বৃষ্টি শেষে
পর্ব – ১০,১১,১২
আমিরাহ্ রিমঝিম
পর্ব – ১০
মরিচা বাতির ঝিকিমিকি, সাজানো তোরণ, অজস্র তাজা আর কৃত্রিম ফুল – সবই যেন জানান দিচ্ছে “ আজ নাফিসার বিয়ে ”
মেয়েকে কনের সাজে দেখে বুকটা হাহাকার করে উঠে নাফিসার বাবার। কলিজার টুকরা মেয়েটা আজ আরেকজনের দায়িত্বে চলে যাবে!চোখের কোণে পানির অস্তিত্ব টের পেয়ে দ্রুত চোখ মুছে নেন তিনি।
সামিয়া, যুথি আর রাইসা এক জায়গায় বসে গল্প করছে আর নাফিসাকে দেখছে। নাফিসা ছবির জন্য বিভিন্ন পোজ দিচ্ছে আর ফটোগ্রাফার ছবি তুলছে। এই ফটোগ্রাফার নাকি বেশ ভালো ছবি তুলতে পারেন।
সামিয়া সেই কখন থেকে বকবক করেই যাচ্ছে। তার বকবকানির মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে সে তার নিজের বিয়েতে কি কি করবে।
— ভাবছি আমার বিয়েতে এই ফটোগ্রাফার দিয়েই ছবি তুলাবো।
— তোর বিয়ে হতে হতে ফটোগ্রাফার বুড়া হয়ে যাবে।
— হ্যাঁ, তাও ঠিক।
সামিয়া মলিন মুখে বললো।
গল্পের চেয়ে নাফিসার দিকে মনোযোগ বেশি রাইসার। নাফিসার শাড়ির রঙ, গয়নার ডিজাইন সব খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে সে। সামিয়ার কথা কানে প্রবেশ করাতে তার মনে প্রশ্ন জাগে, সে নিজে কিভাবে সাজবে বিয়েতে? কি রঙের শাড়ি পরবে? কেমন গয়না পরবে? আচ্ছা, বিয়েটা কার সাথে হবে ওর? অজান্তেই একটা আজগুবি প্রশ্ন জাগে মাথায়, ওর বিয়ে যদি নাফিদের সাথে হয়? অবচেতনেই যেন কল্পনা করতে থাকে, লাবন্য আপুর সাথে বিয়ে ঠিক হলো নাফিদ ভাইয়ার। কিন্তু বিয়ের ঠিক আগে নাফিদ ভাইয়া বললো সে রাইসাকে পছন্দ করে আর রাইসাকেই বিয়ে করবে।, তারপর নাফিদ ভাইয়ার সাথেই রাইসার বিয়ে হয়ে গেলো।পরক্ষণে নিজেই বিব্রতবোধ করে রাইসা। দূর! কিসব ভাবছে!
— কি গল্প করো তোমরা? তোমাদের সাথে তো কথাই বলা হলো না।
মুখে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে মিষ্টি কন্ঠে বললো লাবন্য। সামিয়া, যুথি, রাইসা হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো লাবন্যর দিকে। সামিয়াই প্রথম মুখ খুললো,
— আপু আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে।
লাবন্য বিগলিত হাসলো।
— থ্যাংক ইউ! তোমার নাম সামিয়া না?
— হ্যাঁ আপু। এইটা যুথি আর এইপাশে এটা রাইসা।
লাবন্য এবার রাইসার দিকে তাকালো।
— রাইসা মনে হয় একটু কম কথা বলো, না?
উত্তরে রাইসা হাসে, কিছু বলে না।
— কোন ক্লাসে এবার তুমি?
— জেএসসি পরীক্ষা দিলাম। নাইনে উঠবো ইনশাআল্লাহ।
….
ক্লাস শেষ করে অস্থির হয়ে বাসায় ফেরে রাইসা। এত্ত গরম পড়েছে! একেতো গরম, তার উপর ক্লাস নাইনের ম্যাথ, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি। ঘরে এসে ব্যাগটা রেখেই ডাইনিং এ গিয়ে ঢকঢক করে দুই গ্লাস ঠান্ডা পানি খেয়ে ফেলে।
— রাইসা, এতো ঠান্ডা পানি খেয়ো না মামনি।
— অনেক গরম আম্মু।
— তাও। দরকার হলে অল্প একটু ঠান্ডা পানি মিশিয়ে নিবে নরমাল পানির সাথে, এতো ঠান্ডা পানি খাবে না।
— ঠিক আছে আম্মু। রাহিব আর রাকিব কি ঘুমায়?
— হ্যাঁ ঘুমাচ্ছে। তুমি ফ্যানের নিচে বসে রেস্ট নাও কিছুক্ষণ।
রাইসা জিরোতে বসে। হঠাৎ কিছু একটা মনে হতেই আবার ডাক দেয় ওর মা কে।
— আম্মু, নাফিদ ভাইয়া আজকে বিকালে সবাইকে খাওয়াবে বলেছে। আমি কি যাবো?
— কে কে যাবে?
— সামিয়া, যুথি, যারিন আপু, সিয়াম ভাইয়া সবাই যাবে।
— আচ্ছা যাস তাহলে। তোর আব্বুকে বলেছিস?
— না বলিনি এখনো।
— ফোন করে জানা তাহলে।
ফোনে বাবাকে জানানো হলে রাইসার মা আবার প্রশ্ন করলেন,
— খাওয়াবে কি উপলক্ষে?
— সেটাতো বলেনি।
….
সামিয়া, যুথি, রাইসা, যারিন, সিয়াম, নাফিদ, লাবন্য – সবাই চলে এসেছে। নাফিদের আরো দু-চারজন বন্ধুও এসেছে। রাইসার বড় ফুপির দুই ছেলেই বয়সে বেশ বড়, নাফিসারও বড়। তাই তারা সাধারণত ওদের সাথে অতটা ঘুরতে বের হন না।
এই কয়দিনে লাবন্যকে বেশ পছন্দ হয়ে গেছে রাইসার। আপু সবার সাথেই খুব সুন্দর মেশে, কি সুন্দর করে কথা বলে সবার সাথেই। নাফিসা আপুর বিয়েতে রাহিব আর রাকিবের সাথেও বেশ সখ্যতা হয়ে গিয়েছে লাবন্য আপুর। কিন্তু নাফিদ ভাইয়ার সাথে কিভাবে দুই দিন পরপর এতো ঝগড়া লাগে বুঝতে পারেনা রাইসা। কিছুদিন পরপরই সামিয়ার কাছ থেকে জানতে পারে নাফিদ ভাইয়া আর লাবন্য আপুর ঝগড়া হয়েছে।
এখন আর নাফিদের কথা ভাবে না রাইসা। আগে যে নাফিদকে নিয়ে এতোকিছু ভাবতো, মনে করতো নাফিদ ভাইয়া ওকে পছন্দ করে, এসব মনে পড়লে এখন বিব্রতবোধ করে নিজে নিজেই, বোকা বোকা লাগে নিজেকে। নাফিদ ভাইয়া ওকে পছন্দ করে না।রাইসা তো আর লাবন্যর মতো সুন্দর না।নাফিদকে নিয়ে আর ভাববে না রাইসা। নাফিদ আর লাবন্যের যেন তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যায় এটাই চায় এখন।
— রাইসা? তুমি নাইনে না এবার?
লাবন্য প্রশ্ন করে।
— হ্যাঁ আপু।
— রাইসা মনে হয় আগের চেয়ে আরো লম্বা হয়ে গেছো? সামিয়া, যুথিও তো লম্বা হয়ে গেছে।
— লম্বা তো হবেই। বড় হচ্ছে না ওরা। আর তোমার সাথে ওদের তো নাফিসার আপুর বিয়ের পর এই প্রথম দেখা হলো।
লাবন্যর কথার উত্তর দেয় নাফিদ।
খাবার অর্ডার করা হলে সিয়াম প্রশ্ন করে,
— কিরে ভাই, তুই আজকে নিজে থেকে সবাইকে এরকম ট্রিট দিচ্ছিস? কাহিনি কি?
নাফিদ একটু হাসে। তারপর বলে,
— আজকে আমাদের রিলেশনের তিন বছর।
সিয়াম, যারিন আর নাফিদের বন্ধুরা “ওওওওওওও” বলে আওয়াজ করে।
খেতে খেতে যারিন প্রশ্ন করে,
— তা ভাবির কথা বাসায় জানাবি কবে?
— গ্রাজুয়েশনটা হোক, তারপরই জানিয়ে রাখবো বড়দের। নাফিসা আপুতো লাবন্যের কথা জানেই।
( চলবে ইনশাআল্লাহ)
বৃষ্টি শেষে
পর্ব – ১১
আমিরাহ্ রিমঝম
দিন পেরিয়ে মাস যায়, মাস পেরিয়ে বছর। একটু একটু করে কিভাবে সময় বয়ে যায় তাও সবসময় বুঝে ওঠা যায় না। মাঝে মাঝে যখন পুরনো কোনো স্মৃতি মনে পরে তখন হয়তো খেয়াল হয়, আরে! এতগুলো দিন কিভাবে পেরিয়ে গেল?
“ লাবন্য ”
লাইব্রেরিতে এতো জোরে ডাক দেয়ায় প্রায় সবাই ঘুরে তাকিয়েছে কে ডাকলো দেখার জন্য, রাইসাও ঘুরে তাকিয়েছে। ডাকটা যে দিলো সে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। বেখেয়ালে লাইব্রেরিতে এতো জোরে বান্ধুবির নাম ধরে ডেকে ফেলেছে। বেচারির অবস্থা দেখে রাইসা নিঃশব্দে হাসলো। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে নিলো।
লাবন্য ভাবির কথা মনে পড়ে গেলো রাইসার। মনটা একটু খারাপ হলো। আজ ছয় সাত মাস হয়ে গেলো নাফিদ ভাইয়া আর লাবন্য ভাবি আলাদা থাকছে। বিয়ের পরেও এদের ঝগড়াঝাটি থেমে নেই। কিছুদিন পরপরই কিছু না কিছু নিয়ে ঝামেলা হবেই দুইজনের মধ্যে। আর তার রেশ ধরে ভাবি বাবার বাড়ি চলে যাবে। যদিও যেদিন এমন হয় সেদিনই নাফিদ ভাইয়া গিয়ে ভাবিকে নিয়ে আসে। তবে এবার আর নাফিদ ভাইয়া নিতে যায়নি, ভাবিও আসে নি। এর আগেও দুইবার এমন হয়েছিলো। একবার ডিভোর্সের কথাও উঠেছিলো। রাইসা জানে এইবারও কিছুই হবে না, কিছুদিন পর আবার সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। কিন্তু কতদিন পর সেটাই ও ভেবে পাচ্ছে না।
লাবন্য ভাবির কথা মনে পড়াতে নাফিসা আপুর বিয়ের কথা মনে পড়ে রাইসার, লাবন্য ভাবিকে নাফিসা আপুর হলুদেই প্রথম দেখেছিলো। নাফিসা আপুর বিয়ের সাত বছরের বেশি হয়ে গেছে। এতগুলো বছরে পাল্টেছে অনেক কিছুই। নাফিসা আপুর বাবু হয়েছে দুইটা, দুইজনই মেয়ে। রাইসা ভার্সিটিতে পড়ছে, রাকিব ক্লাস নাইনে এবার, আর রাহিব ক্লাস টু তে । তবে সবচেয়ে বড় যে বিষয় ঘটেছে তা হলো, রাইসার দাদা মারা গেছেন। দাদার কথা মনে পড়ায় বুকটা ভার হয়ে আসে রাইসার, মুহুর্তের মধ্যে দুচোখ পানিতে ভরে যায়।
কাধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে দ্রুত চোখ মুছে পেছনে তাকায়, দেখে তিন্নি দাঁড়িয়ে আছে। তিন্নির সাথে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে আসে রাইসা।
— কাদছিলি কেন তখন?
— দাদার কথা মনে পড়ছিলো রে।
রাইসার কন্ঠের বিষন্নতা তিন্নিকেও স্পর্শ করে। কোমল কন্ঠে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে,
— দাদাভাইকে ঈমানদার হিসেবেই জেনেছি। উনি মারা যাওয়ার এত দিন পরেও কত মানুষ দোয়া করে উনার জন্য। আল্লাহ যেন জান্নাত দান করেন উনাকে।
— আমিন।
….
বাড়ির উদ্দেশ্যে বাসে যেতে যেতে আবার স্মৃতির ডালি মেলে বসে রাইসার মন।
একসময় সে নাফিদ ভাইয়াকে পছন্দ করতো। আগে থেকেই নাফিদ ভাইয়াকে ভালো লাগতো কারণ উনি দেখতে সুন্দর, তারপর একদিন একসাথে গাড়িতে করে কোচিং থেকে বাসায় ফিরলো। এরপর থেকে ওর মনে প্রশ্ন জাগতো নাফিদ ভাইয়াও ওকে পছন্দ করে কিনা, যদিও এমন প্রশ্ন জাগার কারণ ছিলো না কোনো। নাফিদকে নিয়ে রাইসার ধ্যানভঙ্গ হওয়া শুরু হয় লাবন্য ভাবির কথা জানার পর থেকে। এসব কথা এখন মনে পড়লে মনে মনে খুবই লজ্জা লাগে রাইসার। কি আজগুবি চিন্তাভাবনা করতো তখন। বয়স তখন কত ছিলো ওর? ১৩ বছর! ক্লাস এইটে পড়তো মাত্র। অল্প বয়সের যত আজগুবি চিন্তা!
স্কুলজীবনের কথা মনে পড়ে যায়।স্কুলে পড়ার সময় দিশা আর রাইসা পড়তো একসাথে, তিন্নি ছিলো অন্য স্কুলে। কলেজে তিন বান্ধবী এক জায়গাতেই ভর্তি হয়েছিলো, কলেজ জীবনটা তাই একসাথেই কেটেছে তিনজনের। ভার্সিটিতে এসে স্কুলের উল্টা হয়ে গেছে। রাইসা আর তিন্নি দুইজন একই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, যদিও আলাদা আলাদা ডিপার্টমেন্টে। পাবলিকে হয়নি রাইসার। তিন্নির অবশ্য হয়েছিলো একটা পাবলিক ভার্সিটিতে কিন্তু বাসা থেকে দূরে বিধায় সেখানে পড়তে চায়নি, রাইসার সাথে এখানেই ভর্তি হয়ে গেছে। দিশা পড়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাসার কাছেই। বিয়েও হয়ে গেছে মেয়েটার, আল্লাহ চাইলে কয়েক মাস পর ওর বেবিও হবে।
দিশার বাবুর কথা মনে পড়তেই রাইসার নিকাবের আড়ালে থাকা মুখে হাসি ফুটে ওঠে। দুচোখের আনমনা দৃষ্টি দূরে নিবদ্ধ হয়। মেয়েবাবু হবে শুনেছে। আচ্ছা, পিচ্চিটার নাম কি দেয়া যায়?
….
বাসায় ফেরার পর থেকে রাইসা খেয়াল করেছে ওর মা হতাশ মুখে কাজকর্ম করছেন, আর মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন। রাইসা ব্যাগ, বোরকা-নিকাব রেখে ডাইনিং এ আসে, পানি খেতে খেতে মায়ের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে কি হয়েছে। মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরে আবারো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
— আমাদের নাফিদের সংসারটা বোধহয় আর টিকলো না রে।
এবার রাইসা বুঝতে পারলো ওর মা এতো হা-হুতাশ কেন করছেন। হাতের গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে বললো,
— এতো টেনশন কেন করছো আম্মু? ইনশাআল্লাহ এরকম কিছুই হবে না। লাবন্য ভাবি আর নাফিদ ভাইয়ার যে কয়দিন পরপরই শুধু শুধুই ঝগড়া হয় এটা তো মোটামুটি সবাই জানে। কয়দিন পরই দেখা যাবে নাফিদ ভাইয়া গিয়ে ভাবিকে নিয়ে আসবে নাইলে ভাবি একাই চলে আসবে।
— লাবন্য আর আসবে না, ডিভোর্স চেয়েছে। নাফিদ লাবন্যকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিয়েছে। মৌখিক তালাকও হয়ে গেছে। তোর চাচার বাসার পরিস্থিতি ভালো না, তোর চাচি যেতে বলেছে। রেডি হয়ে নে তাড়াতাড়ি।
মায়ের কথা শুনে থমকে যায় রাইসা। ও ভেবেছিলো ওর কথার উত্তরে মা হয়তো বলবে যে আর কতদিন পরে যাবে লাবন্যকে আনতে, এতোদিন হয়ে গেলো। কিন্তু এমনকিছু যে শুনতে হবে তা ওর দূরতম কল্পনাতেও ছিলো না। নাফিদ ভাইয়ার সংসারটা ভেঙে গেলো?
( চলবে ইনশাআল্লাহ )
বৃষ্টি শেষে
পর্ব – ১২
আমিরাহ্ রিমঝিম
হাত বাড়িয়ে ম্যাচের বক্স নেয়ার সময় ধাক্কা লেগে এলুমিনিয়ামের একটা ঢাকনা নিচে পড়ে গিয়ে ঘরময় ঝনঝন আওয়াজ ছড়িয়ে গেলো।
— রাইসা? কি হয়েছ?
রাইসার মায়ের কন্ঠে উৎকন্ঠা।
— কিছু না মা, ঢাকনা পড়ে গেছে হাত লেগে।
রাইসা ঢাকনাটা উঠিয়ে জায়গামতো রাখতে রাখতে জবাব দিলো।
ম্যাচ দিয়ে চুলা জ্বালিয়ে দুধ ফুটতে দিলো, সাথে এলাচি আর দারচিনি টুকরা। দুধ ভালোভাবে ফুটলে সেখানে পোলাও চাল দেয়া হবে,পায়েশ বানাবে রাইসা। রাকিব পায়েশ খাওয়ার বায়না করেছে, রাকিবের দেখাদেখি রাহিবও পায়েশ খেতে চেয়েছে। সেজন্যই এতো আয়োজন।
রাইসার বাবা মাগরিবের নামাজ পড়ে ফেরেননি মসজিদ থেকে, ওর মা মনযোগ দিয়ে পত্রিকা পড়ায় ব্যস্ত। রাকিব, রাহিব দুইজন পড়ছে। রাইসা দুইজনকে কিছুক্ষণ পড়া বুঝিয়ে দিয়ে পায়েশ বানাতে এসেছে।
পায়েশের সুমিষ্ট গন্ধে সারা বাসা ম ম করছে। রাইসা চুলাটা বন্ধ করে পায়েশ বড় বাটিতে ঢেলে টেবিলে এনে রাখলো। রাকিব আর রাহিবের পড়া দেখার জন্য সেই ঘরে গেলো রাইসা।
— আপু, পায়েশ কি হয়েছে?
— হয়েছে রাহিব। কিন্তু পায়েশ এখনো অনেক গরম, ঠান্ডা হলে তারপর খেতে পারবে।
— আচ্ছা।
বলে রাহিব আবার হাতের লেখা লিখতে ব্যস্ত হয়ে গেলো।
…..
নাফিদের ডিভোর্সের পর সবারই মন ভীষণ খারাপ ছিলো। এই তিন চার মাসে আস্তে আস্তে সব স্বাভাবিক হয়েছে। এতদিনের পছন্দের সংসার দুজনের, কেউ ভাবতেও পারেনি এভাবে ভেংগে যাবে সংসারটা। ডিভোর্সটা আটকানোর জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সবাই চেষ্টা করেছে, শুধু নাফিদ আর লাবন্য বাদে। দুইজন নিজেরাই আর বিয়েটা টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী ছিলো না।
রাইসার চাচি এখনো খুবই আপসেট নাফিদের ডিভোর্সটা নিয়ে। যদিও ডিভোর্সটা দুইজনের ইচ্ছাতেই হয়েছিলো তবুও ডিভোর্সের পর নাফিদ বেশ কিছুদিন খুবই চুপচাপ ছিলো, নিজের এতো বেতনের চাকরিটাও ছেড়ে দিয়েছিলো। তারপর দুইমাস আগে থেকে চেষ্টা করছিলো দূরের কোনো জায়গায় চাকরি নিতে। দেড়মাস আগে চাকরির সুযোগ পেয়ে সিলেট চলে গিয়েছে নাফিদ। এজন্যই আরো রাইসার চাচির মন ভালো হচ্ছে না।
সেই বাসায় এখন মানুষ মাত্র তিনজন – রাইসার চাচা-চাচি আর দাদি। এতোবড় বাড়িটা খালি খালি লাগে খুব। আগে নাফিসা ছিলো, রাইসার দাদা ছিলো, নাফিদ ছিলো। এরপর নাফিসার বিয়ে হলো, রাইসার দাদা মারা গেলেন। নাফিদের বিয়েটা তো শেষই হয়ে গেলো, নাফিদও চলে গেলো সিলেট। যদিও নাফিদ প্রতি সপ্তাহেই চলে আসে, বৃহস্পিবার রাতে এসে শুক্রবার রাতেই আবার চলে যায়। রাইসা তবু দুইদিন পরপরই গিয়ে দেখা করে আসে। নাফিসাও যায় ঘনঘনই।
……
রাইসার ফোন বাজছে, হাতে নিয়ে দেখলো দিশা ফোন দিয়েছে। হাসিমুখে ফোন রিসিভ করলো।
— আসসালামু আলাইকুম। কিরে বাবুর আম্মু? কি অবস্থা?
— ওয়ালাইকুমুসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো বাবুর খালা, আপনার কি খবর?
— আলহামদুলিল্লাহ। কি করছিস?
টুকটাক অনেক কথা হলো দুইজনের মধ্যে। দিশার ডেলিভারির ডেট কাছাকাছি চলে এসেছে। নরমাল ডেলিভারিতেই বাবু হওয়ার কথা। দিশা এখন দিন গুনছে কবে বাবু আসবে।
— রাইসা, আমার খুব ভয় করছে রে।
দিশার কন্ঠের উৎকন্ঠা টের পেতে অসুবিধা হয়না রাইসার।
— ভয় তো একটু লাগবেই রে। সাহস রাখ। ইনশাআল্লাহ সব ঠিকঠাক হবে।
দিশাকে সাহস দিলেও রাইসা নিজেও ভয় পাচ্ছে। দিশার জন্য টেনশন হচ্ছে খুব।
দিশার সাথে কথা বলে রাকিব, রাহিবকে পায়েশ দিলো রাইসা। মাকে এক বাটি পায়েশ দিয়ে নিজেও মায়ের সাথে বসে একবাটি খেলো। পায়েশের বাটি হাতে নিয়ে রাইসার মা হেসে বললেন,
— এখন পায়েশ খেয়ে আবার রাতের খাবার কখন খাবো?
রাইসার বাবা এলেন একদম এশার নামাজ পড়ে। রাইসা তখন পড়ছিলো বসে। বাবার সাথে দেখা করার জন্য ঘর থেকে বের হবার আগেই বাবা মা দুজনেরই নিচু স্বরে বলা কিছু কথা কানে এলো রাইসার। বাবা হয়তো নতুন কোনো ছেলের খোঁজ পেয়েছে, সেটা নিয়েই আলাপ। ঘর থেকে আর বের হলোনা রাইসা।
গতবছর সামিয়া, যুথি দুজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে কয়েক মাসের ব্যাবধানে। রিতুর জন্যও ছেলে দেখা হয়েছে। এর মধ্যে একটা ছেলেকে সবার বেশ ভালো লেগেছে রিতুর জন্য, যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে সেখানেই রিতুর বিয়ে হয়ে যাওয়ার।
রাইসার জন্যেও ওর বাবা ছেলে দেখতে শুরু করেছেন। রাইসাও অমত করে নি। রাইসা জানে অনেক সময় পছন্দসই ছেলে খুঁজে পেতে পেতে অনেক সময় লেগে যায়। দু-চার-পাঁচ-দশ বছরও লাগে, কেউ কেউ পায়ই না। আর রাইসা যেরকম ছেলে চাচ্ছে আদৌ সেরকম ছেলে পাবে কিনা বা পেলেও সে ছেলে রাইসাকে বিয়ে করতে চাইবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
আবারো পড়ায় মন দিলো রাইসা। পরশু একটা টিউটোরিয়াল আছে, এখনো বেশকিছু পড়া বাকি।
( চলবে ইনশাআল্লাহ )