#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ৩৭,৩৮
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
৩৭
সকাল গড়িয়ে দুপুর হতেই ছুটে চলছি আন্টির বাসায়। উদ্দেশ্য নিজ মুখে তাকে রেজাল্টের সুসংবাদ দেওয়া আর তার সাথে মনভরে গল্প করা! এমনিতেই বিয়ের পর থেকে শত ব্যস্ততায় ইচ্ছে থাকলেও আন্টির সাথে ওইভাবে কথা বলা, দেখা করার সুযোগ হয়নি। ফোনেই যা আলাপ হয়েছে টুকটাক কয়েকবার। আজকে তাই সুযোগ পেয়ে ছুটেই চলে এসেছি আন্টির কাছে, সাথে এসেছে রাইসা। অবশ্য আমাদের দুজনের কেউই জানাইনি আন্টিকে আমাদের আসার কথা, এক প্রকার সারপ্রাইজই বলা চলে। বাসার মেইনগেটের সামনে আসতেই দেখি আমায় কল দিচ্ছেন আন্টি। হয়তো রেজাল্ট জানার জন্য ফোন দিয়েছেন, মুখ টিপে হেসে তার কল কেটে দিলাম আমি। রাইসাও আমার কান্ড দেখে মিটিমিটি হাসছে। বাড়ির ভেতর পৌঁছে যেই না দরজায় কলিংবেল দিয়েছি, ঠিক সেই মুহুর্তে আবারও বেজে উঠলো আমার ফোন। এবার রিসিভ করতেই আন্টির চিন্তিত গলা,
—তুরফা, ফোন কেটে দিলি কেন? রেজাল্ট ভালো হয়নি? আমার খুব চিন্তা হচ্ছে তোর জন্য। কি হয়েছে তাড়াতাড়ি বল।
—সব বলছি তুমি আগে তোমার বাসার গেট খুলো।
হেসে বললাম আমি। তৎক্ষণাৎ হন্তদন্তভাবে গেট খুললেন আন্টি। উনার এক কানে ফোন, আমাদের দেখে চেহারায় চিন্তা ও অবাকের মিশ্রণ। ফোন কেটে দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম আন্টিকে। উনিও আলতো হাতে আমায় ধরে আদর করে দিলেন। একটু পর আমায় ছেড়ে কান টেনে দিয়ে বললেন,
—এত বাদর কেন তুই? বিয়ে হয়ে গেছে তাও দুষ্টুমির স্বভাব গেলোনা! তোরা ভালো হবিনা, তাইনা?
—কি করবো বলো। এভাবে না এলে তোমার সারপ্রাইজ দিতে পারতাম না যে! তোমার এই রিয়েকশনটাও মিস করে ফেলতাম!
দুষ্টু হেসে বললাম আমি। আমার কথায় আন্টি চোখ পাকিয়ে বললেন,
—তোর সারপ্রাইজ এর জন্য যে আমি একটু আগে টেনশনে পড়ে গেছিলাম তার কি হবে? এখন সবকিছু বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি রেজাল্টের কথা বল। ঠিকঠাক নাম্বার পেয়েছিস না সবগুলোয়?
এবার আমি কিছু বলার আগেই রাইসা মুখ খুললো। দাত কেলিয়ে বললো,
—শুধু ভালো না, মা। অনেক ভালো করেছে তুরফা। প্লাস পেয়েছে সবগুলোয়। ওর পরিশ্রম আল্লাহ সার্থক করে দিয়েছেন।
—আমি জানতাম আমার মেয়ে পারবে। আমার বিশ্বাস ও দোয়া সবসময় ছিলো ওর সাথে।
আমার গালে হাত রেখে কোমল সুরে বললেন আন্টি। দীর্ঘদিন পর তার স্নেহ পেয়ে এতক্ষণের বিষন্ন মনটা নিমিষেই ফুরফুরে হয়ে গেলো আমার! অতঃপর দরজা লাগিয়ে তিনজন ভেতরে আসতে আসতেই দেখা মিললো দাদির। মনের সুখে ড্রয়িংরুমের সোফায় পা তুলে পান চিবুতে চিবুতে টিভি দেখছিলেন তিনি। আন্টিকে আসতে দেখে টিভি দেখতে দেখতেই বললেন,
—এই দুপুরবেলা আবার কে আইছে?
নিজের কথা শেষ হওয়ার আগেই আন্টির পেছনে রাইসা ও আমায় দেখতে পেলেন দাদি। আমাদের দেখে আন্টির মতো উনিও বিস্মিত হলেন। টিভি থেকে মনোযোগ সরিয়ে পা নামিয়ে বসলেন সোফায়। রাইসাকে দেখে বললেন,
—কি রে, কেমন আছিস? এতদিন পর এই বাড়ির কথা মনে পড়লো তোর?
নিজের দাদিকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো রাইসা। দাদিকে জড়িয়ে ধরেই বললো,
—তোমাকে ভুলে যেতে পারি, দাদি? এতদিন খুব ব্যস্ত ছিলাম বলেই তো আসিনা। তুমিও তো গেলেনা একবার আমায় দেখতে।
—কথা শোন আমার নাতনির! আরেহ, মেয়ের শশুড়বাড়িতে আমরা যখন-তখন যাবো নাকি? বরং তুই চলে আসবি আমার কাছে সময় পেলে।
—এইতো চলে এসেছি। সাথে তুরফাও এসেছে দেখো। আজ ওর রেজাল্ট দিয়েছে, এ প্লাস পেয়েছে জানো?
রাইসার কথায় দাদির দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ হলো। কিছুটা তাচ্ছিল্যের সাথে আমায় বললেন,
—তো মহারানীর কি খবর? অনেকদিন পর এ বাড়িতে দেখা পাইলাম তোর।
দাদির কথায় আমিও ব্যঙ্গাত্বক হেসে বললাম,
—কি করবো বলো দাদি? তুমি আমায় এত মিস করছিলে যে না এসে পারিনি!
আমার কথায় ঠোঁট টিপে হাসলো রাইসা আর আন্টি। দাদি চোখ পাকিয়ে তাকালেন আমার দিকে। নীরস মুখে বললেন,
—নিজের বাসায় গেছিস এখন, দেখে তো বুঝাই যাচ্ছে বেশ ভালোই আছিস।
—ভালো তো থাকবোই। ওখানে কেউ আমাকে দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে কাজ করিয়ে নেয়না যে, বুঝেছো!
নিচুকণ্ঠে তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বললাম দাদিকে। আমার কথায় উনি খানিকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন। সরু চোখে আমায় দেখে জবাব না দিয়ে পুনরায় টিভি দেখায় মনোযোগ দিলেন।
অতঃপর একসাথে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম চারজন। খেয়েদেয়ে রেস্ট নিয়ে আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা হওয়ার পর আমি ও রাইসা চলে যেতে নিচ্ছিলাম তখনি আন্টি জিদ ধরে বললেন যে আমাদের আজ যেতে দিবেন নাহ তিনি। এতদিন পর এসেছি একদিন তো থেকে যেতেই হবে! রাইসা একবার মানা করলো বাসায় বলে আসেনি বিধায়, তবে আমি কিছু একটা ভেবে আন্টির কথা মেনে নিলাম। আমায় রাজি হতে দেখে রাইসা ফিসফিসিয়ে বললো,
—তুই রাজি হলি কেন? মা কে তো আমরা জানিয়ে আসিনি থাকার কথা। আর আজ তো বাবা মিস্টি, গিফট আনবে তোর জন্য। তাদের সাথে তো রেজাল্টের পর দেখাই হলোনা তোর। বাসায় গিয়ে নিবিনা সেগুলো? আমার মনে হয় পূর্ণ ভাইয়াও হয়তো কিছু আনতে পারে তোর জন্য!
রাইসার কথায় মেকি হাসি হাসলাম আমি। পূর্ণ আর গিফট আনবেন আমার জন্য? কয়দিন ধরে যে ঢং শুরু করেছেন তাতে মনে হয়না উনি এমন কিছু করবেন। যে লোক সামান্য কংগ্রেটস বলার জন্যও ফোন দিতে পারেন না সে আবার কি গিফট আনবে? তার থেকে এসব আশা করাও আদিখ্যেতা! তাই গম্ভীরমুখে রাইসাকে বললাম,
—দেখ বোন, আমার মুড ভালো নেই আজকে সকাল থেকেই। তুই তো দেখেছিসই, তাইনা? এখানে এসে আন্টির সাথে থেকে ভালো লাগছে। আজ রাতটা এখানেই থাকি না? কি এমন হবে! আমি বড়মাকে ফোন দিয়ে ম্যানেজ করে নিবো তুই চিন্তা করিস না।
খানিকটা থেমে দুষ্টু সুরে বললাম,
—অবশ্য তুই যদি প্রান্ত ভাইয়াকে খুব বেশি মিস করিস তাহলে তুই যেতে পারিস। আমি তোকে বাধা দিবোনা।
রাইসা চোখ পাকিয়ে আমার বাহুতে মারলো আলতো করে। সেদিকে হাসলাম আমি। যাক! রাইসা রাজি হয়েছে। আজকে এ বাসায় থাকা হবে। মনে মনে পৈ/শা/চিক শান্তি পেলাম আমি। পূর্ণ আমাকে ইগ্নোর করছিলেন এ কয়দিন, তাইনা? এবার আমিই উনাকে ইগ্নোর করবো। দেখাই করবোনা তার সাথে।
বাকা হেসে ভাবলাম আমি।
________________
রাইসাকে রাজি করেই তৎক্ষণাৎ বড়মার সাথে ফোনে কথা বলে তাকেও জানিয়ে দিয়েছি আমি আজকে আন্টির বাসায় থাকার কথা। বড়মা প্রথমে একটু রাগ করলেও পরে আমি উনাকে রাজি করিয়েছি। বলেছি মিস্টিগুলো কাল যেয়ে খাবো, আমার গিফট যত্ন করে তুলে রাখতে। আমার আদুরে গলার আবদার আর ফেলতে পারেননি বড়াম্মু। তবে আমাদের এ বাসায় থাকায় সবচেয়ে খুশি হয়েছেন আন্টি! উনার খুশি দেখে কে? সন্ধ্যা পেরোতেই নিজ হাতে আমার ও রাইসার পছন্দের সব খাবার বানানো শুরু করে দিয়েছেন। আমি, রাইসা ও দাদি ঝালমুড়ি খেতে খেতে মহাআয়েশে সোফায় বসে নাটক দেখছি।
সিরিয়ালের ভিলেনটা নায়িকা ও নায়কের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাতে চাইছে। সেজন্য তার উপর বেজায় চটেছেন দাদি। টিভির সামনে যেয়েই গালিগালাজ করছেন ভিলেনটাকে। পারলে টিভির ভেতরে ঢুকে দু-চারটা মেরে দিয়ে আসবেন। এদিকে তার কান্ড দেখে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছি আমি আর রাইসা! ঝালমুড়ি খাওয়া শেষে আমি হাত ধুয়ে রান্নাঘরে গেলাম। আন্টি কি করছন দেখার চেস্টা করতেই দেখি উনি একহাতে সব করছেন। আমি সাহায্য করতে গেলে উনি নিতে নারাজ। আমাকে ঠেলেঠুলে রেস্ট নিতে পাঠিয়ে দিলেন। সোফার কাছে গিয়ে দেখি দাদি একাই টিভি দেখে বকবক করছেন, রাইসা নেই। ওর রুমে উকি দিয়ে দেখি বিছানায় হেলান দিয়ে গল্প করছে ফোনে, নিশ্চয়ই প্রান্ত ভাইয়ার সাথে হবে? এরা দুজন কি সুন্দর চুটিয়ে প্রেম করে সারাদিন! আর একদিকে আমার কপাল! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিরস মুখে এসব ভাবতে ভাবতেই নিজের রুমে চলে এলাম আমি।
ফোন চেক করে দেখি এখনও পূর্ণর তরফ থেকে কোন ফোন/মেসেজ আসেনি। অভিমান জমলো তার উপর। বেশ অভিমান! এমন কেউ করে? বউয়ের সাথে এত ভাব না দেখালেও তো পারে লোকটা। রাগে-দুঃখে ফোন সুইচড অফ করে শুয়ে পড়লাম বিছানায়। সারাদিনের ধকল শেষে অবচেতন শরীর নিমিষেই তলিয়ে পড়লো ঘুমের ঠিকানায়!
_____________
ঘুম থেকে উঠে কারও সাড়াশব্দ না পেয়ে রুম থেকে বের হলাম আমি। ঠিক কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম তাও জানিনা! যাওয়ার সময় রাইসার রুমে দেখলাম সে নেই। হয়তো আংকেল এসেছেন এতক্ষণে আর সবাই তার সাথে কথা বলছে ভেবে ড্রয়িংরুমের দিকে পা বাড়ালাম আমি। কিছুদূর যেতেই দেখা হলো রায়হান ভাইয়ার সাথে। এতদিন পর হঠাৎ উনাকে দেখে চমকে গেলাম আমি! বেশ পরিবর্তন লাগছে উনার চেহারায়। আগে ক্লিন শেভ চেহারায় এখন খোচা খোচা দাড়ি, শুকিয়েও গেছেন বেশ খানিকটা। চোখের নিচে গর্ত উনার। উনার কি ঘুম হয়না ঠিকমতো? এরকম লাগছে কেন তাকে? আমার ধ্যান ভেঙে গেলো ভাইয়ার কথায়। শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
—কেমন আছো, তুরফা?
—আমি ভালো আছি, ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন? অনেকদিন পর দেখা হলো আপনার সাথে।
—হুম, অনেকদিন পর। আমি আছি।
কথাটুকু বলে মলিন মুখে হাসলেন উনি। আমি কৌতুহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
—আপনার কি শরীর খারাপ? অনেক শুকিয়ে গেছেন। রোগা লাগছে আপনাকে।
রায়হান ভাইয়া আগেকার মতোই ম্লান হাসলেন তবে জবাব দিলেন নাহ। হঠাৎ করে পকেট থেকে একটা চকলেট বের করে বললেন,
—রাইসা বললো আজ নাকি তোমার রেজাল্ট দিয়েছে? শুনলাম অনেক ভালো করেছো তুমি। তাই এটা তোমার জন্য। নেও!
উনার কথায় মুখে হাসলেও চকলেটটা নিতে খানিকটা ইতস্ততবোধ করছিলাম। কেন এমন লাগছিলো নিজেও বুঝলাম নাহ। তবুও উনি হাত বাড়িয়ে রেখেছেন বিধায় ধীর হাতে নিয়ে নিলাম ভাবলাম একটা চকলেটই তো! নিচু স্বরে বললাম,
—ধন্যবাদ, ভাইয়া। আমি তাহলে ড্রয়িংরুমে যাই। রাইসাদের সাথে গিয়ে বসি?
উনি কিছুক্ষণ আমার দিক তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে নিজেই চলে গেলেন। তার কর্মকাণ্ড অদ্ভুত ঠেকলো আমার কাছে! তবুও তেমন মাথা না ঘামিয়ে চলে গেলাম ড্রয়িংরুমের উদ্দেশ্য। সেখানে প্রবেশ করতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ! আংকেলের সামনে সোফায় বসে আছেন প্রান্ত ভাইয়া আর পূর্ণ। উনার দিকে আমি তাকানোর সাথে সাথেই উনিও তাকালেন আমার দিকে। তার দৃষ্টি শান্ত, বরাবরের ন্যায়। এক পলক আমার দিক চেয়ে হঠাৎ ভ্রু-যুগল কুচকে গেলো উনার। তার কারণ অনুসন্ধান করতে উনার দৃষ্টি অনুসরণ করলাম আমি!
পূর্ণর চোখ আমার হাতে রাখা চকলেটের উপর। তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছেন সেদিকে! এদিকে আমি উনাদের দিকে বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে ভাবছি তারা দুজন এখানে কি করতে এসেছেন রাতের বেলা এই সময়?
#চলবে
#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ৩৮
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
আমাকে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করতে দেখেই পাশ থেকে এগিয়ে এলো প্রিয়া। ওকে দেখে আরেকদফা চমকে গেলাম আমি! ভাইদের সাথে সে-ও এসেছে? হচ্ছেটা কি এখানে? আমাকে জড়িয়ে ধরে প্রিয়ার কণ্ঠস্বর,
—কংগ্রেটস, ভাবী! আমি খুব খুশি তোমার জন্য।
—থ্যাংকিউ, প্রিয়া। তোমরা সবাই হঠাৎ একসাথে এলে যে?
—আর বলোনা। তোমার সাথে তো রেজাল্টের পর দেখাই হলোনা আমাদের। বাবা মিস্টি নিয়ে এসেছিলো, সে তোমাকে বাসায় না দেখে নারাজ। বলেছে আমরা আজই যেন তোমার মিস্টিমুখ করি। সাথে আংকেল-আন্টির জন্যও মিস্টি পাঠিয়েছেন। যেহেতু ভাইয়ারা আসছিলো তাই ভাবলাম আমিও চলে আসি সাথে।
প্রিয়ার হাসোজ্জল চেহারা দেখে হাসি চলে এলো আমার মুখেও। মেয়েটা বড্ড সরল, সবার সামনে নিদারুণ চঞ্চলতায় কথা বলছে। আমি ওকে নিয়ে সোফায় বসলাম। পূর্ণ ওভাবেই ঠাই তাকিয়ে আছেন আমার হাতের দিকে। বিরক্ত হলাম আমি। কি সমস্যা উনার? সবার সামনে এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন!
কিছুক্ষণ সবাই কথাবার্তা বলে ডিনার করতে গেলো। খাওয়া শেষ করে প্রান্ত ভাইয়া চলে আসতে চাইছিলেন সেসময় আন্টি জেদ করলেন তাদের থাকার জন্য, প্রান্ত ভাইয়া রাজি হলেন নাহ। তাদের সকালে অফিস আছে, সাথে ব্যাগ-ফাইল কিছুই আনেননি তাই থাকতে চাচ্ছেন নাহ। পূর্ণ মাথা নেড়ে সায় দিলেন। তাদের কিছুক্ষণ রেস্ট নেওয়ার জন্য আন্টি তাড়া দিলেন আমাদের,
—রাইসা, তুরফা জামাইদের তোদের রুমে নিয়ে যা। মাত্র খেয়ে উঠলো, রেস্ট নিক কিছুক্ষণ।
আমরা মাথা দুলিয়ে রুমের দিকে অগ্রসর হলাম। দুই ভাই এলেন পিছু পিছু।
______________
রুমে ঢুকতেই চুপচাপ খাটে গিয়ে বসলাম আমি। পূর্ণর দিকে তাকালাম না পর্যন্ত। উনি ধীর পায়ে এসে বসলেন আমার পাশঘেঁষে। আমি খানিকটা সরে বসলাম, পূর্ণও সরে এলেন। বেশ কয়েকবার একি ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো! আমি যত সরছি উনি ঠিক ততই আমার পাশঘেঁষে বসছেন! এদিকে সরতে সরতে যে কখন আমি খাটের কিনারায় চলে এসেছি নিজেও বুঝিনি। একটু নড়তেই খাট হতে পড়ে যেতে নিয়েছিলাম এমন সময় উনার বলিষ্ঠ হাত শক্তভাবে চেপে ধরলো আমার কোমড়! মুহূর্তেই টেনে আমাকে খাট থেকে উনার কোলে বসিয়ে দিলেন পূর্ণ। ঘটনার আকস্মিকতায় অক্ষিদ্বয় কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম আমার! উনি গভীর চোখে আমার দিক চেয়ে আছেন। স্তম্ভিত আমি ভ্রু কুচকে উনার দিক চেয়ে সরে যাওয়ার জন্য ছটফট করলাম বারকয়েক। তবুও উনার শক্তির সাথে পাল্লা দিতে সক্ষম হলাম নাহ! একপর্যায়ে উনার প্রগাঢ় চাহনি ও শক্তহাতের স্পর্শ নিতে না পেরে বিরক্তিকর কণ্ঠে বলে উঠলাম,
—কি শুরু করেছেন? এভাবে কোলের উপর বসিয়েছেন কেন? ছাড়ুন আমায়।
—আমার বউকে আমি কোলে তুলে রাখি, না হয় মাথায় তুলে রাখি। সেটা একান্তই আমার ইচ্ছা। এতে তোমার কি?
পূর্ণর কথায় বেকুব সেজে গেলাম আমি। ক’দিন যাবত উনার চোখের সামনে ঘুরঘুর করলাম, তখন ঠিকই ইগ্নোর করলেন আর এখন উনাকে একা থাকতে দিয়ে আন্টির বাসায় চলে এসেছি তাতে যেন সোহাগ উপচে পড়ছে উনার! কেমন বউ বউ করছেন! উনাকে পাত্তা না দিয়ে তাচ্ছিল্যভরা কণ্ঠে বললাম,
—অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে। বাসায় চলে যান।
—সারাদিন পর মাত্র তোমার দেখা পেলাম, তুরফা। আর তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছো? নট ফেয়ার।
দুঃখী কণ্ঠে বললেন উনি। শুনে আমার হঠাৎ রাগ হলো। এখন উনার কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন সব দোষ আমার।
—আমি থাকলেও আপনার কি যায় আসে? আমি থাকা, না থাকা সমান আপনার কাছে। এখন বাসায় যেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। আর ছাডুন আমায়!
—আমি তো একা যাচ্ছিনা। তোমাকেও নিয়ে যেতে এসেছি।
উনার কথা শুনে গোলগোল চোখে চেয়ে রইলাম। আমাকে নিয়ে যেতে এসেছেন? কিন্তু কেন? উনি কি জানেন না আমি থাকবো আজ এখানে। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললাম,
—আমি যাবোনা আপনার সাথে। আজ আন্টিকে কথা দিয়েছি এখানে থাকার। বড়াম্মুকেও বলে দিয়েছি। তিনি আপনাকে বলেননি?
—মা বলেছে আমায়। তাতে কি? আমি তোমার আন্টিকে রাজি করাবো। তুমি রাজি হলেই হচ্ছে। এখন তুমি আমার সাথে বাসায় যাবে।
জেদি গলায় বললেন পূর্ণ। আমিও দ্বিগুণ জিদ দেখিয়ে বললাম,
—অসম্ভব! আমি আপনার সাথে যাবোনা মানে যাবোই না আজ। আর আপনার সাথে যেয়েও বা কি? আপনি তো দিব্যি নিজের মতোই থাকবেন। মাঝখান দিয়ে আমার মন খারাপ হয়ে যাবে। এর চেয়ে আমি আন্টির এখানেই ভালো আছি৷ কেউ তো আমার কথা ভাবে, আমাকে মিস করে।
—তুমি বলতে চাইছো আমি তোমার কথা ভাবিনা? আমি তোমাকে মিস করিনা? তাহলে তোমাকে এই রাতের বেলা কেন নিতে এসেছি?
রেগে বললেন পূর্ণ। এই মুহুর্তে উনার চেহারা স্পষ্ট বলে দিচ্ছে আমায় “পূর্ণ তোমায় খুব মনে করে”। তবুও উনার মুখ থেকে শুনার অদম্য ইচ্ছে জাগলো মনে। উনার থেকে স্বীকার করিয়ে নেওয়ার এটাই সুযোগ। তেজী গলায় বললাম,
—অবশ্যই করেন না। আমার কথা মনে করলে এই যে আজ আমার রেজাল্ট দিলো, আপনি একটাবারও ফোন দিয়েছেন আমায়? ফোন তো দূরের কথা, মেসেজ অব্দি দেন নি! সবাই আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে, গিফট দিয়েছে শুধু আপনি বাদে। এখন এসব আদিখ্যেতা দেখাতে হবেনা আপনার। আমাকে ছাড়ুন বলছি৷
আমার এত রাগি গলার তেজ দেখে যেন বিস্মিত হয়ে গেলেন পূর্ণ। হাতের বাধন আপনা-আপনিই আলগা হয়ে গেলো উনার। সেই সুযোগে উনার কোল থেকে নেমে জানালার কাছে গিয়ে দাড়ালাম। এক নিঃশ্বাসে এত কথা বলায় হাপিয়ে গিয়েছি। তবে মনে মনে খুশিও হলাম। উনাকে জানানো দরকার ছিলো আমার মনের অবস্থা। কখনো সুন্দর ব্যবহার করবেন তো কখনো অবহেলা করবেন এমনটা হয় নাকি? উনার এত মুডসুইংস সহ্য হয়না আমার!
এসব ভাবতে ভাবতেই জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছি চুপচাপ। আকাশে মেঘ। চাঁদের দেখা নেই আজ। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে যেন! জানালা দিয়ে সাই সাই করে ঠান্ডা বাতাস প্রবেশ করছে ঘরে, চুলগুলো ছন্নছাড়াভাবেই দুলছে মুখের আশেপাশে। বিরক্তিতে আলতো হাতে এলোমেলো চুল খোপা করলাম আমি। খানিকক্ষণ বাদে ঘাড়ের কাছে উষ্ণ নিঃশ্বাস পেতেই পেছন ঘুরার চেস্টা করলাম। তবে আমায় পিছনে ঘুরার সুযোগ দিলেন না পূর্ণ! আচমকা উনার বড়সড় হাতজোড়া দিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলেন আমায়। মুহুর্তেই স্থির হওয়া শ্বাসপ্রশ্বাস যেন দ্বিগুণ গতিতে উঠানামা করতে লাগলো আমার! উনার উষ্ণ হাতের স্পর্শেও ঠান্ডা হয়ে এলো আমার হাত-পা। অদ্ভুত সব অনুভূতির বৃষ্টিতে ভিজে গেলাম যেন আমি৷ এমন সময় পূর্ণ কানের কাছে মুখ নিয়ে ধীর গলায় নরম সুরে বললেন,
—সরি। তুমি রাগ করোনা। ভেবেছিলাম সবাই তো ফোনেই শুভেচ্ছা জানাচ্ছে, আমি না হয় সরাসরিই জানাবো। নয়তো সবার আর আমার মধ্যে পার্থক্য থাকলো নাকি?
মস্তিষ্ক জবাব দিতে চাইলেও মন তাতে দ্বিমত জানালো। মনের বিরুদ্ধে যেয়ে কথা বলতে পারলাম না আমি। শিউরে উঠে চুপচাপ শুনতে লাগলাম উনার কথা। এই নরম-কোমল পূর্ণকে আমি সচারাচর দেখিনা, কিন্তু যখন তার দেখা পাই তখন শুধু উনার কথা শুনতেই মন চায়। আমায় চুপ থাকতে দেখে পূর্ণ আবারো বললেন,
—কথা বলছোনা কেন? এখনও অভিমান করেছো? আমি সবার মতো তোমায় কংগ্রেটস জানাবোনা। কারণ এটা তোমার সফলতার প্রথম ধাপ মাত্র, আসল পরীক্ষা এখনও বাকি আছে। আমি চাই তুমি সেটাও সফল হও ভালোভাবে। আমি চাইনা তুমি ঢাকার বাহিরে যাও। তোমাকে আমার সাথেই থাকতে হবে। এটা মাথায় রাখবে, বুঝেছো?
চুপচাপ উনার কথায় মাথা নাড়লাম আমি। এতক্ষণের জমে থাকা অভিমান যেন নিমিষেই ধূলিসাৎ হয়ে গেলো! এই গম্ভীর লোকটা ভালো করেই জানেন কিভাবে আমার অভিমান ভাঙ্গাতে হয়। এই যে উনার কোমল আচরণ যে আমার হৃদয়ে কম্পন তুলে সেটা কি উনি জানেন?
আচমকা চুলে টান অনুভব হতেই নড়ে উঠলাম আমি! পূর্ণ হালকা সুরে ধমক দিলেন,
—উফ, তুরফা! নড়োনা তো৷ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো।
উনার কথা মেনে কৌতুহলের সাথে চুপচাপ ঠাই দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। কিছুক্ষণ পর উনি কাজ শেষ করে আমায় নিয়ে অপরপাশ ঘুরলেন আয়নার দিকে। নিজের খোপায় বেলিফুলের মালা দেখে বেশ অবাক হয়ে গেলাম আমি। নাকে এসে ঠেকলো তাজা ফুলের মিস্টি ঘ্রান, যা বৃষ্টির সুবাসের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে!
—বুঝতে পাচ্ছিলাম না তোমার জন্য কি নিবো। হঠাৎ এটা চোখে পড়লো ফেরার পথে। আমি অবশ্য চুলে ঠিকমতো লাগাতে পারিনা এগুলো। তাও বেধে দেওয়ার চেস্টা করলাম। ভালো লেগেছে তোমার?
হালকা হেসে বিচলিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন পূর্ণ। উনার সরল মুখ বলছে তার এসব বিষয়ে কোন পূর্বঅভিজ্ঞতা নেই। তবুও এই মানুষটা ধীরে ধীরে সব চেস্টা করছেন। শুধু আমার জন্য! এর চেয়ে বড় ভালো লাগা আর কি হতে পারে আমার কাছে?
মুহুর্তেই এক পশলা ভালো লাগার বৃষ্টি নামলো আমার হৃদয়জুড়ে! বাইরে প্রকৃতির বৃষ্টির বেগ বাড়ছে, খানিকটা ছিটেফোঁটা এসে ছুয়েও দিচ্ছে আমাদের দুজনকে! এদিকে বেখেয়ালি মন বলছে, এটাকেই বোধহয় প্রেমের বৃষ্টি বলে, তাইনা?
#চলবে