বৃষ্টি,২য় শেষ পর্ব

0
6812

বৃষ্টি,২য় শেষ পর্ব
Tasmima Yeasmin

তারপর থেকেই অয়ন ভাইয়াকে আমি এড়িয়ে চলি। অবনী আপুর বিয়ের দিন আমি লাল টুকটুকে একটা লেহেঙ্গা পড়লাম। অয়ন ভাই নাক কুঁচকে বললেন ‘তোর কি বিয়ে অনু। এভাবে সেজেছিস কেন? একবার অন্ধকার রঙ পড়ছিস এখন আবার লাল পড়েছিস ঘটনা কি?’
আমি অয়ন ভাইয়াকে এড়িয়ে চলে আসলাম।
নিবিড় কল দিয়েছে। এত ঝামেলায় ওর সাথে কথা বলাই হচ্ছেনা। আমি কল কেটে দিয়ে রিসিপশনে আসলাম। একটা বিষয় সুক্ষ্মভাবে খেয়াল করলাম অয়ন ভাইয়া আমাকে দেখলেই কঠিন করে কথা বলছেন।
.
.
অবনী আপু চলে যাওয়ার পরে বাড়িটা একদম খালি হয়ে গিয়েছে। মাত্র একটা মানুষ নেই তাও শূন্য বাড়ি মনে হয়। অয়ন ভাইয়া আমাকে দেখলে এখনও কঠিন কথা শোনান। ইদানীং তার সাথে দেখা হয় কম। উনি একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জব নিয়েছেন। মামা অয়ন ভাইয়াকে বললেন, ‘বাবা আমাদের নিজেদের অফিস থাকতে অন্য কোথাও জয়েন করার কি দরকার ছিলো?’
উনি কঠিন গলায় বললেন ‘আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই বাবা।’
মামা আর আপত্তি করেনি।
.
.
সন্ধ্যাবেলা খুব মনযোগ দিয়ে ক্যালকুলাসের একটা অংক মেলাচ্ছিলাম তখন অয়ন ভাইয়া আমার রুমে আসলেন। বললেন ‘চা খাবি অনু।’ আমি অংকের মধ্যে ডুবে গিয়েছিলাম। অয়ন ভাইয়াকে খেয়াল করিনি। উনি মুখের সামনে তুড়ি বাজালেন। আমি চমকে গিয়ে বললাম, ‘হচ্ছে কি অয়ন ভাইয়া। আমি ম্যাথ করছি ডিস্টার্ব করবেন না।’
উনি মাথায় একটা টোকা দিয়ে বললেন ‘তোর জন্য চা করেছি খেয়ে নে। ঠাণ্ডা হয়ে গেলে ভালো লাগবে না।’
আমি ফু দিয়ে চায়ে চুমুক দিতেই থু দিয়ে ফেলে দিলাম। আমার খাতা, কলম, ক্যালকুলেটরের উপর চা পড়লো। চিনি না দিয়ে সম্ভবত নিমের রস দিয়েছে। অথচ চায়ের রং টা এত সুন্দর হয়েছে। ঐযে কথায় আছে না চকচক করলেই সোনা হয় না। চায়ের ব্যাপারটা হয়েছে সেরকম। আমি রাগী মুখে সামনে তাকিয়ে দেখলাম অয়ন ভাইয়া নেই।
.
.
দুদিন পর আম্মা আমাকে দেখতে এলেন। আম্মাকে ডেকে মামা বললেন, ‘তোর মেয়েটাকে আমার অয়নের বউ করে এ বাড়িতেই রাখতে চাই। তুই কি বলিস?’
আম্মা মনে মনে এটাই চাইতেন। তিনি বললেন ‘আপনার যা ইচ্ছা। অনু এখানে ভালোই থাকবে। আমার কোন আপত্তি নেই। অনুর বাবাও অমত করবে না।’
আমার মাথায় তো আকাশ ভেঙে পড়লো। তাহলে আমার আর নিবিড়ের প্রেমের কি হবে।
কিন্তু মাঝখান থেকে মামি অমত করলেন। তিনি সোজাভাবে বলে দিলেন আমাকে কোনদিনও তিনি তার ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিবেন না। তাদের বাড়িতে দয়া করে থাকতে দিয়েছেন এইটাই বেশি।
আম্মার সাথে মামির বেশ কথা কাটাকাটি হয়ে গেলো। সেই এক কাপড়েই আম্মা আমাকে নিয়ে গ্রামে চলে এলেন। আসার সময় অয়ন ভাইয়া বাড়িতে ছিলেন না। আমি ভাবছিলাম তিনি কি এসে আমাকে খুঁজবেন।
.
.
কয়েকদিন পর আম্মা হুট করেই আমার বিয়ে ঠিক করে ফেললেন। আমি বিয়ের কথা শুনে কেঁদেকেটে সারা। আব্বা চুপচাপ সব দেখছেন। তিনি কখনো আম্মার মুখের উপর কথা বলেন না। আম্মাকে বললাম ‘আম্মা এভাবে আমার পড়াশুনা বন্ধ করে বিয়ে দেয়াটা কি ঠিক হচ্ছে।’ উনি কঠিন গলায় বললেন, ‘তোমার পড়াশোনার কোন দরকার নেই। ছেলে অয়নের থেকেও ভালো। অয়নদের থেকেও টাকাপয়সা বেশি।’
“কিন্তু মা ঐ ছেলের তো বয়স বেশি।” আমি প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলাম।
আম্মা বললেনন, ‘সবদিক একসাথে পাওয়া যায় না অনু। তুমি সুখেই থাকবে। বড়ঘরে বিয়ে দিয়ে আমিও দেখিয়ে দেবো আমার মেয়েও ফেলনা নয়।’
.
.
আম্মাকে কোনভাবেই বোঝানো গেলো না। এই ছেলের নাম হচ্ছে শাহেদ। একে তো বিয়ে না ভেঙে যাওয়ায় মন খারাপ তার মধ্যে এই শাহেদ সকাল বিকাল কল দিয়ে মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। ওনাকে কতবার, কতভাবে বোঝাতে চাইলাম আমি ওনাকে বিয়ে করতে চাই না। উনি ততবার বলছেন বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে অনু। আমি মনে মনে বদদোয়া দিলাম, ‘তোর টাকের আশেপাশে যে কয়টা চুল আছে তাও যেনো পড়ে যায়।’

.
.
নিবিড়ের সাথে কথা বলে পালবো বলে ঠিক করলাম। পালানোর বুদ্ধিটা আমার ছিলো। এমনিতেও নিবিড়কে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না আর এই বুড়ো লোকটাকে বিয়ে করার তো কোন প্রশ্নই ওঠে না।
.
.
বিয়ের দিন ঝামেলা ছাড়াই পালিয়ে আসলাম। রেলস্টেশনে বসে নিবিড়কে বারবার কল দিচ্ছি কিন্তু নিবিড় কল তুলছেনা। শেষে ফোনে একটা মেসেজ দিলো, ‘অনু আমি তোমাকে নিয়ে পালাতে পারবোনা। তখন আবেগে আমি বলে ফেলেছিলাম কিন্তু বাস্তবতা এত সহজ নয়। আমি নিজেই আমার পরিবারের উপর নির্ভরশীল। তোমাকে এনে কই রাখবো অনু। তুমি বাসায় ফিরে যাও।’
আমার হাত কাঁপতে লাগলো। পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসলো। এরকম কিছু হবে আমি কখনো কল্পনা করিনি। কিন্তু বাসায় ফিরে গেলেই তো আমাকে জোর করে ঐ বুড়োর সাথে বিয়ে দেবে। আমি পাথর হয়ে বসে রইলাম। ব্যাগটা পায়ের কাছে পড়ে রইলো। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে এলো।
হঠাৎ করে আমার নাম শুনে সামনে তাকালাম। অয়ন ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। উনি ঠাস করে আমাকে এক চড় দিলেন। তারপর স্বাভাবিক ভাবে বললেন, ‘চল’
আমার হাত মুঠো করে ধরলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম ‘যাবো কোথায়।’
উনি কোনো কথা বললেন না। গাড়ির কাছে এনে বললেন ‘উঠে বস।’
.
.
কাজী অফিস থেকে যখন বের হলাম আমি তখনো বিশ্বাস করতে পারিনি যে আমার বিয়ে হয়ে গেছে। অয়ন ভাইয়া এখনো মুখ গম্ভীর করে আছেন। আমি কিছু জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দিচ্ছেন না। আবার ঐ বাড়িতে নিয়ে গেলেন। বসার ঘরে মামা মামি বসে রয়েছে। অয়ন ভাইয়ার সাথে আমাকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন মামি। তারপর চিৎকার করে বললেন ‘ছি অয়ন। শেষ পর্যন্ত এই মেয়েকে তুই বিয়ের আসর থেকে ভাগিয়ে আনলি। বিয়ে টিয়ে করেছিস নাকি। একে তো কখনো মানবোনা আমি।’
অয়ন ভাইয়া ঠাণ্ডা মাথায় বললেন, ‘মা জীবন টা যেহেতু আমার তাই সিদ্ধান্ত আমিই নিলাম। আর আমার বউয়ের ভরণপোষণ করার সামর্থ্য আমার আছে। যদি তোমাদের সমস্যা হয় অনুকে নিয়ে এ বাড়ি ছেড়ে আমি চলে যাবো।’
মামা একরকম বাঁধা দিয়ে বললেন ‘এটা আমার বাড়ি। কে থাকবে আর কে না থাকবে আমি সিদ্ধান্ত নিবো। অয়ন তুই অনু কে নিয়ে ভিতরে যা।’
মামা মামির একরকম ঝগড়া লেগে গেলো।
অয়ন ভাইয়া তখনো আমার হাত ধরে রেখেছেন। সোজা ওনার রুমে চলে আসলেন।
‘আমি আমার রুমে যাই’
আমার কথায় অয়ন ভাইয়া বললেন এখন থেকে এটাই তোমার রুম। ফ্রেশ হয়ে নাও।
.
.
বিয়ের পরেও অয়ন ভাইয়া পাল্টালেন না। আগের মতই কড়া করে কথা বলেন। মামি মনের বিরুদ্ধে একরকম জোর করেই আমাকে মেনে নিলেন। তবে মামা ভীষণ খুশি হয়েছে।
.
.
আমার অয়ন ভাইয়ের জন্য খুব রকম খারাপ লাগতে লাগলো। ওনার আগের কথাগুলো, ঘটনাগুলো মনে পড়তে লাগলো। এখনো আমরা আলাদা থাকি।
একদিন বিকেলবেলা ছাদে দাঁড়িয়ে আছি। আমার মত আকাশের ও মন খারাপ। মেঘলা হয়ে আছে। পেছন থেকে কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে পেছন ফিরে তাকালাম। অয়ন ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন। আমি জোর করে হাসার চেষ্টা করলাম। তিনি আমার এলোমেলো চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিলেন। কেন জানিনা আমার খুব কান্না পেলো। আমি অয়ন ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম। অয়ন ভাইয়া শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। বললেন ‘কাউকে ভালোবাসলে আগে ভালো রাখতে হয়। যখন আমি দেখলাম তুই কারো সাথে সম্পর্কে আছিস আমি আর ঘাটাইনি তোকে। তোকে তোর মত ছেড়ে দিয়েছিলাম। তাই বলে ভালোবাসা কমেনি। তোর বাবা যখন আমাকে কল দিয়ে বললো তুই বাড়ি থেকে পালিয়েছিস আমি তোর আশেপাশেই ছিলাম। তোকে শেষবার দেখার জন্য গিয়েছিলাম কিন্তু বুঝিনি তোকে সারাজীবনের মত পাবো। আমি তোকে আগের মতই ভালোবাসি বোকা মেয়ে।’
এতক্ষণে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমরা দুজনেই ভিজে গিয়েছি। আমি মনেমনে বললাম ‘অয়ন ভাইয়ের ভালোবাসা সারাজীবন এভাবে আমাকে বৃষ্টির মত ভিজিয়ে রাখুক।’

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here