বৃষ্টি শেষে
পর্ব – ১৬,১৭,১৮
আমিরাহ্ রিমঝিম
পর্ব – ১৬
সেমিস্টার ফাইনালের শেষ পরিক্ষা দিয়ে হল থেকে বের হয়ে রাইসা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। যাক, এখন কিছুদিন অন্তত শান্তিতে থাকা যাবে।
— কিরে রাইসা, পরিক্ষা কেমন হলো?
রাইসার ক্লাসের এক বান্ধবি প্রশ্নটা করে। ওর প্রশ্ন শুনে পাশে থেকে আরেকজন বলে উঠলো,
— পরিক্ষা কেমন হলো সেটা বড় কথা না, পরিক্ষা শেষ হয়েছে এটাই বড় কথা।
সবাই এই কথার সাথে একমত প্রকাশ করে। রাইসার প্রথম বান্ধুবি আবার বলে,
— পড়ালেখার প্রসঙ্গ বাদ, ঠিক আছে? আচ্ছা রাইসা তোর নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে?
— বিয়ে ঠিক হয়নি, বিয়ের জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে।
— ওইতো একই কথা। তোর জন্য ছেলে খুজছে তো?
— সেই এক দেড় বছর আগে থেকেই তো খুজছে।
— হুম্মম্মম্ম…. বিয়ের দাওয়াত পাবো কবে? বলো বলো?
— বিয়ে ঠিকঠাক হলে দাওয়াত পেয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
……
বাড়ির পথে ফিরতে ফিরতে ধপ করেই রাইসার মন কিছুটা খারাপ হয়ে যায়। বান্ধবিকে মজা করে বললো তো যে বিয়ে ঠিকঠাক হলে দাওয়াত পেয়ে যাবে, কিন্তু বিয়েটা ঠিক হবে কিভাবে? ছেলেপক্ষ থেকে তো রাইসাকে পছন্দই করে না। এ পর্যন্ত অনেক ছেলে দেখা হয়েছে রাইসার জন্য, কোনোবারই দেখাদেখির পর আর কথা আগায় নি।
এমন নয় যে রাইসা বিয়ের জন্য মরিয়া হয়ে গেছে, বিয়ে না করতে পারলে তার জীবন বৃথা হয়ে যাবে। আল্লাহর ফয়সালার উপর সন্তুষ্ট সে। তার তাকদীরে বিয়ে না থাকলে হবে না বিয়ে, এটা নিয়ে রাইসার কোনো অভিযোগ নেই। ওর যেটা ভাবলে খানিকটা মন খারাপ হয় তা হলো, এতগুলো প্রস্তাবের মধ্যে কারোরই কি রাইসাকে একটুও পছন্দ হলো না? যারা ওকে দেখতে এসেছে সবাই বলেছে রাইসা খুব ভালো মেয়ে, ওর আচার আচরণ চমৎকার। তাহলে কারোই কি এটা মনে হলো না যে চেহারার দিকে কমতি থাকলেও আচরনের কারণে রাইসার কথা বিবেচনা করা যায়?
বাস থেকে নেমে নিজের মন খারাপ গুলিকে ঝেটিয়েই বিদায় করে দিলো রাইসা। কারো যদি ওকে দেখতে ভালো না লাগে তাহলে তো আর জোর করে ভালো লাগানো যাবে না। রাইসা নিজের ক্ষেত্রেই ভাবে, যাকে দেখতে একদমই ভালো লাগবে না তাকে কি রাইসা বিয়ে করতে চাইবে? যদিও উত্তরটা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে তবু এই মুহূর্তের উত্তর হলো যে চাইবে না। এটাই সত্যি। এ পর্যন্ত সব ছেলেপক্ষের ক্ষেত্রেই হয়তো এটাই হয়েছে। কারো রাইসাকে একটুও ভালো লাগেনি, একটুও না।
রাইসা বুঝলো ওর আবারো মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। নিজের উপর নিজেরই কিছুটা বিরক্ত লাগলো এবার। অন্যকিছু ভাবতে হবে। আচ্ছা কয়েকদিন তো ক্লাস পড়া কিছু নেই, তাহলে এই কয়দিন কি কি করা যায়? রান্না শিখবে নতুন? নাকি ঘোরাঘুরি করবে এই কয়দিন?
…….
নাফিদ বাসায়ই আছে এখন। দুই সপ্তাহের ছুটি নিয়েছে।
গত সপ্তাহে বাসায় আসার পর থেকেই ভীষণ জ্বর ছিলো। সেই জ্বর ছেড়েছে চারদিন পর। এরপর দুই তিনদিন গেছে জ্বরের রেশ কাটতে। গতকাল থেকে ভালো বোধ করছে নাফিদ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে ভেজা হাত মুখ মুছতে মুছতে আনমনে বাইরে তাকালো।
কেন জানি আর সিলেট যেতে ইচ্ছা করছে না তার। এইবার যে এসে এতোদিন থাকছে এতে নাফিদের মায়ের যেন খুশি ধরে না। জ্বরের কারণে নাফিদকে ভালোমন্দ খাওয়াতে পারেননি এটা নিয়ে উনার আফসোসের কমতি নেই। নাফিদের বাবা আর দাদির চেহারাই বলে দেয় উনারা কতটা খুশি। এতোদিন পর নিজের বাসায়, নিজের ঘরে শান্তিমতো থাকতে পেরে নাফিদেরও খুব ভালো লাগছে।
হয়তো তার জীবন নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসে গেছে। নাফিদের দাদি তো সেই কত মাস আগে থেকে নাফিদকে বিয়ের জন্য বলছে। এমনকি বাবাকে দিয়ে চাচার কাছে রাইসাকে পর্যন্ত চেয়েছে ওর জন্য!
এই কথা নাফিদ প্রথম যখন জানতে পেরেছিলো বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলো। কি প্রতিক্রিয়া জানাবে বুঝতে পারছিলো না। তবে এই কথা শোনার কয়েক সেকেন্ড পর রাগ আর বিরক্তি ভর করেছিলো মনে, যদিও চেহারায় বা আচরণে নাফিদ সেটা প্রকাশ করেনি। নিজের রাগ, বিরক্তি কখনোই বাবা মা বা শ্রদ্ধাভাজন কাউকে দেখায় না নাফিদ। শুধু শান্ত কন্ঠে বলেছিলো চাচার কাছে এই কথা বলার আগে নাফিদকে জানালে ভালো হতো।
এমন নয় যে রাইসাকে সে পছন্দ হবার মতো বলে মনে করে না। রাইসা যথেষ্ট ভালো মেয়ে। আগে ইসলামের অনেক কিছুই নাফিদ জানতো না, বুঝতো না, পালন করা হতো না। এখন যথাসম্ভব চেষ্টা করে ইসলাম পালন করতে। তাই রাইসার কদর সে বুঝে। কিন্তু রাইসাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে ভাবতে পারে না নাফিদ।
নাফিদ ঠিক করলো এবার বাসার সবাই যেটা চাইছে সেটাই হবে। মেয়ে দেখতে বলবে তার জন্য। দ্বিতীয়বার বিয়ের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিবে সে।
……
রাতে রাকিব আর রাহিবকে পড়াচ্ছিলো রাইসা। রাহিবকে স্কুলের হোমওয়ার্ক করতে বসিয়ে দিয়ে রাকিবকে হায়ার ম্যাথ বোঝাচ্ছিল। এমন সময় রাইসার বাবার ডাক পরে।
— রাইসা, মা একটু এদিকে এসোতো।
বাবার কন্ঠ শুনে রাইসার মনে হলো গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিয়ে তিনি আলাপ করতে চান। রাকিবকে ম্যাথ করতে বলে রাইসা ওর বাবা মায়ের ঘরে গেলো।
— বলো আব্বু।
— ইমদাদের বাসা থেকে পরশুদিন আসতে চাচ্ছে। এ ব্যাপারে তুমি কি বলো?
রাইসা কিছুক্ষণ বোকার মতো তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করলো,
— ইমদাদ কে?
— গতমাসে যে তোকে দেখতে আসলো, তোর পরীক্ষা শুরুর কিছুদিন আগে।
রাইসার মা উত্তর দিলেন।
এবার রাইসার মনে পড়লো। পরীক্ষা শুরুর কিছুদিন আগে ইমদাদ নামের এক ছেলে আর তার পরিবার দেখতে এসেছিলো ওকে। রাইসা পাত্র ছাড়া সে পরিবারের আর কোনো ছেলের সামনে যাবে না, এটা আগে থেকে তাদের জানিয়ে দেয়ার পরও ইমদাদের বাবার সামনে যাওয়ার জন্য রাইসাকে অনেকবার করে বলেছিলো। শেষমেশ রাইসা সত্যি না যাওয়ায় বেশ মনোঃক্ষুন্ন হয়েছিলো ইমদাদ বাদে তারা সবাই। রাইসা তাদের বোঝাতেই পারেনি বিয়ে হলে তখন নয় ইমদাদের বাবা তার শ্বশুড় হবে, তখন তার সামনে যাওয়া যাবে কিন্তু এখন তো তিনি কিছু হন না রাইসার।
এক ইমদাদ বাদ দিলে সেই পরিবারে পছন্দ হওয়ার মতো কিছু নেই। কিন্তু এখন তারা আবার কেন আসতে চাচ্ছে? দেখে যাওয়ার পর তো বলেছিলো তারা আরো মেয়ে দেখবে। মনে জেগে উঠা প্রশ্নটা করেই ফেললো রাইসা।
— তারা আবার আসতে চাচ্ছে কি কারণে?
গলাটা একটু পরিষ্কার করে রাইসার বাবা উত্তর দিলেন,
— তারা সম্বন্ধটা নিয়ে আবার ভাবছেন। যতদূর মনে হচ্ছে উনারা আগাতে চাচ্ছেন। বিয়ে হবে কি হবে না সেটা তারা আরো ভাববেন, আমরাও ভেবে আমাদের সিদ্ধান্ত জানাবো। এখন বলো, পরশু কি আসতে বলবো উনাদের?
রাইসা চুপ করে কয়েক মুহূর্ত ভাবলো। তারপর মৃদু কন্ঠে বললো,
— আমার কোনো সমস্যা নেই।
— ঠিক আছে মা, তুমি যাও এখন।
বাবা মায়ের ঘর থেকে বের হয়ে রাইসা নিজের ঘরে চলে এলো, রাকিব-রাহিবকে পড়াতে গেলো না। ঘরের লাইট না জ্বালিয়ে অন্ধকারেই খাটের উপর বসে রইলো। অদ্ভুত লাগছে ওর। ভালো লাগা, ভয়, দ্বিধা, আশংকা – সব মিলিয়ে মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে রাইসার।
( চলবে ইনশাআল্লাহ )
বৃষ্টি শেষে
পর্ব – ১৭
আমিরাহ্ রিমঝিম
আগের বার ইমদাদের পরিবার থেকে রাইসাকে দেখতে ছয়জন এসেছিলো, এবার এসেছে ছাব্বিশজন। চাচা-মামা, ফুপু-খালা, চাচাতো-ফুপাতো-মামাতো-খালাতো ভাই বোন কারো আর আসতে বাকি আছে বলে মনে হয় না। এদের মধ্যে একদম ছোট বাচ্চাও আছে দুই তিন জন। বাচ্চারা বেশ শোরগোল করছিলো বলে তাদের অন্য ঘরে খেলতে দেয়া হয়েছে। সেখানে এখন ছোট বাচ্চারা আর রাহিব খেলছে। রাকিবকে এদের দেখে রাখার দায়িত্বে দেয়া হয়েছে। বাকি বড়রা ড্রয়িং রুমে এটা সেটা নিয়ে আলাপ করছে রাইসার বাবা, চাচা আর মামাদের সাথে।
নাফিদ সেখানে বসে চুপচাপ তাদের আলাপ শুনছে। নিজে আলাপে যোগ দেয়ার বিন্দুমাত্র আগ্রহবোধ করছে না।
রাইসাদের বাসায় আসতে চায়নি নাফিদ। যদিও নাফিদের দাদি বলেছিলেন ওর জন্য যে রাইসাকে চাওয়া হয়েছিলো সেকথা রাইসাকে বলেনি কেউ, তবু ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল আসতে। শেষ পর্যন্ত বাবা বারবার বলায় আসতে হয়েছে।
নাফিদ চুপচাপ বসে ইমদাদকে পর্যবেক্ষন করে। গায়ের রঙ শ্যামলা, তবে রাইসার চেয়ে কম শ্যামলা। তবে রাইসার গায়ের রঙ যেরকম মেটে, মলিন, এই ছেলের আবার তা নয়। উজ্জ্বল শ্যামলা বর্নের সাধারণ চেহারা। চেহারায়, আচরণে বিনীত ভাব। ছেলেটা মনে হয় কথাবার্তা কমই বলে, শান্ত স্বভাবের বলেই মনে হচ্ছে। রাইসার জন্য এই ছেলে খারাপ হবে না।
নাফিদের খেয়াল হয়, সে নিজেও কতটা চুপচাপ হয়ে গেছে। একটা সময় চঞ্চল ছিলো খুব। আর তার এক উচ্ছল সাথীও ছিলো। একসাথে পথ চলতে শুরু করেছিলো দুইজন। তারপর তো……..
হৃদয়ের গভীরে কোথাও একটা ব্যাথা অনুভূত হয়।
— নাফিদ….
বেশ জোরে ডাকটা শুনে নাফিদ সচেতন হয়ে তাকিয়ে দেখে ঘরের সবাই তার দিকেই তাকিয়ে আছে। নিজের খেয়ালে এতোটাই ডুবে ছিলো যে ইমদাদের বাবা যে তাকে এতোবার ডেকেছেন তার কোনোটাই নাফিদের কানে যায় নি। নিজেকে সামলে নিয়ে নাফিদ জবাব দেয়।
— জ্বী আংকেল?
— বোনের বিয়ে নিয়ে পেরেশান নাকি? এতোবার ডাকলাম শুনতেই পেলে না? এতো চিন্তা বোনের জন্য?
উনারা যখন রাইসাকে আবারো দেখতে আসতে চাইলো তখন রাইসার বাবা ভেবেছিলেন উনারা হয়তো রাইসাকে নিয়ে আরেকবার ভাবছেন, আবার দেখে গিয়ে নিজেরা আলোচনা করে বিয়ের ব্যাপারে মত দেবেন। কিন্তু উনাদের বাসা থেকে এতো সংখ্যক লোক আসবে জানার পর রাইসার বাবার মনে হয়েছিলো উনারা নিজেরা আলোচনা করেই এসেছেন, আবার দেখতে আসাটা শুধু ফরমালিটি। এখন ইমদাদের বাবার কথা তো উনার এই ধারণাকেই সমর্থন করছে। উনারা হয়তো আজকেই বিয়ের ব্যাপারে মত জানিয়ে যাবেন।
রাইসার বাবার চিন্তাই সঠিক হলো। খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হলে ইমদাদের বাবা বললেন,
— ভাই, তাহলে আমরা এখন আসল কথায় আসি। রাইসা অত্যন্ত ভালো মেয়ে। এতো নম্র, ভদ্র, আচার-ব্যবহার ভালো মেয়ে, তাকে ছেলের বউ কে না বানাতে চাইবে? আমার ছেলেও রাইসাকে বেশ পছন্দ করেছে। এখন আপনাদের আপত্তি না থাকলে রাইসা আর আমাদের ইমদাদের বিয়ের ব্যপারে পাকা কথা বলাই যায়।
এমন কিছু শোনার জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন তিনি। তবে বিয়ের ব্যাপারে চূড়ান্ত মতামত দেয়ার আগে সবার সাথে, রাইসার সাথে আলোচনা করে নেয়া প্রয়োজন। মেয়ের জীবনের অনেক বড় একটা ব্যাপার এটা। তাই কিছুটা সময় চাইলেন তিনি।
— শুনে খুশি হলাম ভাই। ইমদাদও তো ছেলে হিসেবে খুবই ভালো। তার কাছে মেয়ে দিতে কে আপত্তি করবে। কিন্তু বিয়ের মতো এতো বড় একটা ব্যাপারে তো আর হুট করে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। পাকা কথা দুই চারদিন পরে হলেও তো ক্ষতি নেই।
খাওয়ার পরপরই নাফিদ বেরিয়ে গিয়েছিলো বাসায় ফেরার জন্য। নাফিদের মা আর দাদি ছাড়া বাড়িতে আর কেউ নেই, এদিকে রাত বাড়ছে। আর রাইসার বাবার হাবেভাবে মনে হচ্ছে না আজকে তিনি তার ভাইকে ফিরতে দেবেন। সেজন্য আগেভাগেই বেরিয়ে এসেছিলো নাফিদ।
গাড়িতে বসে তখনকার কথা মনে পড়ে গিয়েছিলো নাফিদের। এভাবে আনমনা হয়ে গিয়েছিলো কেন তখন? ডিভোর্সটা নিয়ে সে কষ্ট পেতে পারে, কিন্তু আফসোস কেন থাকবে? তার তাকদীরে আল্লাহ এটাই রেখেছিলেন। এখন সে সামনের দিকে তাকাবে, পেছন নিয়ে পরে থাকবে না।
ভাবনার মাঝখানে ফোন বেজে উঠায় গাড়ি আর স্টার্ট দেয়া হলো না। অনেকদিনের পুরনো বন্ধুর কল। গাড়ি থেকে বেরিয়ে বাড়ির সামনে দাড়িয়ে ঘন্টাখানেক কথা বলার পর যখন কথা শেষ হলো তখন ইমদাদের পরিবার বের হয়ে চলে যাচ্ছে। আবছা আলোর কারণে তারা কেউই নাফিদকে খেয়াল করেননি।
সবার শেষে বের হওয়া তিন চারজন মহিলার আলাপ নাফিদ স্পষ্ট শুনতে পেলো। একজন আরেকজনকে বলছে,
— মেয়ে তো একটুও সুন্দর না। ইমদাদ কি দেখে ওরে পছন্দ করলো আর ইমদাদের আব্বাই বা কি মনে করে এই বিয়েতে রাজি হলো?
— আরে ইমদাদের আব্বা তো প্রথমে রাজি ছিলেন না। ইমদাদরে যত মেয়েই দেখায় সব না করে দেয়। নিজে হুজুর তো, ওর নাকি হুজুর মেয়ে লাগবে। পরে এই মেয়েরে দেখে হ্যাঁ বলছে। ইমদাদের আব্বা রাজি হয়েছে কারণ এই মেয়ের বাবার ভালো সহায়-সম্পত্তি আছে।
— তাই বলে এইরকম একটা মেয়ে? একটু যদি সুন্দর হইতো। আর তার উপর দেখলেন ইমদাদের আব্বার সামনে গেলো না, এর আগের দিনও নাকি যায় নাই। কি যে…..
বাকি কথাগুলো আর শুনতে পেলো না নাফিদ, ততক্ষণে তারা বেশ খানিকটা দূরে চলে গিয়েছে। সেখান থেকে আর কথার আওয়াজ আসছে না।
রাইসার বাবা সত্যিই রাইসার চাচাকে যেতে দেন নি। এই প্রস্তাবের ব্যাপারে আলোচনার জন্য উনাকে রেখে দিয়েছেন। রাইসার মামা-মামীও যারা এসেছিলেন সবাই রয়ে গেছেন।
ড্রয়িংরুমে বিস্তর আলোচনা চলছে। মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে চলবে এই আলোচনা। রাইসার বাবা-মা, চাচা, মামা-মামীরা আছেন সেখানে। রাহিব ঘুমিয়ে গেছে। রাকিব মেহমানদের আনা মিষ্টি, মেহমানদের জন্য বানানো নাস্তা সব খাচ্ছে একের পর এক।
রাইসা এশার নামাজ পড়ে ঘরের লাইট নিভিয়ে দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। আকাশে চাঁদ নেই আজ, অনেকগুলো তারা মিটমিট করছে। শরীর শীতল করা বাতাস বইছে বাইরে, সেই বাতাস এসে রাইসার গায়েও লাগছে।
( চলবে ইনশাআল্লাহ )
বৃষ্টি শেষে
পর্ব – ১৮
আমিরাহ্ রিমঝিম
ইমদাদের সম্পর্কে সব খোঁজ খবর রাইসার বাবা আরো আগেই নিয়েছিলেন, সেখানে খারাপ কিছু দেখেননি। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান ইমদাদ বেশ সরল-শান্ত প্রকৃতির। রাইসাও ইমদাদের ব্যাপারে আপত্তি করেনি। কিন্তু রাইসার বাবার চিন্তা অন্য জায়গায়। ইমদাদের পরিবারের বাকিরা কেউই ইসলাম মানতে ততটা আগ্রহী নয়, তাদের সাথে থাকতে রাইসার বেশ কষ্ট হতে পারে। এছাড়াও ইমদাদ বাদে তাদের মধ্যে আর কেউই যে রাইসাকে দেখে পছন্দ করেনি সেটা তিনি গতবারই বুঝে গিয়েছেন। তারা রাইসাকে আবার দেখতে এসেছে শুধুমাত্র ইমদাদের কারণে।
রাইসার বাবা কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। এমনিতে ইমদাদকে নিয়ে তো কোনো সমস্যা নেই। ইসলাম মানে, ভালো চাকরি রয়েছে, দেখতে মোটামুটি। কিন্তু ইমদাদের পরিবারের কি করবেন তিনি? তাদেরকে খুব একটা ভালো লাগছে না। এখন কি এখানেই রাইসার জন্য কথা আগাবেন, নাকি আরো ছেলে খুজবেন?
অবশেষে সবার সাথে বিস্তর আলোচনার পর রাইসার সম্মতি নিয়ে ইমদাদের পরিবারকে পাকা কথার জন্য আসতে বললেন তিনি। ঠিক হলো, দুই মাস পরেই বিয়ে হবে রাইসা আর ইমদাদের।
…….
রাইসা আগেভাগেই সাফ জানিয়ে দিয়েছে বিয়েতে গায়ে হলুদ হবে না, কোনো গান-বাজনা হবে না। আর বিয়েতে, ওয়ালিমায় রাইসা সেজেগুজে স্টেজে গিয়ে বসে থাকবে না। ছেলে আর মেয়েদের জায়গা আলাদা করা থাকবে কমিউনিটি সেন্টারে। আর যখন সবার সামনে যাওয়া দরকার হবে তখন বোরকা নিকাব পরে যাবে। কনের ছবিও তুলতে পারবে না কেউ।
রাইসা ভেবেছিলো এসব নিয়ে ইমদাদের পরিবার তুমুল ঝামেলা করবে, রাজি হতে চাইবে না তারা। কিন্তু এমন কিছুই হলো না, কারণ ইমদাদ নিজেও এরকমই চাইছিলো। নাহলে বেশ সমস্যায় পড়তে হতে পারতো রাইসার।
ধীরে ধীরে বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসতে থাকে। রাইসার দিন কাটে অস্থিরতায়। অদ্ভুত অনুভূতি খেলা করে মনে। ইমদাদকে ভালোই লাগে রাইসার। নতুন জীবন শুরু করা নিয়ে রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয়। আবার নতুন পরিবেশ কেমন হবে তা নিয়ে ভয়ও লাগে। বাবা-মা, আদরের দুইজন ভাইকে ছেড়ে কিভাবে থাকবে এসব ভেবে কান্নাও পায়।
রাইসা বাদে সকলেই তুমুল ব্যাস্ত। মাত্র দুই মাসের মধ্যে বিয়ের সব আয়োজন সম্পন্ন করতে হবে। রাইসার বাবা আয়োজনের কোনো ত্রুটি রাখতে চান না, তার অতি আদরের মেয়েটার বিয়ে।
……..
নানান রঙের অজস্র কৃত্রিম ফুল দিয়ে সেজেছে বিশাল কমিউনিটি সেন্টার। আলোয় আলোয় চারিদিক ঝলমল করছে। বাহারি পোশাকে সজ্জিত মানুষজন দিয়ে ভর্তি হয়ে আছে বিশাল ঘরটা।
মেয়েদের জন্য আলাদা করা অংশে বউ সেজে বসে আছে রাইসা। স্বস্তি পাচ্ছে না একটুও। কিছুক্ষণ আগেই বরযাত্রী চলে এসেছে, আর আসার পর থেকেই কিছু না কিছু নিয়ে ঝামেলা লাগছেই। এর এটা পছন্দ হচ্ছে না, আবার তার সেটা পছন্দ হয়নি। আবার আগে থেকেই মানা করা সত্ত্বেও মেয়েদের অংশে বরযাত্রার ছেলেরা ঢুকে পরার চেষ্টা করছিলো রাইসাকে দেখার জন্য। তারা তো ভেতরে ঢুকতে পারেনি, কিন্তু মেয়েরা যারা এসেছে তারা অনেকেই রাইসার ছবি তুলতে চেয়েছে। তাদেরকেও মানা করতে হচ্ছে বারবার। তাও হয়তো দুই একজন রাইসার ছবি তুলে ফেলেছে। নানান বিরক্তি আর অস্বস্তিতে রাইসার মুখ মলিন হয়ে আছে, সৌজন্য হাসিটুকুও আসছে না মুখে।
বরপক্ষের চার-পাঁচজন মেয়ে বারবার নাফিদের সাথে গল্প জমানোর চেষ্টা করছিলো। নাফিদের সাথে সেলফিও তুলতে চেয়ে বসে। প্রচন্ড বিরক্ত হলেও মুখভঙ্গি স্বাভাবিক রেখে ভদ্রভাবে তাদের মানা করে দিয়ে অন্য দিকে সরে আসে নাফিদ।কয়েকজন মহিলার কথা কানে আসে নাফিদের।
— ইমদাদ নিজেও এক হুজুর, আর বিয়ে করছে আরো এক ডিগ্রি উপরের হুজুরনিকে। বিয়ের দিনেও স্টেজে এসে বসলো না? বিয়ের দিনেও কি পর্দা করতে হবে? আর মেয়ে ভ্রু প্লাক করেনি, লেন্স লাগায় নি, ল্যাশ লাগায়নি। একদম হালকা মেকয়াপ করেছে। পার্লারে গিয়ে সাজলোটা কি তাহলে?
— আর অবস্থা দেখেছেন? এটা একটা বিয়ের অনুষ্ঠান? কোনো গানবাজনা নেই, কোনো আনন্দ নেই। গায়ে হলুদটাও হলো না। ইমদাদ যে কি করলো!
আর শুনলো না নাফিদ, সরে এলো সেখান থেকেও। এদের মাঝে রাইসা থাকবে কিভাবে? রাইসার শ্বশুড় শ্বাশুড়ি যেন এমন না হয়- মনে মনে এই দোয়াই করলো।
নাফিসা এসে জানায় কাজী চলে এসেছে, কিছুক্ষণ পরেই হয়তো বিয়ে পড়ানো শুরু হবে। মনে মনে কবুল বলার প্রস্তুতি নেয় রাইসা। হঠাৎ বাইরে থেকে মৃদু হট্টগোলের আওয়াজ আসতে থাকে। হয়তো আবারো কিছু একটা নিয়ে ঝামেলা হয়েছে। দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলে রাইসা। এখনই এতো এতো ঝামেলা হচ্ছে, আল্লাহ জানেন বিয়ের পর কি হবে।
( চলবে ইনশাআল্লাহ )