বৃষ্টি তোমাকে দিলাম❤️পর্ব-৫

0
2210

বৃষ্টি তোমাকে দিলাম❤️পর্ব-৫
ফাবিহা নওশীন

ইশারার ঠোঁটের কোনে তৃপ্তির হাসি, চোখ চকচক করছে৷ ওর চোখ-মুখে খুশির আভা ছড়িয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে হাঁটছে। ঠিক হাঁটছে না শূন্যে ভাসছে। ও যেন মুক্ত বিহঙ্গের মতো আকাশে ডানা মেলে উড়ছে। আশেপাশের কোনো কিছুই ওর উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না। সবাই অবাক দৃষ্টিতে ওকে দেখছে। ওর খুশি খুশি মুখটা ওর সৌন্দর্যকে যেন আরো বাড়িয়ে তুলছে। এই প্রথম ও কারো জন্য স্ট্যান্ড নিয়েছে যে কি-না নিজের জন্যও কখনো স্ট্যান্ড নেয়নি। আর সফল হয়েছে। গতকাল যারা ওর দিকে রাগ, ঘৃণা, অবজ্ঞা, বিরক্তি পোষণ করেছে তারা আজ লজ্জিত। লজ্জিত ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকাচ্ছে আর এটাই ওর জয়, সত্যের জয়। ইশারা আপসোস করেছিল সাহায্য করার জন্য কিন্তু এখন একটা জিনিস বুঝতে পেরেছে সত্যের জয় সবসময়। হয়তো কিছুটা সময় নেয় কিন্তু সত্য কখনো কারো সাথে আপোষ করে না। তাই সব সময় সত্যের পথ অনুসরণ করা উচিত।

~ফ্ল্যাশব্যাক~
ফারান নিজের কেবিন থেকে রেগেমেগে বের হচ্ছে। ইশারা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ওর পেছনে পেছনে আসছে। সবার দৃষ্টি সেদিকে৷ কেউ কাজে মগ্ন থাকলেও আরেকজনের দ্বারা আলতো ধাক্কা কিংবা ফিসফিসানিতে সামনের দিকে তাকায়। এখন সবার মনোযোগ ফারানের দিকে। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। সবাই নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলছে। ফারান আনিস রহমানের কেবিনের সামনে গেল। আনিস রহমান ফারানের এমন অগ্নিমূর্তি দেখে ভেতরে ভেতরে কোনো ভয়ংকর শংকা করছিলেন। কি-বোর্ডের উপর থেকে তার আঙুল সরে গেল পেছনে ইশারাকে দেখে। তিনি নিজের অজান্তেই উঠে দাঁড়ালেন। ইশারার দিকে তাকাল। ইশারা শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেও ফারান রক্তচক্ষু নিয়ে চেয়ে আছে।

আনিস রহমান ভেতরে ভেতরে ভয় পাচ্ছেন। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল,
“কিছু হয়েছে স্যার?”

ফারান আবিরের দিকে চেয়ে বলল,
“আবির, পারুল মেমকে ডাকুন।”

আবির পারুলকে ডাকতে চলে যেতেই আনিস শুকনো ঢোক গিলে বলল,
“স্যার, কোনো সমস্যা?”

ফারান নিজের রাগ কন্ট্রোল করে মৃদু হেসে বলল,
“জি অবশ্যই, তবে নিশ্চিত থাকুন খুব শীঘ্রই সমাধান করে ফেলব। আমি কোনো কাজ বেশিদিন ফেলে রাখি না। এটা আমার একদম অপছন্দ। জানেন তো?”

আনিস রহমান শুকনো হেসে তাল মিলিয়ে বলল,
“জি স্যার।”

ফারান ইশারার দিকে তাকাল। ইশারা শান্ত দৃষ্টিতে পারুলের আসার পথে চেয়ে আছে। পারুল যদি এবারও মিথ্যা বলে কিংবা অস্বীকার করে তবুও স্যার ওর কথা বিশ্বাস করবে না এটুকু বিশ্বাস ইশারা রাখতে পারছে। কিছুক্ষণ আগে ইশারা ফারানের চোখে ওর প্রতি বিশ্বাস দেখেছে। তাই পরম সত্যকে মিথ্যা হয়ে যাওয়ার ভয় পাচ্ছে না।

পারুল আনিস রহমানের কেবিনে এসে আনিস রহমানের থমথমে, ইশারার নিশ্চিন্ত আর ফারানের রাগান্বিত মুখ দেখে থমকে গেল। একবার আনিসের দিকে তাকাল তারপর ফারানের দিকে তাকাল। ফারান ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।

পারুল ঢোক গিলে বলল,
“জি স্যার, ডেকেছেন?”

ফারান একটা চেয়ার টেনে বসল। পায়ের উপর পা তুলে বসেবলল,
“মিসেস পারুল, জানেন তো কিছু মানুষের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য, অকৃতজ্ঞ আচরণের জন্য এই পৃথিবীতে একদিন আর কেউ কাউকে উপকারের কথা ভাববে না? কারো দিকে হাত বাড়াবে না সাহায্যের জন্য। জানেন তো?”

পারুলের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে।
“জি স্যার, জানি। এই যেমন ইশারাও আর কখনো আমার দিকে হাত বাড়াবে না।”

ফারান ভ্রু কুঁচকে আনিসের দিকে তাকাল। তারপর আবার পারুলের দিকে চেয়ে শীতল কন্ঠে বলল,
“তাহলে গতকাল কেন মিথ্যা বললেন? আমি যতদূর জানি মিস ইশারা তো আপনার জন্য যথেষ্ট করেছে। তাহলে আপনি উনার সাথে কেন এটা করলেন?”

পারুল মাথা নিচু করে চোখ মুছে আনিসের দিকে তাকাল। তারপর আঙুল দিয়ে আনিসকে দেখিয়ে বলল,
“এই লোকটা আমাকে ভয় দেখিয়েছে। বলেছে আমি যদি উনার বিরুদ্ধে একটা শব্দ বলি তবে আমার পাশাপাশি ইশারার চাকরি খেয়ে দিবে। আমি চাইনি আমার জন্য ইশারা বিপদে পড়ুক। ও চাকরিটা হারাক। আমি জানি এই জবটা ওর জন্য কত প্রয়োজন। আমি কি করে ওর এতবড় ক্ষতি করতে পারি?”

ফারান তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“তাই না-কি? আপনি কি জানেন যে আপনি ওর চাকরি বাঁচানোর কথা বলছেন সেই আপনার জন্য ইশারা আজ ইস্তফা দিয়েছে।”

পারুল চমকে ইশারার দিকে তাকাল। তারপর ইশারাকে হাত জোড় করে বলল,
“ইশারা আমাকে মাফ করে দেও। প্লিজ তুমি চলে যেও না। আমি নিরুপায় ছিলাম।”

ইশারা কিছু বলার আগেই ফারান ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর চিৎকার করে বলল,
“বস কে? আমি না আনিস সাহেব? আপনি আনিসকে ভয় পেয়ে আমাকে মিথ্যা বলেন? সাচ এ জোক।”

পারুল হাতজোড় করে বলল,
“স্যার, আমি সত্যিই খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আনিস স্যার আপনার অনেক বিশ্বস্ত। আপনি যদি আমার কথা বিশ্বাস না করেন তাই চুপ ছিলাম। এই চাকরিটা আমারও খুব প্রয়োজন। আমি একটা প্রাণ বয়ে বেড়াচ্ছি। তাকে সুন্দর একটা ভবিষ্যত দেওয়ার জন্য অসুস্থতা নিয়ে এত খাটুনি করছি। আমার স্বামী অসুস্থ। কোনো কাজ করতে পারে না। এই চাকরির বেতনেই সব চলে। যদি চাকরিটা চলে যেত আমি কি করতাম?
আমি, আমার পরিবার সব শেষ হয়ে যেত স্যার। আমি জানি আমি অন্যায় করেছি। কিন্তু বাধ্য হয়েই করেছি। আমাকে মাফ করে দিন স্যার?”

“মাফ চাইতে হলে ইশারার কাছে গিয়ে চান।”

পারুল ইশারার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ইশারা ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে চেয়ে আছে। পারুল ইশারার দিকে কান্না মিশ্রিত চোখে তাকাল। তারপর ধীরে ধীরে হাত তুলে কিছু বলার আগেই ইশারা ওর হাত ধরে ফেলল।
“ইট’স ওকে। কিন্তু একটা অনুরোধ আর কখনো কোনো অমানুষকে ভয় পাবেন না। তবে একদিন না একদিন এর জন্য আপনাকে পস্তাতে হবে। ভয় পেয়ে নিজেকে দমিয়ে রাখবেন না। প্রতিবাদ করবেন নয়তো আজীবন চোখের পানি ফেলতে হবে।”

পারুল মাথা নাড়িয়ে বলল,
“মনে থাকবে। তোমার এই অনুরোধ আমি উপদেশ হিসেবে গ্রহণ করলাম।”

ইশারা একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মনে মনে বলছে,
“আই হোপ সো। নয়তো আমার মতো আপনাকেও আজীবন কষ্ট পেতে হবে। আমি চাই না আর কেউ আমার মতো ভুল করুক, কষ্ট পাক।”

ফারান এতক্ষণে আনিসের দিকে তাকাল। আনিস মাথা নিচু করে আছে। ফারানের দিকে চোখ তুলে চেয়ে হাতজোড় করে বলল,
“স্যার, মাফ করে দিন। আর কখনও এমন কাজ করব না। এইবারের মতো মাফ করে দিন। আমি কথা দিচ্ছি আমার বিরুদ্ধে আর কোনো অভিযোগ পাবেন না।”

“সরি আনিস সাহেব৷ ভেরি সরি। আপনাকে আমি সে সুযোগ দিতে পারছি না। আজকের পর আপনাকে আমার অফিসে যেন আর না দেখি। যারা মেয়েদের সম্মান করতে পারে না তাদের এখানে কোনো স্থান নেই। আপনার পরিবার, সন্তানের কথা ভেবে পুলিশে দিচ্ছি না।”

আনিস রহমান আরো অনেক অনুনয় করল কিন্তু কাজ হলো না। ফারান ইশারাকে নিজের কেবিনে ডেকে চলে যাচ্ছে৷
আনিসের কেবিন থেকে বের হতেই ফারান স্টাফদের জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। ফারানকে দেখে ওরা দ্রুত নিজেদের জায়গা ত্যাগ করছে।

ফারান সবাইকে দাঁড়াতে বলল। সবাই দাঁড়িয়ে গেল।
“আপনারা নিশ্চয়ই উৎসুক হয়ে আছেন এখানে কি হচ্ছে জানার জন্য? তাহলে শুনুন। আনিস রহমান সাহেব মেয়েদের বিভিন্নভাবে হ্যারেজ করে আসছেন অনেক দিন ধরে। তারপর তাদেরকে চাকরির ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখেন। তাই কেউ ভয়েজ উঠায়নি। ইশরা আজ উনার মুখোশ উন্মোচন করেছেন। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।”

ফারান ইশারার দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকাল। যারা গতকাল ইশানির দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকাচ্ছিল আজ তারা অনুতপ্ত, লজ্জিত।

ইশারা ফারানের রুমের দরজা নক করল। ফারান পকেটে হাত গুজে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
“স্যার, আসব?”

ইশারার কন্ঠস্বর শুনে পেছনে ঘুরে মুচকি হেসে বলল,
“জি আসুন।”

ইশারার বেশ অবাক লাগে ফারানকে। এই তুমি বলছে তো আবার আপনি, এই রেগে যাচ্ছে তো এই ঠান্ডা৷ অদ্ভুত মানুষ তিনি। ইশারা ঠিক বুঝতে পারে না৷

ইশারা ফারানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ফারান মুচকি হেসে বলল,
“তো ইশারা আপনি কি বলছিলেন অফিস ছেড়ে দিচ্ছেন?”

ফারানের কথা শুনে ইশারা না চাইতেও হেসে ফেলল। ফারান মুগ্ধ নয়নে ওর হাসি দেখছে। ফারানকে এভাবে চেয়ে থাকতে দেখে অস্বস্তিতে পড়ে যায় ইশারা৷ হাসি থামিয়ে দিয়ে বলল,
“স্যার, আর কিছু বলবেন?”

ফারান অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে তারপর নিজেকে সামলে বলল,
“জি না, সব পুরুষ কিন্তু এক হয় না। তাই একজনের শাস্তি অন্যজনকে দেওয়া উচিৎ না।”

ইশারা অবাক চোখে ফারানের দিকে তাকাল। ফারানের এই সামান্য কথার মাঝে লুকানো রহস্যের হদিস পাচ্ছে। ইশারা পরিস্থিতি অন্যদিকে নেওয়ার জন্য বলল,
“জি স্যার৷ ধন্যবাদ।”

ইশারা দ্রুত ফারানের রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ইশারার উজ্জ্বল মুখটা হটাৎই ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ফারান বুঝতে পারছে না ইশারা হুট করে চলে গেল কেন?

~বর্তমান~
ইশারা অফিস থেকে বেড়িয়ে গেছে। অটো, রিকশা কোনো কিছুর জন্যই অপেক্ষা না করে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। ওর মনে যেন বসন্তের ছোয়া লেগেছে৷ ডানায় রঙ জড়িয়ে প্রজাপতি হয়ে উড়ছে৷ নীল দিগন্তে উড়ছে। অনেকটা পথ হেঁটে চলে গেছে। হটাৎই ইশারা ফুটপাতে ফাঁকা জায়গায় বসে পড়ল। অজানায় হারিয়ে গেছে ও। হুশ ফিরল গুড়িগুড়ি বৃষ্টির স্পর্শে। বৃষ্টির ফোঁড়া শরীরে নয়,হৃদয়ে কাঁপন বইয়ে দিচ্ছে। ইশারা চাইছে খুব জোরে বৃষ্টি হোক, পুরো শহরের সাথে বৃষ্টিস্নাত করবে। মনের যত ব্যথা পবিত্রতার ছোয়ায় মুছে ফেলবে। ইশারা বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। আকাশের দিকে চেয়ে চোখ বন্ধ করল। মুখের উপরে বৃষ্টির ছোট ছোট ফোঁটা পড়ছে।
হটাৎই ঝমঝম শব্দে বৃষ্টি ধরণীকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। খুব জোরে বৃষ্টি হচ্ছে।
ইশারা দু-হাত প্রসারিত করে বৃষ্টিকে উপভোগ করছে। বৃষ্টিতে ধীরে ধীরে হাঁটছে আর গুনগুন করে গান গাইছে।
নিজেকে বাচ্চা মনে হচ্ছে। রাস্তার মাঝে চলে যাচ্ছে যখনই ফাঁকা পাচ্ছে। ইশারা খেলায় মেতে উঠেছে৷ হটাৎই একটা গাড়ি ওর সামনে এসে দাঁড়াল। দরজা খুলে ছাতা মাথায় বেড়িয়ে এল সুদর্শন এক পুরুষ।

ইশারা অবাক হয়ে বলল,
“স্যার আপনি?”

ফারান ধমকে বলল,
“আপনি এখানে কি শুরু করে দিয়েছেন? এভাবে বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর,ঠান্ডা লেগে যাবে। গাড়িতে উঠুন আমি আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি।”

ইশারা গাল ফুলিয়ে বাধ্য মেয়ের মতো গাড়িতে গিয়ে বসল৷ ঠান্ডায় ইশারা জমে যাচ্ছে। ভিজে একাকার হয়ে আছে। কাচ ভেদ করে বাইরের দৃশ্য উপভোগ করছে।
ফারান ওর বাসার সামনে গাড়ি থামাতেই ইশারা ধন্যবাদ দিয়ে নেমে গেল। তখনও বৃষ্টি পড়ছে। গাড়ি থেকে নামতেই অহনাকে রিকশা থেকে নামতে দেখল। চোখ বড়বড় করে কাচ ভেদ করে ফারানের দিকে চেয়ে আছে। ফারান চলে যেতেই অহনা বলল,
“বাহ! তোকে আজও দিয়ে গেল?”

ইশারা তাড়া দেখিয়ে বলল,
“বৃষ্টি পড়ছিল তাই।”

অহনা দুষ্টু হেসে বলল,
“বাবাহ! এত কেয়ার? আমার তো কেস সুবিধার লাগছে না। দুলাভাই হলে মন্দ হবে না।”
বলেই হেসে উঠল।

ইশারা অহনার কথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল,
“ফান করার একটা লিমিট আছে অহন, সব জেনেশুনে এমন সস্তা মজা কি করে করিস? বল?”

অহনা চুপ হয়ে গেল। ইশারার প্রশ্নের উত্তর দিল না। কিছু প্রশ্নের উত্তর না দেওয়ায় শ্রেয়।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here