বৃষ্টিময়_প্রেম #পর্বঃ৪১,৪২

0
1206

#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ৪১,৪২
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
৪১

ইষৎ ফাঁকা রাস্তায় রিকশা ছুটে চলেছে নিজের মতো করে। ঢাকা শহরে জ্যামের অভাব না থাকলেও কাকতলীয়ভাবে আজকে রাস্তায় জ্যাম কম। রিকশায় উঠার পর থেকেই চুপচাপ বসে আছি দুজনে, কথা বলছে নীরবতা। সন্ধ্যাবেলায় যেন রাস্তাঘাটের আসল সৌন্দর্য ফুটে উঠে, ঘরফেরা মানুষের কোলাহলে চারপাশ মুখোরিত থাকে। আশেপাশে সে-সব দেখতে দেখতে চলছি আমরা! চায়ের টং এ আড্ডা দিচ্ছে লোকজন, সুখ-দুঃখের গল্প হচ্ছে চায়ের কাপের সাথে, দোকানিরা ক্রেতা পেয়ে ব্যবসায় মত্ত, চারদিকে রমরমা অবস্থা। জামা, চুড়ি কতকিছুর দোকান একসাথে! ফুলের দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মৌ-মৌ গন্ধে মোহনীয় হয়ে আছে চারপাশ!

রঙ-বেরঙের ফুলের সমাহার মুগ্ধ চোখে চেয়ে চেয়ে দেখছি আমি। হঠাৎ মনে হলো এই মুহুর্তে এক তোড়া ফুল হাতে নিয়ে থাকলে নেহাৎ মন্দ হতো নাহ! আর কিছুদূর যেতেই পূর্ণ রিকশাওয়ালা মামাকে বললেন,

—মামা, রিকশাটা একটু সাইড করো তো।

উনার কথামতো রিকশা থামলো। আমরা রিকশা থেকে নামতেই পূর্ণ আমাকে একটা চুড়ির দোকানের সামনে নিয়ে গেলেন। চুড়িগুলোর দিক চেয়ে বললেন,

—দেখো তো কোন রং এরটা পছন্দ হচ্ছে?

—আমার জন্য?

—নাহ, আমার আরেকটা বউ আছে তার জন্য বলছিলাম। তোমার সতীনের জন্য পছন্দ করো।

আমি সরু চোখে তাকিয়ে উনার হাতে চিমটি দিলাম। পূর্ণ বাকা হেসে বললেন,

—হারি আপ, তুরফা। বাসায় যেতে হবে আমাদের। রিকশা দাড় করিয়ে রেখেছি তো!

আমি মাথা নাড়িয়ে চুড়িগুলো দেখতে লাগলাম। এরই মাঝে পূর্ণ কোথায় যেন গেলেন। আমি একজোড়া নীল চুড়ি হাতে পড়ে দেখছিলাম। তখনি পূর্ণ ফিরে এলেন। আমার হাতের দিকে তাকিয়ে মানিব্যাগ বের করতে করতে বললেন,

—পারফেক্ট। এটা মানিয়েছে তোমার হাতে। হাতে পড়েই থাকো, খুলো নাহ।

অতঃপর চুড়ির দোকানিকে দাম দিয়ে আমায় নিয়ে রিকশায় উঠলেন। আমি হাতের চুড়িগুলো নেড়েচেড়ে দেখছিলাম। হঠাৎ কোমড়ে পূর্ণর স্পর্শে শিউরে উঠে উনার দিকে তাকালাম। উনি পকেট থেকে একটা গোলাপ বের করে আমার কানে গুজে দিতে দিতে বললেন,

—কোন কিছু ভালো লাগলে তুমি আমাকে বলোনা কেন? তোমার তো অধিকার আছে আমাকে বলার। সবসময় কেন আমাকেই নিজে থেকে বুঝে নিতে হবে? এরপর থেকে কোনকিছু নিতে মন চাইলে আমাকে সরাসরি বলবে, ঠিক আছে?

উনার ভারী কন্ঠে তার দিকে আড়চোখে তাকালাম আমি। পূর্ণ কান থেকে হাত সরিয়ে ভ্রু তুলে বললেন “কি?” আমি মাথা নেড়ে বললাম “কিছু না”। এরপর আর কোন কথা হলোনা আমাদের। মিনিট পাচেকের মধ্যেই বাসায় পৌঁছে গেলাম। রিকশা থেকে নেমে বাসায় ঢুকবো এমন সময় পূর্ণ পেছন থেকে বললেন,

—ভাবছিলাম যে কোন ফুলটা বেশি সুন্দর, বলো তো? তোমার গোলাপ না আমার গোলাপ?

উনার প্রশ্নে থমকে দাড়ালাম আমি। পেছনে ঘুরতেই চোখে পড়লো তার মুখের স্নিগ্ধ হাসি। যে হাসিতে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা দায়!

_______________

বাসায় প্রবেশের পরই চুড়ি আর ফুল দেখে হইহই করছে রাইসা আর প্রিয়া। এমনকি ওদের সাথে যোগ দিয়েছেন প্রান্ত ভাইয়াও! কেউ আমাকে ক্ষেপাতে বাকি রইলোনা, বড়াম্মু শুধু মিটমিটিয়ে হাসছিলেন। এদিকে আমি লজ্জায় শেষ আর পূর্ণ দিব্যি নির্বিকারভাবে ফ্রেশ হতে চলে গেলেন উনার গম্ভীর মুখখানা প্রদর্শন করে। ভাবখানা এমন যেন এখানে কি হচ্ছে উনি কিছুই জানেন নাহ! রাইসা আমার দিকে ভ্রু তুলে জিজ্ঞেস করলো,

—জল গড়িয়ে তাহলে এতদূর গিয়েছে আর আমি জানলামও নাহ?

—চুপ কর। এখনো তেমন কিছুই হয়নি।

—তা তো দেখতেই পাচ্ছি বেবি। আর কিছু হওয়া বাকি আছে কই?

আমি রাইসার দিক চোখ পাকিয়ে তাকাতেই ও হেসে মুখ বন্ধ করলো। এদিকে প্রিয়া উদাসী মুখ করে বললো,

—আজ আমার জামাই নেই বলে কেউ এভাবে চুড়ি, গোলাপ গিফট করেনা! জীবনটাই কস্টের!!

ওর রিয়েকশন দেখে হেসে ফেললো সবাই। প্রান্ত ভাইয়া প্রিয়ার মাথায় গাট্টি মেরে বললেন,

—তাই না? খুব শখ হয়েছে তোর বিয়ে করার? দাড়া আজকেই বাবাকে বলছি তোর জন্য পাত্র খুজতে!

—পাত্র তো খুজেই ফেলেছি, ভাইয়া। বিয়ে হওয়াটাই বাকি এখন।

বিরবিরিয়ে বললো প্রিয়া। প্রান্ত ভাইয়া ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলেন,

—কি বললি? স্পষ্ট করে বল। বুঝিনি।

—কিছু নাহ৷ এখন বুঝা লাগবেনা তোমার। যাকে বুঝা দরকার তাকেই এখনো বুঝাতে পারিনি তোমায় আর কি বুঝাবো!

প্রিয়ার কথায় হতাশ দৃষ্টিতে তাকালেন প্রান্ত ভাইয়া। উনার মুখ দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে তিনি কিছুই বুঝেননি। অবশ্য উনি একা নাহ, আমরা কেউই বুঝলাম নাহ প্রিয়ার কথার অর্থ। মেয়েটা কেমন জানি অদ্ভুত কথাবার্তা বলছে আন্টির বাসায় থেকে আসার পর থেকে!

প্রান্ত-প্রিয়ার খুনসুটির মধ্যেই কিছুক্ষণ পর পূর্ণ এসে প্রিয়ার পাশে বসে ওর দিকে নিজের কার্ড এগিয়ে দিয়ে রাশভারি বললেন,

—এই নে। যা মন চায় শপিং করিস কাল। এরপর থেকে আর কখনো বলবিনা তোর কেউ নেই। যতদিন না তোর বিয়ে হচ্ছে তোর সমস্ত শখ-আহ্লাদ পূরণ করার জন্য তোর বড় ভাই এখনও জীবিত আছে। কথাটা সবসময় মাথায় রাখবি৷

—ইয়েএএএ! থ্যাংক ইউ, বড় ভাইয়া। তুমি দিন দিন আরও সুইট হয়ে যাচ্ছো। লাভ ইউ।

পূর্ণকে জড়িয়ে ধরে খুশিতে গদগদ হয়ে বললো প্রিয়া। পূর্ণও হেসে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। প্রান্ত সেদিকে চেয়ে বললেন,

—হ্যা হ্যাঁ, এখন তো বড় ভাইয়াকেই তোর সুইট লাগবে। এরপর কোনকিছু কিনতে হলে আমার কাছে টাকা চাস। আমিও সোজা বড় ভাইয়ার কাছেই পাঠিয়ে দেব।

প্রিয়া তার দিকে ভেংচি দিয়ে বললো,

—আর কিছু চাবোনা তোমার কাছে। তুমি সবসময় আমাকে ক্ষেপাও। আমি বড়ভাইয়ার কাছেই চাবো এরপর থেকে। তুমি ভালো নাহ।

—আচ্ছা? আমি তো ভালো নাহ, ভালো নিয়াই থাক তুই। দেখবোনি কতদিন এমন থাকিস।

ব্যস! পুনরায় শুরু হয়ে গেল ভাইবোনদের টকঝাল ঝগড়া। সেদিকে মনোযোগ দিয়ে দেখছি আমি আর রাইসা। কত মজা লাগে এমন দৃশ্য দেখতে! রাইসার তো তাও একটা ভাই আছে। আচ্ছা ওর কি মনে পড়ছে রায়হান ভাইয়ার কথা? মনের প্রশ্নটা মুখে করেই ফেললাম। রাইসাকে বললাম,

—রায়হান ভাইয়ের কথা মনে পড়ছে?

রাইসা হালকা হেসে মাথা নাড়লো। আমি ওর কাধে হাত রেখে বললাম,

—সমস্যা নেই। শীঘ্রই দেখা হবে ভাইয়ার সাথে। আমরা আবার আন্টির বাসায় যাবো।

—আম্মুর বাসায় যাওয়ার দরকার নেই। কালকে এমনিতেও ভাইয়ার সাথে দেখা হবে।

হেসে বললো রাইসা। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

—কাল দেখা হবে মানে? রায়হান ভাই এখানে আসবেন নাকি?

—নাহ। তবে কাল একটা পার্টি আছে প্রান্তদের অফিসের। অনুষ্ঠানে অন্য কোম্পানির মানুষদেরও ইনভাইট করা হয়েছে, ভাইয়াও যাবে।

—ওয়াও। তাহলে তো ভালোই। এটা তুই জানলি কিভাবে? প্রান্ত ভাইয়া বলেছে?

—হ্যাঁ, প্রিয়াও জানে। ওই-ও যেতে চাইছে কাল। প্রান্ত প্রথমে রাজি না হলেও পরে প্রিয়ার জিদের কারণে রাজি হয়েছেন। ওর জন্য তোকে আর আমাকেও যেতে হবে পার্টিতে!

—বাহ! এত কিছু হয়ে গেলো, তোরা সবাই জানতি অথচ পূর্ণ আমাকে কিছুই বলেন নি এ ব্যাপারে।

গোমড়া মুখে বললাম আমি। সবাই জানে অথচ পূর্ণ আমাকে জানালেন না একবারও। হুহ! আড়চোখে উনার দিকে তাকাতেই আমাকে চোখ টিপ মারলেন পূর্ণ। থতমত খেয়ে গেলাম আমি। উনার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে প্রিয়ার দিকে তাকাতেই ওর হাসোজ্জল চেহারা চোখে পড়লো! মেয়েটাকে বেশ খুশি খুশি দেখাচ্ছে। তবে এই খুশির আসল কারণ কি? ওর এমন পরিবর্তিত আচরণেরই বা কারণ কি? জানার আগ্রহ বেড়ে চললো মনে!

#চলবে

#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ৪২
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা

এলোমেলো ভঙ্গিতে বিছানার মাঝে বসে আছি আমি। আমার একপাশে শাড়ির স্তুপ, অপরপাশে ছোট-খাট গহনাপত্রের সমাহার! স্বভাবসুলভ মেয়েলি অভ্যাসের কারণে পার্টিতে কোনটা পড়ে যাবো না যাবো সেটা ভাবতে ভাবতেই আধ-ঘন্টা খানেক পেরিয়ে গেছে ইতোমধ্যে! অথচ এখনও মনমতো শাড়ি বাছাই করতে পারিনি আমি৷ এরই মধ্যে পূর্ণ লম্বা শাওয়ার নিয়ে ফিরে আসলেন। আমায় এভাবে চিন্তিত বেশে বসে থাকতে দেখে হাতের তোয়ালা দিয়ে ভেজা চুল মুছতে মুছতে বললেন,

—কি হয়েছে? এভাবে সব জিনিসপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখেছো কেন? কোথাও যাবে?

—কোথায় যাবো মানে? একেতো আপনি আমাকে পার্টির কথা কিছু বলেন নি তার মধ্যে এখন জিজ্ঞেস করছেন কোথায় যাবো? আপনি আদৌ আমাকে নিয়ে যেতে চাইছেন নাকি আমি বুঝতে পাচ্ছিনা। আপনার মতলবটা কি বলুন তো?

কোমড়ে হাত রেখে রাগী গলায় জিজ্ঞেস করলাম আমি। তবে আমার রাগ দেখেও পূর্ণর ভাবভঙ্গির বিশেষ পরিবর্তন হলোনা। স্বাভাবিকভাবেই তোয়ালেটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

—আপাতত মতলব হচ্ছে তোমার কালকে পড়ার শাড়ি সিলেক্ট করে দেওয়া। তুমি ততক্ষণ বারান্দায় যেয়ে ভেজা তোয়ালাটা নেড়ে দিয়ে এসো।

বলতে বলতেই আমায় হাত ধরে রীতিমতো বিছানা থেকে টেনে উঠালেন উনি। অগত্যা তোয়ালে নিয়ে বারান্দায় মেলে দিয়ে আসলাম আমি। পূর্ণ এতক্ষণে বিচক্ষণ চোখে শাড়িগুলো দেখতে শুরু করেছেন। একটি কালো রঙের শিফনের পাতলা শাড়ি দেখে মৃদু হাসলেন উনি, যেন মনে হয় উনার পছন্দ হলো! পরমুহুর্তেই কি যেন ভেবে চোখমুখ গম্ভীর করে শাড়িটাকে রিজেক্ট করলেন। এদিকে আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি উনার কান্ড! অবশেষে একটি মোটা জর্জেটের লাল শাড়ি বাছাই করলেন। আমার দিক এগিয়ে এসে আমার উপর শাড়িটা ধরতেই মুখে হালকা হাসি ফুটে উঠলো উনার। গর্বিত স্বরে বললেন,

—শাড়ি সিলেক্টেড! তুমি এটা পড়ে যাবে কালকে। সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস। পার্টির জন্য গুড এনাফ!

পূর্ণ শাড়িটা পাশে রেখে জুয়েলারি বক্স ঘেটে একটা মুক্তার মালা ও কানের দুলের সেট বের করলেন। শাড়ির পাশে সেটা রাখতে রাখতে বললেন,

—ব্যস, হয়ে গেছে। এর সাথে বিয়ের পরেরদিন তোমায় যে লালচুড়ি দিয়েছিলাম সেটা পড়বে। আর কিচ্ছু লাগবেনা।

আমি শুধু চুপচাপ মাথা নাড়লাম। উনি রুম থেকে বের হয়ে যেতে যেতে বললেন,

—এইটুক কাজ করার জন্য এত সময় লাগে? দেখো আমি কত তাড়াতাড়ি ডিসাইড করে দিলাম সব। তোমরা মেয়েরা পারোও বটে!

পূর্ণর কথা আমার মস্তিষ্কে ঢুকলেও সেটা নিয়ে মাথা ঘামালাম না। আমার ভাবনা উনার করা কাজকর্মে! কতটা সাবলীলভাবে আমার জন্য শাড়ি গহনা বাছাই করে দিলেন, অথচ উনাকে দেখলে কেউ কখনো ভাবতে পারবে এমন গম্ভীর লোকটা একান্তে নিভৃতে বউয়ের জন্য এসব করতে পারে? পূর্ণর আচরণে সবসময় বিস্ময় জেগে উঠে মনে। এ বিস্ময় যেন কখনো শেষ হবার নয়!

________________

পরেরদিন সন্ধ্যায় পার্টিতে যাওয়ার আগে প্রিয়ার রুমে বসে ওকে শাড়ি পড়তে সাহায্য করলাম৷ এ কয়দিন শাড়ি পড়তে পড়তে বেশ খানিকটা আয়ত্তে এসে গেছে আমার, নিজেও পড়তে পারি অন্যকেও পড়াতে পারি। প্রিয়া গুনগুন করে গান গাইছে আর মেকাপ করছে। নতুন নতুন প্রেমে পড়লে মানুষের যা যা হয় তার সবটা লক্ষণ ওর মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে! আমি শতভাগ নিশ্চিত যে প্রিয়া প্রেমে পড়েছে। তাও অপরিচিত কারও নয়, রায়হান ভাইয়ার প্রেমে পড়েছে! এ অঘটন কখন কিভাবে হলো জানার আগ্রহ জন্মাচ্ছে মনে তবুও সরাসরি ওকে জিজ্ঞেস করা হয়ে উঠছেনা। প্রিয়া অবশ্য নির্দ্বিধায় আমাকে দু-তিনবার রায়হান ভাইয়ের পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছে৷ আমার সন্দেহ ওর প্রশ্নেই নিশ্চয়তা পায়! অবশেষে আর কৌতুহল দমাতে না পেরে ওকে প্রশ্ন করেই বসলাম,

—হঠাৎ রায়হান ভাইয়ের পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে তোমার এত চিন্তা হচ্ছে কেন বোন? প্রেমে পড়ে গেছো নাকি ভাইয়ার?

ভেবেছিলাম প্রিয়া হয়তো রাগ করবে নয়তো লজ্জা পাবে কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে সরল মুখে প্রিয়ার স্বীকারোক্তি,

—প্রেমে পড়েছি কিনা জানিনা তবে উনাকে আমার অনেক বেশি ভালো লেগেছে। তার শান্তশিষ্ট পারসোনালিটি, নরম স্বভাব আমাকে মুগ্ধ করেছে! আমি জানিনা একদিনে ভালোবাসা হয় কি না তবে আমার কাল থেকে শুধু তার কথাই মাথায় আসছে, ভাবী। উনি আসবেন শুনেই আমি পার্টিতে যাওয়ার জিদ করেছি ভাইয়ার বারণ সত্ত্বেও! তুমি আমাকে হেল্প করবে? উনার জীবনে কেউ আছে কি না এ বিষয়ে খোজ নিয়ে আমায় জানাবে প্লিজ?

প্রিয়ার প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলাম আমি! রায়হান ভাইয়ার জীবনে কেউ আছে কি না এটা আমি কিভাবে জানবো? এক ছাদের নিচে একসাথে বহুবছর থাকলেও আমার উনার সাথে এমন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার মতো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এখনও তৈরি হয়নি! আমি উনাকে জিজ্ঞেসও করতে পারবোনা এমন কিছু। তাই আমতা আমতা করে প্রিয়াকে বললাম,

—দেখ প্রিয়া, আমি তো এ ব্যাপারে তেমন কিছু বলতে পারবোনা। রায়হান ভাইয়ার সাথে এমন বিষয়ে কখনো কথা হয়নি আমার আর হওয়ার চান্সও নেই। আমার মনে হয় রাইসা জানবে। ও তোমার হেল্প করতে পারবে। ওর বড় ভাই কি না? রাইসাকেই না হয় বলো তুমি!

—এই না না, ভাবী। রাইসা ভাবীকে বলবেনা প্লিজ। সে তো রায়হান ভাইয়ার নিজের বোন তাই তাকে বলতে অসস্তি লাগবে আমার। আমার আর রায়হান ভাইয়ার মধ্যে কিছু হওয়ার আগে রাইসা ভাবীকে জানাতে চাইছিনা আমি। আশা করি তুমি বুঝবে? ভাবীকে কিছু বলবেনা প্লিজ?

—ঠিক আছে। রাইসাকে আমি কিছু বলবোনা। তবে তোমার যে অবস্থা, এখনি প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছো আমিই সন্দেহ করছিলাম তোমার উপর৷ তোমার ভাইদের বুঝতেও বেশি সময় লাগবেনা, বুঝেছো?

—এই রে! আমি এত বেশি এক্সাইটেড ছিলাম যে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি তখন। এরপর থেকে আর কাউকে বুঝতে দিবোনা। তবে তুমি আমাকে কথা দেও তুমি এ ব্যাপারে কাউকে বলবেনা। এমনকি বড় ভাইয়াকেও না? প্রমিস করো আমায়? সবকিছু সেট হওয়ার আগে তুমি এমন ভাব করবে যেন তুমি কিছুই জানো নাহ!

—আমি না হয় প্রমিস করলাম কিন্তু উনি পরে জানতে পারলে রাগ করবেন।

কাচুমাচু মুখে বললাম আমি। পূর্ণকে যতদূর চিনি উনার বোনের এমন বিষয় তার থেকে লুকোনোর জন্য উনি অবশ্যই রাগ করবেন। তবে প্রিয়ার যুক্তিও ফেলতে পারলাম না যে সবকিছু ঠিক হওয়ার আগে কেন অযথা সবাইকে বলে বেড়াবো যেখানে এখনও কিছুই শুরুই হয়নি, সবটাই অনিশ্চিত!

প্রিয়ার সাথে কথাবার্তা বলে ওকে রেডি হতে দিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালাম আমি। উপরে যাওয়ার আগে রাইসার রুমে উকি মেরে দেখলাম ওর ইতোমধ্যেই অর্ধেক রেডি হওয়া শেষ! তার মানে এখন শুধু আমিই বাকি। জলদি রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে রেডি হওয়া শুরু করলাম আমি। শাড়ি পড়া যেই না শেষ করেছি এমন সময় ওয়াশরুম থেকে পুরোপুরি রেডি হয়ে বের হলেন পূর্ণ। আমার পাশে দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজের জেল দেওয়া চুল আঁচড়িয়ে সেট করলেন ঠিকমতো। অতঃপর পারফিউম লাগিয়ে হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে নিজের সব কাজ শেষ অতঃপর এক পলক তাকালেন আমার দিকে। আমাকে এখনও রেডি না হতে দেখি নিচু স্বরে চেচিয়ে বললেন,

—এখনও তুমি রেডি হওনি কেন, তুরফা? সবার রেডি হওয়া শেষ! তোমাকে রেখেই আমরা চলে যাই নাকি?

—যান৷ আমি যাবোনা।

নিরস মুখে বললাম আমি। এমনিতে প্রিয়ার কথায় মাথার মধ্যে চিন্তার ডালপালা গজিয়েছে তার মধ্যে উনার এত তাড়া! একটু দেরি হয়েছে বলে ছেড়ে যাওয়ার কথা বলছেন। আমাকে উদাস মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যেন খানিকটা নরম হয়ে গেলেন পূর্ণ! এগিয়ে এসে ধীর গলায় বললেন,

—কি হয়েছে তুর পাখির? কোন কারণে মন খারাপ?

উনার কথায় আমি চিন্তিত চোখে চাইলাম তার দিকে তবু মুখ ফুটে কিছু বললাম নাহ। শুধু “না-বোধক” মাথা নাড়লাম। কেননা উনাকে চাইলেও কিছু বলা যাবেনা এখন! আবার এদিকে প্রিয়ার লক্ষণ ভালোনা পার্টিতে যেয়ে না জানি কি করে বসে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেকাপ কর‍তে আরম্ভ করলাম আমি। হালকা মেকাপ করে গলায় তড়িঘড়ি করে মালা পড়তেই চুলের সাথে প্যাঁচ লেগে গেলো সেটি। হন্তদন্ত হয়ে খুলার চেস্টা করতেই পূর্ণ বিরক্তিকর চাহনি নিয়ে এগিয়ে আসলেন। দ্রুতহাতে যত্নসহকারে খুলে পড়িয়ে দিলেন মালাটি। অতঃপর ড্রেসিং টেবিল থেকে নিজেই কাচের চুড়িগুলো তুলে পড়িয়ে দিতে লাগলেন হাতে। চুড়ি পড়ানো শেষ করে আমায় আপাদমস্তক পরখ করে কপালের সামনের পড়ে থাকা এলোচুল কানের পেছনে গুজে দিয়ে খানিকটা কাছে এগিয়ে এলেন। দুর্বোধ্য হেসে বললেন,

—চলুন মিসেস তাজওয়ার চৌধুরী। আপনি এখন পার্টিতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত!

________________

পড়ন্ত সন্ধ্যায় রেস্টুরেন্টের ছাদে পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। বলতে গেলে এটা অফিসিয়াল পার্টি হলেও আশেপাশের মানুষের আলোচনায় সেটা বুঝার জো নেই, কেননা অফিসের চাপে দীর্ঘদিন দেখা না হওয়া ভার্সিটির বন্ধুমহলরা একত্রে একদিন দেখা করার জন্য একত্রিত হয়েছে এখানে! তাই নামেই এটি অফিসিয়াল পার্টি, প্রকৃত অর্থে এখানে উপস্থিত কলিগ নামক বন্ধুদের কাছে তাদের গেট টুগেদার পার্টি! সজ্জিত ছাদের রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে রায়হান। তার স্থির দৃষ্টি রেস্টুরেন্টের নিচে গাড়ি থেকে নামা যুগলের উপর। গাড়ি থেকে নামছে তুরফা, তার শাড়ির আঁচল গাড়ির সিটে আটকে গেছে যা সযত্নে গাড়ি হতে ছাড়িয়ে নিলো পূর্ণ। অতঃপর তুরফার হাত ধরে তাকে এগিয়ে নিয়ে আসতে থাকলো রেস্টুরেন্টের দিকে।

যে দৃশ্য দেখে বুকের গহীনে অদৃশ্য এক দহন হতে থাকলো রায়হানের। অবশ্য এ অনুভুতি নতুন নয়, তুরফার বিয়ের পর থেকেই হচ্ছে তার মনে। প্রতিদিন ভুলবে ভুলবে করেও ভুলতে পারেনি তুরফাকে। বিগত দুই বছর ধরে আনমনেই কখন যে নীরবে ভালোবেসেছিলো তাকে নিজেও বুঝেনি রায়হান! যতদিনে বুঝেছে তার অনুভুতির প্রখরতা ততদিনে তুরফার জীবনে পূর্ণর আগমন ঘটেছে! হাজার চেয়েও কিছু বলতে পারেনি রায়হান, কারণ যেদিন তুরফার সাথে রায়হানের বিয়ের কথা উঠে সেদিন সে পূর্ণর চোখে তুরফার জন্য অনুভূতির তীব্রতা দেখেছিলো যা সে নিজের মাঝে দেখেনি!

রাইসার ইংগেজমেন্ট এর দিন পূর্ণ যখন সবার আড়ালে তুরফার জন্য মলম রেখে আসে সেটা আর কেউ না দেখলেও নজর এড়ায়নি রায়হানের! সেদিনই সে বুঝে গিয়েছিলো তার মতো আরও কেউ আছে যে তুরফাকে গোপনে ভালোবাসে, যার ভালোবাসার অপেক্ষা ও প্রখরতা রায়হানকেও ছাড়িয়ে যায়! অতঃপর তুরফার তাকে শুধুই বড় ভাইয়ের নজরে দেখা রায়হানকে তেতো সত্যের সম্মুখীন করায়! সেদিনই রায়হান সিদ্ধান্ত নেয় পূর্ণর ভালোবাসায় সে বাধা হয়ে দাঁড়াবেনা, তুরফা যদি তার হওয়ার থাকতো তবে তার হাতের কাছে এতবছর থেকেও মাঝখান দিয়ে পূর্ণ এসে ওকে ছিনিয়ে নিতে পারতোনা। এখানে দোষ তুরফারও নয়, পূর্ণরও নয় দোষটা রায়হানের নিয়তির! যা বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন হওয়ায় রায়হান মেনে নিয়েছে! তবুও বেহায়া মন তো মানেনা, বিরহের দাবানলে প্রতিনিয়ত পুড়ে ছাড়খার হয়ে যায় সে! কিভাবে এ থেকে বের হবে রায়হান ভেবে পায়না। ওর জীবনে কি এমন কেউ আসবে যে তার ভালোবাসার মলমে সেড়ে তুলতে পারবে ওর মনের ক্ষত? নিজের ভাবনায় মগ্ন ছিলো রায়হান। পাশ থেকে হঠাৎ মেয়েলি গন্ধে ভ্রু-যুগল কুঞ্চিত হয় তার! পাশ ফিরে দেখে হাসোজ্জল মুখে প্রিয়া দাঁড়িয়ে। কিন্তু ও এখানে কেন? প্রিয়াকে দেখে অবাক হয় রায়হান। তবে প্রিয়াকে স্বাভাবিক দেখা যায়। হাসিমুখেই বলে,

—কেমন আছেন?

—ভালো। তুমি এখানে কি করছো?

—কি করছি মানে? আমার ভাইয়েরা পার্টিতে এসেছে সাথে আমিও এসেছি। কেন আপনার ভালো লাগেনি আমাকে দেখে?

উদাস মুখে প্রশ্ন করে প্রিয়া। ওর এমন সোজাসাপ্টা প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় রায়হান। ইতস্ততভাবে বলে,

—না মানে, তোমাকে এখানে দেখবো আশা করিনি তাই একটু অবাক হয়েছি। ভালো করেছো এসে।

রায়হানের কথায় পুনরায় মুখে হাসি ফুটে প্রিয়ার। সে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন লোকটার দিকে! সে কি আদৌ বুঝবে তার প্রেমে কতটা ব্যাকুল হয়ে আছে প্রিয়ার ছোট্ট হৃদয়? মুগ্ধ চোখে রায়হানের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে প্রিয়া। একজনের মনে বিরহের আগুন, অপরজনের মনে প্রণয়ের চাওয়া। দুটি অতৃপ্ত হৃদয় কি তবে একে অপরের সান্নিধ্যে তৃপ্ত হবে?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here