বৃষ্টিময়_প্রেম #পর্বঃ৩১,৩২

0
1137

#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ৩১,৩২
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
৩১

আকাশ হতে বিন্দু বিন্দু জলরাশি গড়িয়ে পড়ছে আপন গতিতে। মেঘরাশি একেঅপরের সাথে ঝগড়ায় ব্যস্ত, বাতাসের গতিবেগও বাড়ছে ক্রমশ। এরই মাঝে ছাদে দাড়িয়ে আছি পূর্ণ আর আমি। না উনি নিজে নিচে যাচ্ছেন, না আমাকে যেতে দিচ্ছেন। উনার শক্ত হাতের বন্ধনীতে আবদ্ধ আছে আমার ছোট্ট হাতজোড়া। যে দৃঢ় হাতের বন্ধন ছিন্ন করার শক্তি, সাধ্য কোনোটাই আমার নেই!

পূর্ণ শুধুই একদৃষ্টিতে চেয়ে আছেন আমার দিকে। বৃষ্টির মাঝে এভাবে তাকিয়ে থাকার কারণে উনার চোখজোড়া খানিকটা লালচে হয়ে আছে, তবে এই লাল বর্ণটা কি নিছক বৃষ্টির কারণে নাকি অন্য কোন কারণে আমি ঠিক বুঝতে পেলাম নাহ। উনি-আমি কিছু বলার আগেই মেঘদ্বয় ক্ষিপ্ত হয়ে ডেকে উঠলো প্রবল স্বরে। যে গর্জনে ভীষণভাবে কেপে উঠলাম আমি। চোখমুখ খিচে বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম কোনোরকম। বৃষ্টি আমার পছন্দ হলেও বিদ্যুৎ একেবারেই পছন্দ নাহ, খুব ভয় লাগে বিদ্যুৎ চমকালে। কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই পূর্ণ তড়িৎ বেগে টেনে নিলেন আমায়, আলতো করে আমার মাথা চেপে ধরলেন তার বুকে।

ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্মিত হয়ে বন্ধ চোখদ্বয় খুলে ফেললাম আমি। বৃষ্টিতে ভিজে উনার সাদা শার্ট গায়ের সাথে লেপ্টে আছে, যার দরুন তার বুকে মাথা রেখে তার শরীরের উষ্ণতা অনুভব করতে পেলাম আমি। উনার কি জ্বর এসেছে নাকি? গা এরকম গরম কেন তার? আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই পূর্ণ কোমল কন্ঠে বললেন,

—এত ভয় পাচ্ছিলে কেন তুমি? রিল্যাক্স। আমি আছি না তোমার সাথে? আর কখনো এভাবে ভয় পাবেনা।

উনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন। এদিকে তার নরম কথায়-আচরণে এতক্ষণের অভিমান ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো আমার! তবু কিছু না বলে চুপচাপ উনার সাথে লেগে থেকে তার বুকের মাঝে কম্পনরত ধুকপুক ধ্বনি শুনতে লাগলাম আমি। খানিকবাদে পূর্ণ আবার বললেন,

—কথা বলছোনা কেন আমার সাথে, তুরফা? কিছু বলো। তখন থেকে তুমি একটা কথাও বলোনি আমার সাথে।

যদিও পূর্ণর উপর জমা অভিমান আমার আগেই ধুয়ে গেছে তবুও উনাকে খানিকটা জালাতন করতে উতলা হলো মন! গলায় কৃত্তিম রাগ মিশিয়ে বললাম,

—কেন কথা বলবো আপনার সাথে? আপনি কথায় কথায় আমার উপর রাগ দেখান। আমিও রাগ করেছি আপনার উপর।

—তখন আমার মাথা গরম ছিলো খুব। তোমায় তো একবার বলেছিলাম আমার কাজ আছে তুমি তাও জিদ করছিলে। এজন্য রাগের মাথায় ধমক দিয়েছি।

—কখন কাজ থাকেনা আপনার? যখনই কিছু বলি তখনি শুধু কাজ কাজ আর কাজ!! আমার জন্য তো সময়ই নেই আপনার কাছে। আবার আমাকে খোটাও দিয়েছেন ফাকা বসে আছি বলে। ভার্সিটিতে যাই আগে, অনেকগুলো ছেলেবন্ধু বানাবো আর ওদের সাথে ঘুরতে বেড়াবো। আপনার ফ্রি হওয়ার আশায় থাকলে এ জীবনে আর কোনকিছু করা হবেনা আমার!!

আমার কথায় পূর্ণ আচমকাই ছেড়ে দিলেন আমায়। কোনমতে টাল সামলিয়ে দাড়ালাম আমি। এরই মাঝে পূর্ণ তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠলেন,

—কথা বলতে বলেছি তার মানে এই নয় যে যা মন চায় তা-ই বলবে! খুব সাহস বেড়েছে তোমার, তাই না? পা ভেঙে বাসায় রেখে দিবো, বেয়াদব।

—আসছেন আমার পা ভাংতে। শখ কত! আপনি পা ভাংগার আগেই আমি ওদের সাথে পালিয়ে যাবো।

—তুরফা। আমায় রাগিয়ো না বলছি। এখন আমি রেগে কিছু বললে পরে আবার তুমিই কস্ট পাবে।

শক্ত চোয়ালে বললেন উনি। উনার মুখের দিক তাকিয়ে এ মুহুর্তে চুপ করাটাই ভালো মনে করলাম আমি। তাই কথা না বাড়িয়ে তাকে মুখ ভেংচিয়ে চলে আসছিলাম। এমন সময় উনি পেছন থেকে বললেন,

—কেউ রাগ করেছিলো বলে তার জন্য চকলেট নিয়ে এসেছিলাম। সে এখন আমায় রাগিয়ে দিয়েছে তাই এগুলো আমি নিজের কাছেই রাখছি।

চকলেটের কথা শুনে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখি পূর্ণর হাতে আমার প্রিয় ডার্ক চকলেট। কত্তদিন খাইনি এটা! খুশি হয়ে উনার কাছে থেকে চকলেট নিতে ধরতেই উনি হাত উচুতে তুলে বললেন,

—এখন নিতে চাচ্ছো কেন? তখন রাগ ভাংগিয়ে নিজে থেকে দিতে চাচ্ছিলাম সেটার তো সুযোগই দিলেনা। উলটো রাগিয়ে দিলে আমায়। এখন এমনি এমনিই কেন দিবো তাহলে তোমায়? ধরতে পারলে দিবো, তাছাড়া নয়।

উনার কথা শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো আমার। আমি কি জানতাম উনি চকলেট আনবেন আমার জন্য? আর দিতেই যখন এসেছে তখন এসব নাটক করার কি আছে! উনি কত লম্বা, তার মধ্যে হাত উচু করে উপরে উঠিয়ে রেখেছেন। আমি তো লাফিয়েও তার উচু করা হাতের নাগাল পাবোনা। তাই জ্বালাময়ী কন্ঠে বললাম,

—দিতে মন চাইলে সরাসরি দিবেন। নাহলে দিবেন নাহ। বৃষ্টির মধ্যে ভিজে আর কোন তামাশা করতে মন চাইছেনা আপনার সাথে আমার।

আমার তীক্ষ্ণ কণ্ঠের বিপরীতে উনি সামান্য হাসলেন। তারপর আমার হাত ধরে টেনে সেহাতের মুঠোয় দিয়ে দিলেন চকলেটটা। হঠাৎই আমার নাক টেনে দিয়ে বললেন,

—ছোট্ট একটা মানুষ হয়ে এত তেজ কোথা থেকে পাও তুমি? আমার উপরও রাগ দেখানো শিখেছো আজকাল! খুব বউ বউ আচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে তোমার মধ্যে, তুরফা। ব্যাপার কি?

বাকা হেসে বললেন উনি। তার কথার বিপরীতে কোন কথা বললাম নাহ আমি। গরম হওয়া গাল লুকোতে অন্যদিকে তাকালাম। পূর্ণ হাল্কা হেসে নিচে যেতে যেতে বললেন,

—অনেক হয়েছে। এবার জলদি নিচে এসো। কতক্ষণ ধরে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছো সে খেয়াল আছে? ঠান্ডা লাগলে কি হবে? স্টুপিড।

উনার কথায় বোকা বনে গেলাম আমি। নিজেই আমায় বৃষ্টির মধ্যে দাড়িয়ে রাখলেন এতক্ষণ আবার এখন নিজেই বকছেন বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য! খারাপ লোক একটা।

______________

পূর্ণর পিছু পিছু সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে হাতে রাখা চকলেটটা নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলাম আমি। হঠাৎই মনে পড়লো ছোটবেলার কথা। উনি তখনও আমার জন্য চকলেট আনতেন। পুরনো স্মৃতি মনে হতেই হাসির রেখা চলে এলো ঠোঁটের কোণে। মুচকি হেসে বললাম,

—থ্যাংকিউ, তাজওয়ার ভাইয়া।

আমার ডাকে থমকে গেলেন পূর্ণ। আচমকাই পা থেমে গেলো উনার, যার দরুণ উনার পিঠের সাথে সামান্য ধাক্কা খেলাম আমি। ভাগ্যিস এতক্ষণে আমরা সিড়ি থেকে নেমেছি নয়তো দুজনেই পড়ে যেতাম, মাথায় হাত ডলতে ডলতে ভাবলাম আমি।

এদিকে পূর্ণ অবাক চোখে বললেন,

—এতদিন পর এ নামে ডাকছো যে?

আমি স্মিত হেসে বললাম,

—আসলে আমি সেদিনই অফিসে গিয়ে জেনেছি যে আপনিই তাজওয়ার ভাইয়া। যদিও তখনই কথা বলতে চেয়েছিলাম এ ব্যাপারে। কিন্তু পরে বলবো বলবো করে আর সুযোগই হয়নি।

পূর্ণ চোখে বিস্ময় ঢেলে বললেন,

—তুমি অফিসে গিয়ে জেনেছো মানে? আমাদের বিয়ের দিন শুনোনি আমার পুরো নাম?? তুমি কি বলছো এসব, তুরফা?

উনার কথায় খানিকটা লজ্জাই পেলাম আমি। আসলেই বিয়ের দিন ক্ষুধায় অসস্তিতে আমি কোনকিছুই ঠিকমতো খেয়াল করিনি। একপ্রকার বাধ্য হয়েই বিয়ে করছিলাম যেহেতু তাই কোনমতে কবুল বলে দিয়েছি। এখন এ ব্যাপারে আমি যথেষ্ট লজ্জিত। তাই ভীষণ ইতস্ততভাবে বললাম,

—আসলে বিয়ের দিন শরীরটা ভালো ছিলোনা আমার। আপনি তো দেখেছিলেনই আমার কেমন অবস্থা হয়েছিলো। ওর মধ্যে কি আর খেয়াল করবো বলুন। কোনরকম বিয়ে সেড়ে ফেলার চিন্তায় ছিলাম শুধু আমি।

আমার কথা শুনে পূর্ণ হতাশ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। আহত গলায় বললেন,

—অথচ আমাদের বিয়ের সবকিছু আমার মনে আছে। তোমার ক্লান্ত মলিন চেহারা, তোমার কবুল বলা, আমার কবুল বলা। ভেবেছিলাম তুমি ক্লান্ত হলেও বিয়ের ক্ষেত্রে মনোযোগী ছিলে। কিন্তু আমার ধারণাকে তুমি ভুল প্রমাণ করলে। এত খামখেয়ালিপনা কেন তোমার মধ্যে, তুরফা?

পূর্ণর কথার বিপরীতে কি জবাব দিবো আমি তৎক্ষণাত ভেবে পেলাম নাহ। হঠাৎ করেই যেন অপরাধবোধ কাজ করলো নিজের মধ্যে। পূর্ণ তো ভুল কিছু বলেন নি, ভুল আমারই ছিলো। কিন্তু আমি নিজেও ইচ্ছা করে অমনোযোগী ছিলাম নাহ। পরিস্থিতিটাই এমন ছিলো। উনাকে কিভাবে বুঝাবো বুঝতে পারলাম নাহ। তবুও কাচুমাচু করে উনাকে কিছু বলতে যাবো তার আগেই আমায় জোরেশোরে ডাকলেন দাদি। দাদির কন্ঠ শুনে পূর্ণ একবার আমার দিক চেয়ে চলে গেলেন রুমে, আমিও দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ চলে গেলাম দাদির কাছে।

_________________

কাজিনমহলের সাথে গল্পগুজব করে রাতের খাবার খেয়ে পূর্ণর রুমে চলে আসলাম আমি। দাদি নিজেই আজ পাঠিয়েছেন আমায় উনার রুমে। বেশি মানুষ হয়েছে বিধায় বাকি রুমগুলোই অন্যরা গাদাগাদি করে থাকবে। যাই হোক, রুমে এসে দেখি পূর্ণ বালিশছাড়া চুপচাপ শুয়ে আছেন উপর হয়ে। উনাকে এভাবে দেখে ভ্রু কুচকে গেলো আমার। কি হয়েছে লোকটার? ডিনারেও তেমন কথা বললেন না আজ কারও সাথে, আগে আগে খেয়েই চলে এলেন। আমি ভেবেছিলাম সবসময়ের মতো এবারও উনার কাজ আছে তাই এমন করছেন কিন্তু উনি তো চুপচাপ শুয়ে আছেন রুমে! ব্যাপার কি?

খাটের কোণে গিয়ে পূর্ণর পাশে বসে উনাকে ডাকলাম বার কয়েক। উনি সাড়া দিলেন নাহ। ভাবলাম ঘুমোচ্ছেন তাই উনার মাথার নিচে বালিশ দিয়ে দেওয়ার জন্য তার গলার নিচে হাত দিতেই চমকে উঠলাম আমি। শরীর ভীষণ গরম উনার, জ্বরে যেন পুড়ে যাচ্ছে গা! জ্বরের প্রকোপে তার ফর্সা চেহারা যেন ফ্যাকাশে গেছে। তার এমন অবস্থা দেখে চিন্তায় ভয়ে ঘামছুটে গেলো আমার। কাপা কাপা হাতে উনার মাথায় হাত রেখে কি করবো ভাবতে লাগলাম আমি…

#চলবে

#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ৩২
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা

জ্বরের ঘোরে কাতর হয়ে আছেন পূর্ণ। হালকা গোঙানির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে উনার কাছে থেকে। আমি কম্পনরত হাতে উনার ভারী দেহকে সোজা করে শুয়ে দিলাম। বিছানায় ভাজ করে রাখা কাথাটা নিয়ে তার উষ্ণ শরীর ঢেকে দিলাম। তবুও উনি ইষৎ কাপছেন তাই আমি রুমের আশেপাশে অন্য কাথা খোজার জন্য চোখ বুলালাম। রুমের কোণে অবস্থিত এক পুরনো আলমারি চোখে পড়লো। দ্রুত পায়ে হেঁটে আলমারির কাছে গিয়ে খুলে দেখি ওর ভেতরে কিছু বালিশ আর দুটো কাথা রাখা আছে। কাথাটি নিয়েই পূর্ণর কাছে গেলাম। উনাকে পুনরায় কাথা দিয়ে ঢেকে দিলাম। কিছুক্ষণ যেতেই উনার কম্পনের বেগ কমে এলো। চিন্তিত মুখেই একটি সস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি!

উনি চোখ বন্ধ করে এখনও ঘুমের ঘোরেই আছেন। এদিকে আমি ঠান্ডা মাথায় ভাবতে লাগলাম কি করে তার জ্বর কমানো যায়। সবাই মাত্র খেয়েদেয়ে ঘুমিয়েছে। তাদের কাচাঘুম ভাংতে সায় দিলোনা মন। বাথরুম থেকে এক মগ পানি নিয়ে এসে বিছানার পাশের সাইড টেবিলে রাখলাম। হাতের কাছে সুতি কাপড় বলতে তৎক্ষণাৎ আমার ওড়নাই চোখে পড়লো তাই সেটাই পানিতে ভিজিয়ে তার মাথায় জলপট্টি দিতে লাগলাম। কিছুক্ষণ জলপট্টি দেওয়ার মাঝেই তার শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এলো। শরীরের তাপমাত্রাও বেশ কিছুটা কমে এসেছে এতক্ষণে। ভাবলাম এখন উনাকে ওষুধ দেওয়া উচিত, যেহেতু কিছুক্ষণ আগেই খেয়েছেন তাই ভরপেট থাকা অবস্থায়ই ওষুধ দিয়ে ফেলতে। এতে জ্বরটাও একেবারেই কমে যাবে।

যা ভাবা সেই কাজ। তবে নিজের ব্যাগ ঘেটে ফার্স্ট এইডের কোন বক্স পেলাম নাহ, হতাশ মনে নিজের উপর নিজেই ক্রুদ্ধ হলাম আমি। আসলেই পূর্ণ ঠিকি বলে আমি বড্ড খামখেয়ালি, ওষুধপত্রের মতো দরকারি জিনিস যে সাথে করে ক্যারি করতে হয় এটাও আমি করিনা। অসহায় মুখে ফিরে আসছিলাম বিছানায়, হঠাৎই কি মনে করে যেন পূর্ণর ব্যাগ চেক করলাম। উনার ব্যাগ কিছুদূর হাতড়াতেই পেয়ে গেলাম কাংক্ষিত ফার্স্ট এইডের বক্স! লোকটা আসলেই প্রচন্ড কান্ডজ্ঞানসম্পন্ন, দরকারি জিনিস সব সাথে নিয়েই ঘুরেন। বক্স থেকে প্যারাসিটামল বের করে খেতে দিলাম উনাকে। পূর্ণ খেতে চাইছিলেন নাহ, একপ্রকার জোর করেই খাইয়েছি তাকে। ওষুধ খেয়ে উনি আবার ঘুমে ঢলে পড়লেন। তার গায়ে ভালোভাবে কাথা টেনে দিয়ে জানালার ধারে গিয়ে দাড়ালাম আমি।

এভাবে ঠিক কতক্ষণ অতিক্রম হয়েছে আমার জানা নেই। সময় গড়িয়ে চলেছে নিজের মতোন। অশান্ত মনকে শান্ত করতে আকাশের চাঁদটার দিকে তাকিয়ে আছি। আজকের চাঁদটা সেদিনের মতো বড় নয়। সেদিন চাঁদটাও যেন হাসছিলো আমার খুশিতে যেদিন পূর্ণ আমার সাথে ছিলেন, আজ আমার একাকিত্ব দেখে যেন চাঁদটা মন খারাপ করে আছে। পেছন ঘুরে পূর্ণর দিকে তাকালাম আমি, এখন জ্বর নেই বোধহয় আর। শান্তভাবে ঘুমোচ্ছেন। ধীর পায়ে উনার শিয়রে বসে আলতোভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। লোকটাকে এমন নিথরভাবে পড়ে থাকতে দেখতে মোটেও ভালো লাগছেনা আমার। মনে হচ্ছে কখন উঠবেন আর উনার চিরচেনা গম্ভীর স্বরে ডাকবেন আমায়। একিসাথে রাগও হলো উনার উপর৷ কি দরকার ছিল এতক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজার? অযথাই ভিজলেন অসময়ের বৃষ্টিতে, জ্বর তো বাধবেই! উপরন্তু উনি আমার রাগ ভাংগানোর জন্য ভিজেছিলেন এটা ভাবতে আরও বেশি খারাপ লাগলো আমার।

মনের কস্ট কখন চোখের অশ্রু হয়ে ঝরে পড়লো বুঝে এলোনা আমার। এরই মাঝে নড়েচড়ে উঠলেন পূর্ণ। ঘুম থেকে উঠে আধো চোখে চারপাশ চেয়ে আমার দিকে নিষ্পলক চেয়ে রইলেন চুপচাপ। যেন সদ্য ঘুম ভেঙে বুঝার চেস্টা করছেন এখানে কি হচ্ছে। খানিক মুহুর্ত বাদে কোমল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

—কাদছো কেন তুমি? আমার জন্য চিন্তা হচ্ছে?

এতক্ষণ পর উনার কণ্ঠ শুনে আমার বাকশক্তি লোপ পেলো যেন! আমি কিছু বলতে পারলাম নাহ। ঠোঁট চেপে ধরে কান্না থামানোর চেস্টা করলাম। হঠাৎ করেই লোকটার প্রতি নিজেকে বড় দূর্বল লাগছে। আমাকে কথা না বলতে দেখে পূর্ণ কাথার নিচ থেকে উনার হাত বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,

—আমি ঠিক আছি তো, তুরফা। শুস,,কাঁদে নাহ। এই যে আমার হাত ধরে দেখো।

আস্তে করে উনার হাতের তালুতে হাত রাখলাম আমি। তার হাতে-গায়ে পরশ লাগিয়ে বুঝলাম তাপমাত্রা প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে বটে। তবুও খানিকটা উষ্ণতার রেশ আছেই। গলার দিকে সামান্য ঘেমে গেছে উনার তাই উপর থেকে দ্বিতীয় কাথাটা সরিয়ে দিলাম আমি। পূর্ণ চুপচাপ দেখছেন আমায়। আমি অভিমানী কণ্ঠে বললাম,

—কেন ভিজলেন বৃষ্টিতে এতক্ষণ? নিচে নেমে কি কথা বলা যেতো না? আপনার হঠাৎ এত জ্বর দেখে আমি কত ভয় পেয়েছিলাম জানেন??

আমার কথা শুনে পূর্ণ মৃদু হাসলেন। এই ফ্যাকাশে চেহারায়ও তার হাসির সৌন্দর্য বিন্দুমাত্র ম্লান হলোনা। উনি মুখে হাসি রেখেই বললেন,

—তুমি সব কথাতেই এত ঘাবড়ে যাও কেন, পাগলি? এই সামান্য জ্বর পূর্ণকে কাবু করতে পারেনা, বুঝেছো?
এক মুহুর্ত থেমে বললেন,
“আমি সেদিনও বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম খুব, জ্বর আমার সেদিনও এসেছিলো। সেদিনই যখন কিছু হয়নি আর আজ তো তুমি পাশে আছো, আজ কিভাবে কিছু হতো?”

পূর্ণর কথা শুনে কান্না থামিয়ে চকিত দৃষ্টিতে তাকালাম আমি। সেদিন বলতে উনি কোনদিনের কথা বলছেন? কৌতুহলী কণ্ঠে বললাম,

—কোনদিনের কথা বলছেন আপনি? কি হয়েছিলো সেদিন? আর আপনি বৃষ্টিতে ভিজেছিলেন কেন এত? বৃষ্টি কি আপনার খুব পছন্দ?

আমার কথায় উনি মলিন হাসলেন। ধীম সুরে বললেন,

—আগে পছন্দ ছিলোনা। এখন ভালো লাগে।

পূর্ণর কথা শেষ না হতেই বাহিরে ঝড়ো বাতাস বইতে শুরু করলো। জানালা খোলা থাকায় যে বাতাসে শিউরে উঠলাম আমরা দুজনেই। উনার ঠান্ডা লাগতে পারে ভেবে আমি জানালা বন্ধ করে দিয়ে চলে এলাম। পূর্ণর দিকে তাকাতেই উনি বললেন,

—আমার ঠান্ডা লাগছে, তুরফা।

—আরেকটা কাথা গায়ে দিয়ে দিবো?

চিন্তিত মুখে কথাটা বলেই উঠতে লাগলাম কাথা নেওয়ার জন্য। উনি তৎক্ষণাৎ ধরে ফেললেন আমার হাত। কোমল সুরে বললেন,

—তুমি আমার পাশে শুয়ে পড়ো তাহলেই হবে।

পূর্ণর কথায় একিসাথে বিস্ময় ও লজ্জা ঘিরে ধরলো আমায়! জ্বরের ঘোরে কিসব বলছেন নিজেও বুঝতে পারছেন তো? স্তিমিত সুরে বললাম,

—আমার ঘুম ধরছেনা। এখন আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন, আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। আপনি ঘুমানোর পরে আমি ঘুমাবো। আপনার রেস্টের প্রয়োজন।

—তুমি আমার খেয়াল রাখতে রাখতে নিজের অযত্ন করবে এটা আমি হতে দিবোনা। আমি ঘুমাবো, সাথে তোমাকেও ঘুমাতে হবে। এটাই হচ্ছে শর্ত। এখনি আমার পাশে এসে শুয়ে পড়ো চুপচাপ।

পূর্ণর কথা শুনে নিশ্চুপ হয়ে গেলাম আমি। উনি খুব জেদি। যা বলবে সেটাই করবে! তাই উপায় না পেয়ে উনার পাশে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়লাম। হঠাৎই পূর্ণ উনার কাথার মাঝে টেনে নিলেন আমায়। বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে চেয়ে রইলাম আমি! আমার বিস্ময়কে আরও বাড়িয়ে দিতে উনি একহাতে আমার কোমড় জড়িয়ে ধরে অতি নরম গলায় বললেন,

—আজকের রাতের জন্য তোমার উষ্ণতা আমার সাথে ভাগাভাগি করবে, তুরফা?

নিঃসংকোচ সামান্য আবদার যাতে সাড়া না দিয়ে পারলাম নাহ আমি। এত সুন্দরভাবে চাইলে কেউ মানা করতে পারে? আমিও পারলাম নাহ। আলতোহাতে জড়িয়ে ধরলাম উনাকে। এই নিশুতি রাতে তার বুকের ঢিপঢিপ ধ্বনি শুনতে বেশ লাগলো। পূর্ণ ধীরস্বরে বললেন,

—বৃষ্টির সাথে একজনের জীবনের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে, শুনবে?

আমি মাথা নেড়ে বুঝালাম “আমি শুনবো”। এবার উনি আরেকটু প্রবলভাবে জড়িয়ে ধরলেন আমায়। যদিও সরাসরি জবাব দিলেন নাহ। বরং কণ্ঠে একরাশ স্নিগ্ধতা মিশিয়ে বললেন,

—বৃষ্টির প্রতি ছিলো তার বড্ড অভিমান। জীবনের সবচেয়ে বড় কস্ট সে বৃষ্টির দিনেই পেয়েছিলো! কেন তার সাথে এমনটা হলো কিশোরমনের ছিলো অভিযোগ, তাই তো বৃষ্টির প্রতি অবহেলা বাড়তে লাগলো প্রতি রোজ। তবে প্রকৃতির খেলা যে বড়ই অদ্ভুত। যা বুঝার সাধ্য নেই কারও। প্রমাণ পেলো সে আরও একবার। বৃষ্টি তার কৈশোরের অভিমান নিভিয়ে দিলো যৌবনের এক বৃষ্টিময় দিনে। নিজহাতে তুলে দিলো বৃষ্টিকন্যাকে তার হাতে…

—তারপর?

পূর্ণর কোন সাড়া না পেয়ে মাথা উঠিয়ে উনার দিকে তাকালাম। অক্ষিজোড়া বন্ধ হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। শান্ত নিঃশ্বাস বলে দিচ্ছে এতক্ষণে ঘুমের রাজ্যে বিচরণ করছেন উনি। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। গল্পটা পুরোটা শুনাই হলোনা। অসম্পূর্ন থেকে গেলো। তবে শুনতে খুব ভালো লাগছিলো। অন্য একদিন উনার থেকে জেনে নিবো। ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করতেই পূর্ণর উষ্ণতার আবেশে শিহরণ জাগলো মনে।

মনে হচ্ছে এতক্ষণ মনের মধ্যে বিরাজমান অশান্ত ভাবটা যেন নিমিষেই উড়ে গেছে উনার কাছে আসায়! মনটা যেন বলছে উনার কিছু হলে আমি ভালো থাকবোনা। আমার ভালো থাকার জন্য হলেও উনার ভালো থাকা প্রয়োজন। উনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম আমিও…

______________

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here