বৃষ্টিময়_প্রেম #পর্বঃ৪৫,৪৬

0
1624

#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ৪৫,৪৬
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
৪৫

রেস্টুরেন্টের বাহিরে ঠাই দাঁড়িয়ে আছি। ভেতরে গিয়ে সময় জিজ্ঞেস করলাম এক স্টাফের কাছে থেকে। রাত প্রায় ১০.৩০ টা বাজে। এ অসময়ে সবাই আমাকে রেখে চলে গেলো বিষয়টা বিশ্বাস করতে পাচ্ছিনা আমি! আর কেউ না খেয়াল করলেও এটলিস্ট পূর্ণর তো আমার কথা মনে রাখা উচিত ছিলো নাকি? উনিও আমায় ভুলে গেলেন? এটা কিভাবে হলো! এই তার ভালোবাসা? তাচ্ছিল্যের সাথে ভাবলাম আমি। রাগ হলো সবার উপর। কিন্তু এখন আর উপায় নেই, বাসায় তো যেতে হবে কোনভাবে। একটা রিক্সা বা সিএনজি খুজে পেলেও হয়! বাসায় যেয়ে না হয় ভাড়া দিবো। কিন্তু রেস্টুরেন্টের বাহিরে বের হতেই আমার আক্কেলগুড়ুম! বাহিরে জোরে হাওয়া বইছে, আকাশের চাঁদটাও কালোমেঘের আড়ালে মুখ লুকিয়েছে এতক্ষণে! বৃষ্টি হবে নাকি আবার? ভয়-দুশ্চিন্তায় ঘাম ছুটে গেলো আমার।

ভীত পায়ে বৃষ্টি আসার আগেই সিএনজি খুজতে বের হয়ে সামনের রাস্তায় এগোলাম আমি, কিন্তু এ গুমোট আবহাওয়ায় সব চেস্টা ব্যর্থ হলো আমার! কোন রিকশা বা সিএনজি কিছুই খুজে পেলাম নাহ! এমন বাজে পরিস্থিতিতে এর আগে পড়তে হয়নি কখনো তাই রাগে-দুঃখে অভিমানে চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়লো আমার! ওরা কিভাবে পারলো আমায় রেখে যেতে? কান্নার বেগ আরেকটু বাড়তেই কাধে হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম। ভয়ে চমকে উঠলাম আমি! ফাঁকা মস্তিষ্কে বাজে চিন্তা এলো! এ সময় কে স্পর্শ করবে আমায়? নিশ্চয়ই কোন ভালো উদ্দেশ্যে নয়? পেছন না ঘুরেই চোখ-মুখ খিচে দৌড়াতে আরম্ভ করলাম। কয়েক কদম এগোতেই আমার নামের ডাক পড়লো। সেই চিরচেনা আওয়াজ কানে বাজতেই নিজ হতেই থেমে গেলো পা-জোড়া!

—দাঁড়াও, তুরফা।

পেছনে ফিরতেই চোখে পড়লো পূর্ণর ক্লান্ত-শ্রান্ত মুখশ্রী৷ উনাকে দেখে আমার চোখমুখের অন্ধকার দূর হয়ে গেলো! এতক্ষণের ভয় যেন নিমিষেই কেটে গেলো! অথচ আমাকে ডেকে ওখানেই ঠাই দাঁড়িয়ে আছেন পূর্ণ। তার উষ্কখুষ্ক চুলগুলো বাতাসে উড়ছে, গভীর চোখজোড়া অদ্ভুতরকমের শান্ত, জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে যেন নিজেকে শান্ত করার চেস্টা করছেন উনি। কি হয়েছে উনার? উনি না চলে গিয়েছিলেন? এখানেই হঠাৎ কিভাবে এলেন? প্রশ্ন এলো বিস্মিত মনে! ভাবতে ভাবতেই ধীর পায়ে এগোতে লাগলাম উনার দিকে। ঠিক এমন সময় আধার রাত্রিকে আলোকিত করে গুরুগম্ভীর বজ্রপাতের ধ্বনি শুনা গেলো! সেই সাথে বেড়ে গেলো আমার পায়ের গতি। দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম উনাকে। আচমকা আমার এহেন আক্রমণে পূর্ণ খানিকটা পিছিয়ে গেলেন। তবুও হাতের বন্ধন ছাড়লেন না, নিজেকে সামলিয়ে শক্তহাতে জড়িয়ে ধরলেন আমায়! যেন ছেড়ে দিলেই আমি হারিয়ে যাবো। কিছুক্ষণ কোন কথা বললাম না দুজনেই। উনার বুকে মাথা ঠেকিয়ে শুধু অনুভব করলাম মুহুর্তটাকে। মিনিট কয়েক বাদে আমি পূর্ণকে ছাড়লেও উনি ছাড়ছেন না আমায়, তার হৃদপিন্ড প্রচন্ড জোরে ধুকধুক করছে। যেন ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছেন বা ভয় পেয়েছেন। অথচ ভয় তো আমার পাওয়ার কথা! উনার এমন আচরণ দেখে আমি নিজের ভয়ের কথা ভুলে গেলাম। তার বুক থেকে মাথা তুলে মুখের দিক চেয়ে বললাম,

—কি হয়েছে আপনার? এমন অস্থির হচ্ছেন কেন? প্লিজ শান্ত হোন।

—কোথায় যাচ্ছিলে তুমি?

আমায় হঠাৎ ছেড়ে দিয়ে থমকে উঠলেন পূর্ণ। যে ধমকে হতবাক হয়ে গেলাম আমি! অবাক গলায় বললাম,

—কোথায় যাচ্ছিলাম মানে? আপনারা সবাই তো আমাকে ফেলে চলে গিয়েছিলেন। বাসায় যাওয়ার জন্য সিএনজি খুজতে এসেছিলাম এদিকে!

—হোয়াট? তোমার কি মাথা খারাপ, তুরফা? তুমি এটা ভাবলে কি করে যে তোমাকে একা রেখে চলে যাবো আমি?

রেগে বললেন পূর্ণ। রাগের শিখায় উনার চোখজোড়া খানিকটা লালচে হয়ে গেছে। আমার ভ্রুদ্বয় কুঞ্চিত হয়ে গেলো উনার কথায়। উনি আমাকে রেখে না গেলে তাকে দেখলাম না কেন ভেতরে? বিস্মিত সুরে জিজ্ঞেস করলাম,

—আপনি তাহলে কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? আমি তো গাড়িতে আপনার হাতঘড়িই তো দেখেছি আমার স্পষ্ট মনে আছে! ওটা আপনি ছিলেন নাহ?

বলতে বলতেই পূর্ণর হাত টেনে নিলাম আমি। উনার হাত ফাঁকা দেখে গোলগোল চোখে তার মুখের দিক তাকালাম। আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে পূর্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

—আকাশ দেখে মনে হচ্ছিলো বৃষ্টি আসতে পারে তাই হাতঘড়ি আর ফোন প্রান্তের কাছে দিয়ে এসেছি আমি। সব বন্ধুরা গাড়িতে গেলে লিমনের বাইকটা থেকে যেতো তাই আমি পরে ভাবলাম তোমাকে নিয়ে বাইকে বাসায় যাই। এজন্যই ওদের গাড়িতে তুলে দিয়ে বাইক নিতে গিয়েছিলাম পার্কিং থেকে। ভেবেছিলাম বাইক রেস্টুরেন্টের সামনে এনে তারপর তোমাকে নিয়ে আসবো ভেতর থেকে কিন্তু এরই মাঝে যে তুমি রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে এসব কান্ড করবে তা তো আমি জানতাম না!

পূর্ণর কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লাম আমি। উনি এতকিছু ভেবে রেখেছিলেন আমাকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আর আমি ভাবলাম উনি আমাকে রেখেই চলে গেছেন? নিজের উপর নিজেই বিরক্ত হলাম, উনার ভালোবাসাকে সন্দেহ করছিলাম আমি! কাচুমাচু মুখে তার পানে চেয়ে বললাম,

—সরি। আসলে রাইসাদের চলে যাওয়ার পর আমি না প্রান্ত ভাইয়ার হাত দেখে আপনি মনে করে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম! ভয়েচিন্তায় মাথা কাজ করছিলোনা আমার তাই কি করবো না করবো ভাবতে ভাবতেই…

—কি করবে না করবে ভাবতে ভাবতেই বেকুবের মতো এত রাতে মাঝরাস্তায় সিএনজি খুজতে বেরিয়ে পড়লে তুমি তাই তো? আবহাওয়ার ভাবসাব দেখেছো তুমি? আর রাস্তাঘাটে এমন রাতে কেমন বিপদ হতে পারে তোমার আইডিয়া নেই? এতটা কেয়ারলেস কেন তুমি, তুরফা? আমাকে কি তুমি শান্তিতে থাকতে দিবেনা?

আমার কথা শেষ না করতেই চেচিয়ে উঠলেন পূর্ণ। যদিও উনার কথায় যুক্তি আছে, আমার বোকামির জন্য এটুক কথা প্রাপ্য আমার তবুও হঠাৎ উনার এত বকা খেয়ে মুখটা ভার হয়ে গেলো আমার! চোখের কোঠায় জমা হলো বিন্দু বিন্দু অভিমানী জল। যেগুলোকে কোনমতে সামলিয়ে মাথা নিচু করে ছোট গলায় বললাম,

—আমি কি করবো বুঝতে পারিনি। ভয়ে টেনশনে মাথা কাজ করছিলোনা আমার। আমি..

কথার মাঝখানে আচমকা দুইগালে পূর্ণর হাতের স্পর্শ পেয়ে কেপে উঠলাম আমি। চোখ তুলে উনার দিকে তাকাতেই দুজনের অক্ষিদ্বয় মিলিত হলো! পূর্ণর চোখে আকুলতা। নরম সুরে বললেন,

—তুমি এমন করো কেন, তুর পাখি? আমার কথা কি একবারো ভাবোনা? আজ যদি তোমাকে আমি ঠিকসময়ে খুজে না পেতাম তবে আমার কি হতো বলো?

উনার কোমলকন্ঠের এমন কথা শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না আমি। ঝাপিয়ে পড়লাম তার বুকের মধ্যিখানে! চোখের পানিগুলো বাধ ভেঙে গড়িয়ে পড়লো আরও একবার। কাদতে কাদতেই বললাম,

—আমি সত্যিই সরি। আমি ভেবেছিলাম সবার মতো আপনিও হয়তো আমায় ভুলে রেখে চলে গিয়েছেন এখানে।

—তোমার অনুপস্থিতিতেই তোমাকে ভুলতে পারিনি আমি। আর এখন তুমি আমার জীবনের অর্ধাংশ। তোমাকে কি ভুলে যাওয়ার সাধ্য আছে আমার?

পূর্ণর মুখে এমন প্রণয়বার্তা শুনে কি বলবো খুজে পেলাম না আমি! আজ উনার কথায়, আচরণে আমি ক্ষণে ক্ষণেই স্পষ্ট প্রমাণ পাচ্ছি উনি আমায় ঠিক কতোটা ভালোবাসেন! আনমনে প্রশ্ন এলো আমি কি সত্যিই তার এত ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য? মনের প্রশ্ন মনেই থেকে গেলো, উত্তরটা পেলাম নাহ। শুধু দৃঢ় করলাম হাতের বন্ধন, আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম তাকে। এতে পূর্ণ মৃদু হাসলেন যেন, বুকটা হালকা কেপে উঠলো উনার! আমার মুখটা হঠাৎ টেনে তুলে কপালে ভালোবাসার স্নিগ্ধ স্পর্শ একে দিলেন উনি, যে স্পর্শের উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়লো আমার সমগ্র চেতনাজুড়ে!

—তোমাকে একবার হারিয়ে বিরহের দাবানলে পুড়েছি আমি, পুনরায় হারানোর সামর্থ্য নেই আমার। কবে বুঝবে তুমি, তুর পাখি?

পূর্ণর কথায় আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেললাম আমি! মনে মনে উচ্চারিত হলো স্বীকারোক্তি “আমি আপনার ভালোবাসা বুঝেছি, পূর্ণ। দেরিতে হলেও আমি আপনার চোখের ভাষা পড়তে শিখেছি!”

চোখ খুলে পূর্ণর দিক তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসলাম আমি! উনি কি বুঝলেন কে জানে? তবে বিনিময়ে তিনিও মৃদু হাসলেন! প্রায় সাথে সাথেই আকাশের বুক চিড়ে নেমে এলো এক পশলা স্নিগ্ধকায় বৃষ্টি!

বৃষ্টি নামতে দেখে আমি তড়িঘড়ি করে উনার হাত টেনে ধরলাম। আগেরবার বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাধিয়েছিলেন, এবারও যদি হয়? রিস্ক নেওয়া যাবেনা তো! আমাকে ব্যাকুল হতে দেখে পূর্ণ দুস্টু হেসে বললেন,

—এত ব্যাকুল হয়োনা, বৃষ্টিকন্যা! এ বৃষ্টি তো প্রেমের বৃষ্টি। এই বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর হয়না! এ বৃষ্টিতে শুধু প্রেম হয়! তোমার আমার বৃষ্টিময় প্রেম!

পূর্ণর কথায় লজ্জা পেলেও উনার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালাম আমি। হুট করেই যেন বেখেয়ালি মন বলে উঠলো আমাদের দুজনের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে বৃষ্টি! আমাদের প্রণয়ের সূচনাও যেমন বৃষ্টিতে হয়েছিলো, আমাদের প্রণয়ের পরিণতিও যেন বৃষ্টিময় দিনেই হবে!

#চলবে

কেমন লেগেছে পাঠকমহল? কেউ জানাতে ভুলবেন না! ❤️

#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ৪৬
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা

নির্জন রাস্তায় ছুটে চলছে বাইক। বৃষ্টির বেগ কমেনি একটুও, বরং সময়ের সাথে সাথে একটু করে বাড়ছে যেন! বেশ জোরেই বাইক চালাচ্ছেন পূর্ণ, উনার শার্ট ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে গিয়েছে, সেই কাধে হাত রেখে নিঃশব্দে বসে আছি আমি। লুকিংগ্লাসে খানিকটা সময় পর পর চোখাচোখি হচ্ছে দুজনের! বলা বাহুল্য, ফাকা রাস্তায় এমন বৃষ্টিময় মুহুর্ত- ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করছি আমরা। নীরবতা কাটিয়ে পূর্ণকে প্রশ্ন করলাম,

—আচ্ছা, আপনি এই বৃষ্টির মধ্যে বাইকেই কেন যেতে চাইলেন? দেখুন না অযথাই ভিজে যাচ্ছি আমরা। আমাকে আপনার সাথে যদি নেওয়াই লাগতো তবে আপনার বন্ধুদের গাড়িতে গেলেও তো পারতাম?

আমার প্রশ্নে পূর্ণ ভ্রু কুচকালেন যা বাইকের আয়নায় স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমি। ব্যাঙ্গাত্বক সুরে বললেন,

—ওদের সাথে এক গাড়িতে তুমি যেতে চাও? শুনলে না ওরা কেমন কথা বলছিলো? রেস্টুরেন্টে ওইটুক শুনেই তো অসস্তিতে পড়ছিলে, একান্তে আমাকে ওরা কিসব বলেছে সেসব শুনলে তো নির্ঘাত অজ্ঞান হয়ে যেতে! যার জন্য করলাম চুরি সেই বলে চোর! দুনিয়াটা সত্যিই নিষ্ঠুর। বুঝলে, তুরফা?

ঠোঁট বাকিয়ে বললেন উনি। উনার কথা শুনে আমি কিছুটা লজ্জা পেলাম! আমি কি অতসব ভেবেছি নাকি? তাই কথা ঘুরানোর জন্য বললাম,

—তা না হয় বুঝলাম কিন্তু আমি তো এমনিতেও রাইসাদের সাথে আমাদের গাড়িতে আসছিলাম তাই না? ওদের সাথেই আসতাম না হয়! জায়গা তো ছিলোই ওখানে। আপনি হঠাৎ কেন আমার সাথে বাইকে যেতে চাইলেন?

আমার এত প্রশ্নে পূর্ণ বেশ বিরক্ত হলেন বোধহয়। তীক্ষ্ণ চোখে আয়নায় আমার দিক তাকিয়ে বললেন,

—কেন আমার সাথে বাইকে যেতে ভালো লাগছেনা তোমার? গাড়িতে রায়হানের সাথে গেলে খুব ভালো লাগতো, তাই না?

উনার কথায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম আমি! এখানে রায়হান ভাইয়া কই থেকে আসলেন? ইতস্তত গলায় বললাম,

—রায়হান ভাই কি করেছেন? উনি তো যেতেই চাচ্ছিলেন না, পরে সবার কথায় রাজি হয়ে গেলেন আমাদের সাথে যাওয়ার জন্য৷ প্রান্ত ভাইয়াই তো বলেছিলেন উনাকে…

—আমি জানি, তোমাকে আর বলতে হবেনা। প্রান্তটারও কি দরকার ছিলো রায়হানকে তোমাদের গাড়িতে যাওয়ার কথা বলার আমি বুঝিনা! রায়হানের সাথে তোমাকে আমি যেতে দিবো?

—কেন দিবেন না?

উনার চোখেমুখে জেলাসি ছড়িয়ে আছে, সেটাকে একটু বাড়াতে ইচ্ছে করেই অবুঝের মতো প্রশ্ন করলাম আমি। পূর্ণ চোয়াল শক্ত করে বললেন,

—তুমি কি বুঝোনা ও তোমাকে পছন্দ করে? অবশ্য বুঝবে কি করে? বুঝার জন্য মাথায় ঘিলু থাকতে হয়, যেটা তোমার মাথায় নেই। আমার সাথে এতদিন একসাথে থেকে আমারটাই বুঝোনি আর তো রায়হানেরটা! স্টুপিড!

একটু থেমে আবার বললেন,

—আজকে তো তোমার জন্য বিরহের গানও গাইছিলো, আমার এত রাগ হচ্ছিলো নাহ! শুধু নেহাৎই বন্ধুমহলের সবাই ছিলো সেখানে আর রায়হান আমার পূর্বপরিচিত এজন্য নিজেকে কন্ট্রোল করছিলাম আমি। নয়তো অন্য কেউ আমার সামনে আমারই বউয়ের জন্য গান গাইবে সেটা আমি মোটেও সহ্য করতাম না!

কথাগুলো বলতে বলতে রাগের চোটে বাইকের স্পীড বাড়িয়ে দিলেন উনি। এখন উনাকে আর রাগানো যাবেনা, ঠান্ডা করতে হবে। তাই আমি উনার কাধ থেকে হাত সরিয়ে তার কোমড় ভালো করে জড়িয়ে ধরে কোমল কন্ঠে বললাম,

—শান্ত হোন আপনি। রায়হান ভাইয়া আমাকে বিয়ের আগে পছন্দ করলেও আমার মনে হয়না এখন তার মনে এমন কিছু আছে। সবারই তো অতীত থাকে তাই না? আর আপনি এত রেগে যাচ্ছেন কেন? আমার ভয় লাগছে, প্লিজ স্পীড একটু কমান।

আমার নরম কথায় ও আচরণে কাজ হলো বোধহয়। পূর্ণ খানিকটা শান্ত হলেন, বাইকের স্পীড কমে গেলো। পূর্ণ কিছুক্ষণ চুপ করে হঠাৎ অভিযোগের সুরে বললেন,

—আমি জানি রায়হান এখন মুভ অন করার চেস্টা করছে। তোমাকে দেখেই ও এখন চোখ ফিরিয়ে নেয়, আমি খেয়াল করেছি। আর আমি এটাও জানি যে ও খারাপ ছেলে নয়। কিন্তু আমিও বা কি করবো বলো? তোমাকে আমি ছাড়া অন্য কেউ পছন্দ করে, তোমাকে নিয়ে অন্য কেউ ভাবে এটা ভাবতেই আমার রাগ চলে আসে। আমি তখন নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি। তুমি আমার বউ, অন্য কেউ কেন তোমাকে পছন্দ করবে? এখানে যদি আমার রাগ আসে তবে সেটা কি আমার দোষ, তুর পাখি?

হঠাৎ পূর্ণর এমন বাচ্চাসুলভ কথায় বেশ মজা পেলাম আমি। তবে উনার কথায় ও আচরণে স্পষ্ট পুরুষালি অধিকারবোধ। কোথায় যেন শুনেছিলাম প্রেমিকাকে অন্য পুরুষের সাথে দেখে যদি তার পা থেকে মাথা অব্দি না জ্বলে তবে সে কিসের প্রেমিক? এখন পূর্ণকে দেখে কথাটির হাতেকলমে প্রমাণ পেয়ে গেলাম আমি! উনি তো আমার প্রেমিকও নন, আমার স্বামী। যে মানুষটার আমার উপর অধিকারবোধ এ দুনিয়ায় সবথেকে বেশি! তাই উনার মুখে এসব কথায় আমি আজ অবাক হলাম নাহ, বরং উনার আচরণ বেশ মানানসই লাগলো আমার কাছে! আয়না ভেদ করে লক্ষ করলাম উনাকে! বৃষ্টির পানি ভিজিয়ে দিচ্ছে তার সুন্দর মুখশ্রী! মাঝেমধ্যে চোখের পাপড়ির উপর পড়া পানির ফোটাগুলো সরাতে হুটহাটই চোখ পিটপিট করছেন সামনের দিকে তাকিয়ে! দৃশ্যটা কেন জানি বেশ চমৎকার লাগলো আমার কাছে।

হঠাৎ করেই আজ উনাকে বড্ড বেশি ভালো লাগছে আমার কাছে! বিয়ের পর থেকে ভালো তাকে সবসময়ই লেগেছে কিন্তু আজ উনার মনের কথাগুলো জানার পর থেকে যেন আলাদা প্রশান্তি কাজ করছে আমার মাঝে, উনার প্রতি কোন জড়তা কাজ করছেনা আর! পূর্ণও অনেকটাই সহজ হয়ে গেছেন আমার সাথে, সরাসরি মনের কথাগুলো প্রকাশ করছেন। বিষয়টা ভাবতে ভাবতেই এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো মুখে! পুনরায় আয়নায় তাকিয়ে দেখি পূর্ণ নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে চুপচাপ বাইক চালাচ্ছেন মনোযোগ দিয়ে! ইশ এত্ত সুন্দর লাগছে কেন লোকটাকে? উনাকে দেখার মাঝেই আচমকা একটা অদ্ভুত ইচ্ছা জেগে উঠলো মনে! হুট করেই একটা দুঃসাহসিক কাজ করে ফেললাম আমি! হঠাৎই উনার সাথে ঘেঁষে পেছন হতেই এগিয়ে তার গালে টুপ করে চুমু দিয়ে ফেললাম। আমার আচরণে স্তব্ধ হয়ে তৎক্ষনাৎ জোরে ব্রেক কষলেন পূর্ণ! হঠাৎ বাইক থেমে যাওয়ায় ভয়ে উনাকে খামচে ধরে তার পিঠের সাথে লেপ্টে যাই আমি।

এদিকে পূর্ণ জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন। যেন আমার দ্বারা এমন সময়ে এমন আচরণ কস্মিনকালেও আশা করেননি উনি! আমার হাত পেছন থেকে তার বুকের উপর ধরে থাকায় টের পেলাম উনার বুকের দ্রুততম হৃদস্পন্দন। ধুকপুকানি যেন বেড়েই চলেছে ক্ষণে ক্ষণে! এদিকে আবেশের বশে কি করে ফেলেছি বোধগম্য হতেই লজ্জায় নুইয়ে গেলাম আমি! মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছি কোন কথা ছাড়াই৷ খানিকক্ষণ বাদে পূর্ণ গলা ঝেড়ে পুনরায় বাইক স্টার্ট দিতে দিতে বললেন,

—হঠাৎ করে এমন আক্রমণ করে আমার তৃষ্ণা বাড়িয়ে দিলে কেন, বৃষ্টিকন্যা? আমার প্রতি তোমার এ অবিচার কিন্তু বৃষ্টিও সহ্য করবেনা!

পূর্ণর কথা বলতে দেরি কিন্তু বৃষ্টির বেগ বাড়তে দেরি হলোনা! যেন বৃষ্টিও সায় দিলো উনার কথায়! এদিকে এতক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজে আমার নাজেহাল অবস্থা। পূর্ণ কিছু বলার আগেই হাচ্চি দিলাম আমি। বাইক চালানো শুরু করে আয়নায় আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে পূর্ণ বললেন,

—দেখেছো? আমার জন্য চিন্তা করছিলে তুমি এখন নিজেই হাচ্চি দিচ্ছো! আর কোন কথা নয়, বাসার প্রায় কাছেই এসে পড়েছি আমরা। এখনি বাসায় পৌঁছে যাবো দুজন।

_________________

বৃষ্টিময় সেই দিনের পর থেকে বেশ কিছুদিন অতিক্রান্ত হয়েছে। ওইদিন বাসায় আসার পর আমার জ্বর এসেছিলো। কিন্তু পূর্ণ এবার বকেননি আমায়, চুপচাপ মাথায় পট্টি দিয়ে ওষুধ খাইয়ে দিয়েছেন। ওইদিনের পর থেকে গম্ভীর পূর্ণর পরিবর্তে এক কোমল পূর্ণর দেখা আমি সচারাচরই পাই! তবে এক ব্যাপারে উনি এখনো কঠোর আছেন আর তা হলো আমার পড়াশুনার ক্ষেত্রে! রোজ রাত করে আমার পড়া চেক করেন। যেদিন পড়তে দেন তার পরেরদিন নিয়ম করে চেক করেন সব পড়া ঠিকমতো করেছি কি না। যদিও আমি নিয়মিতই পড়াশুনা করি তবুও যদি মাঝেমধ্যে কোন কারণে পড়াশুনায় ফাকিবাজি করি তবে সেদিন আর রক্ষে নেই আমার! ঠিকই উনার কড়া বকুনি হজম করতে হয়! মন খারাপ করে থেকেও লাভ হয়না, যেহেতু এডমিশন টেষ্ট এর খুবই অল্পদিন বাকি তাই আগে পড়া আদায় করে দিতে হয় এরপরই উনি মানেন। তার আগে আমার কথা চলেনা উনার উপর! এছাড়াও মাঝেমধ্যে হুটহাট চুড়ি, ফুল, চকোলেট এসব ছোটখাটো গিফট দেওয়া তো আছেই উনার। সব মিলিয়ে ভালোই চলছিলো জীবন।

এরই মধ্যে রাইসার থেকে খবর পেলাম রায়হান ভাইয়া অন্য কোম্পানিতে জয়েন হয়েছেন, সেখানে বেশ ভালো পদে যোগ দিয়েছেন! আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো উনার নতুন অফিসটা প্রিয়ার কলেজের একদম কাছেই! এ কথাটা অবশ্য আমি প্রিয়ার থেকেই জানতে পারলাম। সাথে প্রিয়া আরও বললো,

—জানো ভাবী, রায়হান ভাই অনেক ভালো মানুষ। আমার মনে হয় উনার জীবনে হয়তো কেউ ছিলো যার জন্য উনি শুরুতে সহজে মিশতে চাইতেন না আমার সাথে। তবে এখন দেখছি উনার পরিবর্তন হচ্ছে। প্রথম প্রথম উনার ফেসবুক আইডি নেওয়ার পর তো ঠিকমতো জবাবই দিতেন না আমাকে। এভোয়েড করতেন এক প্রকার। তবে এখন দেখি মাঝেমধ্যেই নিজে থেকেই মেসেজ দেন, আমার খোজ-খবর নেন! বলতে গেলে আমার সাথে বেশ অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে কথা বলা শুরু করেছেন।

প্রিয়ার কথায় স্বস্তি পেলাম আমি। আমি তো বরাবরই চেয়েছিলাম রায়হান ভাই আমার আশায় অযথা পড়ে না থেকে নিজ জীবনে মুভ অন করুক। আর এখন সেটাই হচ্ছে। উনি একজন বুদ্ধিমান মানুষের পরিচয় দিয়ে নিজের ভালো বুঝেছেন এবং নিজেকে পরিবর্তন করছেন তার ভালোর জন্য! এর চেয়ে ভালো সংবাদ আর কি হতে পারে! তাই হাসিমুখে প্রিয়াকে বললাম,

—বাহ! তাহলে তো বেশ ভালোই। রায়হান ভাই আসলেও ভালো মানুষ। যদি তোমাকে মন থেকে পছন্দ করেন তাহলে তুমি জিতে যাবে!

—আমার মনে হয় একটু-আধটু পছন্দ করতে শুরু করেছেন। সেদিন নিজে থেকেই বললেন আমার কলেজের কাছে তার অফিস। সময় পেলে একদিন দেখা করবেন আমার সাথে!

লাজুক হেসে বললো প্রিয়া। ওর কথায় চোখ বড় বড় করে তাকালাম আমি! দুস্টু সুরে বললাম,

—বাহ ননদিনী, তুমি তো দেখি অনেক ফাস্ট হয়ে গেছো! ইতোমধ্যেই রায়হান ভাইকে প্রেমের জালে ফাসিয়েও দিয়েছো!

—ধুর ভাবী, তুমিও নাহ! তবে আমি ভাবছি অন্য কথা! যদি আমাদের প্রেম শুরু হয় তবে বাবা-মা তো মেনে নিবেই আশা করি। কিন্তু ভয়ে আছি আমার ভাইদের নিয়ে! যদিও প্রান্ত ভাইয়াকে আমি নিজেই রাজি করিয়ে নিতে পারবো, কিন্তু বড় ভাইয়াকে রাজি করানোর দায়িত্ব তোমার! তাকে বলতেও আমার ভয় লাগবে!

প্রিয়ার কথা শুনে চমকে উঠলাম আমি। পূর্ণকে আমি রাজি করাবো ওর আর রায়হান ভাইয়ের ব্যাপারে? উনি আদৌ রাজি হবেন তো? সেদিন বাইকে বলা উনার কথা মনে পড়লো হঠাৎ! পূর্ণ উনার একমাত্র বোনের ব্যাপারে যথেষ্ট পজেসিভ। অনেক আদরে বড় করেছেন প্রিয়াকে! যে ছেলে তার বউকে পছন্দ করতো এককালে তার সাথে কি নিজের বোনকে বিয়ে দিতে আদৌ রাজি হবে কোন ভাই? উনি যদি আমার উপর রাগ করেন?

বিষয়টা হঠাৎ করেই কেমন যেন জটিল হয়ে গেলো। প্রিয়ার কথা শুনে মাথার মধ্যে এলোমেলো ভাবনাগুলোর কুন্ডলী পেকে গেলো যেন!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here