বৃষ্টি শেষে পর্ব – ১৩,১৪,১৫

0
892

বৃষ্টি শেষে
পর্ব – ১৩,১৪,১৫
আমিরাহ্ রিমঝিম
পর্ব – ১৩

চাচাদের বাড়িতে পৌছাতে পৌছাতে দশটা বেজে গেলো রাইসার। বাসা থেকে বের হয়েছিলো সাড়ে আটটায়। ভেবেছিলো সাড়ে নয়টার মধ্যে হয়তো এসে পরবে কিন্তু কিভাবে কিভাবে যেন দশটা বেজে গেলো।
দরজা খুললেন রাইসার চাচি। রাইসা হাসিমুখে সালাম দিলো চাচিকে।

নাফিসারা এসেছে আজকে। নাফিসার দুই পিচ্চি মেয়ে ঘরময় ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে। বড় মেয়ের বয়স চার বছর, ওর নাম মেঘলা। আর ছোটটা দেড় বছরের, নাম রোদেলা। রাইসা গিয়ে আদর করে রোদেলাকে কোলে নিতেই রাইসার নিকাব ধরে দিলো জোরে এক টান। নাফিসা তাড়াতাড়ি রোদেলাকে কোলে নিলো।

— দুষ্টু মেয়ে, খালামনির সাথেও এরকম দুষ্টুমি করছো?

রোদেলা মায়ের কথা শুনে মিচকে হাসি হেসে এবার নাফিসার চুল ধরে টান দিলো।

— কি দুষ্টু মেয়েরে! ছাড়ো, চুল ছিড়ে গেলো!

শেষ পর্যন্ত রাইসার চাচি এগিয়ে গিয়ে রোদেলার হাত থেকে নাফিসার চুল ছাড়িয়ে দিলেন। বাকিরা সবাই তখন হাসছে।

নিকাব খুলে কাধের ব্যাগ রেখে সোফায় আরাম করে বসলো রাইসা। বললো,

— নাফিসা আপু, দুলাভাই আসে নি?

— না রে, ব্যস্ত আছে মেঘলার আব্বু। সন্ধ্যায় আসবে।

— আপনারা থাকবেন আজকে?

— হ্যাঁ, মেঘলার আব্বু এখান থেকেই অফিসে যাবে কালকে।

টেবিলে নাস্তা সাজাচ্ছিলেন রাইসার চাচি। ভাজির বাটি রাখতে রাখতে বললেন,

— তুমিও থাকো আজকে রাইসা। তোমরা আসলে তাও ভালো লাগে, বাড়িটা ভরা ভরা লাগে। আজকে দেখো সবাই আছে, তুমিও এসেছো, মনটা কত ভালো লাগছে।

— না চাচি। পরে একসময় এসে থাকবো।

— জানি তো, পরে তো আর থাকা হয়না তোমার। এখন আসো, নাস্তা খাও।

— সবাই বসুন, একসাথে খাই।

— সবারই খাওয়া হয়ে গেছে। শুধু তুমি আর নাফিদ বাকি। নাফিদ সকালে এসে থেকে ঘুমাচ্ছে, এখনো উঠেনি।

রাইসার একদমই মনে ছিলো না আজ যে নাফিদ আসার কথা। নাফিদ বাসায় আছে শুনে রাইসার অস্বস্তি হলো কিছুটা। নিকাব খুলে বসে আছে সে, যদি হঠাৎ নাফিদ ভাইয়া চলে আসে? শেষে ভেবেচিন্তে নাফিদের ঘরের বিপরীত দিকে মুখ করেই খেতে বসলো।

খাওয়ার মাঝে মেঘলা হঠাৎ হাতে একটা কাগজ নিয়ে এলো। একটা ছবি একে নিয়ে এসেছে সে।

— খালামনি দেখো কি একেছি?

— কি একেছো? দেখি?

রাইসা তাকিয়ে দেখে মেঘলা একটা বনের ছবি একেছে। সবুজ বন, সবুজ গাছ। কিন্তু কাহিনি হলো, সেই বনের মাঝে একটা পুকুর, সেই পুকুরের পানিও সবুজ। বনের আকাশটাও সবুজ।

— আকাশটা সবুঝ রঙের কেন মেঘলা?

— এই বনে, এইখানে একটা হাতি থাকে। সেই হাতিটা নাক দিয়ে, ওই যে অনেক লম্বা নাক। দেখেছো না হাতির কত্ত লম্বা নাক থাকে? এই যে এত্তো লম্বা…

— হ্যাঁ, শুড় বলে হাতির নাককে।

— হ্যাঁ। ওই শুড় দিয়ে এই পুকুরের পানি নিয়ে ছিটিয়ে দিয়েছে। পরে আকাশে সবুজ রঙ হয়ে গেছে।

— আচ্ছা, এই পুকুরের পানি সবুজ হলো কিভাবে?

— ওই যে, ওই যে পুকুরের পানিতে গাছের পাতা পরেছে না? ওই গাছের পাতার রঙ থেকে পুকুরের পানি সবুজ হয়ে গেছে। বুঝেছো?

— হ্যাঁ, বুঝেছি বুঝেছি।

…..

ঘড়িতে সাড়ে দশটার একটু বেশি বাজে। খেয়ে দেয়ে সোফায় বসে গল্প করছিলো রাইসা, তখন ফোন বেজে উঠলো। তিন্নি কল দিয়েছে। হাসিমুখে কল রিসিভ করলো রাইসা।

— আসসালামু আলাইকুম। কি রে তিন্নি কি খবর?

— ওয়ালাইকুমুসসালাম। দিশার পেইন উঠেছে। হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছে ওকে।

— হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছে? তুই কি যাবি এখন?

— হ্যাঁ বেরোচ্ছি আমি। তুই আসছিস?

— হ্যাঁ আসছি।

তিন্নির সাথে কথা শেষ করে ফোনটা রাখলো রাইসা।

— কাকে হসপিটালে নিচ্ছে? কি হয়েছে?

রাইসার চাচির কন্ঠে উৎকন্ঠা।

— আমার বান্ধুবি দিশার বাবু হবে, ওকে হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছে। আমিও যাচ্ছি।

নিকাব বাধতে বাধতে বললো রাইসা।

রাইসা বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর নাফিদ ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। মাত্রই ঘুম ভেঙেছে তার। ঘুমুঘুমু চোখে সোফায় গিয়ে বসলো। কোথায় থেকে মেঘলা দৌড়ে এসে নাফিদের হাতে একটা ঘুষি মারলো। নাফিদের চোখ থেকে ঘুম ছুটে গেলো। মলিন মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

— আরে মেঘলা মামনি এসেছে? রোদেলা কোথায়? তোমার আব্বু আম্মু কোথায়?

— রোদেলা আম্মুর কাছে। আম্মু নানুর কাছে। নানু নানার কাছে। নানা নানার আম্মুর কাছে। নানার আম্মু আমার আম্মুর কাছে…

— আচ্ছা আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। তোমার আব্বু আসেনি?

— না আব্বু আসেনি।

নাফিদের দাদির ঘরে সবার আলাপের আসর বসেছে। বাড়ির বর্তমান অবস্থা নিয়ে কি করা যায় সেটা নিয়েই আলোচনা। লাবন্যের সাথে সম্পর্কের অবনতি হওয়ার পর থেকে নাফিদের কেমন এলোমেলো অবস্থা। তারপর ডিভোর্সের পর থেকে সিলেট থাকছে। নাফিদের দাদি চাচ্ছেন নাফিদের আবার বিয়ে দিতে। বাকিরা কিছুটা অমত করলেন উনার কথায়। ছয় মাসও হয়নি ডিভোর্সের। নাফিদ এখন বিয়ে করতে চাইবে কিনা সেটা ওর সাথে আলাপ করতে হবে। নাফিদের দাদিও মত দিলেন, বিয়েটা কিছুদিন পরই হোক, কিন্তু মেয়ে খুজতে শুরু করা যায়।

( চলবে ইনশাআল্লাহ )

বৃষ্টি শেষে
পর্ব – ১৪
আমিরাহ্ রিমঝিম

করিডোরে পাতা চেয়ারে দিশার ছোটবোন দিবাকে মলিন মুখে বসে থাকতে দেখে মনে আশঙ্কা জেগে উঠে রাইসার। দিবার চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে একটু আগেও মেয়েটা কেঁদেছে। তিন্নি দিবার পাশে বসে হাত ধরে আছে, আর নিচু কন্ঠে কিছু একটা বলছে। খারাপ কিছু হলো না তো আবার? দিশা আর ওর বাবু সুস্থ আছে তো? এগিয়ে গিয়ে তিন্নি আর দিবার কাছে গিয়ে দাড়ালো রাইসা।

— আসসালামু আলাইকুম। তিন্নি? দিবা? কি হয়েছে?

রাইসার কন্ঠ শুনে দিবা এবার মাথা তুলে তাকিয়ে মৃদু হাসে। তিন্নি হেসে বলে,

— ওয়ালাইকুমুসসালাম। মেয়ে হয়েছে।

— আলহামদুলিল্লাহ। যদিও আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম সব ঠিকঠাক আছে কিনা। দিশা, দিশার বাবু সুস্থ আছে?

— হ্যাঁ। মা, বাবু দুইজনই সুস্থ আছে।

— আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ। দিবা কাদঁছিলো কেন?

— ভয় পেয়েছিলো খুব।

তিন্নি নিজেও ভীষণ ভয় পেয়েছে। দিশাকে হসপিটালে নিয়ে আসার কিছুক্ষণ পরে তিন্নিও এসে পৌঁছেছে। দিশার চিৎকার গুলো সহ্য করা যাচ্ছিলো না। মা হওয়া এতোটাই কষ্ট? দিবা পুরোটা সময় তিন্নির কাছে বসে ওর হাত ধরে কেঁদেছে। দিশার হাজবেন্ডকেও তিন্নি কাঁদতে দেখেছে।

কেবিনের দরজা ঠেলে সাবধানে ভেতরে ঢুকলো রাইসা। একটা বেডে দিশা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে, পাশেই কাথায় মোড়ানো ছোট্ট একটা পিচ্চি ঘুমায়। দিশার চেহারার বিদ্ধস্ত অবস্থা। মনে হচ্ছে ওর উপর দিয়ে ঘুর্ণিঝড়, সাইক্লোন, টর্নেডো সব একসাথে বয়ে গেছে। এমন গভীর ঘুমাচ্ছে যেন দিন দুনিয়ার কোনো খেয়ালই নেই ওর।

আরেকটা খাটে দিশার মা, শ্বাশুড়ি, ননদ আরো কে কে যেন বসে আছে, সবাইকে রাইসা চেনে না। রাইসা আস্তে করে তাদের সালাম জানিয়ে, কুশলাদি জিজ্ঞাসা করে, পিচ্চির একটা ছবি তুলে কেবিন থেকে বের হয়ে চলে আসলো।

— দিশাকে রিলিজ দিবে কবে?

— কিজানি, আজকেও দিয়ে দিতে পারে, নরমাল ডেলিভারি যেহেতু।

বলে তিন্নি বার্গারে একটা কামড় বসালো। ওরা এসেছে একটা শপিংমলে, পিচ্চিটার জন্য কিছু কিনতে। কিন্তু কি কেনা যায় ঠিক করতে না পেরে খাবার খেতে বসে গেছে। কিন্তু এখনো দুইজনে ঠিক করে উঠতে পারেনি যে বাবুর জন্য কি কিনবে। বিল পে করার সময় আবারো তিন্নি প্রশ্নটা করলো,

— দিশার বাচ্চার জন্য কি কেনা যায়? ভেবেছিস কিছু?

— জামা নিলে কেমন হবে?

দোকানে কাজ করা এক কম বয়সী মেয়ে ফট করে বললো,

— হ্যাঁ আপু, ফ্রেন্ডের জন্য জামা নিতে পারেন। ওইপাশের দোকানে অনেক সুন্দর সুন্দর ড্রেসের কালেকশন আছে। থ্রি পিস আছে, গাউন আছে, আনারকলি আছে। শাড়িও আছে। দেখে আসেন। পছন্দ হলে আপনারাও নিতে পারেন।

তিন্নি, রাইসা বোকা হয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকালো। একদিনের বাচ্চার জন্য শাড়ি?

রাইসা বললো,

— আমরা তো আমাদের ফ্রেন্ডের জন্য ড্রেস খুজছি না। আমাদের বান্ধুবির আজকে বাবু হয়েছে, মেয়ে বাবু। বাবুর জন্য ড্রেস খুজছি।

দোকানের মেয়েটা লজ্জা পেলো খুব। বোকা হেসে বললো,

— ও আচ্ছা, আসলে আপু আপনারা “দিশার বাচ্চার জন্য” বলছিলেন না তাই ভেবেছিলাম আপনাদের ফ্রেন্ডের জন্যই খুজছেন। দিশার বাচ্চা মানে যে আসলেই দিশার বাচ্চা সেটা বুঝতে পারিনি।

রাইসা, তিন্নি দুইজনের হেসে ফেলে এবার।

….

— আম্মু, দেখো দিশার মেয়ে

বলতে বলতে রাইসা ফোনে বের করা ছবিটা ওর মাকে দেখালো। রাকিবও উঁকি দিয়ে দেখলো ছবিটা।

রাহিব অন্য ঘর থেকে দৌড়ে এলো।

— কি দেখো তোমরা? কার ছবি? দেখি?

রাইসা ফোনটা নিচু করে ধরলো যাতে রাহিব দেখতে পায়।

— এই বাবুটা কে?

— এটা তোমার ওই যে একটা আপু আছে না? ওই যে দিশা আপু? সেই আপুর মেয়ে।

উত্তর দিলো রাইসা।

রাইসার মা ছবিটা ভালো করে দেখার জন্য ফোন হাতে নিলেন।

— মাশা আল্লাহ। কি সুন্দর হয়েছে মেয়েটা। চোখ দুইটা তো মনে হয় পুরোই দিশার মতো হয়েছে। নাম রাখেনি এখনো?

— জানি না আম্মু। দিশার সাথে আজকে আর কথা হয়নি। আমি যখন গেলাম তখন দিশাও ঘুমায়, পিচ্চিও ঘুমায়। পরে দিশার আম্মু আর দিবার সাথেই কথাবার্তা বললাম।

— কি কিনেছিলি পরে দিশার মেয়ের জন্য?

— জামা কিনে দিয়েছি এক সেট, হালকা বেগুনি রঙের। মাশা আল্লাহ অনেক সুন্দর। আমি আর তিন্নি দুইজন মিলেই এক সেট জামা দিয়েছি।

রাইসার মা মেয়ের কথা শুনছেন আর ফোনে পিচ্চিটার ছবি দেখছেন। তবে তার মনে অন্য আরেক চিন্তা ঘুরছে। মেয়ের বান্ধুবির মেয়ে হলো আজকে, কয়দিন পর হয়তো রাইসারও বিয়ে হয়ে যাবে। ছেলে দেখা হচ্ছে। মেয়েটা এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে বড় হয়ে গেলো? এইতো সেদিন রাইসা হলো?

……

নাফিসা চলে গেলে বাড়ি জুড়ে আবারো নিশ্চুপতা নেমে আসে। রাইসার দাদি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। একেতো রাইসার দাদা মারা যাবার পর থেকে সঙ্গীহীন জীবনের শুন্যতা গ্রাস করেছে তাকে, তার উপর নাতির সংসারটা ভেঙে গেলো। নাতিও থাকে এখন সিলেট। আগে সুন্দর ছেলে মেয়ে, নাতি-নাতনিরা কিছুদিন পরপরই আসতো, বাড়িটা ভরে থাকতো। এখন নাতি-নাতনিরা বড় হয়ে গেছে, বেশিরভাগেরই বিয়ে হয়ে গেছে, কত ব্যস্ততা তাদের।

লাবন্যের সাথে নাফিদের ডিভোর্স কেন হলো সেটা কেউই জানে না, দাদিও জানেন না। লাবন্য সবার সাথেই এতো সুন্দর মিশতো, কত ভালো সম্পর্ক ছিলো সবার সাথে। দাদিরও ভালোই লাগতো মেয়েটাকে। শুধু নাফিদের সাথেই কিছুদিন পরপরই কেন ঝগড়া লাগতো বুঝে উঠতে পারেননা তিনি। কোথায় ভেবেছিলেন কিছুদিন পর নাতির ঘরে ছেলে মেয়ে আসবে, তাদেরকে আদর করবেন, তাদের সাথে গল্প করবেন। কিন্তু কি হয়ে গেলো!

— নাফিদের মা….

শ্বাশুড়ির ডাক শুনে রাইসার চাচির ধীরেসুস্থে উনার কাছে গেলেন।

— বলেন আম্মা।

— নাফিদের জন্য রাইসা কেমন হয়?

রাইসার চাচি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান। হুট করে বলা কথাটায় কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবেন বুঝতে পারেন না তিনি। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা হজম করেন তিনি। তারপর মুচকি হাসেন।

— আম্মা, রাইসা তো অনেক ছোট আমাদের নাফিদের চেয়ে। আর সবথেকে বড় কথা নাফিদের আগে একবার বিয়ে হয়েছিলো, তিন-চার বছর সংসার করার পর ডিভোর্স হয়ে গেছে। এমন ছেলের কাছে কোনো রাইসার বাবা নিজের মেয়েকে দিবে? যতই ভাইয়ের ছেলে হোক।

রাইসার দাদির মুখটা চুপসে গেলো। উনার চুপসানো মুখ দেখে রাইসার চাচি শ্বাশুড়ি বললেন,

— তাও আমি নাফিদের বাবার সাথে কথা বলে দেখবো।

রাইসার দাদি খুশি হলেন খুব।

— ঠিক আছে। তুমিও বলো। আমিও বলবো।

শ্বাশুড়ির সাথে কথা বলার পর রাইসার চাচি বিষয়টা নিয়ে ভাবতে লাগলেন। এরকম কিছু উনার মাথাতেই আসেনি। রাইসাকে উনারও খুব ভালো লাগে। কি শান্ত মেয়েটা! দেখলেই ভালো লাগে। রাইসার সাথে নাফিদের বিয়ে হলে ভালোই হবে হয়তো, যদিও রাইসার বাবা এ ব্যাপারে রাজি হবেন তার সম্ভাবনা খুবই কম।

( চলবে ইনশাআল্লাহ )

বৃষ্টি শেষে
পর্ব – ১৫
আমিরাহ্ রিমঝিম

রাইসার বাবার মন কিছুটা খারাপ। বেশ ভালো একটা ছেলের সন্ধান পেয়েছিলেন। বেশ ভালো বলতে ছেলে বেশ ভালো চাকরি করে, ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো। ছেলের আচার-ব্যাবহার সন্তোষজনক, দেখতেও খারাপ না। ছেলে আবার নামাজ পড়ে ঠিকমতো, যেমনটা রাইসা চায়। রাইসার অবশ্য চাওয়া ছিলো সুন্নতি দাড়ি থাকতে হবে। এই ছেলের আবার খোচা দাড়ি, তবে ইসলাম মানে মোটামুটি সব জায়গাতেই যতদূর তিনি খোঁজ নিয়েছেন।

রাইসার বাবার আশা ছিলো এই ছেলের কথা রাইসা না করবে না। এই পর্যন্ত চারজন ছেলের শুধু বর্ণনা শুনেই রাইসা দেখতে আসতেও মানা করে দিয়েছে। যখনই শুনেছে ছেলে ইসলাম পালনে খামখেয়ালি, সাথে সাথে অমত জানিয়েছে। কিন্তু এই ছেলের কথা রাইসাকে জানানোর আগেই ছেলেরাই মানা করে দিয়েছে।

রাইসা নাকি যথেষ্ট সুন্দর না! এমন কথাও শুনতে হলো উনাকে? হ্যাঁ রাইসা হয়তো ফর্সা না, রাইসার চেহারার আকৃতিও মিষ্টি না। তাই বলে তার মেয়ের কাদামাটি রঙের শান্ত মুখটায় তারা কি কোনোই মায়া খুঁজে পেলো না? উনার কাছে তো নিজের মেয়েকে রূপকথার রাজকন্যার মতোই সুন্দর লাগে।

কিছুদিন আগে সে ছেলের মা, বোন আর ফুপি মিলে রাইসাকে দেখে গেছে। রাইসা অবশ্য ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি তারা ওকে দেখতে এসেছে। রাইসা ভেবেছে কোনো প্রতিবেশি হয়তো। রাইসাকে দেখে গিয়ে সেদিনই ফোন করে কথা আগানোর ব্যাপারে না করে দিয়েছেন উনারা। ছেলের জন্য আরো সুন্দর মেয়ে চাই তাদের।

……

দিশার মেয়ের নাম শোভা। দুই মাস হয়েছে এখন। দুই মাসেই আগের চেয়ে মাশা আল্লাহ কত বড় হয়ে গিয়েছে। রাইসা আর তিন্নি যে জামাটা কিনে দিয়েছিলো পিচ্চিকে সেটাও এখন আর হয়না শোভার। ছোট বাচ্চারা কত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায়!

শোভা হওয়ার পর থেকে দিশা ওর বাবা মায়ের কাছেই আছে। তবে আর কিছুদিন পরেই চলে যাবে। রাইসা আর তিন্নি এসেছে দিশা আর ওর পিচ্চিকে দেখতে। পিচ্চির সাথে খেলতে খুব মজা লাগছে রাইসার। পিচ্চিটাকে কোলে নিতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু তিন্নি শোভাকে রাইসার কাছে দিচ্ছে না। সেই কখন থেকে নিজে কোলে নিয়ে বসে আছে আর দুনিয়ার হাবিজাবি বকবক করছে শোভার সাথে। শোভা কি বুঝছে কে জানে? শুধু হাত পা নাড়ছে আর মাঝে মাঝে অ-অ আওয়াজ করছে।

চা নাস্তা খেতে খেতে দিশার সাথে গল্প শুরু করলো রাইসা আর তিন্নি, শোভা তখন ঘুমায়। দিশার শরীর এখন কেমন, শোভা কেমন বিরক্ত করে, এখানে আর কয়দিন আছে – এইসব টুকিটাকি নিয়ে গল্প।

টুকিটাকি বিষয় নিয়ে গল্প শুরু হলেও গল্পের বিষয় টুকিটাকিতে থেমে রইলো না। পড়ালেখা, পরীক্ষা, দিশার শ্বশুড়বাড়ি, রাইসা আর তিন্নির বিয়ে নিয়ে ভাবনা, স্কুল কলেজ জীবনের স্মৃতি কত কিছু নিয়ে যে কথা হলো। গল্প করতে করতে কোন বিষয় যে কোথায় গিয়ে দাড়ালো খেয়াল রইলো না কারোই।

হঠাৎ শোভার কান্নায় তিনজনের খেয়াল হলো গল্প করতে করতে দুই ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। স্কুল কলেজের সময়গুলোর মতো গল্প করছিলো তিনজন। কোনদিক দিয়ে যে এতটা সময় চলে গেলো টেরই পায়নি কেউ।

…….

রাইসার চাচা আজ এসেছেন রাইসাদের বাসায়। ছোটভাইয়ের খোঁজ খবর নেয়া ছাড়াও ভাইয়ের বাসায় আসার পেছনে উনার আরেকটি উদ্দেশ্য আছে। নিজের স্ত্রী আর মায়ের বারবার বলা কথা ফেলতে না পেরে আজ উনি এসেছেন রাইসার বাবার কাছে, যদিও জানেন বিফল হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগের কাছাকাছি।

একথা-সেকথা বিভিন্ন কিছু নিয়ে আলাপ করার পর আসল প্রসঙ্গ তুললেন তিনি।

— আসলে, কিভাবে যে কথাটা বলি তোমাকে। মা আর নাফিসার মা এতোবার করে বললো…

রাইসার বাবা উৎসুক চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

— আসলে নাফিদের তো আবার বিয়েশাদির কথা ভাবতে হবে। আমরাও চিন্তাভাবনা শুরু করেছি এই বিষয়ে। মা ভাবছিলেন যে, মানে, রাইসার জন্য নাফিদকে কেমন লাগে তোমার?

রাইসার বাবার চেহারা ধপ করে নিভে গেলো। ছেলে হিসেবে নাফিদ বেশ ভালো, তাই বলে একজন ডিভোর্সি ছেলের কাছে তিনি মেয়েকে কিভাবে বিয়ে দেন?

আড়াল থেকে সব কথাই কানে গিয়েছে রাইসার। ও গিয়েছিলো খালি ট্রে নিয়ে আসতে। এটুকু শোনার পর আর ঘরে ঢুকলো না, নিজের ঘরে চলে আসলো। এখন যদি সে সেই তের বছরের রাইসা হতো তবে হয়তো খুশিতে আত্মহারা হয়ে যেত। কিন্তু সে তো আর সেই তের বছরের রাইসাটি নেই, বুঝতে শিখেছে এখন অনেক কিছুই। রাইসা জানে ওর বাবা মানা করে দিবে, আর এখানে দাঁড়িয়ে এই কথাগুলো না শুনলে এসব ওর কান পর্যন্ত আসতোও না। রাইসার তবুও খুবই অপ্রস্তুত লাগছে। নাফিদ ভাইয়া ডিভোর্সি এটা নিয়ে রাইসার আপত্তি এমনটা নয়, নাফিদকে ও সেভাবে ভাবতেই পারছে না। কি একটা অস্বস্তিকর ব্যাপার।

রাইসার বাবা পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলেন, নিজের চিন্তাগুলিকে দূরে সরিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুললেন। শান্ত কন্ঠে বললেন,

— ভাই, নাফিদ অনেক ভালো ছেলে, যারাই ওকে চেনে কেউ এই কথা অস্বীকার করতে পারবে না আমার বিশ্বাস। কিন্তু আমি কিভাবে রাইসাকে নাফিদের কাছে দেই আপনিই বলুন?

রাইসার চাচা শুধু চুপ করে উপর নিচে মাথা নাড়ালেন।

……

— ভাই কিভাবে রাইসার জন্য নাফিদের কথা বলতে পারলেন?

রাইসার মায়ের কন্ঠে একরাশ অভিযোগ। রাইসার বাবা তাকে শান্ত করতে বললেন,

— মেয়ে যদি এতো ভালো হয়, নিজের ছেলের জন্য সেই মেয়েকে তো চাইবেই।

— তাই বলে একটা বুঝ আছে না? নাফিদের বিয়ে হয়েছিলো, ডিভোর্স হয়ে গেছে। সেই ছেলের কাছে রাইসাকে কেন দিবো? তাছাড়া নাফিদ কত বড় ওর চেয়ে।

— তা ঠিক আছে, কিন্তু নাফিদ তো ছেলে হিসেবে খারাপ না। নামাজ কালাম পড়ে, আচার-ব্যবহার ভালো, দেখতে শুনতে ভালো, ভালো ইনকামও করে। আর ডিভোর্স হয়ে গেছে বলে কি আরেক ডিভোর্সিকেই বিয়ে করতে হবে নাকি?

— তুমিও কি এখন চাইছো নাফিদের সাথে রাইসার বিয়ে দিতে?

রাইসার বাবা বিপাকে পরে গেলেন।

— আরে না না। আমিতো তোমাকে বুঝানোর চেষ্টা করছিলাম, তুমি রেগে ছিলে তাই।

রাইসার মা চুপ করে গেলেন।

( চলবে ইনশাআল্লাহ )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here