বৃষ্টি শেষে পর্ব – ১৯,২০,২১

0
847

বৃষ্টি শেষে
পর্ব – ১৯,২০,২১
আমিরাহ্ রিমঝিম
পর্ব – ১৯

কিছুক্ষণ আগে শুরু হওয়া মৃদু হট্টগোল এখন বিশ্রী বাক-বিতণ্ডায় রূপ নিয়েছে। বাইরের উচ্চস্বরের চেচামেচির আওয়াজ রাইসাও শুনতে পাচ্ছে, আর ঝগড়ার মধ্যে হওয়া সব কথাই স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।

রাহিব, মেঘলা, রোদেলাসহ আরো বাচ্চারা যারা অল্পসময় আগেও দৌড়াদৌড়ি করে খেলছিলো সবাই এখন ভয়ে চুপ হয়ে গেছে। রোদেলা কাঁদছে খুব, আর রাইসা শুধু রোদেলাকে জড়িয়ে ধরে বসে চুপচাপ চোখের পানি ফেলছে। ইমদাদের মায়ের খালাতো ভাইয়ের বলা প্রতিটি কথাই যেন অন্তরে সূচের মতো বিঁধছে রাইসার, আজকের এই পরিস্থিতির জন্য নিজেকেই দায়ী মনে হচ্ছে।

ঝামেলাটা বেধেছে দেনমোহর নিয়ে। রাইসার বাবা ভালো করেই জানতেন দেনমোহর নিয়ে অনেক জায়গায়ই পরে ঝামেলা হয়, তাই তিনি দেনমোহরের ব্যাপারটা নিয়ে আগেই ইমদাদের পরিবারের সাথে স্পষ্টভাবে আলোচনা করে নিয়েছিলেন।

রাইসা চেয়েছিলো ছেলে যেন নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী একটা মডেস্ট এমাউন্টের দেনমোহর দেয়, আর সেটা যেন বিয়ের আসরেই পরিশোধ করে। রাইসার ইচ্ছাও ইমদাদের বাসায় জানানো হয়েছিলো।

দুইপক্ষের আলোচনায় একটা পরিমাণ স্থির করা হয়েছিলো আর কথা ছিলো তারা স্বর্ণালঙ্কার দিয়ে দেনমোহর পরিশোধ করে দিবে। সে অনুযায়ী বরযাত্রীর মেয়েরা এসে রাইসাকে স্বর্ণের গহনায় সজ্জিত করে দিয়েছে।

কিন্তু বিয়ে পড়ানোর আগ দিয়ে দেনমোহরের পরিমাণ দেখে এবং এখনই দেনমোহর পরিশোধ করা হচ্ছে জেনে রেগে যান ইমদাদের এক মামা, যিনি ইমদাদের মায়ের খালাতো ভাই। উনার কথা হচ্ছে এতো দেনমোহর কেন ধরা হয়েছে আর ধরা হলেও সেটা এখনি কেন পরিশোধ করা হবে? মেয়ে পক্ষের নিশ্চয়ই কোনো ফন্দি আছে।

এটা নিয়েই রাইসার মামাদের সাথে ইমদাদের সেই মামার কিছুটা মনোমালিন্য হয়ে যায়। রাইসার চাচা উনাদের শান্ত করতে আসলে ইমদাদের মামা উনার সাথেই বাক-বিতন্ডা শুরু করে দেন। প্রথম দিকে ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা সামলানোর চেষ্টা করলেও পরে রাইসা আর তার পরিবার নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা শুনে নিজের মেজাজ ধরে রাখতে পারেননা তিনি, নিজেও জোরেশোরে উত্তর দেন কথার।

লজ্জায় ইমদাদের নাক কাটা যাচ্ছে। নিজের ছাব্বিশ বছরের জীবনে এতো বাজে পরিস্থিতিতে কখনো পড়েনি সে। দুই তিনজন মিলেও ইমদাদের মামাকে থামানো যাচ্ছে না। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ইমদাদ নিজেই যায় তার মামাকে শান্ত করতে, কিন্তু মামা তাকেই “বেয়াদব, অসভ্য, ভন্ড” ইত্যাদি ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করেন।

…….

রোদেলা রাইসার কোলে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেছে। রাইসার চোখেও পানি নেই এখন আর। চুপচাপ শুধু বাইরে থেকে আসা একেকটা কথা শুনে যাচ্ছে। উপস্থিত সবার চেহারাই অত্যন্ত মলিন।

— কি একখান মেয়ে, একটু সুন্দর না দেখতে। পাবলিকেও চান্স পায় নাই। একে নিয়ে গেলে কয়দিন পরপর চল্লিশ পঞ্চাশ হাজার টাকা আবার উনার ভার্সিটিতে দিতে হবে। পড়ার পর আদৌ চাকরি বাকরি পাবে কিনা তার নাই ঠিক। ছেলেরা কিছু চায়নাই বলে দেয়ও নাই কিছু। আবার দেনমোহর চায় এতো টাকা!

রাইসার চাচাও এখন একদন চুপ হয়ে গেছেন। আর একটা কথাও তিনি বলছেন না। চুপচাপ একটা চেয়ারে বসে সব কথা শুনছেন। নাফিদের খুব চিন্তা হচ্ছে। যে পরিস্থিতি, বাবার প্রেশার বেড়ে যায় নাকি আবার।

কিছুক্ষণ পর রাইসার চাচা উঠে দাড়ালেন। ইমদাদের মামা তখনো কিছুক্ষণ পরপর একা একাই ফোস ফোস করে উঠছেন। তাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে এগিয়ে গেলেন ইমদাদের বাবার কাছে। বিনীত কন্ঠে বললেন,

— ভাই, আপনারা চলে যান। আপনাদের কাছে রাইসাকে দিবো না আমরা।

ইমদাদের বাবার চোখ বিস্ফোরিত হয়। তিনি ভেবেছিলেন এখন হয়তো মেয়ে পক্ষ হতে তাদের কাছে ক্ষমা-টমা চেয়ে বিয়ের কাজ শুরু করা হবে। রেগে গেলেন উনি।

— মানে? ফাজলামি নাকি এইসব? আর আপনি মেয়ের চাচা হয়ে কিভাবে বলেন বিয়ে হবে না? মেয়ের বাবা কই?

রাইসার বাবা এগিয়ে এসে ভাইয়ের কথায় সমর্থন দেন। এতক্ষণে ইমদাদের মামার কথার জোরে যেটুকু ভাটা পরেছিলো এখন যেন তার দ্বিগুন বৃদ্ধি পেলো। অবশেষে আধাঘন্টা ধরে চেচাঁমেচির পর ছেলেপক্ষ বুঝতে পারলো সত্যিই বিয়েটা হচ্ছে না।

এর পাঁচ মিনিটের মধ্যে ছেলেপক্ষের দুই তিনজন মহিলা গিয়ে অত্যন্ত অভদ্রভাবে রাইসার গয়না খুলে নিয়ে গেলো, এর মধ্যে রাইসার বাবার দেয়া একটা হারও ছিলো। এমনকি তৎক্ষণাৎ গিয়ে রাইসার জন্য শাড়ি কিনে আনতে হলো সামিয়া আর যুথির, চেঞ্জ করে শাড়ি পরে বিয়ের জন্য দেয়া লেহেঙ্গাটাও ফেরত দিতে হলো তখনি।

……..

ইমদাদরা চলে যাওয়ার পর পরিবেশ যেন হঠাৎ করেই অনেক বেশি ঠান্ডা হয়ে গেল। কেউ কোনো কথা বলছে না। রাইসা অনুভূতিশূন্য মুখে বসে আছে। রাইসার বাবা এক ধ্যানে কোনো এক দিকে তাকিয়ে আছেন, কি ভাবছেন তিনি বলা মুশকিল। রাইসার চাচা তখনো চুপ করে চেয়ারে বসে নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন।

— নাফিদ….

হঠাৎ রাইসার চাচার ডাক শুনে সবাই উনার দিকে তাকায়। নাফিদ এগিয়ে আসে তার বাবার দিকে। হয়তো এখন সবাইকে বের হতে বলবে বাসার উদ্দেশ্যে। তবে বাসায় যাওয়ার আগে বাবাকে ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

— রাইসাকে বিয়ে করতে কি তোমার সমস্যা আছে?

নাফিদের ঠায় দাঁড়িয়ে গেলো। ব্যাপারটা বুঝতেও যেন বেশ খানিকটা সময় লাগলো তার। কি শুনলো সে?

— কি বাবা?

— বলেছি, রাইসাকে বিয়ে করতে তোমার কোনো সমস্যা আছে?

নাফিদ হতবাক হয়ে যায়। বাবা কি মজা করছে তার সাথে? ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে সে। এদিকে নাফিদের বাবা উত্তর জানার আশায় তার দিকে তাকিয়ে আছে।

বেশ কিছুক্ষণ পর নিজেকে ধাতস্থ করে নাফিদ বলে,

— মানে, রাইসাকে? কিন্তু কিভাবে? কেন? ওকে বিয়ের কথা ভাবতে পারছি না আমি…

— যৌক্তিক কোনো কারণ থাকলে সেটা বলো। রাইসাকে তোমার পছন্দ না? বা ওর কোনো একটা দিক তোমার ভালো লাগে না? এরকম কিছু কি?

— আব্বু, তোমার মাথা গরম হয়ে আছে এখন। বাসায় চলো, রেস্ট নাও, মাথা ঠান্ডা করো। তারপর ঠান্ডা মাথায় ভেবে…

— যেটা প্রশ্ন করেছি সেটার উত্তর দাও নাফিদ।

নাফিদ চুপ হয়ে যায়। তার বাবার প্রেশার এমনিতেই বেড়ে গেছে, আরো বেড়ে যায় এমন কিছু করা যাবে না। কিন্তু বাবা শুধুমাত্র রাগের মাথায় এই পরিস্থিতিতে বিয়ের কথা ভাবছে। রাইসাকে বিয়ে করতে সমস্যা নেই তার। শুধুমাত্র ওকে বিয়ের কথা ভাবলে অস্বস্তি হয়, এটুকুই।

— নাফিদ? রাইসার কোনোদিক কি তোমার কাছে সমস্যা মনে হয়? একেবারেই পছন্দ না এমন কিছু?

চোখ বন্ধ করে শ্বাস ফেলে নাফিদ। তারপর ধীর কন্ঠে বলে,

— না আব্বু, এরকম কিছু না।

রাইসার বাবা কাছেই ছিলেন। এতোক্ষণ অবাক হয়ে শুনছিলেন সব কথা। রাইসার চাচা এবার উনার দিকে ফিরলেন।

— তোর অমত আছে কোনো?

— কিন্তু….

— কোনো আপত্তি বা সমস্যার জায়গা থাকলে সেটা বলবি। এখন? কিভাবে? এসব প্রশ্ন করবিনা।

উনার দৃঢ় কন্ঠ শুনে দমে যান রাইসার বাবা।

— না ভাই, আমার কোনো অমত নেই।

— হুম ঠিক আছে, রাইসা কি বলে জেনে আয়।

নিজে থেকে ভেবে কোনো মতামত জানানোর মতো অবস্থায় তখন ছিলো না রাইসা। ওর আপত্তি আছে কিনা জিজ্ঞাসা করা হলে শুধু মাথা নেড়ে না জানালো।
পরক্ষণেই কাজী বিয়ে পড়ানো শুরু করলো।

এক রকম নিরানন্দ ভাবেই নাফিদের সাথে বিয়ে হয়ে গেলো রাইসার।

( চলবে ইনশাআল্লাহ )

বৃষ্টি শেষে
পর্ব – ২০
আমিরাহ্ রিমঝিম

পুবাকাশে সূর্য তখনো উঁকি দেয় নি। চারিপাশ সবে আলোকিত হতে শুরু করেছে। ভোরের মিষ্টতার সাথে পাখিদের মিষ্টি কিচিরমিচির যেন নিমেষেই মন ভালো করে দেয়। নাফিদদের বাসার ছাদে দাঁড়িয়ে লেবু দেয়া রঙ চায়ে চুমুক দিতে দিতে রাইসা সকাল হওয়া দেখে।

গতকাল এতো কান্নার পর প্রচন্ড মাথাব্যথা হয়েছিলো রাইসার। মাথা ব্যাথা আর ক্লান্তিতে গাড়িতে বসার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘুমিয়ে গেছে। সারাটা রাস্তা যুথির কাধে মাথা দিয়ে ঘুমাতে ঘুমাতে এসেছে। এখানে পৌছানোর পর যুথির ডাকে ঘুম ভেঙেছে। ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে দাদীর ঘরে গিয়ে আবার ঘুমিয়ে গেছে। সেই ঘুম ভেঙেছে একেবারে ফজরের সময়। ভালোতো গতকাল পার্লার থেকে ফিরেই এশার নামাজটা পড়ে নিয়েছিলো, নাইলে হয়তো নামাজ কাজা হওয়ার আশংকা থাকতো।

ফজরের নামাজ পড়ে চা বানিয়ে নিয়ে ছাদে চলে এসেছে এসেছে রাইসা। ভোরের এই হালকা ঠান্ডার মধ্যে লেবু চায়ে চুমুক দিতে বেশ ভালো লাগছে। খালিপেটে সবটুকু চা খাওয়ার পর ছাদে হাটাহাটি করলো কিছুক্ষণ।

পরিবেশটা বেশ নিস্তব্ধ হয়ে আছে। বাসাভর্তি মানুষ থাকা সত্ত্বেও এই বাড়ির এখনো দিন শুরু হয়নি। রাইসা ফজরের নামাজ পড়ার পর দেখলো অনেকে নামাজ পড়ে মাত্র ঘুমাতে যাচ্ছে। আর যারাও রাতে কিছুটা ঘুমিয়েছে কারোরই ঘুম পুরোপুরি হয়নি। রাইসাই সবার আগে ঘুমিয়েছিলো গতকাল, এরপর কি হয়েছে না হয়েছে কোনো খবরই জানে না সে।

বেশ কিছুক্ষণ হাটাহাটির পর খালি চায়ের কাপটা নিয়ে রাইসা নিচে নেমে এলো। চায়ের কাপ রান্নাঘরে রেখে দাদির ঘরের দিকে যাওয়ার সময় নাফিদের সামনে পরলো রাইসা। হঠাৎ করে এভাবে নাফিদের সামনে চলে আসায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো রাইসা। কি করবে বা বলবে বুঝতে না পেরে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলো।

নাফিদকে দেখতে বিদ্ধস্ত লাগছে। গতকাল রাতে বিয়ে পড়ানোর পর যুথি,সামিয়া, রাইসার বাবা আর দাদির সাথে রাইসাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছিলো নাফিদ। এর মাঝখানে আর দেখেনি নাফিদকে।

নাফিদও অপ্রস্তুত হয়ে তাকিয়ে আছে রাইসার দিকে। আজ কত বছর পর রাইসার চেহারা দেখলো? চার-পাঁচ বছর হবে হয়তো। রাইসা নিকাব পরতে শুরু করার পর আর ওর চেহারা দেখেনি নাফিদ।

কিছুক্ষণ পর নিজেকে স্বাভাবিক করে নাফিদ বললো,

— বাইরে যাচ্ছি আমি, তুই যাবি?

রাইসার হতবিহ্বল অবস্থা তখনো পুরোপুরি কাটেনি। উত্তর কি দিবে খুঁজে না পেয়ে আমতা আমতা করতে লাগলো। নাফিদ কিছুক্ষণ তার উত্তরের অপেক্ষা করলো। তারপর বললো,

— আমি গাড়িতে গিয়ে বসছি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে আসবি।

তারপর রাইসাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। রাইসা সেদিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে দাদির ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো তাড়াতাড়ি।

……..

সকালের মৃদু বাতাস ভেদ করে প্রায় ফাঁকা একটা রাস্তা দিয়ে মাঝারি গতিতে একটা গাড়ি যাচ্ছে। রাস্তার দুই ধারে বড় বড় গাছ, আর দুইপাশে সবুজ ধানের ক্ষেত। গাড়িতে বসে সেই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখে চোখ জুড়াচ্ছে রাইসা, পাশে ড্রাইভিং সিটে বসে সামনের দিকে তাকিয়ে এক মনে ড্রাইভ করছে নাফিদ।

গত পাঁচ ঘন্টায় ছয়বার কফি খাওয়ার কারণেই হয়তো সারারাত না ঘুমানো চোখেও ঘুম আসেনি নাফিদের, সেকারণে আর মনটাকে শান্ত করতে বাইরে ঘুরে আসতে চাইছিলো। গতরাতে বেশ ধকল গেছে নাফিদের। রাইসাকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে বাবাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছে। বাসায় ফিরেও আরেক ঝামেলা শুরু। নাফিদের বাবার কথা হচ্ছে ওয়ালিমাটা বিয়ের পরদিনই করতে হবে। শেষ পর্যন্ত নাফিদের মায়ের দিকের আত্মীয় স্বজন সবাইকে খবর দিয়ে, এতো রাতে আজকের ওয়ালিমার জন্য রাইসার কেনাকাটা করে, ওয়ালিমার খাবার দাবারের জন্য এক রেস্টুরেন্টে অর্ডার দিয়ে তারপর বাসায় ফিরতে পেরেছে।

রাইসার হাতে একটা খালি চকলেটের প্যাকেট। আসার আগে নাফিদ কিনে দিয়েছিলো। পুরোটা খেয়ে শেষ করে ফেলার পর খেয়াল হয়েছে যে নাফিদকে একটুও দেয়া হয়নি। অন্তত জিজ্ঞাসা তো করা উচিত ছিলো যে নাফিদ খাবে কিনা।

একটা জায়গায় এসে রাস্তাটা দুই ভাগ হয়ে গিয়েছে। দুই ভাগ যে দুই দিকে যায় এমন নয়। কিছুদুর গিয়েই আবার রাস্তার দুই ভাগ একসাথে মিশেছে। রাস্তাটার দুই ভাগের একভাগ দিয়ে এখন গাড়ি চলাচল করে। আরেকটা ভাগ পুরনো। সেখান দিয়ে কোনো এক কালে গাড়ি চলাচল করলেও এখন গাছপালা গজিয়েছে। একটা ছোট ব্রিজও আছে পুরনো রাস্তায়। বেশ সুন্দর জায়গাটা, পিকনিক স্পটের মতো।

চল্লিশ মিনিট ধরে চলার পর সেই পুরনো রাস্তায় ছোটো ব্রিজটার সামনে গিয়ে রাইসাদের গাড়িটা থামলো।

………..

দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে রাস্তার পাশে ধানক্ষেতের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নাফিদ। একটু পিছনে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দুই হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে রাইসা, মাটিতে একদল পিঁপড়ার হেটে যাওয়া দেখছে খুব মনযোগ দিয়ে। ওরা এখানে এসেছে প্রায় দশ মিনিট হয়। এতোক্ষণ ধরে এভাবেই দাঁড়িয়ে আছে দুইজন।

কিছুটা সামনে এগিয়ে গিয়ে গাছের নিচে ঘাসের উপর বসে নাফিদ। পেছনে তাকিয়ে দেখে রাইসা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ছাইরঙের বোরকা পরেছে, আর গোলাপি ধরনের একটা রঙের হিজাব নিকাবে মুখ ঢাকা, শুধু দুই চোখ দেখা যাচ্ছে। একটা নিশ্বাস ফেলে রাইসাকে ডাক দেয় নাফিদ।

— রাইসা?

যাবতীয় মনযোগ পিঁপড়ার দলের দিকে থাকায় প্রথমবার ডাক শুনতে পায়না রাইসা। আবার আরেকটু জোরে ডাক দেয় নাফিদ।

— রাইসা?

এবার চমকে সামনে তাকায় রাইসা, দেখে নাফিদ ঘাসের উপর বসে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

— হ্যাঁ?

— এখানে এসে বস।

রাইসা ধীর পায়ে গিয়ে সসংকোচে নাফিদের পাশে বসে। কিছু মুহূর্ত এভাবেই কেটে যায়, কথা হয়না কোনো। দুইজনের দৃষ্টিই সামনের দিকে। সবুজ ক্ষেতের উপর সকালের সোনালি আলো, কোলাহলহীন স্নিগ্ধ পরিবেশ, পাখির ডাক; অসাধারণ সময়।

— দেখ রাইসা…

নাফিদ হঠাৎ কথা বলা শুরু করলে রাইসা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় ওর দিকে। নাফিদ বলতেই থাকে-

— তুই হয়তো জানিস না তোর সাথে আরো আগেই আমার বিয়ের কথাবার্তা উঠেছিলো। এজন্যই হয়তো বাবা গতকাল হুট করে আমার সাথে তোর বিয়ের কথা বলতে পেরেছেন। এখন বিয়েটা যে পরিস্থিতিতে হয়েছে, তুই বা আমি কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। এখন নিজেরা নিজেদের জায়গা থেকে উচিত এই সম্পর্কটাতে কম্ফোর্টেবল হওয়ার চেষ্টা করা, সময় নিয়ে হলেও। আর আমার মনে হয় আমাদের দুইজনেরই সময় দরকার বেশ খানিকটা। তুই কি বুঝতে পারছিস?

রাইসা মুখে বলে না কিছু, শুধু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। রাইসা ভালোভাবেই বুঝতে পারছে সব। বরং রাইসার চেয়ে নাফিদের হয়তো সময় বেশি দরকার। বিয়েটা হয়েছে পুরো মানসিক প্রস্তুতি ছাড়া। হুট করে কিছু একটা ঘটলে সেটা মেনে নিতেও সময় লাগে।

— আবার এটা ভাবিস না যে আমি তোর চেয়ে ফর্সা বলে আগেরবার তোকে না করেছি বা এখন তোর থেকে পালাতে চাইছি।

নিচের দিকে তাকিয়েই রাইসা শান্ত কন্ঠে বলে-

— এরকম মোটেও ভাবিনি।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলে-

— তবে আমাকে কারো ভালো না ই লাগতে পারে, মানুষের তো নিজস্ব পছন্দ অপছন্দ আছে। যার আমাকে ভালো লাগে না, জোর করে কেন তার কাছে থাকতে চাইবো।

নাফিদ তাকিয়ে থাকে রাইসার দিকে। মেয়েটার বেশ বুদ্ধি।

তারপর কিছুক্ষণ এটা সেটা নিয়ে কথা হয়। একথা সেকথার পর নাফিদ বলে-

— আজকে রাতের বাসেই সিলেট যাবো ইনশাআল্লাহ।

রাইসা অবাক হয়ে তাকায়,

— ছুটি নেই আপনার?

— না, কিছুদিন আগে অনেকদিনের ছুটি নিয়েছিলাম। এবার আর এতো ছুটি নেয়া যাবে না।

— বাসায় জানাবেন না আজকে চলে যাচ্ছেন যে?

নাফিদ হতাশ দৃষ্টিতে তাকায় রাইসার দিকে। নাহ্, মেয়েটাকে যতটা বুদ্ধিমান ভেবেছিলো ততটাও বুদ্ধি হয়নি।

…….

ঘড়ির কাটায় যখন আটটা বাজে তখন দুইজন ফেরার উদ্দেশ্যে গাড়িতে উঠলো। গাড়ি ঘুরাতেই নাফিদের ফোনে কল এলো নাফিসার।

— হ্যাঁ নাফিদ, রাইসা কি তোর সাথে?

— হ্যাঁ আমার সাথেই। বাসায় আসছি এখন।

— তো যাচ্ছিস যে বলে যাবি না?

— ঘুমে ছিলো সবাই।

আরো টুকটাক দু-এক কথা বলে ফোন রেখে দিলো নাফিদ।

— রাইসা, গাড়িটা তুই চালা প্লিজ। আমি প্রচন্ড টায়ার্ড, ঘুম আসছে খুব।

রাইসা কথা না বাড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। নাফিদ গিয়ে ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসে, আর রাইসা ড্রাইভিং সিটে। পাঁচ-ছয় মিনিট গাড়ি চালানোর পরই খেয়াল করে নাফিদ ঘুমিয়ে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার ড্রাইভিংয়ে মনযোগ দেয় রাইসা।

( চলবে ইনশাআল্লাহ )

বৃষ্টি শেষে
পর্ব – ২১
আমিরাহ্ রিমঝিম

নিজের ব্যাগ, জামা কাপড় সব গুছিয়ে রাখছে রাইসা। গতকাল ওয়ালিমার পর বাবা মায়ের সাথে বাসায় ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়েছিলো। জামা কাপড় গুছিয়ে রাখার মতো ইচ্ছা বা শক্তি কোনোটাই তখন ছিলো না। আজকে তাই সকাল সকালই সব গুছিয়ে ফেলছে।

ব্যাগ থেকে সব কাপড় বের করার পর এক কোনে চকলেটের খালি প্যাকেট দেখতে পেলো রাইসা। গতকাল নাফিদ ওকে যে চকলেট দিয়েছিলো সেটার প্যাকেট। খালি প্যাকেটটা হাতে নিয়ে মৃদু হাসলো রাইসা। কিশোরী বয়স হলে হয়তো যত্ন করে প্যাকেটটা রেখে দিতো। কি অদ্ভুত চিন্তাভাবনা থাকে অল্পবয়সে! প্রিয় মানুষ দিয়েছে বলেই খালি প্যাকেট জমিয়ে রাখার কোনো দরকার আছে?

প্যাকেটের ভেতর চকলেট যে কাগজে মোড়ানো থাকে সেটায় কিছুটা চকলেট লেগে আছে। ভালোতো পিপড়া উঠেনি। কাগজটা নিয়ে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দেয় রাইসা, কিন্তু প্যাকেটটা ফেলে না। ময়লার ঝুড়ির কাছে চকলেটে খালি প্যাকেটটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর ঘুরে রুমে চলে আসে। নিজের পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে অন্যান্য প্রিয় জিনিসের সাথে খালি প্যাকেটটা রেখে দেয় যত্ন করে। স্পেশাল এটা।

………

রাকিব আর রাহিব এখনো বিয়ের ছুটি কাটাচ্ছে। রাইসার নিজেরও এখন পড়তে ইচ্ছা করছে না। মাগরিবের নামাজের পর তাই ফোন হাতে নিলো অলসভাবে। ফেসবুকে ঢুকে স্ক্রল করতে শুরু করলো অযথাই।

ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে খেয়াল হলো, ফেসবুকে তার বিয়ের কথা তো ঘোষণা করা হয়নি। চটজলদি নিজের প্রোফাইলে গিয়ে রিলেশনশিপ স্টাটাস গট ম্যারিড দিতে গিয়েও থেমে গেলো। স্টাটাসের সাথে নাফিদকে ট্যাগ কিভাবে করবে? নাফিদতো তার ফ্রেন্ডলিস্টেই নেই। আর যদি থাকতোও, রাইসার এরকম তাকে ট্যাগ করে স্টাটাস দেয়াটা কি পছন্দ করতো? আচ্ছা উনার নিজের প্রোফাইলের রিলেশনশিপ স্টাটাস কি দেয়া?

নাফিদের নাম লিখে সার্চ দিলে কাঙ্খিত আইডিটাই সবার প্রথমে চলে আসলো সামনে। বেশি কিছু নেই আইডিতে, অথবা রাইসা তার ফ্রেন্ডলিস্টে নেই বলে সব পোস্ট দেখতে পেলো না। কিছুক্ষণ নাফিদের প্রোফাইলে ঘোরাঘুরি করে প্রোফাইল ছবিটা দেখতে শুরু করলো মনযোগ দিয়ে।

চা বাগানের সামনে দাঁড়িয়ে ছবিটা তোলা। হাত ভাজ করা, মুখে সামান্য হাসি। আগের সেই চঞ্চল ভাবটা নেই চেহারায়, তার বদলে বয়সের সাথে মানানসই গাম্ভীর্য শোভা পাচ্ছে। দেখতে আগের চেয়েও ভালো লাগছে এখন। তবে দুই চোখ যেন কিছুটা বিষাদাচ্ছন্ন, শুন্যতা গ্রাস করেছে দৃষ্টিতে।

প্রোফাইল ছবি থেকে বের হয়ে রাইসা কিছুক্ষণ ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট বাটনটার দিকে তাকিয়ে রইলো। মন তো চাইছে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠাতে, কিন্তু কেমন একটা হয়ে যাবে না ব্যাপারটা? উনি কি ভাববেন? হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে বেখেয়ালে আঙুলের চাপ লেগে রিকুয়েষ্ট চলে গেলো। তরিঘরি করে রিকুয়েষ্ট ক্যান্সেল করার আগেই দেখলো রিকুয়েষ্ট একসেপ্ট হয়ে গেছে, মানে নাফিদ অনলাইনেই ছিলো। ধুর, কি হলো এটা? কি বিশ্রী অবস্থা! মনে মনে নিজেই নিজেকে গালমন্দ করলো রাইসা।

ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট একসেপ্ট করেই মেসেজ পাঠিয়েছে নাফিদ।

— আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছিস? চাচা-চাচি, রাকিব, রাহিব সবাই কেমন আছে?

রাইসা দ্রুত উত্তর লিখলো,

— ওয়ালাইকুমুসসালাম। সবাই ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন?

ওপাশ থেকে উত্তর আসলো,

— আলহামদুলিল্লাহ ভালো। ব্যস্ত আছিস নাকি?

রাইসা “ না ” উত্তর দিতেই নাফিদ কল দিলো মেসেঞ্জারে। হঠাৎ কল আসায় চমকে রাইসার হাত থেকে ফোন খাটের উপর পরে গেলো। ভালোতো খাটের উপরেই পরেছে, নাইলে হয়তো ফোনের স্ক্রিন ফেটে চৌচির হতো নিচে পরলে।তারাতাড়ি ফোন হাতে নিয়ে কল রিসিভ করে রাইসা।

তেমন কোনো কথা হয়না তাদের মধ্যে। নাফিদ যা যা জিজ্ঞাসা করে শুধু সেগুলোরই উত্তর দেয় রাইসা, যদিও চায় নিজে থেকে নাফিদের সাথে কথা বলতে কিন্তু কি বলবে খুঁজে পায় না। ছয় সাত মিনিটেই তাদের কথা শেষ হয়ে যায়। নাফিদ বিদায় নিয়ে কল কেটে দেয়।

কথা শেষ হবার পর ফোনের দিকে তাকিয়ে রাইসা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নাফিদ যে দুইজনের মধ্যে সম্পর্কটা সহজ করার জন্য এসব করছে তা ও ভালোই বুঝতে পারছে। এককালে নাফিদকে দিয়েই রাইসার সারা মন আচ্ছন্ন হয়ে থাকতো। কিশোরী বয়সের সেই ভালোলাগাকে এখন নতুন করে ভালোবাসতে শিখতে হবে।

ফোন রেখে উঠে চলে যাচ্ছিলো রাইসা, তখন খেয়াল হলো যে নাফিদের প্রোফাইল যে কারণে খুজছিলো সেই কাজটাই করা হয়নি। আবারো ফেসবুকে ঢুকে নাফিদের প্রোফাইলে গেলো। গিয়ে দেখলো নাফিদের প্রোফাইলে কোনো রিলেশনশিপ স্টাটাস দেয়া নেই। শেষ পর্যন্ত ভেবে চিন্তে নিজের প্রোফাইলে গট ম্যারিড স্টাটাস দিলো রাইসা, কিন্তু নাফিদকে ট্যাগ করলো না।

পরেরদিন সকালবেলায় ফেসবুকে ঢুকে দেখলো তার গট ম্যারিড স্টাটাসে রিয়্যাক্ট-কমেন্টের ছড়াছড়ি। নাফিদ নিজেও একটা লাভ রিয়্যাক্ট দিয়ে রেখেছে।

( চলবে ইনশাআল্লাহ )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here