#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ৩৫,৩৬
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
৩৫
পূর্ণর সামনে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছি। পাশেই বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে বন্ধুমহল! হঠাৎ করে যে উনি চলে এসে এভাবে আমাদের মধ্যে কথা বলবেন এমনটা আশা করেনি ওরা হয়তো! সামিন ছেলেটা বিরক্ত হয়ে পূর্ণকে বললো,
—এখানে কি হচ্ছে তা আপনার জানার কি দরকার, ভাই? আমরা বন্ধুরা কথা বলছি। আপনি গিয়ে নিজের কাজ করুন নাহ!
—নিজের কাজেই এসেছি আমি এখানে। তোমাদের মতো অযথা মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে টাইম ওয়েস্ট করার মতো সময় আমার কাছে, বুঝেছো?
পূর্ণর কথায় খানিকটা অপমানিত বোধ করলো সামিন। অন্তত ওর মুখভঙ্গি দেখে এমনটাই মনে হলো আমার কাছে! মনে মনে হাসলাম সেদিকে চেয়ে আমি। ঠান্ডা মাথায় মানুষকে কিভাবে জব্দ করা যায় এ বিষয়ে পূর্ণর জুড়ি মেলা ভার! সামিন মিনমিনে গলায় বললো,
—আপনার কাজে এসেছেন বলতে? আমাদের সাথে আপনার কি কাজ? আমরা তো আপনাকে চিনিই নাহ।
—চেনোনা তা তো আমি বুঝেছিই। সেজন্যই নিজের পরিচয় দিতে এলাম।
অতঃপর এক পলক আমার দিকে চেয়ে বললেন,
“তোমার বন্ধুদের বলো আমি তোমার কে হই?”
—উনি আমার স্বামী। তোদের দুলাভাই।
আড়চোখে পূর্ণর দিকে চেয়ে ধীরস্বরে জবাব দিলাম আমি। উনি এখনও ভাব নিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছেন, মধ্যখানে শুধু আমার কথায় তার ঠোঁটের কোণে যোগ যুক্ত হলো একটি সূক্ষ্ম নজরকাড়া হাসি।
—দুলাভাই?
বিস্মিত কণ্ঠে চিল্লিয়ে উঠলো আমার বন্ধুরা। প্রায় সাথে সাথেই তাদের প্রশ্নের বাণ নিক্ষেপ করতে লাগলো আমার দিকে! বান্ধবী মাইশা বললো,
—তুরফা, তুই বিয়ে করেছিস অথচ আমাদের একটিবার জানালিও নাহ? কাজটা মোটেও ঠিক করলি না।
—আরে বাবা সবকিছু এত জলদি হয়ে গিয়েছে যে তেমন কাউকে জানানোর সময়ই পাইনি! বুশরা জানে শুধু। তোদের সাথে এইচএসসির পর আর দেখা হয়নি যোগাযোগও হয়নি তাই তোরা জানিস না।
আমার কথায় বাকিরা কিছুটা দমে গেলেও সামিন বিরবির করে বললো,
—এত অল্প বয়সে বিয়ে করাটা ঠিক হয়নি তোমার। আরেকটু সময় নিয়ে ভার্সিটিতে উঠে না হয় দেখেশুনেই বিয়ে করতে?
—ভার্সিটিতে উঠতে আর বেশিদিন বাকি নেই ওর। তাই তুমি এ ব্যাপারে চিন্তা করোনা। তুরফার চিন্তা করার জন্য আমি আছি! আর কোনটা ঠিক কোনটা ভুল এ প্রসঙ্গ যখন উঠলোই তখন এটাও জেনে রাখো যে একটা মেয়ে যদি কোনকিছুতে “না” বলে তবে সেটাকে মেনে নেওয়াই ভদ্রলোকের কাজ। তার অসম্মতিতে জোর করে না-কে হ্যাঁ তে রুপান্তর করতে যেয়োনা। এর পরিণাম সবসময় ভালো হবেনা।
সামিনের উদ্দেশ্যে শান্ত অথচ কড়া গলায় বললেন পূর্ণ। উনার কণ্ঠে সূক্ষ্ম রাগের আভাস স্পষ্ট টের পেলাম আমি। প্রত্যক্ষ অপমানে মুখে কলুপ আটলো সামিন। বন্ধুমহলের বাকিরা মিটিমিটি হাসলো। পূর্ণর সাথে কিছুক্ষণ কথা বললো সবাই, উনি জানালেন আমাদের শুধু আকদ হয়েছে, অনুষ্ঠান এখনও বাকি। সেখানে সবাইকে দাওয়াত দিবেন। পূর্ণর সাথে কথা বলে আমাকে বিদায় দিয়ে খুশিমনে চলে গেলো বন্ধুমহল। যাওয়ার আগেই মাইশা আমার কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
—মামা, তুই জিতছিস! এরকম সুন্দর ছেলেকে পাইলে আমিও তৎক্ষণাৎ করে বিয়ে সেড়ে ফেলতাম! তাই তোকে দোষ দেওয়া যাচ্ছেনা।
ওর কথায় হালকা হাসলাম আমি। ওরা চলে যেতেই আমার কাজিনরা চলে এলো আমাদের কাছে। দূর হতে আমার বন্ধুদের যেতে দেখে রাইসা আমার কাছে এসে বললো,
—কি রে তুর, ওরা তোর কলেজের ফ্রেন্ড না? ওদের এখানে কিভাবে পেলি?
—আর বলিস নাহ। শহরের ব্যস্ততায় ক্লান্ত হয়ে ওরাও কাশবনে ঘুরতে এসেছে। এখন ট্রেন্ড চলছে কি না? কাকতালীয়ভাবেই দেখা হয়ে গেলো। ভালোই লাগলো অনেকদিন পর দেখা হয়ে।
—হুম, সন্ধ্যা নামছে নামছে ভাব। একটু পর গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিবো সবাই। তোর জন্য একটা গুড নিউজ আছে, একটা ব্যাড নিউজ আছে। কোনটা আগে শুনবি?
রাইসার কথায় ভ্রু কুঞ্চিত হলো আমার। হঠাৎ করে এসময় ওর কাছে ভালো-মন্দের খবর কিভাবে এলো? কৌতুহল দমাতে না পেরে বললাম,
—আগে খারাপটা বল তারপর ভালোটা শুনবো।
—খারাপ সংবাদ হচ্ছে আমাদের কালকে বাসায় ফিরে যেতে হবে। তোর বর একটু আগেই এসে প্রান্তকে এটা বলেছে। ওদের দুজনকে অফিস যেতে হবে এজন্য বাবা ফোন দিয়েছিলেন।
এত তাড়াতাড়ি বাসায় যাওয়ার কথায় মনটা খারাপ হয়ে গেলো আমার। মলিন সুরেই রাইসাকে জিজ্ঞেস করলাম,
—আর ভালো খবরটা কি?
—ভালো খবরটার ব্যাপারে যদিও আমি পুরোপুরি শিউর না। ৯৯% শিউর বুঝলি। তাও এটা সত্যি হলে তোর জন্য আমি খুব খুশি হবো!
উচ্ছাসিত কণ্ঠে বললো রাইসা। ওর কথার আগামাথা না বুঝে চোখ পাকিয়ে বললাম,
—আরে ভাই, যা বলবি সোজাসুজি বল নাহ! এত ঘুরিয়ে বলার কি আছে?
—আচ্ছা বাবা বলছি! জানিস তুরফা আমার কেন জানি মনে হয় পূর্ণ ভাইয়া হয়তো তোকে পছন্দ করেন! মানে পছন্দ করেন বলতে খুব ভালোবাসেন! তোর প্রেমে রীতিমতো হাবুডুবু খাচ্ছেন উনি!
রাইসার কথায় থম মেরে গেলাম আমি! এটা ওর সুসংবাদ? আর আমি ভাবলাম না জানি কত কি হয়ে গেলো! হতাশ সুরে বললাম,
—হয়েছে তোর? নাকি এটাই তোর সেই গুড নিউজ? কই আমি ভাবলাম তুই আমায় খালা হওয়ার সংবাদ দিবি আর তুই পূর্ণকে নিয়ে এসব কথা বলছিস!
ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে বললাম আমি। আমার কথা শুনে রাইসা লজ্জা পেলো। আমার মাথায় চাটি মেরে বললো,
—ধুর পাগল। এত তাড়াতাড়ি? এসব বাদ দে। আমার না সত্যিই এটা মনে হয়! শুধু আমিই নাহ, তোর বাকি কাজিনরাও এটাই মনে করে জানিস?
বিশেষ করে তাসিন ভাইয়া তো বলছিলো পূর্ণ ভাইয়া তোকে…
রাইসার কথা মাঝপথে থামলো প্রান্ত আসায়। উনার হাতে একটি কাশফুল। সেটা রাইসার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
—এই নেও। এখন তোমায় কাশফুল এনে দেওয়ার বিনিময়ে আমি কি পাবো শুনি?
রাইসা লাজুক হেসে কাশফুল নিয়ে ইশারায় আমাকে দেখিয়ে দিলো প্রান্ত ভাইয়াকে। আমার দিকে তাকিয়ে প্রান্ত ভাইয়া বললেন,
—আরে তুরফা, শুনেছো কাল চলে যাচ্ছি আমরা? তাই যত মজা করার আছে আজকের মধ্যেই করে নেও। আর তোমার বোনকে এখন আমার কাছে রেখে যাও। তোমার বর দেখো ওইদিকে তাসিন, দিশাদের গল্প করছে। তার কাছে যাও।
প্রান্ত ভাইয়ার কথায় ঠোঁট টিপে হাসলাম আমি। রাইসা বিব্রতভাবে তাকালো। আমি ওদের একান্তে ছেড়ে দিয়ে হেটে গেলাম সামনের দিকে। পেছনে চলছে তাদের খুনসুটি। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে হাসলাম আমি! একজন পুরুষ তার বউয়ের আবদার পূরণ করছে, এ দৃশ্য দেখার মাঝে যে কত সৌন্দর্য থাকে সেটা ভাষায় প্রকাশ করা দুরহ।
রাইসার হাতে কাশফুল দেখে আমার মনেও কাশফুল হাতে নেওয়ার সুপ্ত ইচ্ছে জেগে উঠলো! সামনে তাকিয়ে দেখি পূর্ণ কথা বলছেন কাজিনদের সাথে। উনাকে আমি বললে উনি কাশফুল ছিড়ে দিবেন? নাকি নিছক ছেলেমানুষী আবদার ভেবে হেসে উড়িয়ে দিবেন? কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলাম সামান্য এক কাশফুল তোলার জন্য উনাকে বলতে হবে কেন? আমি নিজেই তুলতে পারবো। তাই রাশি রাশি কাশফুলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিড়ার চেস্টা করলাম আমি। কাশফুলগুলো আমার ধারণার চেয়েও বেশ কিছুটা শক্ত, সাবধানে না ছিড়লে হাত ছিলে যাওয়ার ভয় থাকে। উপরন্তু কাশফুলগুলো উঁচুতে হওয়ায় নাগাল পেতে বেগ পাচ্ছিলাম। পায়ের নিচে মাটি খানিকটা উচু-নিচু হওয়ায় ফুল ছিড়ার মাঝেই টাল সামলাতে না পেরে হঠাৎ করেই পড়ে গেলাম আমি। আমি পড়ে যেতেই সকলের দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো সেদিকে! আমার পরিবারের মানুষ বাদেও আশেপাশের কিছু মানুষও আমায় পড়তে দেখেছে এতক্ষণে! এতগুলো মানুষের সামনে এভাবে পড়ে যাওয়ার বেশ লজ্জাবোধ করলাম আমি। পূর্ণ দ্রুতকদমে এগিয়ে এলেন আমার দিকে। ইতস্ততভাবে নিজেকে সামলিয়ে উঠলাম আমি। উনিও হাত দিয়ে ধরে দাড় করালেন আমায়।
এমন সময় দিশা আপু উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। তার হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলাম আমি। উনার হাসি যেন আমাকে খানিকটা অপমানিত করলো। পূর্ণও রেগে চেয়ে আছেন তার দিকে। দিশা আপু হাসতে হাসতেই বললেন,
—তুই কি বাচ্চা নাকি তুরফা? এক সামান্য কাশফুল ছিড়তে গিয়ে পড়ে গেলি? আমি জাস্ট ভাবতে পাচ্ছিনা! তাও এতগুলো মানুষের সামনে? সিনটা কত ফানি ছিলো! আল্লাহ!
—মানুষ পড়ে যেতেই পারে আপু। এখানে এত অবাক হওয়ার কি আছে? তুমি জীবনে কোনোদিন পড়ে যাওনি?
তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললাম তাকে। এভাবে আমাকে সবার সামনে উনার ছোট করাটা আমার মোটেও পছন্দ হলোনা। তখনি দিশা আপু বললেন,
—পড়ে গিয়েছি তবে তোর মতো সবার সামনে এভাবে পড়িনি। দেখ সবাই কিভাবে তাকিয়ে আছে…
—সবাই তাকিয়ে আছে আর তুই সবার সামনে তুরফাকে ইনসাল্ট করে মজা নিতে চাইছিস তাই তো? মিনিমাম কমনসেন্সটুকুও কি নেই তোর?
দিশা আপুকে পুরো কথা শেষ করতে না দিয়েই রাগী সুরে বলে উঠলেন পূর্ণ। উনার কথায় দমে গেল দিশা আপু। তেজী আওয়াজে বললেন,
—আমি মজা নিলে দোষ আর তুমি নিলে দোষ নেই, তাই না? তুমিও তো তুরফাকে ক্ষেপিয়ে কতকিছু বলো আমাদের সামনে। তাতে তো তোমার কোন প্রব্লেম নেই। তাহলে আমি বলাতে তুমি এত রেগে যাচ্ছো কেন, পূর্ণ ভাই?
—কারণ আমি ওকে তোর মতো বাহিরের মানুষের সামনে ইনসাল্ট করিনি। ওকে তোদের সামনে ক্ষেপিয়েছি কারণ তোরা জানিস তুরফা কেমন। তোদের সামনে ওকে আমি মজা করে কিছু বললেও ওর সম্মানহানি হবেনা। কিন্তু বাহিরের লোকদের সামনে তুই যেভাবে বললি তাতে সবাই তুরফাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। ওর অসম্মান হবে৷ আর পূর্ণ থাকতে তার বউয়ের অসম্মান হতে দিবেনা। এটা সবসময় মাথায় রাখবি।
উনার কণ্ঠের গাম্ভীর্য বলে দিচ্ছে উনি নিজের কথায় কতটুক সিরিয়াস। পূর্ণর কথায় পুলকিত হলো আমার মন! আমি যা যা বলতে চাইছিলাম উনি তার সবটুকুই বলেছেন। দিশা আপু রেগে বললেন,
—তোমার সাথে এখন কথা বলাই বেকার। বিয়ে করে তুমি বদলে গেছো, পূর্ণ। আমি আর থাকবোনা এখানে। বাসায় চলে যাবো এখনি।
বলেই হনহন করে গাড়ির কাছে চলে গেলো আপু। পূর্ণ সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আমার হাত নিজের সামনে এগিয়ে এনে বললেন,
—কোথাও লেগেছে কি তোমার? দেখি? ব্যাথা পেয়েছো হাতে বা পায়ে?
উনি জিজ্ঞেস করছেন আর নিজহাতে আমার হাতে লেগে থাকা ধুলো মুছে দিচ্ছেন। পূর্ণর কথায় ও আচরণে কথাগুলো যেন দলা পেকে গেলো আমার মস্তিষ্কে! অকারণেই একরাশ মুগ্ধতা ও লাজুকতা ভর করলো তনে-মনে! আড়ষ্টভাবে আড়চোখে দেখতে লাগলাম উনাকে। এমন সময় অপরিচিত এক কণ্ঠস্বর কানে এলো আমাদের!
—শুনেছি পুরুষের সৌন্দর্য থাকে তার ব্যক্তিত্বে আর নারীর সৌন্দর্য থাকে তার লাজুকতায়! আর আশ্চর্যজনকভাবে আপনাদের দুজনের মাঝে যেন সেটারই প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি আমি! মে গড ব্লেস ইউ বোথ।
তাকিয়ে দেখি এক প্রবীণ লোক হাসিমুখে বললেন কথাটা। এতক্ষণ হয়তো উনি পর্যবেক্ষণ করছিলেন আমাদের! উনার কথাটা যেন ঠিক হৃদয়ে গিয়ে বিধলো আমার! আনমনেই চোখ গেলো পূর্ণর দিকে। যিনি এখনও সযত্নে আমার দু-হাত পরখ করছেন কোথায় ছিলে গেছে কি না! হঠাৎ করেই মনজুড়ে অদ্ভুত রকমের ভালোলাগা কাজ করলো আমার সামনে দাঁড়ানো এই চমৎকার ব্যক্তিত্ববান পুরুষটির উপর! যিনি কিনা আমার একান্তই ব্যক্তিগত মানুষ!
#চলবে
#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ৩৬
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
সন্ধ্যার নিস্তব্ধতায় ডুবে আছে চারপাশ। বিকেলের কোলাহল ভুলে যেন নীড়ে ফেরা পাখির মতো সকলের ছুটতে লাগলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। গ্রামের সরু রাস্তায় একমনে চলছে আমাদের গাড়ি। যা ড্রাইভ করছেন প্রান্ত ভাইয়া, তার পাশের সিটে ক্লান্তভাবে হেলান দিয়ে আছে রাইসা। পেছনের সিটে জানালার এক ধারে বসে আছেন তাসিন ভাইয়া, অপরপাশে বসে আছি আমি আর আমাদের দুজনের মধ্যিখানে বসে আছেন পূর্ণ! কাশবন ছেড়ে দাদুবাড়ি যাওয়ার পথে প্রথমদিকে গাড়িতে তাসিন ভাইয়ার কল্যাণে গল্পগুজব হলেও এখন তিনি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন বন্ধ জানালার সাথে মাথা রেখে। তাই এখন গাড়িজুড়েও বিরাজ করছে অদ্ভুত নীরবতা! বাহিরে বেশ খানিকটা আধার ঘনিয়ে আসায় একনাগাড়ে জ্বলতে আছে গাড়ির ভিতরের লাইট। যার আলোয় সবার চেহারার ক্লান্তি স্পষ্ট টের পাওয়া যাচ্ছে। শুধু পূর্ণই মনোযোগ দিয়ে ফোন টিপছেন, কি এত করেন ফোনে আল্লাহই জানে!
এদিকে আমার নিজেরও ঘুম ধরেছে বিধায় ঘুমু ঘুমু চোখে হেলান দিয়ে আছি আমার পাশের আধখোলা জানালার সাথে। গাড়িতে উঠেই এতক্ষণ খোপা করে বেধে রাখা চুলগুলো খুলে দিয়েছিলাম, এখন একটু হালকা লাগছে মাথা! চুলগুলোও এখন বাতাসের ছোয়া পেয়ে মনের সুখে উড়ে বেড়াচ্ছে! গাড়ি কিছুটা গর্তযুক্ত খাদের পাশ দিয়ে যাওয়ায় খানিকটা কেপে উঠলাম সবাই, জানালার কাচের সাথে মাথায় সজোরে আঘাত পাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই নরম কিছুর উপর গিয়ে ঠেকলো আমার মাথাটা। গাড়ির গতি স্বাভাবিক হতেই পাশ ফিরে দেখি পূর্ণ রাগী চোখে চেয়ে আছেন আমার দিকে। উনার হাত আমার পিঠের পেছন দিয়ে জানালার সাথে ঠেকানো। তার হাতের তালুতে মাথা ঠেকেছে আমার। উনি খানিকটা সরে গিয়ে হাত আমায় তার কাধে মাথা দিতে ইশারা করলেন। উনার ইশারায় আমার চক্ষুচড়ক গাছ!
সামনের সিটে প্রান্ত ভাইয়া ড্রাইভ করছেন যেকোন সময় লুকিং গ্লাস এ আমাদের দেখতে পারবেন আর আমি তার কাধে মাথা দিয়ে ঘুমাবো? আমার কি লজ্জা নেই নাকি! চোখ পাকিয়ে উনাকে মানা করলাম। পূর্ণ এক ভ্রু তুলে জিজ্ঞেস করলেন “কি হয়েছে?” আমি কিছু না বলে ইতস্ততভাবে প্রান্ত ভাইয়ার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। পূর্ণ হয়তো বুঝলেন আমার কথা, তাইতো চুপ হয়ে গেলেন। খানিকক্ষণ বাদে কিঞ্চিৎ কেশে প্রান্ত ভাইয়াকে বললেন,
—বলছিলাম তোর কি অসুবিধা হবে কি লাইট অফ করে ড্রাইভ করতে? হেডলাইট তো অন-ই আছে সামনের। সমস্যা হওয়ার কথা না। রাইসার খুব ঘুম পেয়েছে দেখ, কেমন হেলান দিয়ে আছে। গাড়ির আলোতে ঘুমাতে পাচ্ছেনা বেচারি।
পূর্ণর কথায় প্রান্ত ভাইয়া রাইসার দিকে তাকালেন। ওর চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছিলো ওর ঘুম ধরেছে, তাই প্রান্ত ওকে ধমকে বললেন,
—তোমার সমস্যা হচ্ছে আগে বলোনি কেন? তাহলেই তো আমি লাইট অফ করে দিতাম।
রাইসা বেচারি দুই ভাইয়ের কথায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে। হ্যাঁ না কি বলবে কিছুই বুঝতে পারলোনা। ওর উত্তরের অপেক্ষা না করেই গাড়ির ভেতরের লাইট অফ করে দিলেন প্রান্ত ভাইয়া। ভরাসন্ধ্যার নিকষ আধার এসে গ্রাস করলো গাড়ির মাঝেও। এখন আবছা আলোয় কাউকেই তেমন বুঝা যাচ্ছেনা। রাইসারও সাড়া শব্দ নেই ঘুমিয়ে গেলো হয়তো, এদিকে আমার ঘুম উড়ে এলো পূর্ণর কর্মকাণ্ড দেখে! কি ভীষণ ধুরন্ধর লোকটা! আমি জাস্ট ভাবতে পারলাম নাহ। কেমন চালাকি করে গাড়ির লাইট অফ করে নিলেন। আমার ভাবনার মাঝেই পূর্ণর স্পর্শ পেয়ে ধ্যান কেটে গেল আমার! উনি আমার পিঠের পেছন দিয়ে হাত এলিয়ে দিয়ে নিচু স্বরে বললেন,
—এসো।
আবছা অন্ধকারে তার চেহারা স্পষ্ট দেখতে পেলাম নাহ আমি। তবে আমি মুখ খুলে কিছু বলার আগেই উনি নিজেই টেনে নিলেন আমার মাথাটা, সযত্নে চেপে রাখলেন তার বুকে। স্তব্ধতায় কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেললাম আমি! উনি আমার খোলা চুলের মাঝে হাত এলিয়ে দিয়ে শান্তকণ্ঠে বললেন,
—আর একটাও কথা নয়। চুপচাপ ঘুমাও।
আবেশে, আশ্চর্যতায় চোখ আপনাআপনিই বন্ধ হয়ে গেলো আমার। উনার বুকে মাথা দিয়ে কেন যেন খুব প্রশান্তি লাগছে, মনে হচ্ছে এই স্থানে মাথা দিয়ে যেকোন সময় মহাআয়েশে ঘুমাতে পারবো আমি!
এসব ভাবতে ভাবতে আচমকা ঘুমের রাজ্যে বিচরণ করলাম আমি…
______________
“বিদায়” শব্দটা বরাবরই বেশ কস্টকর। আমার জন্যও ব্যতিক্রম নয়। বিয়ের সময় আন্টির বাড়ি ছেড়ে আসতে যেমন কস্ট লেগেছিলো তেমনি কস্ট দাদুবাড়ি ছেড়ে ঢাকায় আসার সময় লেগেছে। এত বছর পর দাদুবাড়ি এসেছিলাম যেন মনেই হয়নি একবারও! সবাই একয়দিনে এমনভাবে আপন করে নিয়েছেন আমায় যেন এতবছর বিচ্ছিন্ন ছিলামই না আমি তাদের থেকে! সেই প্রিয় পরিবারের মায়া কাটিয়ে পুনরায় ঢাকায় ফিরতে বড্ড খারাপ লেগেছে মনে। দাদি তো কেদেই দিয়েছেন বেচারি। বারবার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে চুমো দিয়ে আদর করেছেন। পূর্ণকে কড়াভাবে বলে দিয়েছেন কখনো আমাকে কস্ট না দিতে। পূর্ণও বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়িয়েছেন।
উল্টো দাদিকে বলেছেন,
—তুমি তুরফার জন্য চিন্তা করোনা, দাদি। আমি কোন অযত্ন হতে দিবোনা তোমার নাতনির। তবে ওকেও বলো আমার মনের খেয়াল রাখতে। সে যে এ বিষয়ে বড্ড কাচা!
দাদির সামনে এমনটা বলায় বেশ রাগ হয়েছে আমার। আমি আবার উনার মনের কি করেছি? আমি কি তার খেয়াল রাখিনা? খারাপ লোক। অযথাই একটা কথা বলে। তারপর থেকে ঢাকা আসার রাস্তায় আমার আর পূর্ণর কোন কথা হয়নি। সকাল সকাল বাসায় ফিরেই পূর্ণ ও প্রান্ত ছুটেছেন অফিসে। আমার দিন কেটেছে বড়াম্মু আর রাইসার সাথে কখনো কাজ করে, কখনো গল্প করে। গত কয়েকদিন আনন্দে কাটিয়ে এখন আবার গতানুগতিক নিয়মে ফিরে এসেছি সবাই। এভাবেই চলছে জীবন।
.
দেখতে দেখতেই সময় চলে যায়। আজ আমার এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট। সকাল থেকেই বেশ নার্ভাস হয়ে, টেনশনে অস্থির হয়ে বসে আছি আমি। তার মধ্যে কালরাতে পূর্ণর সাথে ঝগড়া হওয়ায় রাগ ও ভয় আরো বেড়ে গেছে মনে। কাল রাতে যখন উনাকে জানাই আজ রেজাল্ট দিবে। উনি স্বাভাবিকভাবেই নিলেন। তার মতে রেজাল্ট একদিন দিবেই, এটা জানা কথা অতএব এই বিষয়ে টেনশন করার কোন যুক্তি হয়না। আমি রেগে বলেছিলাম “আপনার মতো টপার কি বুঝবে আমার মতো এভারেজ স্টুডেন্ট এর দুঃখ”
ব্যস! তাতেই উনার ইগোতে লেগে গেছে! আমায় স্পষ্ট ও কড়াভাবে বলে দিয়েছেন আমি টপ করতে পারিনা এটা আমার ব্যর্থতা। উনি টপার হতে পারলে আমি কেন টপার হতে পারলাম নাহ? তাই এ বিষয়ে তাকে যেন খোটা না দিই। আরও অনেককিছুই বলেছেন রাগের বশে যেটা মনে হতেই টেনশনে আমার হাত-পা হিম হয়ে যাচ্ছে। বেশ খানিকক্ষণ রাগ দেখিয়ে কণ্ঠে ব্যাপক গাম্ভীর্য মিশিয়ে বলেছেন,
—দেখো তুরফা, রেজাল্টের পর থেকেই অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে এডমিশনের জন্য পড়া শুরু করো। ঢাকার মধ্যেই চান্স পাওয়ার টার্গেট থাকতে হবে তোমার।
কিছুটা থেমে বললেন,
“অবশ্য ঢাকার বাহিরে চান্স পেলেও আমার সমস্যা নেই। তবে সেক্ষেত্রে তোমাকে হোস্টেলে একাই থাকতে হবে।”
হঠাৎ একা থাকার কথা শুনে পিলে চমকে গেলো আমার! এসব কি বলছেন উনি? কোথায় সাহস দেখাবেন তা নয়, উলটো ভয় দেখাচ্ছেন আমায়। জিহবা দিয়ে শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে বললাম,
—আপনি সত্যিই আমাকে হোস্টেলে রেখে আসবেন?
আমার চোখে স্পষ্ট ভয়, তবে এটা কিসের ভয় আমি জানিনা! উনার চোখের ভাষা অস্পষ্ট।
নেহাৎ-ই ঠান্ডা গলায় বললেন,
—অবশ্যই। কেন রেখে আসতে পারবোনা? পড়ালেখার ব্যাপারে কোন ছাড় নেই আমার কাছে। আর তাছাড়াও আমি অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকি এখানে খুব। তুমি তো জানোই। অতএব ঢাকার বাইরে চান্স পেলে তোমাকে একাই থাকতে হবে। তাই চেস্টা করবে ঢাকার ভেতরে চান্স পাওয়ার।
উনার কাঠ কাঠ গলার গাম্ভীর্যে চিন্তায়-ভয়ে আমার ঘাম ছুটে গিয়েছে। এখন তো এইচএসসির ফলাফলের চেয়ে এডমিশনের টেনশন বেশি হচ্ছে। রাইসার হাত ধরে বসে আছি এসএমএস আসার অপেক্ষায়। টিভিতে দেখাচ্ছে ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। যথারীতি এসএমএস এলো। পেয়ে গেলাম কাংক্ষিত রেজাল্ট। “এ প্লাস” পেয়েছি আমি। এই খুশিতে রাইসাকে জড়িয়ে ধরলাম আমি। তারপর বড়াম্মুকে জানালাম দুজন। বড়াম্মু ফোন করে বড়াব্বুকে জানিয়ে দিলেন অফিসে। আসার সময় মিস্টি নিয়ে আসবে জানালেন বড়াব্বু। তার সাথে কথা বললাম আমি। প্রান্ত ভাইয়াও কংগ্রেটস জানালেন। কি গিফট নিয়ে আসবেন আমার জন্য সেটাও শুনলেন। সবার সাথেই কথা হলো, শুধু হলোনা পূর্ণর সাথে। তাই এত খুশির মাঝেও মনটা যেন শান্তি পেলোনা আমার।
উনি ঢাকায় আসার পর থেকেই এমন করছেন! মনে হচ্ছে যেন ইচ্ছে করেই এভোয়েড করছেন আমায়। অথচ দাদুবাসায় কি সুন্দর ব্যবহার করছিলেন সে কয়দিন আমার সাথে! একবারের জন্য তো রাইসার সেদিনের বলা কথাটা মেনে নিতে ধরেছিলাম আমি, কিন্তু ফিরে আসার পর থেকে উনার ব্যবহার দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে আমায়। এত গোলকধাঁধাঁর মাঝে রেখেছেন কেন আমায় কে জানে? যদি সত্যিই ভালোবাসেন তবে প্রকাশ করলে কি হয় আমি বুঝিনা! আর আমাকে এভোয়েড-ই বা কেন করছেন বিগত কয়দিন ধরে?? আচমকাই উনার এহেন বদলে যাওয়া আচরণ বড্ড ভাবাচ্ছে আমায়।
এইচএসসির চিন্তা তো গেলো, এখন সামনে এডমিশন নামক আরেকটি বড় চিন্তার পাহাড় অপেক্ষা করছে আমার জন্য! সেখানেও আদৌ এবারের মতো সফল হতে পারবো তো?
আল্লাহ-ই ভালো জানেন!
পূর্ণটারও হঠাৎ কি হয়েছে উনার কে জানে? কি চলছে উনার মনে?
গম্ভীরমুখে ভাবতে লাগলাম আমি…
#চলবে