বৃহন্নলার ডিভোর্স পর্ব-দশ,এগারো

0
574

#ধারাবাহিকগল্প
#বৃহন্নলার ডিভোর্স
পর্ব-দশ,এগারো
মাহাবুবা বিথী
দশ

মানুষের জীবনের পথ অনেক দীর্ঘ হয়। এই দীর্ঘপথে কত খানাখন্দ চড়াই উৎড়াই থাকে। চলার পথে কেউ কেউ হোঁচট খেয়ে তার পদস্খলন ঘটে। কিন্তু পদস্খলনের কথা আড়ালে রেখে অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ানোই ওদের জীবনের মুল লক্ষ্য হয়। মানুষকে কথার ছুরিতে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। যাকে আঘাত করে সে হয়ত অনেক আহত হয়। তবে অলক্ষে তার জীবন অনেক পরিশুদ্ধ হয়। রুমি আজকাল ঐ সব মানুষের কটুকথা ignore করতে শিখে গেছে।

রাশেদের শ্বশুরবাড়ি থেকে আকদ এর পর সবাই বাড়ি ফিরে আসলো। যদিও রাশেদের শ্বশুর ওকে থাকতে বলেছিলো কিন্তু রাশেদ রাজি হয়নি। ওর ইচ্ছা অনুষ্ঠান করেই জয়াকে নিজের বাড়িতে তুলে নিবে এবং সেদিনেই ওর বাসর হবে।
অবশেষে রাশেদ মা বোনদের জন্য ওদের পছন্দ মাফিক শপিং করে কনের জন্য শাড়ি গয়না কিনে বেশ ঘটা করে বিয়েটা করে ফেললো। রুম্মান রুমিরও ভাইয়ের বিয়েতে অনেক আনন্দ হলো।
অনেক অতিথির মধ্যে রায়হানদের পরিবারও বিয়েতে এসেছিলো। রায়হান রুমির দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরাতে পারেনি। আড়ালে গিয়ে রুমিকে বললো,
—-আপনাকে খুব মিষ্টি লাগছে। চোখ সরানো যাচ্ছে না।
—-সমস্যা নেই, চোখ সরাতে হবে না,আমিই সরে যাচ্ছি।
—–আমি কি তাই বলেছি নাকি?
—-আমাকে ওদিকটায় এমনিও যেতে হবে। এখনি ভাইয়া ভাবির রুসমত হবে।
রায়হানের সাথে রুমির কথা বলার সময় রায়হানের
মা ও রুমিকে দেখে নিলো।
রুমিকে আসলেই খুব সুন্দর লাগছিলো।

বিয়ের আসরে অনেক আত্মীয়স্বজন এসেছিলো। এখানে রুমির দূরসম্পর্কের এক ফুপুও এসেছিলো। উনি একটা এনজিওতে জব করেন। রুমির ব্যাপারটা রুমির মার কাছে জেনে ওনার অফিসে রুমিকে একটা সিভি জমা দিতে বলেন।
যাক খুব সুন্দরভাবে বিয়েটা সম্পন্ন হলো।
ওদের বিয়ের পর রুমির মা রুমি আর রুম্মানকে বললো,
—–তোমাদের দু,বোনকে একটা কথা বলি আমার অবর্তমানে তোমাদের জীবনে সবচেয়ে আপন হলো তোমাদের ভাই আর ভাবি। ওরা হয়ত তোমাদের সাথে থাকবে না তারপরও একটা সুন্দর সম্পর্ক বজায় রেখে চলবে। বড় ভাবিকে মায়ের মতো সম্মান দিবে।

মায়ের কথা শুনে রুম্মান বললো,
—-তুমি আমাকে আর আপুকে ডেকে তোমার ছেলের পক্ষে ঝোল টেনে কথা বললে। তেমনি আমাদের সম্পর্কেও ভাইয়া আর ভাবিকে তোমার কিছু বলা দরকার। কারণ অনেক সময় ভাইরা বিয়ের পর দুলাভাইদের মতো আচরণ করে। নিজের বোনকে নিজের বোন মনে হয় না। তোমার ছেলে আর ছেলের বউ যেন সেটা আমাদের সাথে না করে।
—তোকে আমায় জ্ঞান দিতে হবে না।তোদের মতো এতো বিদ্যাধারী না হতে পারি কিন্তু সংসারে চলার মতো বুদ্ধি আমার আছে। আমি রাশেদকেও যা বলার বলব।

খুব সকালে উঠে রুমি সবসময় সবার জন্য নাস্তা বানায়। প্রেসারের কারনে ওর মা সকালে উঠতে পারে না। সেদিনও ভোরে নাস্তা বানানোর সময় জয়াও কিচেনে চলে আসলো। রুমি জয়াকে বললো,
—-তুমি এতো সকালে উঠেছো কেন ভাবি? নাস্তা রেডী হলে আমি তোমাদের ডাকবো। তুমি ভাইয়াকে সময় দাও।
—–দু,দিনপর কানাডায় চলে গেলে সারাক্ষণ তোমার ভাইয়াকে সময় দিবো। তখন তোমাদেরকে তো কাছে পাবো না। তাই তোমার সাথে গল্প করতে কিচেনে চলে আসলাম। গল্পও করা যাবে আর কথার ফাঁকে তোমাকে সাহায্য করতে পারবো।
রুমি চা বানিয়ে জয়ার হাতে দিয়ে বলে,
——ভাবি, চা টা মাকে দিয়ে এসো।
রাশেদের মা জয়ার হাতে চা পেয়ে খুবখুশী হলেন।
জয়াকে জিজ্ঞাসা করলেন,
—-চা তুমি বানিয়েছ?
—–না মা,রুমি বানিয়েছে। তবে আমার চা টাও খুব ভাল হয়।
—–বস,তোমার সাথে কথা বলি
—–মা,রুমিকে একটু কাজে সাহায্য করে আপনার কাছে আসছি।
ননদ ভাবি মিলে সকালের নাস্তা রেডী করলো। তারপর রুম্মান রাশেদ আর ওর মা সবাই মিলে নাস্তার পর্ব শেষ করলো।
রাশেদের মা জয়ার আচরণে মুগ্ধ হলেন। ভাবলেন ছেলে আমার যোগ্য মেয়েকেই আমার ঘরের বউ করে এনেছে। রুমির জীবনে এমন ঘটনার পর কাউকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না। আল্লাহর কাছে দোয়া করি রাশেদের বিবাহিত জীবন যেন খুব সুখের হয়।
রুমির মা রাশেদ বড় সন্তান হিসেবে ওকে আগেই সব বলেছেন। বাবার অবর্তমানে ওই তো ওর বোনদের সবচেয়ে আপনজন।
কানাডায় চলে যাবার দুদিন আগে রাতের বেলা রুমি বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলো। রাশেদ এসে রুমির মাথায় হাত রেখে বললো,
—–তোর এতো বড় বিপদে আমি পাশে দাঁড়াতে পারিনি। তবে আমার বিশ্বাস তুই ঠিক সামলে উঠতে পারবি। মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষগুলো খুব শক্ত হয়। কারণ ওরা লড়াই করে বেঁচে থাকে। পরিস্থিতি পরিবেশ অনুযায়ী তাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সামর্থ না থাকার কারনে অনেক ইচ্ছা অকালেই ঝরে যায়। জীবনের কঠিন পথগুলিতে চলার অভিজ্ঞতা মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষগুলো শুধু উপলব্ধি করে।
—-ভাইয়া তুমি আমাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করো না। এখানে আমরা সবাই আছি। বিদেশ বিভুঁয়ে তুমি আর ভাবি একা। আমাদের খুব চিন্তা হয়। রাত অনেক হলো শুয়ে পড়ো।
দু,দিন পর রাশেদ আর ওর জয়া কানাডায় চলে যায়। ভরভরান্ত বাড়িটা হঠাৎ খালি হয়ে যায়। রুমির মারও মনটা বিষাদে ভরে থাকে। কারণ এছাড়া আর কোন অপশন ও নেই। রাশেদ বিদেশে থাকে বলে টাকা পাঠাতে পারে। ও বলেছে সামনে টাকার পরিমান আরও বাড়িয়ে দিবে। জিনিস পত্রের যে দাম বেড়েছে। কুলানো যাচ্ছে না।

রুমির ফোনটা বেজে উঠলো। ব্যারিষ্টার রাবেয়া ফোন দিয়েছে।
—-হ্যালো রুমি দুদিন পর কেসের ডেট পড়েছে। ওইদিন সব ফয়সালা হবে। ওরা আরও পেছাতে চাচ্ছিলো। আমি রাজি হইনি। আবীরের বাবা মারা গিয়েছে। ডেভেলপারের বিজনেসে কি একটা ঝামেলা হওয়ায় সাব্বির জেলে রয়েছে। ওসব শুনে আমাদের কি লাভ। আমরা আমাদের পাওনাটুকু চাই। ওই দিন দেনমোহরের টাকাও দিবে আর একটা পিকআপ নিয়ে মালপত্র আনার জন্য ওদের বাসায় যেতে হবে।
—-আপু আমি কি যাবো?
—-হ্যাঁ তোমাকেই যেতে হবে। আমিও যাব। তবে দুটো পুলিশ সাথে নিবো।
ফোনটা রেখে রুমি ভাবছে, পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না। তারপর মানুষ একই পাপ বারবার করে যায়। আর যুগ যুগ ধরে পাপের শাস্তি ভোগ করে।

অবশেষে সেই কাঙ্খিত দিনে রুমি যথাসময়ে ব্যারিষ্টার রাবেয়ার কাছে চলে যায়। তারপর মামলার আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ওরা একটা পিকআপ ভাড়া করে। ব্যারিষ্টার রাবেয়া দুটো পুলিশ আগেই রিকুইজিশন দিয়ে রাখে। তারাও সঠিক সময়ে চলে আসে। তারপর সবাই মিলে আবীরদের বাসায় চলে যায়। ওর মা শুধু বাসায় ছিলো। দরজা খুলে দিয়ে ব্যারিষ্টার রাবেয়া হাতে দেনমোহরের একলক্ষ টাকা তুলে দেয়। সে সময় আবীরদের উকিল ও উপস্থিত ছিলো। আবীরের মাকে দেখে রুমির খুব খারাপ লাগে। দোর্দন্ড প্রতাপশালী মহিলাকে আজ বড় অসহায় মনে হলো।
রুমি ওর আলমারীর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়। আলমারীর দরজাটা ভেঙ্গে গেছে। কারণ চাবি তো রুমির কাছে ছিলো। ওরা নিশ্চয় দরজা খোলার চেষ্টা করেছে। খুলতে না পেরে ভেঙ্গে ফেলেছে। রুমি ব্যারিষ্টার রাবেয়ার পেমেন্ট দিতে চায়। তখন উনি বলেন
—–রুমি আমি তোমার কাছে কোন পেমেন্ট নিতে পারবো না। তোমার সাথে সহযোদ্ধা হয়ে লড়াইয়ে অংশ নিয়েছি এটাই আমার জীবনের অনেক বড় সৌভাগ্য। আর তুমি কোন প্রাইভেট ভার্সিটিতে ল,তে ভর্তি হয়ে যাও। পড়াশোনা করো দেহ মন ভাল থাকবে। আমি আসি।পরে আবার দেখা হবে।
রুমির কাছে বিদায় নিয়ে রাবেয়া বাড়ির পথে রওয়ানা হয়।
রুমি ভাবে এদের মতো পরোপকারি মানুষগুলো পৃথিবীতে বাস করে। আবার আবীরের মায়ের মতো জল্লাদও বাস করে। এটাই দুনিয়া। শয়তান আর ফেরেস্তার পাশাপাশি নিবাস।

মালপত্র নিয়ে পুলিশ সহ রুমি ওদের বাসায় চলে আসে। সন্ধা হয়ে যায়। ঘরে মালগুলি তোলার পর কিছু বখশিস দিয়ে পিকআপের ড্রাইভার আর পুলিশকে বিদায় করে দেয়। মাগরিবের আযান শোনা যায়। রুমির মা রুমিকে বলে,
—-তোর গয়নাগাটি টাকা সব ঠিক মতো বুঝে নিয়েছিস।
—-নিয়েছি মা।
—–জিনিসপত্রগুলো ফেরত পেয়ে এতো খারাপ লাগার মধ্যেও কিছুটা ভাল লাগছে।রুমি মা তুই ওগুলো যত্ন করে রেখে দে।
—-মা আমি গয়নাগুলো রুম্মানকে দিয়ে দেই।
রুম্মান শুনে বলে,
—-ওগুলো তোমার। তোমারি থাক।ভাইয়া ভাবির জন্য গয়না কিনতে পারলে আমার জন্য পারবে।আমিই বা কেন তোমার গয়না নিতে যাবো?
রুমির মা বলে,
—-রুম্মান সঠিক কথা বলেছে। তোরা নামাজ পড়ে নে আমি চা বানিয়ে আনছি।
সারাদিন অনেক ঝক্কি ঝামেলা গিয়েছে। তাড়াতাড়ি ডিনার শেষ করে রুমি শুয়ে পড়ে। হঠাৎ মোবাইলের টুংটাং শব্দে রুমির ঘুম ভেঙ্গে যায়। ওয়াশরুম ঘেকে এসে মোবাইল ওপেন করে দেখে রায়হান মেসেজ পাঠিয়েছে।
—-ভাইয়ের বিয়ে খেতে গিয়ে ডুমুরের ফুল হলেন নাকি?
—-তা আর হতে দিলেন কই। ঠিক তো খুঁজে বার করলেন।
—-আপনার মামলার ফয়সালা হয়েছে
—হুম
—–আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই।
—–আমি খুব ব্যস্ত। আজরাইল ও এসে যদি দেখা করতে চায় তাহলে কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।
—-আপনি কি জানেন? আপনি একজন রসকষহীন মানুষ।
—গাছে যখন একটা ফল পাকে সঠিক সময়ে না খেলে ফলটা শুকিয়ে যায়। ফলটা রসহীন হয়ে পড়ে। প্রেম প্রীতি ভালবাসা সঠিক সময়ে গ্রহন করতে হয়।তানা হলে সব অতলান্তিক গহ্বরে হারিয়ে যায়। তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। আমার অবস্থাটা অনেকটা সেরকম। খুব ঘুম পাচ্ছে। গুড নাইট।

“আমার শহরটা আজ বড় নির্জন
একাকীত্বের মাঝে আমার বাস
হৃদয়ের জমিনটাতে হয়নি ভালবাসার চাষ
একদিন তোমার কাছে আমি ছিলাম মুল্যহীন
আজ তুমি আমার কাছে বড্ড অর্থহীন”।

চলবে

#ধারাবাহিকগল্প
#বৃহন্নলার ডিভোর্স
পর্ব-এগারো
মাহাবুবা বিথী

রুমির বরাবর ভোরে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস। ফজরের নামাজ পড়ে দিনটা শুরু হলে রুমির খুব ভাললাগে। যদিও সব সময় হয়ে উঠে না। আজ ও চাকরিতে জয়েন করবে। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে নিয়েছে। সকালের নাস্তা বানিয়ে দুপুরের রান্নাটাও একটু এগিয়ে রাখবে। কাজের খালাকেও সকালে আসতে বলেছে। রুমি অফিসে যাওয়ার আগেই ঘর মুছে খালা যেন চলে যেতে পারে। যা দিনকাল পড়েছে কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। মা বাসায় একা থাকে তার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বাসায় রুমি স্থায়ী লোক রাখতে পারে না। ইদানিং বাসায় গৃহকত্রীর হাতে যেমন গৃহকর্মী খুন হন তেমনি গৃহকর্মীর হাতেও গৃহকর্ত্রীও খুন হন।

রুমি সব কিছু গুছিয়ে দিয়ে মায়ের ঘরে গিয়ে বললো,
—-মা আমার জন্য দোয়া করো। আজ প্রথম অফিসে যাচ্ছি।
—-দোয়া ছাড়া দেওয়ার মতো আমার আর কিছু নাইরে মা।
—-আম্মু ঐ অমূল্য রতনটাই তোমার কাছে চাই। মা আসি।
রুমির দিকে তাকিয়ে ওর মা ভাবে
—-মেয়েটা আমার অসম্ভব ভালো। অথচ ওর ভাগ্যটা কি রকম হয়ে গেলো?
কথায় আছে,
“অতি বড় ঘরনী না পায় ঘর
অতি বড় সুন্দরী না পায় বর”
কি জানি আমার মেয়েটার ভাগ্যে কি লেখা আছে?
রুমি অফিসের দিকে রওয়ানা হলো। ওর অফিসটা মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে একটি পাঁচতলা ভবনে।
রুমি অফিসে ঢুকে ওর ফুফুর সাথে দেখা করলো। নিজের কাজের দায়িত্ব বুঝে নিলো। এটা এনজিও হওয়াতে ফিল্ডওয়ার্ক করতে হয় বেশী। তারপর ওর বসের সাথে দেখা করতে ওনার রুমে গেলো।
—May I come in sir
—-yes! আপনি কি আজই জয়েন করলেন?
—-হ্যাঁ স্যার।
কাজের প্রজেক্ট নিয়ে কিছু কথাবার্তা হলো।
বসটাকে দেখে রুমির একদম ভালো লাগেনি। কেমন যেন লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলো। রুমির শরীরটাও ঘিন ঘিন করে উঠলো। ওর বমি উঠে আসতে চাইলো।
রুমি পরিচিত হয়ে ওনার রুম থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে গেলো। যতক্ষণ রুমি ওনার সামনে বসেছিলো নজরটা রুমির বুকের দিকেই ছিলো। মেয়েরা নাকি পুরুষের খারাপ নজরটা বুঝতে পারে। ওনাকে রুমির সুবিধার মনে হয়নি। খুব সাবধানে থাকতে হবে। রুমি তো এই মূহুর্তে চাকরি ছাড়তে পারবে না। কারণ এই অফিসের সাথে এক বছরের কন্ট্রাক্ট করা হয়েছে। অফিসের অন্যান্য কলিগদের সাথে ব্যস্ততার মাঝে ভালই সময় পার হলো। রুমির পাশের ডেস্কে মারিশা বসে। মেয়েটা বেশ মিশুক। শুধু একটু বেশী কথা বলে। রুমি ভাবছে বেশী কথা বলার একটু সুবিধা আছে। অনেক গোপন কথা বলা হয়ে যায়। মারিশাও বললো,
—-রুমি তোমার সাথে বসের কথা হয়েছে?
—–হ্যা হয়েছে।
—–তোমার ওনাকে কেমন লেগেছে?
—–বসেরা যেমন হয় তেমন
—–জ্বীনা আমি তোমার সাথে এক মত না। সব বসেরা একরকম হয় না। এই বসের আলুর দোষ আছে।
—–ওটা আবার কি দোষ?
—–ফিডারে মনে হয় দুধ খাও। কিছু মনে হয় বুঝ না?আরে লুইচ্ছা বেডা। মেয়ে মানুষ দেখলে ওনার জিহ্বা লক লক করে। বড়লোকদের বাড়ির গেটে দেখবা, অনেক সময় লেখা থাকে। কুকুর হইতে সাবধান। আর এই অফিসে বস হইতে সাবধান থাকতে হবে।
রুমি নিজের কাছেও বসের হাবভাব ভাল লাগেনি। ফাইলটি যখন বসের হাতে দেই উনি আমার হাতটা ধরে ফেলে। আমি অস্বস্তি বোধ করলে উনি এমন ভাব করলো ভুলক্রমে হাত লেগে গেছে।
অফিস শেষে ছুটির সময় হঠাৎ একটা গাড়ি সামনে এসে দাঁড়ায়।
রুমি একটু অবাক হয়ে গাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। জানালায় কালো কাঁচ থাকার কারনে ভিতরের আগুন্তক কে চেনা যাচ্ছিলো না।
গাড়ির কাঁচ খুলে মুখটা বাড়িয়ে বললো,
—চলেন একটা লিফট দেই
—–ধন্যবাদ স্যার। ওনার তাকানোটা দেখলেই রুমির বিরক্ত লাগে। তারপরও ভদ্রতা বজায় রেখে বললো
—-আমার একটু বাইরে কাজ আছে। বাজার করতে হবে। আপনার বাসাতো গুলশান। আমার মিরপুর এক নাম্বার। আপনার ঘুর পথ হবে।

মিরপুর এক নাম্বারের কথা শুনে স্যার আগ্রহ দেখালো না। রুমির তাতে সুবিধাই হলো। তবে একটা অস্বস্তি রয়ে গেলো।
অফিস থেকে ফিরে ফ্রেস হয়ে রুমি মায়ের ঘরে গিয়ে বললো,
—-সারাদিন বাসায় একা থাকতে তোমার খারাপ লেগেছে?
—–নারে মা। বিকালে রুম্মান বাসায় ফিরেছে। তখন ওর সাথে কিছুক্ষণ গল্প করেছি।
—–মারে,এখন তুই তোর জীবনটাকে নিয়ে ভাবতে পারিস। সময়তো কারো জন্য অপেক্ষা করে না। রায়হান ছেলেটা খুব ভাল। আর ওর মাও তোকে খুব পছন্দ করে।
—–মা, আমি তোমাকে আগেও বলেছি এখনও বলছি, ভবিষ্যতেও বলবো নিজেকে পরিপূর্নভাবে প্রতিষ্ঠিত না করে আমি বিয়ে করবো না। এতে যদি রুম্মান আগে বিয়ে করতে চায় এতে আমার কোন আপত্তি নাই। আমি ল,তে ভর্তি হয়েছি। এবার পড়াশোনাটা ভালভাবে করতে চাই।
রুমির মা আর কিছু বললেন না। আসলেই রুমিকে একটু সময় দেওয়া উচিত।

__________
রুমির বসের নাম আলম খান। সবাই ওনাকে আলম সাহেব বলে ডাকে। লোকটার স্বভাবচরিত্রে আসলেই গোলমাল আছে। অফিসের শেষ মূহুর্তে এসে রুমির হাতে কাজ ধরিয়ে দেয়। আস্তে আস্তে পুরো অফিস খালি হয়ে যায়। রুমির ভয় লাগে তাই বুদ্ধি করে রুম্মানকে ফোন দিয়ে বলে,
—–রুম্মান তোর ক্লাস শেষ।
—–হ্যা আপু
—–তাহলে তুই আর আসিফ আমার অফিসে চলে আয়।
ওরা যথাসময়ে অফিসে চলে আসে। আলম সাহেব ওদেরকে দেখে বিরক্ত হয়ে রুমিকে জিজ্ঞাসা করলো,
—–ওরা অফিসে কেন?
—–স্যার একসাথে বাড়ি ফিরবো।
কোনক্রমেই রুমিকে বাগে আনতে পারছে না। এদিকে রুমিও ওর ফুফুকে কিছু বলতে পারছে না। ওনার আচরণে ঘাপলা আছে রুমি বুঝতে পারছে কিন্তু ওর হাতে তো কোন প্রমান নেই। প্রমান ছাড়া কেউ বিশ্বাস করবে না।
তাই রুমির নিজেকেই সাবধান থাকতে হচ্ছে।ওদের অফিস থেকে একটা টিম কক্সবাজার যাবে। সেখানে আলম সাহেব ওর ফুফুর সাথে রুমির নামও আছে। এছাড়াও দুজন মহিলা কলিগ আরও দুজন পুরুষ কলিগ যাবে। সবাই একসাথে দলবেঁধে যাওয়াতে রুমির টেনশন কমলো।

যথাসময়ে ওরা কক্সবাজার পৌছে গেলো। ওরা সবাই কক্সটুডেতে উঠেছে। হোটেলে লাগেজ রেখে সবাই বীচে চলে গেলো। তখন সন্ধে হয়ে আসছিলো। এখনি সূর্যডুববে।তাই সবাই বীচে গেলো। রুমিও ওদের সাথে ছিলো। সবাই খুব আনন্দ করছে। রুমির ফুফু রুমিকে ডাকলো,
—–এই রুমি এদিকে আয়। চল একটু পানিতে নামি। —–না,ফুফু ইচ্ছে করছে না। আমি ছাতার নীচেই বসে থাকি।
ভীড় এড়াতে একটু নিরিবিলি জায়গায় রুমি বসে আছে। এসময়টা এমনিতেই পর্যটকদের ভীড় থাকে। বড় বড় ঢেউ তীরে আছড়ে পড়ছে। কান পাতলেই শোনা যায় সমুদ্রের ফুঁসে উঠা গর্জন। কাঠফাটা রোদের পর সন্ধার শীতল বাতাসে শরীরটা জুড়িয়ে যায়।
সন্ধার আলো আঁধারীতে চারিদিক ঢেকে আছে। এমন সময় লুইচ্ছাটা রুমিকে জড়িয়ে ধরে বললো,
—-তুমি তো ডিভোর্সি।স্বামীর সঙ্গ পেতে ইচ্ছে করে না।
—-রুমি একদলা থুথু ছিটিয়ে দিয়ে একঝটকায় সরে গেলো।
এইভাবে রুমি রিঅ্যাক্ট করবে শয়তানটা বুঝতে পারেনি।
এমনসময় ওখানে রুমির ফুফুও চলে এসে বলে,
—-তুই আমাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিস। তোকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
রুমি কিছু বলার আগেই আলম সাহেব বললো,
—–চিন্তার কিছু নেই নাজনীন। তোমার ভাতিজী আবার আমার অফিসের কর্মচারী। ওর দিকে তো আমার নজর রাখতেই হবে।
সবাই মিলে হোটেলে ফিরে গেলো। মানসিক চাপ নিতে না পেরে রুমির প্রচন্ড জ্বর আসলো। সারা রাত রুমি ঘোরের মধ্যে ছিলো। ভোরের দিকে জ্বরটা ছাড়লো। রুমির ফুফু রুমির সাথেই ছিলো। সকালে সবাই ফিল্ডে চলে গেলো। রুমি একাই রুমে ছিলো। ওর শরীর এতো দূর্বল ছিলো যে ওর হাঁটার শক্তি ছিলো না। ও রুমের ছিটকিনি লাগিয়ে জেগেই ছিলো। কেন যেন মনে হচ্ছে শয়তানটা আবার আসবে। ঠিক ঘন্টা তিনেক পর কে যেন ওর দরজায় নক করছে। রুমি ঘুমের ভাণ করে বিছানায় পড়ে থাকলো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here