বাড়িতে চোর ঢুকেনি তো? উল্টোপালটা ভাবতে ভাবতেই পেছনে ঘুরে একটা চিৎকার দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম মনে মনে! পেছন ফিরতেই ধাক্কা খেলাম কারও শক্ত বুকের সাথে, খানিকটা পিছিয়ে ডাইনিং এর চেয়ারের সাথে বারি খেতে ধরলাম আমি কিন্তু তার আগেই আমাকে টেনে কাছে আনলেন পূর্ণ। পুরো বাড়িতে এখন ড্রিমলাইট আর জানালার পর্দার ফাকে দিয়ে আসা চাঁদের আলো ব্যতীত কোন আলো নেই! এর মাঝেও স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমি তার চেহারা! আমার মতো উনিও বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছেন আমার মুখপানে!
দুজনেই অবাক হয়ে হঠাৎ একসাথেই ধীর গলায় বলে উঠলাম,

—তুমি/আপনি এখানে??

#চলবে

#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ২৮
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা

আমার এক কদম সামনে দাঁড়িয়ে আছেন পূর্ণ। ইষৎ অন্ধকার ঘরে দুজনের দৃষ্টি দুজনার পানে। হাত ছেড়ে দিলেও দূরত্ব বাড়েনি আমাদের মাঝে। উনি কিছুক্ষণ পর ধীম আওয়াজে ধমকিয়ে বললেন,

—এত রাতে ঘুমাওনি কেন? গল্প কি এখনও শেষ হয়নি তোমাদের??

ভ্রু কুচকে তাকালাম আমি উনার দিকে। এমনভাবে বলছেন যেন আমি কি একাই জেগে আছি এত রাতে আর উনি ঘুমের মধ্যে হেটে এসেছেন এখানে। তীক্ষ্ণ স্বরে বললাম,

—ঘুমিয়েছিলাম আমি। পানির তৃষ্ণায় ঘুম ভেঙে গেছে তাই এখানে এসেছিলাম। কিন্তু আপনি ঘুমাচ্ছেন না কেন? আমার তো তাও জেগে থাকার একটা কারণ ছিলো, আপনার তো ছিলোনা। তাহলে আপনি কি করছেন এখানে এত রাতে?

আমার কথায় সুচারু দৃষ্টিতে চাইলেন উনি। যেই দৃষ্টি বোধগম্য হলোনা আমার। তবে উনি আমার প্রশ্নের সরাসরি উওর দিলেন নাহ। মৃদু কণ্ঠে বললেন,

—ঘুম ধরছেনা, তুরফা।

ছোট্ট একটি বাক্য অথচ এর মধ্যেও আমি খানিকটা বিষাদের গন্ধ পেলাম! আচ্ছা উনার কি মন খারাপ? আমি কৌতুহলী চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললাম,

—কি হয়েছে আপনার? শরীর খারাপ করছে না ক্ষুধা লেগেছে? কিছু বানিয়ে দিবো??

আমার প্রশ্নের বিপরীতে উনি জবাব না দিয়ে মুচকি হাসলেন। এই আধো আলোছায়ার খেলার মাঝেও যে হাসি হৃদয়ে কম্পন তুলে দিলো আমার! এত সুন্দর হতে হবে কেন লোকটাকে! কি আছে তার মাঝে যা আমার এত ভালো লাগে? বিস্মিত অন্তরে ভাবলাম আমি। আমার ভাবনার মাঝেই পূর্ণ বললেন,

—খাবার বানিয়ে দিতে হবেনা তবে অন্য কিছু করতে হবে। পারবে?

—কি করতে হবে? বলুন।

—আমার সাথে হাটতে যাবে, তুরফা?

পূর্ণর কথায় আরেকদফা বিস্ময় এসে ছুয়ে গেলো আমায়। এই মাঝরাতে উনি আমার সাথে একা হাটতে যেতে চাইছেন? এটা সত্যিই পূর্ণ তো? নাকি ঘুম না হওয়ায় মাথা নস্ট হয়ে গেছে উনার? আমি কিছু না বলে চট করে উনার মুঠোয় ধরে রাখা ফোন অন করে সময় দেখে নিলাম। রাতের ১২টা ১০ বাজে। শহরে এটা খুব বেশি সময় না হলেও গ্রামের জন্য গভীর রাত! এতক্ষণে সবাই ঘুমিয়ে কাদা হয়ে যায়। এই মাঝরাতে চাঁদের আলোর নিচে পূর্ণর সাথে নিরিবিলিতে হাটবো ভাবতেই একটা শিহরণ হচ্ছে মনে! এদিকে পূর্ণ চুপচাপ দেখছিলেন আমার কর্মকাণ্ড, আমি কিছু না বলায় উনি পুনরায় বললেন,

—কি হলো? যাবেনা? আচ্ছা তাহলে এখন চুপচাপ গিয়ে ঘুমাও।

আমায় নির্দেশ দিয়ে উনি একাই হেটে যাচ্ছিলেন দরজার দিকে। ঘটনাটি এত দ্রুত ঘটলো যে পুরোটা বুঝে উঠতে বেগ পেতে হলো আমার! দৌড়ে গিয়ে পেছন থেকে উনার বাহু চেপে ধরলাম আমি।

—এই, আপনি কোথায় যাচ্ছেন একা একা? আমিও যাবো তো আপনার সাথে।

আমার কথার মাঝে আমরা ইতোমধ্যে বাড়ির দরজার বাহিরে চলে এসেছি। পূর্ণ আমার হাত ছেড়ে বাড়ির গেইট লাগিয়ে এসে পুনরায় আমার হাত ধরলেন। আমি হাটার জন্য পা বাড়াতেই উনি থেমে গেলেন। আমি ভ্রু তুলে উনাকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম কি হয়ছে। উনি হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে একবার আমার কপালে, গলায় হাত ছোয়ালেন। হঠাৎ করে তার ছোয়ায় খানিকটা কেপে উঠলাম আমি। চকিত নয়নে তার দিকে তাকাতেই বললেন,

—গা-হাত এত ঠান্ডা কেন তোমার? মনে তো হচ্ছে জ্বর আসবে। তুমি কি নিচে শুয়েছিলে??

তীক্ষ্ণ চোখে প্রশ্ন ছুড়লেন পূর্ণ! এদিকে অবাক হয়ে গেলাম আমি। লোকটার আসলেই ভীষণ বুদ্ধি। এটুকুতেই বুঝে গেছেন আমি নিচে শুয়েছি! জিব দিয়ে শুষ্ক ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে বললাম,

—আসলে বড়াম্মুর কোমড়ে ব্যাথার জন্য উনাকে দাদির সাথে শুতে বলেছি। আপনি তো জানেনই এটা। তাকে নিচে ব্যথা পেতে দিয়ে আমি উপরে ঘুমাতে পারি, বলুন?

—নিচে ঘুমোলেও এটলিস্ট মোটা কাথা নিয়ে ঘুমাতে পারতে ইডিয়েট। তাহলে ঠান্ডা লাগতোনা।

উনাকে কিভাবে বলবো কাথার কাহিনি তাই আমতা আমতা করে বললাম,

—আসলে কাথা নিয়েই শুয়েছিলাম। কিন্তু প্রিয়া ঘুমের মাঝে …

—প্রিয়া ঘুমের মাঝে কাথা নিয়ে নিয়েছে আর তুমিও অন্য কাথা না নিয়ে কাথা ছাড়াই ঘুমিয়েছো? রাইট?
আমার মুখ থেকে কথা ছিনিয়ে বলে উঠলেন উনি। তার কথায় ধীরে মাথা নাড়লাম আমি। উনি দাতে দাত চেপে বললেন,

—বাহ!! কত মহান কাজ করেছো তুমি। স্টুপিড কি সাধে বলি তোমায়! বেয়াদব!

—আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন আশ্চর্য? একদিন ঠান্ডা লাগলে কিছুই হবেনা। আর তাছাড়াও নিচে ঘুমানোর অভ্যাস আছে আমার। এত বছর কতবারই তো কাথা ছাড়া নিচে ঘুমিয়েছি…

—এত বছর আমি ছিলাম না। এখন আমি আছি। এখন থেকে আর কোন অযত্ন হতে দেবোনা তোমার, বুঝেছো??

পূর্ণ অতি কোমল অথচ শান্তগলায় বললেন কথাটি যেটি বেশ এলোমেলোভাবে আমার কর্ণকুহরে এসে ধাক্কা খেলো। একিসাথে বেসামাল করে দিলো আমার মন! এতটা আবেগ দিয়ে কথা বলতে পারেন উনি? জানা ছিলোনা তো আমার। আর কতভাবে অবাক করবেন উনি আমায়? আমার ভাবনার মাঝেই দৃষ্টিগোচর হলো উনার হাত আমার হাত ছাড়িয়ে আমার ওড়নায় গিয়ে পৌঁছেছে। পূর্ণ ধীর হাতে আমার ওড়নাটুকু মেলে গায়ে পেচিয়ে দিলেন শালের মতো করে। কপালজুড়ে খেলতে থাকা এক গুচ্ছ বেখেয়ালি চুল কানের পিছে গুজে দিয়ে আমার হাত ধরে বললেন,

—এবার চলো।

আমি কিছু বললাম না। শুধু মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় চলতে লাগলাম তার পিছু পিছু। পূর্ণ একমনে সামনে তাকিয়ে হাটছেন আর আমি হাটছি তার দিকে মুগ্ধচোখে তাকিয়ে।

______________

আকাশের বিশালতাকে পূর্ণতা দিতে তার বুকজুড়ে জেগে আছে এক ফালি চাঁদ। তার কিরণে যেন অন্যরকম আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে চারপাশে! চাঁদের নিসঙ্গতাকে দূর করতে তাকে পাহারা দিচ্ছে শততারার মেলা! শরতের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে রাতজাগা শিউলি ফুলের সুবাস। যার গন্ধে মৌ মৌ করছে চারপাশ! রাতের আধারেও যে এত সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে কতজনই বা জানতো?

ঠিক কতদিন পর এমন মনমাতানো পরিবেশে নির্জনে হাটছি আমার মনে নেই। তবে আজকের মতো অনুভুতি আমার কোনদিনই হয়নি! হঠাৎ করেই এত্ত ভালো লাগছে কেন চারপাশ? আগে তো এমন লাগেনি কখনো। এই ভালো লাগা কি শুধুই প্রকৃতির কারণে না যার হাত ধরে যার পাশে হাটছি তার কারণে? পূর্ণর দিকে তাকাতেই দেখি উনি তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি মৃদু হেসে বললাম,

—এত সুন্দর কেন আজকের আকাশটা? চাঁদটাও দেখুন কত্ত বড়। আজ মনে হয় পূর্নিমা তাই না? এজন্যই এত বড় চাঁদ উঠেছে!! এত সুন্দর কেন লাগছে সব আজ? চোখই ফিরাতে পাচ্ছিনা আমি!

—হুম, আমিও।

পূর্ণর কথায় তার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি গভীরচিত্তে চেয়ে আছেন আমার দিকে। তার চোখের ভাষা পলকহীন, অন্যরকম। যে চোখের মায়ায় বহুবার হারিয়ে যাই আমি। আমার প্রশ্নবোধক দৃষ্টি বুঝতেই পূর্ণ চোখ সরালেন আমার থেকে। গলা ঝেড়ে বললেন,

—আরো হাটতে চাও? নাকি পা ব্যাথা হয়ে গেছে তোমার??

—এটুকুতেই পা ব্যাথা হবে কেন? আমি আরও হাটতে পারবো। আমার তো মনে হয় আপনার পা ব্যথা হচ্ছে।
ব্যঙ্গ করে বললাম আমি। আমার কথায় বেজায় চটিয়ে গেলেন উনি। রাগী গলায় বললেন,

—আমি তোমার মতো ফার্মের মুরগি নই যে এটুকুতেই হাপিয়ে যাবো। আমায় পুরো গ্রাম হাটতে দিলেও ইজিলি হাটতে পারবো, বুঝেছো পিচ্চি?

পূর্ণর খোচামার্কা কিথা শুনে এতক্ষণের ভালো লাগা উবে গেলো আমার। মনের মধ্যে জমা হলো বিন্দু বিন্দু রাগ। যখনই মুডটা ভালো হয় এই লোকটা ঠাশ করে কিছু উল্টোপালটা বলে মুড নস্ট করে দেয়! রেগে ভাবলাম আমি। উনার হাত ছেড়ে দূরে গিয়ে হাটতে লাগলাম। একটু আগে যেখানে দুজনের মধ্যে ব্যবধান ছিলো খুব সামান্য এখন নিমিষেই সেটা বেড়ে গেছে।

আড়চোখে পূর্ণর দিকে চেয়ে দেখি উনি একমনে হাসছেন সামনের দিক তাকিয়ে৷ এতে রাগ আরও বেড়ে গেলো আমার। আমাকে রাগিয়ে লোকটা কি এমন আনন্দ পায় বুঝিনা? হাটতে হাটতেই শুনলাম উনি বলছেন,

—শুনেছি পুর্নিমারাতে ভূতের আসর বসে মাঝরাতে। গ্রামের খোলা পরিবেশ, ভুতের পারফেক্ট আস্তানা! না জানি এখন কোথায় আসর জমাচ্ছে তারা। এদিকটায় আবার বসেনি তো? কে জানে!

হঠাৎ করে এই সময় ভুতের কথা শুনে পিলে চমকে উঠলো আমার। এতক্ষণের সুন্দর পরিবেশ যেন নিমিষেই গা ছমছমে মনে হলো আমার কাছে। তবুও একটা ঢোক গিলে নিজেকে সামলে নিলাম আমি। উনার সামনে কোনভাবেই দেখানো যাবেনা যে আমি ভয় পাচ্ছি৷ চারদিকে ভয়ার্ত নজর বুলিয়ে দোয়াদরুদ পড়তে পড়তে হেটে চলছি আমি। এদিকে পূর্ণ নিজমনে হেসে এগিয়ে চলছেন। তার হাসি দেখে আমার গা জ্বলে গেলেও এ মুহুর্তে কিছু বলছিনা। উনার সাথে দূরত্ব রেখেই হেটে চলছি বাড়ি পৌছানোর আগ পর্যন্ত।

হঠাৎ ঝোপের মধ্যে একটি ইদুরের মতো প্রানী দৌড় দিতেই ভয়ে পূর্ণর পাশে চলে গিয়ে উনার বাহু খামচে ধরলাম আমি। এদিকে আমি ভয়ে শেষ, ওদিকে সামান্য উচ্চস্বরেই হাসলেন উনি। যেন এটার অপেক্ষায়ই ছিলেন এতক্ষণ। ভ্রু তুলে আমায় জিজ্ঞেস করলেন,

—কি ব্যাপার? আমার সাথে লেগে গেলে কেন? তুমি না দূরে দূরেই হাটবে?

মনে মনে অনেককিছু বলতে চেয়েও নিজেকে শান্ত করলাম আমি। উনাকে এখন কিছু বলা যাবেনা, এটলিস্ট বাসায় পৌছানোর আগ পর্যন্ত উনিই আমার একমাত্র ভরসা, তাই কিছু না বলে চুপচাপ তার বাহু ধরে হেটে চললাম বাড়ির দিকে।

_________________

বাড়ি পৌছাতেই পূর্ণর হাত ছেড়ে দিলাম আমি। উনি দরজা লাগাতে ব্যস্ত থাকায় আমি কিছু না বলেই হনহন করে হেটে যেতে লাগলাম দাদির রুমের দিকে। আকস্মিক চাপা কন্ঠের গুনগুন শুনে পা-জোড়া থেমে গেলো আমার।

~সেই রাতে রাত ছিলো পূর্ণিমা
রঙ ছিলো ফাল্গুনি হাওয়াতে
সব ভালো লাগছিলো চন্দ্রিমা
খুব কাছে তোমাকে পাওয়াতে

মন খুশি উর্বশী সেই রাতে
সুর ছিলো গান ছিলো এই প্রাণে
ঐ দুটি হাত ছিলো এই হাতে
কি কথা বলছিলে মন জানে
সব ভালো লাগছিলো তুমি ছিলে তাই
মন ছিলো মনেরই ছায়াতে~

পেছনে ফিরতেই দেখি পূর্ণ আনমনে হাসছেন। আমার দিক এক পলক চেয়ে চুপচাপ পাশ কেটে চলে যেতে লাগলেন উনার রুমের দিকে। এদিকে তার যাওয়ার পানে চেয়ে আছি আমি! বেশি কিছু না বলেই যেন অনেক কিছুই বলে ফেলেন লোকটা।

“কথায় নয় কাজে বিশ্বাসী” উক্তিটি যেন উনার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য!!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here