বেদনার_রঙ_নীল,২৬,২৭

0
320

#বেদনার_রঙ_নীল,২৬,২৭
ছাব্বিশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz

” তোদের মাঝে অনেক কিছু হয়। কিন্তু তোরা আমাকে জানাস না। আমি কি তোদের কেউ না?”

চোখ বুঁজে অভিযোগ ছুঁড়ে দিল তন্বী। তুলি হাসতে হাসতে বলল,” আচ্ছা স্যরি। এখন থেকে তোকে সব জানাবো।”

” তাহলে বল, রাইফা ভূতের মতো বারান্দায় বসে আছে কেন সারারাত? তার কি হয়েছে?”

তুলি খোশমেজাজে বলল,” রোমিওর ফিমেইল ভার্সন।”

তন্বি আগ্রহী হয়ে উঠল। তুলি সবকিছু বিস্তারিত বলতে লাগল। তন্বি শুধু বিস্মিত হচ্ছে। এতোকিছু ঘটে গেল আর সে জানলোই না! আবারও অভিযোগ ছুঁড়ল সে,” তোরা দু’জনেই গভীর জলের মাছ। একটা ঘটনাও আমাকে বুঝতে দিলি না।”

তুলি চোখ সরু করে বলল,” তোর জায়গায় আমি হলে সব বুঝে ফেলতাম৷ তুই বলদি তাই বুঝিসনি কিছু।”

” একটু-আধটু আন্দাজ করতে পেরেছি। তোর আর প্রণয়ের ব্যাপারটা রাইফা আমাকে বলেছিল। কিন্তু রিসবের কথা একবারও সে বলেনি।”

তুলি নিরাশ কণ্ঠে জানাল,” আমাকেও বলেনি।”

ধীরে ধীরে আকাশ আলোকিত হচ্ছে। তুলি হাই তুলে বলল,” ঘুমা এখন। একটু পরেই ক্লাসে যেতে হবে।”

” আজ আমার ক্লাস নেই। আমি তো আরামে ঘুমাবো। ”

সকাল সাড়ে আটটায় রাইফা আর তুলি কোচিং-এর উদ্দেশ্যে রওনা হলো। তাদের ক্লাস শুরু হবে নয়টা দশে। রাইফা সারারাত ঘুমাতে পারেনি বলে গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়ল। গন্তব্যে পৌঁছানোর পর তুলি তাকে ডাকতে লাগল,” এই রাফু, ওঠ।”

রাইফা বিড়বিড় করে বলল,” তুই যা। আমি আজ সারাদিন গাড়ি নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবো।”

” মানে? মাথাখারাপ হয়ে গেছে নাকি তোর?”

” অলমোস্ট!”

” তুই কি ক্লাসে যাচ্ছিস না?”

” উহুঁ।”

তুলি আর কিছু বলল না। রাইফার সাথে তর্ক করার সময় তার হাতে নেই। পাবলিকে চান্স না পেলেও উত্তর-দক্ষিণ যেকোনো এক জায়গায় রাইফা ভর্তি হয়ে যেতে পারবে। কিন্তু তুলির সেই সামর্থ্য নেই। তাকে পাবলিকেই পড়তে হবে। সেজন্য পড়াশুনায় সিনসিয়ার হওয়া অতি জরুরী। আর নিজের চরকায় তেল দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। রাইফাকে ছাড়াই গাড়ি থেকে নামল তুলি। কিন্তু কোচিং-এর সামনে আসতেই সে হতভম্ব। প্রণয়ও গাড়ি থেকে নামছে। চিনতে বেশি সুবিধা হলো কারণ এই গাড়িতে করেই বিয়ে থেকে পালিয়েছিল তুলি। এতোদিন পর গাড়িটা আবার নিজের রূপে ফিরে এসেছে। তুলি সামনে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,” আরে, আপনি এখানে কেন? আপনার না দুইদিন বেডরেস্টে থাকার কথা ছিল?”

প্রণয় মৃদু হাসল। মোলায়েম কণ্ঠে জবাব দিল,

” আপাতত আমার হার্ট রেস্ট বেশি দরকার। ” এই কথা শুনে তুলির পুরো শরীর লজ্জায় কাঁটা দিয়ে উঠল। খানিক অপ্রস্তুত গলায় বলল,” আপনি আমার সাথে দেখা করার জন্য কোচিং-এ এসেছেন?”

” আজকে আমার ক্লাসও আছে।”

” কিন্তু আপনি তো ফিজিক্সের ক্লাস নেন।”

” তাই বলে কি আমি কেমিস্ট্রি পারি না?”

প্রণয় সিঁড়ি ভেঙে উঠতে লাগল। তাকে দেখে মেয়েরা সালাম দেওয়া শুরু করল। প্রণয় সালামের উত্তর নিতে নিতে তুলির দিকে চেয়ে চোখ টিপল। তুলি বিড়বিড় করে বলল,” পাগল।” তারপর সে হেসে ফেলল। তার ভালো লাগছে খুব। সকালটা সুন্দরভাবে শুরু হয়েছে।

প্রণয়কে কেমিস্ট্রি ক্লাসে দেখে টিনা খুশিতে ডগমগ। অবনী উল্লাসের চিৎকার দিয়ে বলল,” ইয়েস! ভাইয়া আপনি আজকেও আমাদের ক্লাসে? আপনি ক্লাসে এলে আমার অনেক ভালো লাগে।”

মীরা গালে হাত রেখে বলল,” ওরে বাবা, তাই নাকি?”

প্রণয় হাসিমুখে বলল,” তোমাদের ক্লাসে একটা ম্যাগনেটিক ফোর্স আছে। আমাকে টেনে নিয়ে আসে বার-বার।”

টিনার মুখ গোমরা হয়ে গেল। কেউ বলে না দিলেও তুলি বুঝতে পারছে, ম্যাগনেটিক ফোর্স বলতে প্রণয় তাকেই বোঝাচ্ছে। সামনে থেকে একটি মেয়ে বলল,” সেই ম্যাগনেটিক ফোর্সটা কে ভাইয়া? স্পেশাল গার্ল?”

সবাই উৎসাহী হয়ে তাকাল। তুলি লজ্জায় কাবু। প্রণয় গম্ভীর হয়ে পড়াশুনার বিষয়ে কথা বলা শুরু করল। সবাই আশাহত। স্পেশাল গার্লের নাম আজকেও জানা হলো না। প্রণয় বলেছিল বিদায়ের দিন বলবে।

বোর্ডে লিখতে প্রণয়ের অসুবিধা হচ্ছিল৷ কারণ তার ডানহাতের মাসলে ব্যথা। তুলি ব্যাপারটি লক্ষ্য করে বলল,” ভাইয়া, আমার বোর্ডে লিখতে ভালো লাগে। আজকে কি আমি লিখতে পারি?”

” কি লিখতে চাও?”

” লেকচার। আপনি বলবেন আর আমি লিখবো।”

সবাই সমস্বরে উচ্চারণ করল,” না।” প্রণয় অবাক হয়ে বলল,” তুমি কেন লিখতে চাইছো?”

তুলি ফিসফিস করে বলল,” আপনার হাত এখনও ঠিক হয়নি।”

এই কথা শুনে প্রণয় হাসল। সবাইকে অসন্তুষ্ট করে প্রণয় তার দিকে মার্কার পেন বাড়িয়ে দিল। তুলি উৎফুল্ল হয়ে বেঞ্চ থেকে বের হলো। বোর্ডের কাছে এসে লিখতে শুরু করল। প্রণয় বিক্রিয়া বলে দিচ্ছিল আর তুলি লিখছিল। কিছু বিক্রিয়া তো প্রণয়কে বলতেও হলো না। তুলি নিজেই লিখে ফেলছে।

রাইফা চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে ঘুম কাটিয়ে নিল৷ তারপর ড্রাইভারকে বলল,” আপনি চলে যান আঙ্কেল।”

” কোথায় যাবো?”

” আজকে সারাদিন আপনার ছুটি।”

ড্রাইভার অবাক হয়ে তাকাল। রাইফা ব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করে ড্রাইভারের হাতে দিয়ে বলল,” চিল করুন।”

ড্রাইভার খুশি মনে টাকা গ্রহণ করল। সে বের হয়ে যাওয়ার পর রাইফা নিজে ড্রাইভিং সিটে এসে বসল। ড্রাইভ করতে কর‍তে সে ভাবছিল, একটি অদ্ভুত সুন্দর দিনের কথা।

সেদিন বৃষ্টি ছিল। আকাশে নয়, রাইফার চোখে। বৃষ্টির বন্যা বয়ে যাচ্ছিল। রিসব চলে যাচ্ছে। কবে আসবে তার নাকি ঠিক নেই৷ রাইফা সদ্য কলেজে ভর্তি হওয়া আবেগী মেয়ে। মিষ্টির কাছে সে উচ্চতর গণিত পড়তে আসতো। চুপি চুপি রিসবকে দেখা, দুই একবার কথা বলা, এভাবেই কিশোরী মনে গাঢ় অনুভূতির সঞ্চার ঘটে গিয়েছিল অচিরে। সে চলে যাওয়ার সময় রাইফা উপলব্ধি করে, মানুষটিকে সে অসম্ভব ভালোবাসে! যেদিন রিসব যাবে তার আগের দিন সারারাত রাইফা ঘুমায়নি। সকালে হন্তদন্ত অবস্থায় ছুটে গিয়েছিল মিষ্টিদের বাড়িতে। রিসবের কাছে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল,” আপনি যদি আর না আসেন তাহলে আমি আপনার সঙ্গে কোনোদিন কথা বলবো না!”

তার এমন বাচ্চামোতে রিসব অনেক হেসেছিল। সে যদি ফিরেই না আসে তাহলে এমনিতেও কথা হবে না আর। আলাদা করে কথা বন্ধ করার প্রয়োজন নেই। তবে রিসব বলেছিল,” যদি জয়ী হই তাহলে আমি ফিরে আসবো। দোয়া কোরো যেন জয়ী হই।”

রাইফা চোখের জল মুছে বলল,” ওয়াদা করছেন?”

রিসব একটু ভেবে বলল,” কিসের জন্য ওয়াদা? জয়ী হওয়ার জন্য?”

” উহুম। ফিরে আসার জন্য।”

” যদি জয়ী হই তবেই ফিরে আসবো রাইফা। নয়তো আসবো না হয়তো।”

রাইফা কেঁদে ফেলে বলল,” তাহলে ওয়াদা করুন জয়ী হবেন!”

” তুমি কেন কাঁদছো?”

” জানি না। আমি চাই আপনি ফিরে আসেন!”

” আমি কারো চাওয়া পূরণ করার দায়িত্ব নিতে চাই না। তাই ওয়াদাও করতে পারছি না।”

রাইফা অভিমান করে বলল,” আপনি খুব রুড!”

রাইফার মনে আছে, সেদিন রিসবের ঘর থেকে যাওয়ার সময় দরজার সঙ্গে তার গায়ের ওরনাটা আটকে গেছিল। কিছুতেই ছুটানো যাচ্ছিল না। রাইফা অধৈর্য্য হয়েই ওরনা গা থেকে ফেলে চলে এসেছিল। তারপর? রিসব কি এমনি নিজের আলমারিতে ওরনাটা তুলে রেখেছিল? নাকি… জানে না রাইফা। তবে আজ এতোদিন পর ওরনাটা আবার তার কাছে! সে হাতে নিয়ে ওরনার ঘ্রাণ নিল। অন্যহাত দিয়ে ড্রাইভিং করছিল। তখনি দেখতে পেল সামনে একটি বিশাল ট্রাক আসছে। রাইফা চেঁচিয়ে উঠল।

ক্লাস শেষে তুলির বের হতে একটু দেরি হয়ে গেল। সে নিচে নেমে দেখল যথারীতি প্রণয় দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি নিয়ে। তুলিকে দেখেই সে বলল,” আসুন ম্যাডাম।”

তুলি মিষ্টি হেসে বলল,” এখন না। আগে আমি পানিপুরি খাবো।”

প্রণয় একটু চমকে বলল,” এখানের পানিপুরি খাবে?”

” তো কোনখানের? এখন কি পানিপুরি খাওয়ার জন্য দিল্লি যাবো নাকি?”

প্রণয় ফিসফিস করে বলল,” অনেক আনহাইজেনিক। একটু আগে আমি দেখলাম লোকটা হাত দিয়ে..”

প্রণয় বাকি কথা বলার আগেই তুলি ধমকে উঠল,” শাট আপ। যেটা নিজের চোখে দেখিনি সেটা শুনতেও চাই না।”

” শুনলে তুমি আর খেতে পারবে না।”

” এজন্যই শুনবো না। আমি অবশ্যই খাবো এবং আপনাকেও খাওয়াবো।”

” ইম্পসিবল।”

” যদি না খান তাহলে আমি আপনার গাড়িতে উঠবো না।”

প্রণয় বিস্মিত কণ্ঠে বলল,” এটা কেমন কথা?”

” এটা আমার জেদের কথা।”

তুলি কিছুক্ষণ পর পানিপুরি নিয়ে প্রণয়ের সামনে এলো। একটা পুরি উঠিয়ে বলল,” হাঁ করুন।”

প্রণয় মুখে হাত চেপে ধরল। দুইপাশে মাথা নেড়ে বলল,” ছিঃ, না।”

” ঠিকাছে। তাহলে আমিও আপনার সঙ্গে যাবো না।”

” সমস্যা নেই। আমার সঙ্গেই তোমার যেতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই।”

তুলি একটু অবাক হয়ে বলল,” তাই? তার মানে আমি একা চলে যাবো?”

” তোমার উইশ!”

তুলি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পানিপুরি মুখে দিল। রাগে মামাকে বলল,” বেশি করে ঝাল দিন মামা। এটা তো পানসে লাগছে। বোম্বাই মরিচ কই?”

মামা বেশি করে বোম্বাই মরিচ কেটে তুলির বাটিতে ঢাললেন। খেতে খেতে তুলির চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল। প্রণয় হাত ভাঁজ করে শান্ত দৃষ্টিতে তার কান্ড দেখছিল৷ তুলির খাওয়া শেষ হলে প্রণয় বিল দেওয়ার জন্য পকেট থেকে টাকা বের করল। মামা বলল,” পাঁচশো টাকা ভাঙতি হবে না।”

” কীপ দ্যা চেঞ্জ।”

মামা বুঝল না প্রণয়ের কথা। তুলি খপ করে টাকাটা উঠিয়ে বলল,” আপনার বড়লোকি টাকা আপনার কাছেই রাখেন।”

এই বলে সে নিজের ব্যাগ থেকে একশো টাকা বের করে দিয়ে দিল। প্রণয় হাসছিল। তুলি রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে একটা রিকশা নিল। প্রণয় রিকশাওয়ালা মামাকে বলল,” আস্তে যাবেন মামা। খুব সাবধানে।”

তুলি দরাজ গলায় বলল,” আপনি দ্রুত যাবেন মামা। যেন কোনো গাড়ি আমাদের ফলো করতে না পারে।”

প্রণয় হা-হা করে হাসল। রিকশা চলতে শুরু করেছে। প্রণয় গাড়ি নিয়ে তুলির রিকশাকে অনুসরণ শুরু করল।

চলবে

#বেদনার_রঙ_নীল
সাতাইশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz

একঝাঁক মানুষ রাইফাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। এলোমেলো নিশ্বাস ছেড়ে রাইফা নিজের মাথায় হাত চেপে ধরল। কোনো ক্ষতি হয়নি। কিন্তু চোখের পলকে ধ্বংসাত্মক একটা এক্সিডেন্ট ঘটে যেতে পারতো। সেই কথা ভেবেই শিউরে উঠছে মন। বৃদ্ধা একজন রাইফার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,” ঠিকাছো তুমি মা?”

রাইফা মাথা নাড়ল। তারপর গাড়িতে উঠে সবাইকে উপেক্ষা করে চলতে শুরু করল। সবাই তড়িঘড়ি করে সরে যাচ্ছিল। রাইফার চোখে পানি জমছে। আজ তার কি হয়ে গেছে? সে কি খুশিতে আত্মহারা নাকি বিষণ্ণতায় গোবেচারা?

প্রণয়দের ডুপ্লেক্স ভবনে গাড়ি থামল। রিসবের ঘরের ঝুল বারান্দায় কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে রাইফা ভেতরে প্রবেশ করল।বেল চাপতেই দরজা খুলে দিল একটি কিউট মেয়ে। রাইফা অল্প অবাক হলো।

” কে তুমি?”

মেয়েটি জবাব না দিয়ে পেছনে তাকাল। শান বেরিয়ে এলো। ভ্রু কুচকে বলল,” তুমি এইখানে এইসময় কি করছো?”

রাইফা কোমরে হাত গুঁজে শাসনের ভঙ্গিতে বলল,” তোমাকে কৈফিয়ৎ দিতে হবে?”

” অফকোর্স! আমার বাড়ি!”

” ইশ, আসছে আমার বাড়িওয়ালা!”

শানকে উপেক্ষা করে ভেতরে প্রবেশ করল রাইফা। আরও কিছু ছেলে- মেয়ে এখানে আছে। সবাই থ্রিডি দেখছে। ঘরের অবস্থা নাজেহাল। রাইফা কয়েকবার হোচট খেল। বোঝাই যাচ্ছে বাড়িতে কেউ নেই। সে কপালে হাত ঠেঁকিয়ে বলল,” কি নোংরা! সবাই কোথায় গেছে শান?”

শান উত্তরে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,” আমি জানি না। তুমি এখান থেকে চলে যাও।”

” যাবো। আগে বলো তোমার ভাইয়া কোথায়?”

” বাইরে আছে। ঘরে নেই। তাই ঘরে খুঁজে লাভ নেই।”

শানের কথার ঢং-এ সবাই মৃদু হাসল। রাইফা ক্ষেপে বলল,” তাহলে বাইরে কোথায় আছে সেটা বলো!”

শান বলতে নিয়েও থেমে গেল। সরুদৃষ্টিতে তাকাল” তুমি জেনে কি করবে? ভাইয়াকে তোমার কেন দরকার?”

রাইফার এবার মেজাজ খারাপ হলো খুব। সারারাত না ঘুমানোর কারণে মাথা ধরে আছে এমনিতেই। মেজাজটাও একশো ডিগ্রী। সেন্টার টেবিল থেকে প্রিংগেলস চিপসের বয়ম তুলে বলল,” এইটা দিয়ে তোমার মাথা ফাটিয়ে দিবো যদি না বলো।”

শান চটপট করে উত্তর দিল,” এটা আমার মাথায় মারলে এটাই ফাটবে। আমার মাথায় কিছু হবে না। কিন্তু তুমি চিপস ফেলে দিয়েছো। আগে চিপস তুলে রাখো তারপর বলবো।”

রাইফা নিচে তাকিয়ে দেখল প্রিংগেলসের অনেকগুলো চিপস নিচে পড়ে গেছে। রাইফার মাথা গরম থাকলেও শানের সাথে এই নিয়ে তর্ক করতে গেল না সে। শানের সাথে তর্ক করা মানেই ব্যর্থতা নিশ্চিত। রাইফা বাধ্য হয়ে চিপস কুঁড়াতে লাগল। সব উঠানোর পর হাঁফ ছেড়ে বলল,” নাও তুলেছি। এখন বলো, তোমার ভাইয়া কোথায়?”

শান দুষ্ট হাসি দিয়ে বলল,” বলবো। তার আগে আমাদের সাথে একটা গেমস খেলতে হবে।”

সবাই আবারও হেসে উঠল। রাইফা দাঁতে দাঁত পিষল। আঙুল উঁচু করে ধমকাল,” এবার বেশি হচ্ছে শান। বলো নাহলে আমি তোমার থ্রিডি গ্লাস ভেঙে ফেলবো।”

” ভেঙে ফেললেও গেইম খেলতে হবে।” শানের কথায় পাশের মেয়েটি খিকখিক করে হাসল৷ রাইফার চোখে রাগের আগুন ধিকধিক করে জ্বলে উঠল। তবুও স্বার্থের খাতিরে নিজেকে শান্ত রেখে বলল,” কি গেইম?”

” ট্রিজার হান্টিং।”

” সেটা আবার কি?”

” এই ঘরে একটা জিনিস লুকানো আছে। সেইটা খুঁজে বের করতে হবে। যদি পারো তাহলে ভাইয়া কোথায় আছে বলে দিবো। আর না পারলে চুপচাপ তুমি এখান থেকে চলে যাবে। টাইম টেইন মিনিটস অনলি।”

রাইফা বিরক্তিতে চোখমুখ কুচকাল। না পারতে বলল,” জিনিসটা কি?”

শান তার আইপ্যাড থেকে জিনিসটির ছবি বের করল৷ একটি স্পিনার। রাইফার দিশেহারা লাগছে। এই ছোট্ট স্পিনার এতোবড় ঘরে সে কিভাবে খুঁজে পাবে? ভালোই মুশকিল কাজ। কিন্তু করতেই হবে।

মনে মনে শানকে গালি দিয়ে সে জিনিসটি খুঁজতে শুরু করল। বেশ কিছুক্ষণ পর সেটি পাওয়া গেল ভারী ডিপ ফ্রীজের নিচে। রাইফা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,” ফাজিল ছেলে, ওই জায়গায় কেউ রাখে? আমার জানটা বের হয়ে গেছিল ফ্রীজ সরাতে গিয়ে।”

শান হাসিমুখে বলল,” এটা আমি রাখিনি। হারিয়ে গেছিল। অনেকদিন খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাই আজ সুযোগ পেয়ে তোমাকে দিয়ে খুঁজিয়ে নিলাম। থ্যাংকস!”

রাইফা বেকুব হয়ে গেল এমন কথা শুনে। শান স্পিনারটা হাতে নিয়ে চুমু দিল৷ এটা তার প্রিয় জিনিসগুলোর একটি। হাসির রোল পড়ে গেল ড্রয়িং রুমে। রাইফা তেজস্বী কণ্ঠে বলল,” সবাই চুপ একদম। সবকয়টা ফাজিল তোমরা। আর শান, তুমি তো ফাজিলদের সর্দার! বিচ্ছু কোথাকার! বলো, তোমার ভাইয়া কই?”

শান স্পিনার পকেটে ভরতে ভরতে বলল,” ওয়েল, ভাইয়া কোথায় আছে আমি জানি না। তুমি ভাইয়ার ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করতে পারো। সে চলে আসবে।”

রাইফা হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করল,” এই কথাটি তাহলে আগে বললে না কেন? বেকার বেকার খাটলাম আমি!”

” আগে বললে তো বেকার বেকার খাটতে না। তাই আগে বলিনি।”

শানের বন্ধুরা আবার হাসতে লাগল। রাইফা রাগে কটমট করে উপরে উঠে গেল। রিসবের ঘরে এসে প্রথমেই ধরাম করে দরজা বন্ধ করল। তবে ভেতর থেকে লক করল না। ক্লান্তি নেমেছে তার শরীরে। এই ঘরে একটা পারফিউমের ঘ্রাণ ছড়িয়ে আছে। নিঃসন্দেহে রিসবের পারফিউম। রাইফা বিছানায় বসল। অজান্তেই তার চোখ বুজে আসল ঘুমে। সে যে কখন ঘুমিয়ে গেল তা নিজেই টের পেল না!

তুলি রিকশা থেকে নেমে রিকশা ভাড়া মেটানোর সময় খেয়াল করল প্রণয় গাড়িতে নেই। প্রণয়ের গাড়ি আগে থেমেছিল। সে কি গাড়ি থেকে নেমেছে নাকি দেখেনি তুলি। খানিক চিন্তা লাগছে। তখনি হুট করে একটি কাঁচের কোকা কোলার বোতল তুলির সামনে বাড়িয়ে ধরা হলো। তুলির বুঝতে অসুবিধা হলো না যে এটা প্রণয়। তাই সে মুখের দিকে না তাকিয়েই রিকশা ভাড়া মিটিয়ে সামনে হাঁটতে লাগল। প্রণয় তার পেছনে আসতে আসতে বলল,” কি ব্যাপার? তোমার না ঝাল লেগেছিল খুব? এইটা খাও, ভালো লাগবে।”

তুলি মুখ টিপে হাসল৷ প্রণয় আশ্চর্য হলো,” আরে, হাসছো কেন?”

” ঝাল কি কাঁঠালের আঠা যে এখনও জিভে লেগে থাকবে? কখন চলে গেছে!”

” ও আচ্ছা। চলে গেছে তাই না?”

” হুম।”

” তাই বলে কি কোকা কোলা খাওয়া যাবে না?”

” না। আমি কোকা কোলা খাই না। এটা আপনিই খান।”

“ওকে। তাহলে তুমি কি খাও?”

” আমি খাই আঠারো টাকার মোজো।”

তুলি এই কথা বলেই একটা মুদির দোকান থেকে আঠারো টাকা দিয়ে মোজো কিনল। বিশ টাকার নোট দেওয়ার পর যেই দুইটাকা ফেরত পেল সেটা দিয়ে কিনল দুইটা কফি চকলেট। একটা প্রণয়কে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,” কফি খাবেন?”

প্রণয় নাক কুচকে বলল,” এটা তো কফি না। ক্যান্ডি জাস্ট।”

তুলি হাসতে হাসতে চকলেটটা নিজের ব্যাগে ভরল। প্রণয় বলল,” না,না, আমি খাবো। দাও।”

” উহুম। এই দুইটাকার কফি আপনার খাওয়ার জিনিস না। আপনি খাবেন দুইশো টাকার কফি। কি যেন বলে? ক্যাপাচিনো। আলিশান রেস্টরন্টে বসে গরম ক্যাপাচিনোতে চুমুক দিতে দিতে পাঁচশো টাকার নোট বিলবুকে রেখে ওয়েটারকে গম্ভীরমুখে বলবেন, কীপ দ্যা চেঞ্জ।”

প্রণয় অদ্ভুতভাবে হাসল। হালকা অপ্রস্তুতও হলো।

” তোমার আজকে কি হয়েছে তুলি? আমাকে এইভাবে খোচাচ্ছো কেন?

” খোচালাম কই? সত্যিই তো বলছি। শন পাপড়ি খাবেন?”

প্রণয় উত্তর দেওয়ার আগেই তুলি ছুটে গেল ফেরিওয়ালার থেকে শন পাপড়ি কিনতে। প্রণয় দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। সে তুলির মতিগতি কিছুই বুঝতে পারছে না আজ। তুলি ফিরে এসে বলল, ” এটা কিন্তু আপনাকে খেতেই হবে। হাঁ করুন।”

প্রণয় এই যাত্রায় হাঁ করল। তুলি প্রণয়কে শন পাপড়ি খাইয়ে দিল। তারপর প্রশ্ন করল,” কেমন খেতে?”

প্রণয় আঙুল দেখিয়ে বোঝাল,” ওয়ান্ডারফুল।” তারপর কি একটা ভেবে বলল,” এগুলো সুপার শপেও পাওয়া যায়। এখান থেকে কেনার দরকার ছিল না।”

তুলি এমনভাবে হাসল যেন সে জানতো প্রণয় এটাই বলবে!

” আচ্ছা, তুমি এখানে আসলে কেন? মানে আমি ভেবেছিলাম তুমি বাড়িতেই যাবে এই সময়।”

” এখন আমি বাড়ি যাবো না। আপনাকে নিয়ে একটা জায়গায় যাবো।”

প্রণয় উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,” ওয়াও, আমার সৌভাগ্য!”

তারপর সে তার গোটা বামহাত এমনভাবে বাড়িয়ে দিল যেন তুলি তার হাতটা আঁকড়ে ধরতে পারে। কিন্তু তুলি ধরল না। সে হাসতে হাসতে সামনে গেল। প্রণয় পিছু পিছু এসে বলল,” সবসময় কি আমি তোমার পিছুই করে যাবো? কখনও তোমার পাশাপাশি হাঁটতে দিবে না?”

তুলি হালকা গম্ভীর হয়ে বলল,” সত্যি পাশাপাশি হাঁটতে চান?”

প্রণয় তুলির হাত ধরে তাকে থামিয়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল৷ গাঢ় কণ্ঠে বলল,” নিশ্চয়ই চাই।”

তুলি হেসে নিজের হাত ছাড়াতে চাইল। কিন্তু প্রণয় ছাড়াতে দিল না। সে দৃঢ় গলায় বলল,” আমি সিরিয়াস তুলি। এতো সিরিয়াস আমি আগে কোনো বিষয়ে হইনি।”

তুলি জবাব না দিয়ে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল।প্রণয়ও জবাবের অপেক্ষা করার অবকাশ পেল না। ছেড়ে দিল তুলির হাত। তারপর মাথা নিচু করে তুলির পেছনে হাঁটতে লাগল আবারও। তারা যেখানে এসেছে সেটি একটি কাশবন। সামনে দিয়ে বয়ে গেছে ঝিল। তুলি ঝিলের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে পড়ল। প্রণয় দাঁড়িয়ে রইল তার পাশে। তুলি হাত দিয়ে ইশারা করে বলল,” আরে বসুন না! ”

প্রণয় ইতস্তত করল,” এখানে নোংরা অনেক।”

তুলি হাসার ভাণ ধরে বলল,” ওহ স্যরি, ভুলেই গেছিলাম। আপনি কেন এই নোংরা ঝিলের পানিতে পা ভেজাবেন? আপনার জন্য তো দামী সুইমিংপুল আছে। ক্লোরিন মেশানো নীল জল ছাড়া আপনার পা…”

তুলির কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রণয় তার পাশে বসে গেল। ঝিলের পানিতে পাও ভেজালো। তারপর কোমল দৃষ্টিতে তুলির দিকে চেয়ে বলল,” এবার খুশি?”

তুলি নিশ্চুপ হয়ে গেল। স্বচ্ছ পানির তাকিয়ে থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই আনমনা হয়ে উঠল। প্রণয় এই সুযোগে তুলির হাতের উপর হাত রাখল। তুলি চমকে উঠে সেই হাত সরিয়ে নিল দ্রুত। প্রণয় অপ্রস্তুত হয়ে বলল,” স্যরি।”

” না, ইটস ওকে।” তুলি হাসল হালকাভাবে। কিন্তু তার মুখে দেখাচ্ছে করুণ ফ্যাকাশে। প্রণয় পরিষ্কার কণ্ঠে অনুরোধ করল,” তোমার আজ কি হয়েছে তুলি? প্লিজ টেল মি..”

তুলি মৃদু কণ্ঠে বলল,” আমি একটা জিনিস চাইবো আপনার কাছে। দিতে পারবেন?”

” তুমি শুধু বলো কি চাও?”

তুলি কথাটা বলতে সময় নিল। প্রণয় ধৈর্য্য ধরে তার দিকেই তাকিয়ে ছিল তখন। কিছু একটা ভেবে তুলি হঠাৎ বলল,” আচ্ছা থাক, পরে চাইবো। তার আগে আপনার কাছে আমি কিছু কনফেস করতে চাই।”

” কি কনফেস করবে?”

তুলি ঢোক গিলে এক নিশ্বাসে বলল,” প্রিয়ন্তী আপুকে আমি মেরেছিলাম।”

প্রণয় চট করে ধরতে পারল না কথাটা। চোখ কুচকে বলল,” কি?”

তুলি বড় করে শ্বাস ছেড়ে আস্তে-ধীরে আবার বলল,” আমি প্রিয়ন্তী আপুকে বাথরুমে নিয়ে মেরেছিলাম।”

প্রণয়ের চোখ বড় হয়ে গেল। ঠোঁটদ্বয় আলাদা হয়ে গেল। হাঁ করে বোকার মতো চেয়ে থেকে সশব্দে বলল,” মানে ওই চড়, থাপ্পড়, লাথি, এসব তুমি মেরেছো?”

” হুম।” তুলি মাথা নাড়ল। প্রণয় বিষমচিত্তে প্রশ্ন করল,” কেন?”

” আইডিয়াটা রাইফার ছিল। তবে আমিও তাকে সঙ্গ দিয়েছি। আর মারার সময় আমিই বেশি মেরেছি। রাইফা রিসব ভাইয়ের সাথে প্রিয়ন্তী আপুর ভাব সহ্য করতে পারছিল না। এজন্য সে এমন করেছে।”

প্রণয় আগ্রহভরা দৃষ্টিতে জানতে চাইল,” আর তুমি?”

তুলি ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল,” আমি আবার কি?”

প্রণয় হেসে দিল জোরে। তুলি আরও ভড়কে গেল। প্রণয় হাসছে তো হাসছেই৷ তার হাসি থামার নাম নেই। তুলি আশ্চর্য হয়ে বলল,” আপনি আমার উপর রাগ করবেন না?”

প্রণয় উত্তরও দিতে পারল না। কারণ তার হাসিই থামছে না।

রাইফা চোখ মেলে দেখল রিসব তার দিকে তাকিয়ে আছে। নিষ্পলকভাবে। তার ঘুমন্ত মুখটাই দেখছিল হয়তো৷ রাইফার ঠোঁটে হাসি মিশল। সে জিজ্ঞেস করল আদুরে কণ্ঠে, “আপনি আমাকে দেখছেন?”

রিসব সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে বলল,” কই না তো!”

রাইফার ঠোঁটের হাসি দীর্ঘ হলো। সে শোয়া থেকে উঠে বসে রিসবের কাঁধে হাত রেখে বলল,” মিথ্যা বলবেন না। আপনি আমাকেই দেখছিলেন। আমি জানি। বলুন দেখছিলেন কি-না?”

রিসব আড়ষ্টভাবে মাথা নেড়ে বলল,” হুম।”

রাইফা খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। মুখে হাত চেপে বলল,” আমাকে ভালোবাসেন?”

রিসব হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ল। রাইফা সর্বশক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরল রিসবকে। রিসব টাল সামলাতে না পেরে বিছানা থেকে পড়ে গেল৷ রাইফাও পড়ল ধাম করে। তার ঘুমটাও ছুটে গেল। উপলব্ধি হলো, সে এতোক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল। স্বপ্ন দেখেই বিছানা থেকে পড়ে গেছে। এই মুহূর্তে সে আছে রিসবের ঘরে৷ তার হাতে বালিশ, সেটাও রিসবের কোলবালিশ। রাইফার ভীষণ লজ্জা করতে লাগল। তখনি দরজায় খটরখটর আওয়াজ হলো। কেউ কি ভেতরে ঢুকছে? রিসব নয়তো? সে রাইফাকে এই অবস্থায় দেখলে কি ভাববে?

কাদের বেশি পছন্দ? প্রণয়-তুলি নাকি রিসব-রাইফা?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here