বৃষ্টি তোমাকে দিলাম❤️,চলবে,১৩

0
2490

বৃষ্টি তোমাকে দিলাম❤️,চলবে,১৩
ফাবিহা নওশীন

ফারানের গাড়ি একটা এপার্টমেন্টের সামনে এসে দাঁড়াল। ইশারা গাড়ি থেকে নেমে বাড়িটার দিকে চেয়ে আছে। মনে মনে গণনা করার চেষ্টা করছে কত তলা। ছ’তলা পর্যন্ত গণনার পর ফারানের ডাক পড়ল।
ইশারা আর গণনা করতে পারল না। ফারানের দিকে চেয়ে মুচকি হাসল।

ফারানও স্নিগ্ধ হেসে বলল,”চলো।”

ইশারা ফারানের সাথে যাচ্ছে ঠিক কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রচুর নার্ভাস। পাশাপাশি ঘামছে প্রচুর। ফারান বুঝতে পারছে কি পারছে না সেটা জানা নেই। কিন্তু নর্মাল থাকার চেষ্টা করছে।

ফারান লিফটের দরজার কাছে গিয়ে বাটন প্রেস করার আগে বলল,
“আমাদের ফ্ল্যাট সাত তলায়।”

ওরা লিফটের ভেতরে ঢুকতেই ইশারা চুপচাপ হয়ে গেল। ফারান কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল,
“নার্ভাস লাগছে?”

ইশারা চোখ তুলে তাকাল। আলতো হেসে বলল,
“না….
তারপর থেমে বলল,”আসলে লাগছে, প্রচুর নার্ভাস লাগছে।”

ফারান মুচকি হেসে ইশারার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলল,
“এত নার্ভাস হচ্ছো কেন? ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছো না। সব ঠিক থাকবে নিজেকে রিলেক্স রাখো। আমি আছি তো।”

ইশারা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললেও ভেতরে ভেতরে নার্ভাস হচ্ছে।

ফারান ফ্ল্যাটের বেল বাজালে ইশারার বুক ঢিপঢিপ করছে। ফারানের পরিবারের সবাই ইশারাকে কিভাবে গ্রহণ করবে, ওর অতীত নিয়ে প্রশ্ন তুলবে না তো কিংবা যদি আপত্তি জানায়?
ইশারা ভেবে ভেবে ক্লান্ত। ভেতরে না জানি কোন ঝড় আসতে যাচ্ছে৷

একজন মেয়ে এসে দরজা খুলল। তার বয়স ৩৪-৩৫ এর কাছাকাছি হবে। মাঝারি গড়নের শরীর, ফারানের মতো ফর্সা গায়ের রং, অসম্ভব সুন্দর চেহারা। ফারানের সাথে চেহারাও অনেকটা মিল আছে। ইশারার বুঝতে বাকি নেই ইনি ফারানের বোন।
ইশারা সালাম দিতেই তিনি হাসিমুখে ইশারাকে অভ্যর্থনা জানাল।
“এসো বোন ভেতরে এসো।”

ফারান ইশারার দিকে চেয়ে ভেতরে যেতে বলল। ইশারা ভেতরে ঢুকে সাজানো গুছানো বিলাসবহুল ফ্ল্যাটটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। কি সুন্দর পরিপাটি!
ইশারাকে প্রথমে ওর বাবার কাছে নিয়ে গেল। তিনি একটা বই পড়ছেন। বইয়ের ভেতরে এতটাই ঢুকে পড়েছে যে সামনের মানুষের দিকে খেয়াল নেই।

ফারানের বোন উনার বাবাকে বলল,
“বাবা, দেখো কে এসেছে?”

ফারানের বাবা চোখ তুলে তাকাল। ইশারাকে দেখে জিজ্ঞেস করল,
“কে ও?”

ফারানের বোন বলল,
“গতকাল রাতেই তো বলেছি। যাইহোক ওর নাম ইশারা। ফারান যাকে পছন্দ করেছে। তোমার হবু পুত্রবধূ।”

ইশারা সালাম করতেই তিনি ফ্যালফ্যাল কিছুক্ষণ মুখের দিকে চেয়ে থেকে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“সুখী হও মা। তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগছে। এবার বুঝি ছেলেটার গতি হলো। কবে থেকে বলছি বিয়ে কর, বিয়ে কর। ও নাকি পছন্দ মতো মেয়েই পায় না। অবশেষে তাহলে তোমাকে পেয়ে গেছে।”

ইশারা স্নিগ্ধ হেসে বলল,
“জি, দোয়া করবেন।”

“আরে ফারিয়া ওকে বসতে দে, খেতে দে। দাঁড়িয়ে থাকবে? কথা পরে হবে।”

ফারানের বোন ফারিয়া ইশারাকে নিয়ে গেল। ফারান পেছনে পেছনে যাচ্ছে তাই বলল,
“কি রে তুই কি পেছনে পেছনে ঘুরবি? যা ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি ওকে গুম করে দেব না। বোনের উপর ভরসা রাখ।”

ফারান আর ইশারা দু’জনই লজ্জা পেল। ফারান নিজের রুমে ফ্রেশ হতে চলে গেল।
ফারিয়া ইশারাকে কিচেনের দিকে নিয়ে গেল।
“বাবা তোমাকে চিনতে পারেনি কিছু মনে করো না। তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমার ভাইয়ের উপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে। ওর পছন্দ কখনও খারাপ হতে পারে না। আমরা যত দ্রুত সম্ভব তোমার পরিবারের সাথে কথা বলতে চাই।”

ইশারা উশখুশ করছে।
“আচ্ছা আপু আপনি কি আমার সম্পর্কে সব কিছু জানেন?”

ফারিয়া কাজ থামিয়ে ইশারার দিকে তাকাল। ইশারার চোখে মুখে উদ্বিগ্ন, উৎকন্ঠা। ফারিয়া সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর বলল,
“হ্যাঁ আমি সব জানি। ফারান সব বলেছে।”

ইশারা অবাক হচ্ছে এটা ভেবে সব জেনে নিজের অবিবাহিত ভাইয়ের জন্য ওকে চাইছে। চাইলেই আপত্তি করতে পারতেন।
“আপনি কিংবা বাবা আপত্তি করেন নি?”

ফারিয়া আলতো হেসে বলল,
“কোনো মেয়েই চায়না ডিভোর্স শব্দটা গায়ে লাগাতে। তারাও চেষ্টা করে সম্পর্কগুলো মানিয়ে গুছিয়ে নিতে কিছু মানুষ তাদের বাধ্য করে। ডিভোর্স হয়েছে বলে তার কি সুখে থাকার অধিকার নেই? সে কি ভালো থাকতে পারবে না? তুমি কি কোনো অন্যায় করেছো? করোনি তো! তবে কেন শাস্তি পাবে? হ্যাঁ এটা ঠিক যে আমরা কখনো ভাবিনি এমনটা হবে। আমাদের না ভাবাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে ও যখন তোমাকে পছন্দ করেছে আমরা আপত্তি কেন করব? তাছাড়া তোমাকে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে।”

ইশারার চোখে পানি চলে এসেছে। কত সহজ ভাবে সবটা মেনে নিয়েছে। ফারান বলেছে ওর পরিবারের কোনো সমস্যা নেই। তবুও ইশারা মনে মনে ইতস্তত করছিল, সংশয় হচ্ছিল। এখন সব ক্লিয়ার হয়ে গেছে।

ফারান স্যুট কোর্ট চেঞ্জ করে একটা টিশার্ট আর কালো জিন্স পড়েছে। ইশারা আর ওর বড় বোন ফারিয়াকে রান্নাঘরে এক সাথে কাজ করতে দেখছে। ওরা গল্প করছে আর মাঝে মধ্যেই হেসে
উঠছে দু’জন। ফারান সব সময় এমন একজন মানুষ চেয়েছে যে কি না ওর পরিবারকে আপন করে নিবে।
ওর বাবা, ওর বোনকে আপন করে নিবে। এই মানুষগুলো ছাড়া তো ওর আর কেউ নেই। এই মানুষগুলোর জন্যই ও আজ এখানে আসতে পেরেছে। ফারান যেন স্বস্থি পেল। এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর হয় না।

ইশারা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে সাত বছরের একটা ছেলেকে দেখতে পেল। ছেলেটা গুলুমুলু ফর্সা গায়ের রং। ইশারাকে দেখে এগিয়ে এসে বলল,
“তুমি কি আমার নতুন মামি?”

ইশারা ওর কথায় কি উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছে না। কারণ ও জানেই না ছেলেটা কে।
তাই হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“কে তুমি বাবু?”

“আমাকে চেনো না? আমি তন্ময়। ফারান মামার কাঠবিড়ালি।”

ইশারা সম্পর্কের মারপ্যাঁচ খুলে বুঝতে পারল ও ফারানের ভাগ্নে, ফারিয়ার ছেলে।
“ও আচ্ছা, তুমি ফারিয়া আপুর ছেলে?”

“হ্যা, আমার আম্মুর নাম ফারিয়া।”

ইশারা গাল টেনে বলল,
“কিউট তো! তা তোমার বাবা কই?”

তন্ময় নির্দ্বিধায় বলল,
“আমরা বাবার সাথে থাকি না। এ বাড়িতে থাকি। বাবা তার নিজের বাড়িতে।”

ইশারা অবাক হয়ে বলল,
“তোমরা বাবার সাথে থাকো না কেন?”

“জানি না। আম্মু জানে। আমি যখন প্রথম স্কুলে ভর্তি হই তখন থেকেই আমি আর আম্মু এ বাড়িতে থাকি।”

ইশারা বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছে। কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলেও পারছে না। এতটুকু বাচ্চা কিছুই বলতে পারবে না।
তবুও জিজ্ঞেস করল,
“বাবার বাসায় যাও না?”

তন্ময়ের আগেই পেছনে থেকে ফারিয়া বলল,
“না। আমি কিংবা তন্ময় কেউই ও বাসায় যাই না।”
তারপর তন্ময়কে বলল,
“দেখে এসো নানা ভাই কি করে।”

তন্ময় চলে গেলে ফারিয়া ইশারাকে বলল,
“আসলে আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে। তারপর থেকে আমি আর তন্ময় এ বাড়িতেই থাকি। তবে তুমি ভেবো না। আমি ইন্ডিপেন্ডেন্ট। ভালো জব করি। আমি তন্ময়কে নিয়ে খুব শীঘ্রই অন্য বাসায় উঠে যাব। ভাইয়ের সংসারে কখনো নাক গলাবো না। এতদিন ফারানের বউ ছিল না তাই থেকেছি।”

ইশারা ছলছল চোখে হাত জোড় করে বলল,
“আপু আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি এসবের কিছুই জানতাম না। তাই কৌতূহল বশত তন্ময়কে অনেক প্রশ্ন করে ফেলেছি। এটা আপনার, আপনার বাবা আর ভাইয়ের বাড়ি। এখানে আমার চেয়ে আপনার অধিকার বেশি। আমি কখনো চাইবো না আপনি এ বাসা থেকে চলে যান। অন্য জায়গায় গিয়ে একা থাকুন। আপনি প্লিজ এসব ভাবনা মাথায় আনবেন না। আমি পরিবার ভাঙতে না গড়তে চাই। প্লিজ আপু আমার কথায় দুঃখ পেলে ক্ষমা করে দিবেন। ফারান আমাকে আগেই সব বলে দিলে আমি কখনো এ-সব প্রশ্ন তুলতাম না।”

ফারিয়া ইশারাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“বোকা মেয়ে এত কষ্ট পাচ্ছো কেন? আমি কিছু মনে করিনি। তোমার রাইট আছে সবকিছু জানার। আমি সত্যিই কিছু মনে করিনি। যাও ফারানকে ডেকে নিয়ে এসো, সবাই এক সাথে লাঞ্চ করব। ওই যে ওটা ফারানের রুম,যাও।(আঙুল দিয়ে দেখিয়ে)”

ফারিয়া ইশারাকে ফারানের রুমে পাঠিয়ে খাবারের টেবিল সাজাচ্ছে। আজকে শুক্রবার হওয়ায় সবার অফ ডে। তাই সবাই বাসায়।

ইশারা ফারানের রুমের দরজায় নক করে। ফারান ভেতরে আসতে বললে ইশারা ভেতরে ঢুকল। ফারান বিছানার কাভার ঠিক করে ইশারাকে বসতে বলল। ইশারা ফারানের রুমটা ভালো করে দেখে বলল,
“তুমি দেখছি খুব পরিপাটি।”

ফারান মাথা চুলকে বলল,
“কিছুদিন ধরে চেষ্টা করছি। আমি জানি তুমি খুব গোছাল। তাই আমাদের রুমটা পরিপাটি রাখার চেষ্টা করছি শুধু তোমার জন্য।”

ইশারা পা ঝুলাতে ঝুলাতে মৃদু হাসল। তারপর হুট করে দাঁড়িয়ে বলল,
“আচ্ছা তুমি আমাকে ফারিয়া আপুর ব্যাপারে কেন বলোনি? আমি তন্ময়কে ওর বাবার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে ফেলেছি। নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছে।”

ফারানের মুখ শুকিয়ে গেল। ইশারা দুটো হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল,
“আপুর সাথে ওর হাসব্যান্ডের বনিবনা হচ্ছিল না। আপুর জন্য চিন্তা করতে করতে বাবা স্ট্রোক করেন। স্ট্রোক করার পর তিনি প্রায় এটা সেটা ভুলে যান। যেমন তোমার আসার কথা ভুলে গেছেন। তারপর একদিন আপু এখানে চলে আসেন। এক পর্যায়ে মিউচুয়াল ডিভোর্স নেন উনারা। তারপর থেকে এখানেই থাকে। আর আমি চাই ওরা এখানেই থাকবে। আপু আমার জন্য কি তুমি জানো। আমি আশা করি তুমি আমার বাবা, বোন, ভাগ্নেকে আপন করে নিবে। আমি ওদের যতটা ভালোবাসি তুমিও বাসবে।”

ইশারা ফারানের হাতের দিকে চেয়ে বলল,
“আমি তোমাকে নিরাশ করব না।”

“সে ভরসা আমার আছে।”

সবাই একসাথে লাঞ্চ করছে। ফারিয়া বাবার দিকে চেয়ে অনুমতি নিয়ে ইশারাকে জিজ্ঞেস করল,
“আমরা খুব দ্রুত বিয়ের ব্যবস্থা করতে চাই। তোমার পরিবার থেকে কেউ আসবে কথা বলতে না তুমি নিজেই? আমাদের কোনো সমস্যা নেই। তোমার পরিবারের কারো থাকা বাধ্যতামূলক নয়।”

ইশারা বলল,
“আমার বড় খালা মনি বলেছেন আসবেন। আমি উনার সাথে কথা বলে জানাব।”

“আচ্ছা!”

লাঞ্চ শেষে ইশারা আর ফারান বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। ফারান ইশারার দু’হাত ধরে নিজের কাঁধে রেখে বলল,
“প্রসেসিং চলছে। ডিভোর্সটা হয়ে গেলে তুমিও এই পরিবারের একজন হয়ে যাবে। সোহেলের উপর চার্জ আনা হয়েছে। কম করে চার-পাঁচ বছরের জেল হয়ে যাবে।”

“তাই যেন হয়। এই সুখের মূহুর্তগুলো যেন না ফুরোয়, কারো নজর না পরে। তোমাকে, এই পরিবারকে আকঁড়ে ধরে বাঁচতে চাই।”

চলবে….!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here