বৃহন্নলার ডিভোর্স পর্ব-আট,নয়

0
505

#ধারাবাহিকগল্প
#বৃহন্নলার ডিভোর্স
পর্ব-আট,নয়
মাহাবুবা বিথী
আট

রুমি বলে,
—-আপু আমি অবশ্যই চাই ওদের শাস্তি হোক। আমি একলা মেয়ে মানুষ। আমার মা অসুস্থ। যত বেশী মামলা দিব তত ফয়সালা হতে দেরী হবে। আমি আমার প্রতি অন্যায়ের বিচার অবশ্যই চাইবো কিন্তু এই বিচার চাইতে গিয়ে আমার উপর যে আর অন্যায় হবে না এর গ্যারান্টি কে দিবে? আমার নিরাপত্তা কে দিবে?আমাদের দেশে ঘটনা ঘটে যায় কিন্তু ভিকটিম কোন বিচার পায় না।

আমার বাসায় কোন পুরুষ মানুষ নাই। আমি আসলেই আর পারছি না। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইছি। তবে পরমকরুনাময় আল্লাহপাকের উপর ওদের বিচারের ভার ছেড়ে দিয়েছি। অভিশাপ দেওয়া আল্লাহপাক পছন্দ করেন না। কারণ আল্লাহ পাক ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না। আর প্রতিমূহুর্তে আমার ভিতর থেকে যে দীর্ঘশ্বাস বের হচ্ছে। এই দীর্ঘশ্বাস আল্লাহপাকের দরবারে জমা হচ্ছে। সুতরাং আমার প্রতি যে অন্যায় ওরা করেছে এর ফল ওদের ভোগ করতেই হবে। তারউপর আমি একজন এতিম মানুষ। আপু যারা বাইরে চোখের জল ফেলতে পারে না তারা দেহের ভিতরে রক্তাক্ত হয় বেশী। যেটা শুধু পরমকরুনাময় আল্লাহপাক দেখতে পায়।
ব্যারিষ্টার রাবেয়া বলেন
—ঠিক আছে তোমার মত অনুসারেই সব হবে। তবে আমি আবীরের অফিসে মামলার কপি পাঠিয়ে দিবো। এতে হয়ত আবীরের চাকরি চলে যাবে।
রুমি বলে,
—-আপনার নিয়ম অনুসারে আপনি যা করার করবেন এতে আমার বলার কিছু নাই।
ব্যারিষ্টার রাবেয়া বলেন,
—-রুমি, অনেক সময় লক্ষ্যে পৌঁছাতে গেলে মানুষকে কঠোরতা অবলম্বন করতে হয়। সেই কঠোরতাকে অনেকে নিষ্ঠুরতা বলে। ইতিহাস তাদের জন্যও জায়গা রেখে দেয়। কথাটা মনে রেখো। গুরুত্বপূর্ণ কথাটা তোমাকে বলা হয়নি। কাল সকাল এগারোটায় মামলা কোর্টে উঠবে। তুমি ঠিক সময়ে চলে এসো।
ফোনটা রাখার পর রুম্মান চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো
—-আপু তোমার ল,ইয়ার ফোন দিয়েছিলো।
রুমি বললো,
—-হুম
রুম্মান বললো,
—-মামলার ডেট কবে পড়েছে?
রুমি বললো
—-আগামিকাল। তোর কাল ভার্সিটিতে ক্লাস আছে?
রুম্মান বললো,
—-কাল ক্লাসতো আছে আপু ল্যাবও রয়েছে।
রুমি বললো,
—-ঠিক আছে। কালকে মামলার ডেট পড়েছে আম্মুকে জানাবো না। বাসায় একা থাকবে তখন শুধু টেনশন করবে। এতে হয়ত প্রেসার টা বেড়ে যাবে।
রুমি ওর মার ঘরে গেলো।মা ওর ভাইয়ের সাথে ফোনে কথা বলছে। ওকে দেখে ওর মা বললো,
—-কিছু বলবি
রুমি বললো,
—-তুমি ভাইয়ার সাথে কথা শেষ করো তারপর বলি। রুমির মা ছেলের সাথে কথা শেষ করে রুমিকে জিজ্ঞাসা করেন,
—–কিছু বলবি?
রুমি বলে,
—-কাল আমার একটু বাইরে কাজ আছে। তুমি বাসায় একা থাকতে পারবে তো?
ওর মা বলে,
—-কেন পারবো না? কালকে কি মামলার তারিখ পড়েছে?
রুমি বলে,
—-তুমি কি করে বুঝলে মা?
ওর মা বলে,
—-সন্তানের মুখ দেখে যদি মা মনের কথা না বুঝে তাহলে তো সে মা হতেই পারলো না। মায়ের সাথে সন্তানের নাড়ীর সম্পর্ক। জানিস তুই যখন ও বাড়িতে ছিলি একটাদিনও রাত্রে ঠিক মতো ঘুম আসতো না। নানারকম দুঃশ্চিন্তা আমাকে গ্রাস করতো। এজন্যই তো প্রেসারটা এমন বেড়ে গিয়েছে। মারে আমি নিজহাতে তোর জীবনটা নষ্ট করে দিলাম। আমাকে তুই ক্ষমা করে দিস।
রুমি বলে,
—-মা,তুমি যদি একথাটা আবার বলো আমি তোমাকে কিছুই আর জানাবো না। যেদিকে দুচোখ যায় আমি চলে যাবো।
ওর মা বলে,
—-ঠিক আছে,আর বলবো না। তবে কাল তোর সাথে আমিও কোর্টে যাবো।
রুমি বলে,
—-তাহলে তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে শুয়ে পড়ো।ঘুম হলে প্রেসার কন্ট্রোল থাকবে।
দ্রুত রাতের খাওয়া শেষ করে ওরা শুয়ে পড়লো। রুমি একমগ চা নিয়ে বারান্দায় চেয়ারে বসলো। রুম্মান এসে বললো,
—-আপু এভাবে একা বারান্দায় রাতে বসে থাকলে তোমার উপর জ্বীনের নজর পড়বে।
রুমি বলে,
— মুরুব্বিগীরি না করে শুয়ে ঘুম যা। আর আমাকে একটু একা থাকতে দে।
রুম্মান জানে ওর আপুর মনের অবস্থা তবুও স্বাভাবিক করার জন্য দুষ্টুমী করে বলে,
—-তোমার ভালোর জন্যই বলছিলাম। তুমি দেখতে যে পরিমান সুন্দরী জ্বীন না জানি তোমার প্রেমে পড়ে যায়।
রুমি বলে,
—-আজ অবদি কোন মানুষই আমার প্রেমে পড়লো না তুই আবার জ্বীনের প্রেমের পড়ার কথা বলছিস। যা শুয়ে পড়। আউল ফাউল কথা আমার সামনে বলবি না।
রুম্মান আসলেই মুখ ফসকে ফাউল কথা বলে ফেলেছে তাই দ্রুত রুমির কাছ থেকে সরে পড়লো।
রুমি অবশ্য রুম্মানের কথায় কিছু মনে করে না। এমন সময় মোবাইলে টুংটাং শব্দ হলো।তাকিয়ে দেখে রায়হান মেসেজ পাঠিয়েছে।
—-কেমন আছেন?
রুমি বলে,
—-ভাল। আপনি ঘুমাননি
রায়হান বলে,
—আমি ঘুমালে আপনাকে মেসেজ পাঠালো কে?
রুমি বলে
—আপনার ভুতটা মনে হয় পাঠিয়েছে।
রায়হান বলে,
—-আপনিও তো মনে হয় আমার ভুতের মেসেজের জন্য অপেক্ষা করেন।
রুমি বলে,
—-জ্বী না মশাই। শুধু শুধু আমার পিছনে সময় ব্যয় না করে ঘুমিয়ে পড়ুন।
রায়হান বলে,
—-আপনি কি আসলেই কিছু বুঝেন না নাকি বুঝেও না বুঝার ভাণ করেন।
রুমি বলে,
—-আপনার কি মনে হয়?
রায়হান বলে,
—-আসলে যে সত্যি ঘুমায় তাকে জাগানো যায় আর যে ঘুমের ভাণ করে শুয়ে থাকে তাকে জাগানো যায় না।
রুমি বলে,
—-আমিও বুঝি না আপনি কেন আমাকে নিয়ে পড়েছেন?
রায়হান বলে,
—-সমস্যা একজায়গায়। চোখে তো পড়ে অনেকেই কিন্তু মনটা যে একজনকেই ধরে রাখে। ঠিক আছে শুয়ে পড়ুন। গুড নাইট।
চারিদিক নিরব নিস্তব্ধ। সমস্ত পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়েছে। শীতের উত্তরী হাওয়ায় শরীরটা হীম হয়ে যাচ্ছে। রায়হান ভাই মনে হয় মাইন্ড করেছে। উনি মাইন্ড করলে রুমির কিছু করার নাই। রুমি বারান্দার দরজা লাগিয়ে ঘরে এসে শুয়ে পড়লো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত দুটো বাজে।
খুব ভোরে রুমির ঘুম ভেঙ্গে যায়। ফজরের নামাজ পড়ে কিচেনে গিয়ে চা বানায়। মায়ের রুমে উঁকি দিয়ে দেখে মা নামাজ পড়ছে। এক কাপ চা ফ্লাক্সে রেখে দুকাপ চা নিয়ে রুমি মায়ের কাছে আসে। মা রুমিকে বলে,
—–রুমি, দু,দিন আগে রায়হানের মা ফোন দিয়েছিলো। তোর বিষয়ে জানতে চেয়েছে।আমি বলেছি শীঘ্রই তোর ডিভোর্স হবে। তখন উনি বললেন,”তোর যদি কোন আপত্তি না থাকে তাহলে রায়হানের বউ করে তোকে নিতে চায়।
রুমি বলে,
—-তুমি আবারও আমার বিয়ে নিয়ে ভাবছো। মা আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। এটাই এখন আমার জন্য সবচেয়ে বেশী জরুরী। তুমি বরং ভাইয়ার বিয়েটা দিয়ে দাও। তোমার ছেলের যে বয়স বেড়ে যাচ্ছে সে খেয়াল আছে। ভাইয়াকে জিজ্ঞাসা কর ওর নিজের পছন্দ আছে কিনা। যদি না থাকে তাহলে মেয়ে খুঁজতে থাক।
রুমির মা রুমিকে বলে,
—-আসলেই রাশেদের জন্য মেয়ে দেখা দরকার। ভাল পরামর্শ দিয়েছিস।
রুমি নাস্তা রেডী করতে কিচেনে চলে যায়। রুমির মা ভাবে এখন আসলে রুমিকে বিয়ের ব্যাপারে জোর করা উচিত নয়। জীবনে এতো বড় একটা ধাক্কা আগে সামলে উঠুক। তারপর না হয় ওর বিয়ের কথা ভাবা যাবে।
ব্রেকফাস্ট করে রুম্মান রুমি আর ওর মা বাসা থেকে
বের হলো। রুম্মান ভার্সিটি চলে গেলো। রুমি আর রুমির মা আদালত প্রাঙ্গনে হাজির হলো। রুমির ল,ইয়ার আগে থেকেই উপস্থিত ছিলো।
কাঠগড়ায় আবীর সারাক্ষণ মাথা নিচু করে থাকলো। ওরাও উকিল ঠিক করেছে। ওর সাথে সাব্বির এসেছে। আবীরকে ঝড়ো কাকের মতো লাগছিলো। এর পরের মামলার তারিখ ওরা একটু পিছিয়ে নিলো। ওদের উকিলের কাছে খবর পাওয়া গেলো ওর বাবা নাকি স্ট্রোক করে আইসিইউতে ভর্তি আছে। আর আপু মামলার কাগজ আবীরের অফিসে পাঠিয়েছে বলে ওরও চাকরি সাসপেন্ড অবস্থায় আছে। ওদের উকিল রুমির ল,ইয়ারকে বললো,
—-আপু অফিসে কি মামলার কপিটা পাঠানো জরুরী ছিলো। বাসার ঠিকানায় পাঠালেই তো পারতেন।
রুমির ল,ইয়ার বললো,
—-আমি নিয়ম অনুসারে কাজ করছি।
আপু আমাকে আর আম্মুকে নিয়ে কোর্ট থেকে বের হয়ে আসলো। আম্মু আপুকে বললো,
—-জানো মা, আল্লাহর বিচার আছে। অনেকে ক্ষণিক লাভ খাইতে চায়। কিন্তু আল্লাহপাক যখন ফয়সালার দায়িত্ব নেন অসহায় মানুষ তখন শ্রেষ্ট ফয়সালায় পায়। আমরা আল্লাহর কাছে পাপ করি। আল্লাহপাক অসীম দয়ালু। তাই উনি আমাদের ক্ষমা করে দেন। কিন্তু আমরা যখন তার কোন অসহায় বান্দার উপর অত্যাচার করি সে মাফ না করলে আল্লাহপাক মাফ করেন না। ওরা আমার রুমির উপর যা অত্যাচার করেছে এর ফল ওদের ভোগ করতেই হবে।
রুমির মার চোখের পাতা ভিজে গেলো।

চলবে

#ধারাবাহিকগল্প
#বৃহন্নলার ডিভোর্স
পর্ব-নয়
মাহাবুবা বিথী

ব্যারিষ্টার রাবেয়া ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন দুপুর বারোটা বাজে। রুমি আর ওর মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে উনি বাসার পথে রওয়ানা হলেন। রাহাত হয়ত এতোক্ষণে জারিফকে স্কুল থেকে বাসায় নিয়ে এসেছে। তিনবেলা খাবারটা জারিফকে নিয়ে একসাথে খেতে রাবেয়া আর ওর হাসবেন্ড চেষ্টা করে। এতে পারিবারিক বন্ধন মজবুত হয়। রাবেয়া ভাবছে,এই পৃথিবীতে কিছু মা বাবা নিজের সন্তানের ভাল চাইতে গিয়ে সন্তানের ক্ষতিটাই করে ফেলে। আবীরের বাবা মার কি দরকার ছিলো একটা অসুস্থ ছেলেকে বিয়ে দেওয়ার। নিজের ছেলের ভালো চাইতে গিয়ে একটি অসহায় মেয়ের সর্বনাশ করে অলক্ষে নিজেদের ক্ষতি ডেকে আনলো। দুনিয়াতে প্রতিটি মানুষ তার খারাপ কাজের কর্মফল ভোগ করে। রুমির মতো একটা অসহায় মেয়ের উপর যে অত্যাচার উনারা করেছেন তার ফলতো ভোগ করতেই হবে।

________

আদালত প্রাঙ্গন থেকে বাসায় ফিরতে রুমি আর ওর মায়ের বেলা তিনটা বেজে গেলো। তাই ওরা বাসায় ফেরার পথে খাবার কিনে নিলো। রুমি বাসায় ফিরে ওর মাকে বললো,
—-মা ফ্রেস হয়ে এসে খেতে বসো। তোমার আবার ওষুধ খেতে হবে।
ওর মা বললো,
—–আমি যোহরের নামাজ পড়ে খাবো। তুই ও নামাজটা পড়ে নে।
যোহরের নামাজ শেষ করে মা মেয়ে দুজনেই খেতে বসে গেলো। খাওয়া শেষ হতে না হতেই ডোর বেলটা বেজে উঠলো। রুমি খাওয়া শেষ করে দরজাটা খুলে দিলো। রুম্মানকে দেখে রুমি বললো
—-আজ যে একটু তাড়াতাড়ি ফিরলি?
—-ল্যাব টা আজ আর হলো না। শেষ মূহুর্তে স্যার ক্যান্সেল করে দিলো।
—-ফ্রেস হয়ে এসে ভাত খেয়ে নে।
খাওয়ার পাঠ শেষ করে দু, বোন রুমে চলে গেলো।
রুমির মা ও একটু বিছানায় গড়িয়ে নিলো। একটু পরেই আসরের নামাজ পড়ে নিতে হবে। শীতকালের বেলা দ্রুত ফুরিয়ে যায়।
রুম্মান রুমিকে বলে,
—-আপু তোমার মামলার খবর কি?
—-কাজ অনেকদূর এগিয়েছে। আসামীপক্ষ আদালতের কাছে সময় চেয়েছে।
—-কেন আপু?
—-আবীরের বাবা স্ট্রোক করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। জানিস আবীরের চাকরিটা মনে হয় চলে যাবে।
রুম্মান বলে,
—-ঠিক হয়েছে। ওদের আরও শাস্তি হওয়া দরকার।
—-রুম্মান আসিফ কেমন আছে? একদিন ওর সাথে পরিচয় করিয়ে দে।
—-দেব আপু। আপু জান আমাদের ক্লাসে অনেক প্রেমিক কাপল রুম ডেট করে।
রুমি চমকে উঠে বলে,
—-তুই কখনও করেছিস?
—আসিফ খুব ভদ্র ছেলে আপু।
—-ভদ্র অভদ্র বুঝি না করেছিস কিনা বল?
—-আপু তোমার আমার উপর বিশ্বাস নেই?
—-অবশ্যই আছে। তবে অনেক সময় পরিবেশ পরিস্থিতির উপর কারো হাত থাকে না। আর একটা কথা মনে রাখিস,”প্রেমে পবিত্রতা থাকতে হয় তাহলে সেই প্রেম বয়ে নিতে সহজ হয়”। নিজেদের ভালবাসার মর্যাদা নিজেদেরকে রক্ষা করতে হয়।
—-আপু আমি সেটা জানি। তুমি আমার উপর পরিপূর্ণ আস্থা রাখতে পারো।
বারান্দা দিয়ে উত্তরের হিমেল হাওয়া শরীরটাকে হিম করে দিচ্ছে। রুমি জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে রয়

“গোধুলীর আবীর রাঙা আলো চোখে মুখে ছুঁয়ে যায়
রঙহীন আমার জীবন বয়ে যায় এক সাগর বেদনায়”

গোধুলী লগ্নে রুমির মনটা বেদনার্ত হয়ে যায়। কারণ মানুষের জীবনে সন্ধা নামলে আয়ু ফুরিয়ে যায়। মাগরিবের আযান শোনা যায়। রুমি রুম্মানকে নামাজ পড়ার কথা বলে নিজেও মাগরিবের নামাজ পড়ে নেয়।
রুমি মায়ের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে মা ওর ভাইয়ের সাথে ফোনে কথা বলছে। রুমি কিচেনে গিয়ে চা বানায়। রুম্মানের চা রুমে দিয়ে ওর আর মায়ের চা নিয়ে ঘরে এসে মাকে বলে
—-তোমার ছেলেকে বিয়ের কথা বলেছিলে?
রুমির মা চায়ে চুমুক দিয়ে বলে
—-বলেছি। ওর নিজের পছন্দ আছে। কানাডায় ওই মেয়েটাও পিএইচডি করছে।
—ভালই হলো। তোমার মেয়ে দেখার হাঙ্গামা পোহাতে হলো না।
—-নারে রুমি, আমার কাছে বিষয়টা ভালো লাগেনি। মেয়ের বংশ কেমন বাড়ি কোন জেলায় কিছুই তো জানলাম না।
—জানো নাই এখন জেনে নিবা। আর সংসার তো তুমি করছো না, করবে তোমার ছেলে। ওর জানাটাই বেশী দরকার। যোগাযোগ কিভাবে হবে? বলেছে কিছু?
—-আজ তো ডিসেম্বরের দশ তারিখ। এক মাসের ছুটিতে ওরা বিশ তারিখে দেশে আসবে। তারপর দুই পরিবারের মধ্যস্থতায় বিয়ের কাজ সম্পন্ন হবে।
—-তোমার জন্য ভালই হলো মা। ছেলে একা থাকে বলে চিন্তা কর এখন চিন্তার অবসান হবে। আর যার তার সাথে বিয়ে হওয়াটাতো বিয়ে নয়। মনের মিল হলে তবেই বিয়ে করা উচিত বলে আমার মনে হয়। এজন্য বিয়ের আগে একটু বোঝাপড়া থাকা ভালো।
রুমি রুম্মানকে ভাইয়ের বিয়ের খবর দিয়ে ডিনারের ব্যবস্থা করার জন্য কিচেনে চলে যায়। রুম্মান খুশীতে মায়ের কাছে গিয়ে বলে,
—-মা, আমি ভাইয়ার বিয়েতে আনজারা থেকে লেহেঙ্গা কিনবো।
—-রুম্মান আমার কাছে টাকা নাই।
—-তোমাকে কে কিনতে বলেছে? ভাইয়া কিনে দিবে।
—-আমার কাছে বায়না না করে ভাইয়ের কাছে করিস।
রুম্মান মন খারাপ করে রুমে চলে যায়। আর আপন মনে গজ গজ করে বলে
—-জন্ম থেকেই শুনে আসছি মার কাছে টাকা নাই।
রুমি এসে বলে,
—-একা একা কি বিড়বিড় করছিস?আসলেই তো মার হাতে টাকা থাকে না। তুই ভাইয়াকে বলবি। ভাইয়া নিশ্চয় নিজের বিয়ে উপলক্ষে সবাইকে কিছু কিনে দিবে। তখন তুই তোর পছন্দে কিনে নিবি। তাহলেই তো কেনা হয়ে যাবে।
—-আম্মু বাগড়া না দিলেই হলো। তার তো আবার ছেলের দিকে টান বেশী। আপু তুই কিছু কিনবি না?
—-এখনও কিছু ভাবি নাই। আগে সময়টা আসুক।
রুম্মান তুই টেবিলে ভাত বেড়ে ফেল। আমি এশার নামাজ পড়ে আসছি। রাত দশটা বাজে। মার ওষুধ খাওয়ার সময় হয়েছে।

ডিনার করে প্রতিদিনের মতো এক কাপ চা নিয়ে রুমি বারান্দায় এসে বসে। মোবাইলে টুংটাং শব্দে রায়হানের মেসেজ আসে।
—কেমন আছেন?
—-ভালই আছি।
—-আপনাকে নিয়ে আমার খুব চিন্তা হয়। এইটুকু বয়সে এতো ঝড় ঝাপটা পোহাতে হলো।
বিরক্ত হয়ে রুমি বলে,
—-আমাকে নিয়ে অযথা চিন্তা করবেন না। মেয়েমানুষের পরাণ কই মাছের প্রাণ। এই যে মেয়েরা জীবনভর এতো যন্ত্রণা বয়ে বেড়ায় তবুওতো বেঁচে থাকে।
—-ও ভাবে বলা উচিত নয়। আল্লাহপাক যার যতদিন হায়াত রেখেছে সে ততদিনই বেঁচে থাকবে। একদিন আগে কিংবা একদিন পরেও তার মরণ হবে না। আজকে তো আপনার মামলার ডেট ছিলো।
—ওই বিষয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
—-তবে সব কিছুর সমাধান হয়ে গেলে আপনার জীবন নিয়ে নতুন করে ভাবা উচিত। একটা না হওয়া সংসারের দুঃসহ স্মৃতি কিংবা একটা না পাওয়া মানুষের স্মৃতি বয়ে জীবনে একা থাকা উচিত নয়। জীবন গল্প কিংবা নাটক নয়। জীবন গল্প কিংবা উপন্যাসের থেকেও অনেক কঠিন আর নাটকের থেকে অনেক নাটকীয়। দুই বা তিন ঘন্টায় এর সমাপ্তি হয় না। যুগ যুগান্তর ধরে এর ভার বয়ে বেড়াতে হয়।
—-মানুষের মন একবার ভেঙ্গে গেলে তা আর জোড়া লাগে না। আমি আসলে আগে নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে চাই।
—-প্রেম ভালবাসা দিয়ে তো মনটাকে মেরামত করা যায়।
—-নারীর প্রেম তো মুক্তোর মত। বুকের গহীনে লুকিয়ে থাকে। চোখের কার্ণিশের অনেক জল দিয়ে ওই প্রেমের সাগর তৈরী হয়। আপনি পুরুষ মানুষ। হৃদয় মেরামতের জন্য এক সাগর প্রেম আপনার বুকে জমা নেই।
—-জানি,আপনার সাথে কথায় পারা যাবে না। তবে এই অধমের আবেদন আপনার কাছে জমা দিলাম।
গুড নাইট।

রুমি ঘরে এসে রুম্মানের পাশে শুয়ে পড়ে। বেশ ঠান্ডা লাগছে। ভালই শীত পড়েছে। রুমি ভাবছে এতো জায়গায় সিভি জমা দিলাম এখন পর্যন্ত কেউ ডাকলো না। আমার ভাগ্যটাই এমন সহজে কোনকিছু পাওয়া যায় না।

অবশেষে রাশেদের আসার দিন ঘনিয়ে আসলো। এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রুমি রুম্মান আর ওর মা তিনজনেই রওয়ানা দেয়। ওখানেই জয়ার মা বাবার সাথে রুমিদের পরিচয় হয়। রাশেদ আর জয়া ঠিক সময়েই ঢাকায় পৌছে যায়। রাশেদ আর জয়া দুজনেই দুই পরিবারের সাথে পরিচিত হয়ে নেয়। জয়ার মা রুমির মাকে বলে,
—-ওরা অনেক ক্লান্ত।এতোটা পথ জার্ণি করে এসেছে। এখন বাড়ির পথে রওয়ানা দেয়া যাক। ফোনে আমরা আমাদের পরবর্তী আলোচনা করে নিবো।
—-ঠিক আছে আপা। আসি তাহলে।
রাশেদ ওর মা আর বোনদের নিয়ে বাড়ির পথে রওয়ানা হয়।
___________
হাতে সময় কম। তাই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে। রাশেদ ওর মা বোনদের সাথে চাচা চাচী মামা মামী সহ প্রায় বিশ জনের একটা গ্রুপ নিয়ে জয়াকে আনুষ্ঠানিক ভাবে দেখতে
বেলা এগারোটায় ওদের বাসায় আসলো। তারপর দুইপক্ষের আত্মীয় স্বজনের মতামতের ভিত্তিতে ওদের আক্দ করানো হলো। এরপর অনুষ্ঠানের দিন ঠিক হলো। ডিসেম্বরের ৩১ তারিখ। রাশেদ কবুল বলার পর সবাইকে সালাম দিলো।জয়ার বাবার সাথে কোলাকুলি করলো। জয়া ওর বাবা মার একমাত্র সন্তান।সময় কম থাকায় রাশেদ আর জয়ার যৌথ রিসিপশন হবে। রাশেদ জয়ার দুই চাচা এক ফুফু এক খালা এক মামার সাথে পরিচিত হলো। এ পর্যন্ত রুমির সময় ভালই কাটলো। জয়াদের বাড়িটা মিরপুর দশনম্বরে স্কাইভিউ এপার্টমেন্টের দশতলায়। সেদিন ছিলো ছুটির দিন। ২৫শে ডিসেম্বর। সবাই যোহরের নামাজ পড়তে মসজিদে গেছে। জয়াকে ঘিরে রুমিদের বাড়ির আত্মীয়স্বজন নতুন বৌ এর সাথে গল্প করছিলো।রুমি বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলো। পাশের রুমে জয়ার মা আর খালা গল্প করছিলো। ওরা মনে হয় খেয়াল করেনি রুমি বারান্দায় ছিলো। গলার স্বর নিচু করে
জয়ার মাকে ওর খালা জিজ্ঞাসা করলো,
—আপা রাশেদের একটা বোনেরও এখনও বিয়ে হয়নি।
—–রুমির বিয়ে হয়েছিলো। ডিভোর্স হয়ে গেছে।
—–তাহলে তোমার মেয়ের কপালে দুঃখ আছে।
—–কি যা তা বলছিস?
—–জ্বীনা আপা আমি ঠিক বলছি
—-ওই মেয়ের তো জয়ার সুখ সহ্য হবে না।
—–শোন ওরা তো দেশেই থাকবে না। দুজনেই কানাডায় থাকবে। সুতরাং কোন সমস্যা নাই। আর রুমি তো সারাজীবন একা থাকবে না। নিশ্চয় বিয়ে করে সংসারী হবে। শোন মীরা তোর এভাবে বলা উচিত না।
—–শোন আপা,কুমারী মেয়েদের বিয়ে দিতে আজকাল কতো বেগ পেতে হয়। তারউপর এই মেয়ে আবার ডিভোর্সি। আদৌ বিয়ে হবে কিনা ঠিক নাই। নাকি সারাজীবন ওই মেয়েকে রাশেদ আর জয়াকে টেনে নিতে হয়।
—–তুই আর এসব কথা বলার সময় পেলি না। ওদের আত্মীয় স্বজন শুনলে আমাদের সম্পর্কে কি ভাববে? এখুনি নামাজ পড়ে সবাই চলে আসবে।
রুমির মনটা বিষাদে ভরে গেলো। ব্যারিষ্টার আপা সঠিক কথাই বলেছে। ওকে খুব তাড়াতাড়ি একটা চাকরি যোগাড় করে নিতে হবে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here