#বেদনার_রঙ_নীল
আটত্রিশতম পর্ব(৩৮)
লিখা- Sidratul Muntaz
রিসব ক্লান্ত ছিল। তাই বসে থাকা অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। তার মাথাটা হালকা কাত হয়ে আছে। রাইফা খুব সাবধানে তাকে শুইয়ে দিল। যেন তার ঘুম না ভাঙে। রিসবের ঘুম ভাঙল না। বরং সে যেন আরও গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। কপালে এবড়োখেবড়ো সাদা ব্যান্ডেজ। মুখে ক্ষতচিহ্ন। মলিন চেহারা। তবুও রাইফার মনে হচ্ছে এই মুখ পৃথিবীর সেরা সুন্দর মুখ। এতো মুগ্ধতা আর কোনো মুখে নেই। সে তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি নিয়ে নির্ণিমেষ তাকিয়ে রইল। আহা, আর কত অপেক্ষা? এই মানুষটা কি কোনোদিনও তার ব্যক্তিগত হবে না? সে আর কত দূরে দূরে থাকবে? ঘুমানোর আগেও রিসব ট্রেনিং এ যাওয়ার ব্যাপারে বলছিল। তার পাহাড় ভ্রমণ কবে শেষ হবে? রাইফা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। তার স্বপ্নগুলো বেশিরভাগ সময় রিসবকে ঘিরেই হয়। সে দেখে, রিসব তার দুনিয়া তুচ্ছ করে শুধু রাইফার একান্ত হয়ে ফিরে এসেছে। এই স্বপ্ন সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। তবুও রাইফা স্বপ্ন দেখে। কেন যে দেখে!
দরজায় টোকা পড়ল। পেছনে ঘুরতেই রাইফা দেখল তুলি দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ ভর্তি জলে।রাইফা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ছুটে এলো। উদগ্রীব কণ্ঠে জানতে চাইল,” কি হয়েছে তুলি?”
মাথা নিচু করে তুলি সামান্য লজ্জা এবং সামান্য ক্রোধ মেশানো কণ্ঠে বলল,”প্রণয় আমাকে চুমু দিয়েছে।”
রাইফার প্রথমে মনে হলো সে ভুল শুনেছে। তারপর কিছুটা আশ্চর্য হয়ে বলল,” তুই কি এজন্যই কাঁদছিস?”
তুলি মাথা নাড়ল। রাইফা নিশ্চিত হতে আবার বলল,” মানে প্রণয় তোকে চুমু দিয়েছে এজন্য কাঁদছিস?”
তুলি একটা রেগে জবাব দিল,” হ্যাঁ। ”
রাইফা কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে হেসে উঠল। তুলির মেজাজ আরও উত্তপ্ত হয়ে গেল। সে তাকালো প্রসারিত দৃষ্টিতে। রাইফা হাসতে হাসতে বলল,” আমি হলে খুশিতে নাচতাম। আর তুই কাঁদছিস! এতো বোকা কেন?”
তুলির চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে এমনভাবে সে প্রশ্ন করল,” তুই হলে খুশিতে নাচতি? মানে প্রণয় তোকে চুমু দিলে খুশিতে নাচতি?”
রাইফা থতমত খেল। বিব্রত কণ্ঠে বলল,” উফ প্রণয়ের কথা কেন বলবো? আমি রিসবের ব্যাপারে বলছিলাম। সে যদি আমাকে কখনও চুমু দেয় তাহলে তো আমি পার্টি করবো।”
তুলি চোখমুখ বিকৃত করে বলল,” ছিঃ, নির্লজ্জ। তুই আর প্রণয় একদম এক।”
রাইফা হাসতে হাসতে বলল,” তোর মতো সব বিষয়ে ওভার সেন্সিটিভ হতে চাই না আমি। চুমু খেয়ে কাঁদার কি হলো? এতো খারাপ লাগলে তুই নিজেও একটা দিয়ে দে।”
তুলির খুব বিরক্ত লাগছে৷ সে ক্ষীপ্ত হয়ে চলে যেতে লাগল। দরজা পর্যন্ত যেতেই প্রণয় ছুটে এসে বলল,” কোথায় যাচ্ছো তুলি?”
” জাহান্নামে!” তুলির কণ্ঠে তেজ, উত্তাপ। প্রণয় নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলল,” ওকে চলো। আমিও তোমার সাথে জাহান্নামে যাবো।”
” খবরদার, আপনি আমার পেছনে আসবেন না।” তুলি আঙুল তাঁক করে এমনভাবে তাকাল যেন চোখের আগুনে ভস্ম করে দিবে প্রণয়কে। প্রণয় ঠান্ডা স্বরে বলল,” তোমার বাইরে একা যাওয়া নিষেধ তুলি। একটু আগে আমি কি বলেছি মনে নেই?”
তুলি প্রায় চেঁচিয়ে বলল,” একটু আগে আপনি কি করেছেন সেটা মনে আছে?”
প্রণয় ভ্রু কুঁচকালো। সে বুঝতে পেরেছে যে তুলি কি বিষয়ে বলছে। তবুও না বোঝার ভাণ করে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,” কই? কি এমন করলাম?”
তুলি বড় করে নিশ্বাস ছাড়ল। তাকিয়ে থাকল ক্রোধসিক্ত দৃষ্টিতে। প্রণয় বলল,” কিছু মনে পড়ছে না। তুমি একটু মনে করিয়ে দাও তো!”
” আপনার মাথায় বাঁশ দিয়ে একটা বারি দিলে তারপর আপনার মনে পড়বে। শুনেছি যারা স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলে তাদের মাথায় বারি দিয়ে স্মৃতি ফেরাতে হয়।”
প্রণয় হালকা এগিয়ে এসে বলল,” ধূর, সিনেমা নাকি? মাথা খুবই সেন্সিটিভ জায়গা। বারি-টারি দেওয়া যায় না। স্মৃতি ফেরানোর আরেকটা কৌশল আছে কিন্তু। সেটা হচ্ছে প্র্যাকটিক্যালি দেখানো। যেটা আমি ভুলে গেছি সেটা তুমি আমাকে করে দেখাতে পারো। তাহলে হয়তো মনে পড়বে।”
তুলি আছড়ে আছড়ে পা ফেলে ঘরের ভেতরে ঢুকল। প্রণয় মৃদু হেসে তুলির পেছন পেছন এলো। ডাইনিং টেবিলের সামনে এসে তুলি থামল। রাইফাও রুম থেকে বের হয়েছে। হাত ভাঁজ করে বলল,” কি হয়েছে তোমাদের? ঝগড়া চলছে?”
তুলি কোনো কথা বলল না। জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালতে লাগল। কয়েক ঢোক পানি খেয়ে গ্লাসের বাকি পানিটুকু সম্পূর্ণ ছুঁড়ে মারল প্রণয়ের মুখে। আচমকা ঠান্ডা পানি গায়ে লাগায় সামান্য ভড়কে গেল প্রণয়। তার টি-শার্ট আর মাথার চুল ভিজে চুপচুপে অবস্থা হলো। রাইফা মুখে হাত দিয়ে স্বগতোক্তি করল,” হোয়াট ননসেন্স!”
তারপর তুলির দিকে চেয়ে গর্জন করে বলল,” এটা কি করলি তুলি? এই শীতের মধ্যে এমন করতে পারলি?”
তুলি জবাব দিল না কোনো। আঁড়চোখে রাইফাকে একবার দেখে নিয়েই ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিল। ধড়াম শব্দ হলো। রাইফা তেড়ে যেতে নিলেই প্রণয় তার হাত ধরে বলল,” থাক, থাক, ভুলটা আমারই ছিল। আমিই রাগিয়েছি ওকে।”
রাইফা কোমল দৃষ্টিতে প্রণয়কে অবলোকন করল। চুল আর টি-শার্ট ঝেড়ে অমায়িক হাসি দিয়েছে প্রণয়। রাইফা চেয়ারে বসতে বসতে মনখারাপ করে বলল,” তোমার আর আমার অবস্থা প্রায় একই।”
প্রণয় হাসি মুখে জিজ্ঞেস করল,” হঠাৎ এই কথা বলছো কেন?”
” তোমার ভাই একটু আগে ট্রেনিং-এ যাওয়ার কথা বলছিল। এবার গেলে নাকি ছয়মাসেও আর ফিরবে না।”
এই কথা বলে মাথা নিচু করল রাইফা। তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো। যেন কেঁদেই ফেলবে। প্রণয় কৌতুহলী গলায় বলল,” তোমাদের মাঝে কি হয়েছিল রাইফা? স্পষ্ট করে কিছুই জানা হয়নি। কালরাতে রিসব তোমার কাছে কেন এসেছিল?”
রাইফা কফিশপের ঘটনা বলল। তারপর কালরাতের ঘটনাও বলল। একটির সাথে অন্যটি সম্পর্কিত।
” সে কফিশপের ঘটনার জন্য রিগ্রেট ফীল করছিল, প্রণয়। তার মনে হয়েছে, সে আমাকে বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে।তাই ক্ষমা চাইতে এসেছিল৷ দ্যাটস ইট।”
প্রণয় মাথা নেড়ে বলল,”ইম্প্রেসিভ! এটা তো খুবই পজিটিভ সাইন। শুধু ক্ষমা চাইতে কেউ এতোদূর চলে আসবে না। হি কেয়ারস ফোর ইউ।”
” হ্যাঁ সেটা জানি। কিন্তু এক্সপ্রেস করে না কেন?”
প্রণয় একটু চিন্তা করে বলল,” সে বিখ্যাত পর্বত আরোহী হতে চায়। এটা তার স্বপ্ন। সে জানে তার লাইফ রিস্ক আছে। সে হয়তো নিজের কমপ্লিকেটেড লাইফের সাথে তোমাকে জড়াতে চায় না৷ এজন্যই ইগনোর করে। কিন্তু তুমি আপসেট হয়ে যেও না। ‘একবার না পারিলে দেখো শতবার।’ তোমাকে শতবার ট্রাই করতে হবে রাইফা।”
রাইফা স্মিত হেসে বলল,” দেখলে, তোমার আর আমার একই কপাল। তুলি যতদিন বড়লোক না হচ্ছে ততদিন তোমাকেও ধৈর্য্য ধরে শতবার ট্রাই করতে হবে।”
” হ্যাঁ জানি। সেজন্য আমি অলরেডি ডিটারমাইন্ড। সে আমাকে যত ইচ্ছা ভুল বুঝুক, যত ইচ্ছা রাগ দেখাক আর যত ইচ্ছা তাড়িয়ে দিক, আমি তার পিছু কখনও ছাড়ছি না।”
রাইফা উঠে দাঁড়িয়ে প্রণয়কে স্যালুট দিয়ে বলল,” ইন্সপ্যায়ার্ড হলাম, বস।”
প্রণয় হো হো করে হাসল। সঙ্গে সঙ্গেই তার হাঁচি পেল। একসাথে সে দুইবার হাঁচি দিয়ে ফেলল। রাইফা এই অবস্থা দেখে দ্রুত তোয়ালে আনতে ছুটে গেল। প্রণয়ের সর্দি লেগে যাচ্ছে। আবার জ্বর আসবে নাতো! মাথা মুছে দিতে হবে। টি-শার্টও তো ভেজা!
সন্ধ্যাবেলা হেলাল সাহেব এবং আশা বাড়ি ফিরেই খোশমেজাজে গল্প শুরু করল। বৌভাতের অনুষ্ঠান নিয়ে নানান গল্প। তারা খাবারও নিয়ে এসেছে। সেই খাবার রাতের জন্য গরম করছেন আশা। প্রণয় একটু কৌতুহলে ছিল। সকালে আজমীরের সাথে তার একটা ঝামেলা হয়েছে। রিসবকে হাসপাতালে পেয়ে প্রণয়ের একদম মাথা ঠিক ছিল না। আজমীরকে সে আচ্ছামতো মেরেছে আবার নিজেও মার খেয়েছে। এই নিয়ে বৌভাতের অনুষ্ঠানে অবশ্যই কোনো ঝামেলা হবে। এমন কিছুই ভেবেছিল প্রণয়। কিন্তু সৌভাগ্যবশত কোনো ঝামেলা হয়নি। বরং হেলাল সাহেব এই ব্যাপারে কিছু জানতেই পারেননি। তিনি বাড়ি ফিরে প্রথমে কুশল বিনিময় করেছেন। তাকে কিছুদিন থেকে যেতে বলেছেন। কিন্তু রিসব জানাল তার ট্রেনিং আছে। সে সকালের মধ্যেই চলে যাবে। এমন আহত শরীর নিয়ে সে ট্রেনিং-এ যাবে শুনে হেলাল সাহেব অসন্তুষ্ট হলেন। কিন্তু রিসব নাছোড়বান্দা। কারো অনুরোধই কাজে এলো না। সে সকালে চলে যাবে মানে তাকে যেতেই হবে। সিদ্ধান্ত হলো আগামীকাল রাইফা, তুলি আর প্রণয়ও রিসবের সাথে চলে যাবে। তুলিদের কোচিং আছে। এইখানে তাদের থেকেও কাজ নেই। তন্বির বিয়ে উপলক্ষ্যে তারা এসেছিল। বৌভাতের অনুষ্ঠান তো শেষ। তাই আর কোনো উপলক্ষ্য নেই। হেলাল সাহেব সবাইকে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। তবে তুলি এখন মনে মনে খুবই স্বস্তিবোধ করছে। মামার মাথা থেকে বিয়ের ভূত নেমে গেছে। তিনি কালরাতে বিয়ের জন্য একদম উঠে-পরে লেগেছিলেন। আর আজ সে কথা বেমালুম ভুল বসে আছেন। যা তুলির জন্য স্বস্তিদায়ক ব্যাপার। আরাম করে সে বিছানায় বসে পা দোলাচ্ছিল এমন সময় আশা তার ঘরে ঢুকে বলল,” তোর মামা ডাকে। এদিকে আয়।”
তুলি বলল,” কেন ডাকে?”
আশা জবাব না দিয়ে বের হয়ে গেল। তুলি বিড়বিড় করে বলল,” আজব!”
ওরনা গলায় জড়িয়ে চুলে খোপা বেঁধে সে মামার ঘরে গেল। হেলাল সাহেব বসে আছেন বিছানায়। চেয়ারে একজন বৃদ্ধ। দু’জনকেই সালাম দিল তুলি।
বৃদ্ধ সালামের উত্তর নিয়ে কেমন অদ্ভুতভাবে হাসলেন! হেলাল সাহেব বললেন,” এনাকে চিনতে পেরেছিস?”
তুলি চিনতে পারল না। কিন্তু তার মনে হচ্ছে এই লোককে সে কোথাও না কোথাও দেখেছে। সে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। হেলাল সাহেব সামান্য বিরক্ত গলায় বললেন,” আরে, তোর বিয়েতে এসেছিল যে!”
তুলি অবাক হয়ে বলল,” আমার বিয়ে মানে?”
” তোর আর সামিরের বিয়ে। যেটা হতে নিয়েও হয়নি।”
তুলি নিঃসাড় কণ্ঠে উচ্চারণ করল,”ও।”
হেলাল সাহেব আনন্দিত গলায় বললেন,” উনি হলেন মোকাররম সাহেব। সামিরের সাথে তোর বিয়ে হলে উনি হতেন কাজী। কিন্তু সেই বিয়ে তো আর হয়নি। তাই আজ তোর আর প্রণয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য আমি উনাকে দাওয়াত করেছি।”
তুলি নরম কণ্ঠে ‘ হুঁ’ উচ্চারণ করতে নিয়েও থেমে গেল। খুব আঁৎকে উঠল। ভ্যাবাচেকা খাওয়া কণ্ঠে আওড়ালো,” মানে? আমাদের বিয়ে? মানে এখন?”
হেলাল সাহেব অকপটে উত্তর দিলেন,” কালরাতে তো এমনটাই কথা হয়েছিল। তুই কি ভেবেছিস আমি ভুলে যাবো? যা, সবাইকে ডাক। রাইফা, প্রণয় আর তার ভাই রিসবকেও ডাক। ভালোই হলো রিসব এসেছে। প্রণয়ের পরিবারের একজন হলেও বিয়েতে থাকবে।”
তুলি অনবরত ঢোক গিলতে লাগল। শেষমেষ কি তাহলে বিয়ে নামক অঘটনটা ঘটবেই? কাজী মোকাররম সাহেব মুখ ভর্তি হাসি নিয়ে তুলিকে বললেন,” যাও মা, যাও, সবাইকে ডেকে আনো। আমি কাগজপত্র ঠিক করছি।”
তুলি মুখ গোঁজ করে বেরিয়ে এলো। রাগে নিজেকেই তুলে আছাড় মারতে মন চাইল তার।
রিসব আর রাইফা পাশাপাশি বসল। তাদের ঠিক বরাবর বসলেন হেলাল সাহেব। বিছানার উপর তুলি আর কাজী সাহেব। প্রণয় এলেই বিয়ের কাজ শুরু হবে। এই ফাঁকে আশা তুলিকে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছেন। রাইফা তাকে সাজিয়ে দিয়েছে। খুবই হালকা সাজ। কিন্তু তুলিকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। হালকা গয়না আর হালকা মেকাপে তুলিকে যতটা সুন্দর দেখাচ্ছে পার্লার থেকে আয়োজন করে বউ সেজে এলেও কাউকে এতোটা সুন্দর দেখায় না।
আশা আলমারি থেকে তুলির মায়ের কানের দুল বের করেছে। আর একটা চিকন চেইন। নাকফুলও ছিল। কিন্তু তুলির নাকে ফুঁটো নেই বলে পরানো গেল না। আশা বললেন,” এই সুযোগে নাকটা ফুঁড়িয়ে দেই তোর?”
তুলি ধমক দিয়ে বলল,” যথেষ্ট হয়েছে মামী। আর টর্চার করলে কিন্তু আমি এখনি ঘর থেকে বের হয়ে যাবো।”
প্রণয় ঘরে ঢুকে তুলিকে বউ সাজে দেখে বিস্মিত হলো। তার বুকের বামপাশটা চিনচিনে ব্যথা করে উঠল। হেলাল সাহেব উত্তেজিত গলায় বললেন,” এইতো প্রণয়, দ্রুত আসো। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি। কোথায় ছিলে?”
প্রণয় ইতস্তত করে বলল,” বাড়ির পেছন সাইডে গেছিলাম। ওইখানে নেটওয়ার্ক ভালো আসে। আমার বড় আপুর সাথে কথা বলছিলাম।”
” বড় আপুকে বিয়ের কথা জানিয়েছো?”
প্রণয় অপ্রস্তুত হলো। বিয়ের ব্যাপারে সে নিজেই নিশ্চিত ছিল না। সে ভেবেছিল মামা হয়তো এমনিই বলেছেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে তিনি সিরিয়াস! কি হবে? জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে তুলির দিকে তাকালো প্রণয়। মাথা নিচু করে বসে আছে তুলি। মুখটা তার রাশভারী। সে আঁড়চোখে প্রণয়ের দিকে চেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। হেলাল সাহেব তাগাদা দিতে বললেন,” দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি? বসো। বিয়ের কথা পরে জানিয়ে দিলেই হবে। আর তোমার ভাই রিসবও এখানে আছে। তাহলে আর অসুবিধা কি? শুভকাজ সেড়ে ফেলি, কি বলো?”
প্রণয় দুইপাশে মাথা নেড়ে বলল,” না।”
তুলি অবাক হয়ে তাকাল। হেলাল সাহেব ভ্রু কুঁচকালেন। প্রণয় বলল,” এভাবে বিয়ে হয় না, মামা।”
” মানে?”
” আমি এভাবে তুলিকে বিয়ে করতে চাই না। স্যরি, আমাকে ভুল বুঝবেন না।”
” তাহলে কিভাবে বিয়ে করতে চাও?”
প্রণয় মাথা নিচু করে বলল,” বেশি তাড়াহুড়ো হয়ে যাচ্ছে।”
চোয়াল শক্ত করলেন হেলাল সাহেব। মুখের পেশী টান-টান করে জানতে চাইলেন,” কালরাতে যেটা হয়েছে এরপরেও তুমি এই কথা কিভাবে বলছো? আমি তোমাকে ভালো ছেলে ভেবেছিলাম। ভালো ছেলে হলে এই বিয়ে তুমি অবশ্যই করতে।”
প্রণয় উত্তর দিল না। মাথা নত করে রাখল। হেলাল সাহেব একবার তুলির দিকে তাকালেন। তারপর প্রণয়কে বললেন,” তুমি কি শিউর? ভেবে বলছো যে বিয়ে করবে না?”
” হ্যাঁ। আমি একদম শিউর। আমি তুলিকে বিয়ে করবো না।”
প্রণয় তার কথা শেষ করে ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেল। সাথে সাথে সকলের চেহারা একটি মেদুর ছায়ায় ঢেকে গেল। পরিবেশ হলো নিশ্চুপ, দমবন্ধকর। তুলি মাথা নিচু করে চোখের জল ফেলছে। এটা ঠিক যে সে চেয়েছিল বিয়ে না হোক। কিন্তু এখন সত্যিই বিয়ে হচ্ছে না বলে তার খারাপ লাগছে। প্রণয় তাকে প্রত্যাখ্যান করল ভেবে তার কান্না পাচ্ছে। মন এতো অদ্ভুত কেন? কিছুক্ষণ পর হেলাল সাহেব রাগান্বিত কণ্ঠে বলে উঠলেন,” ফাজলামি করছিস নাকি তোরা আমার সাথে?”
মামার গর্জনে কেঁপে উঠল তুলি। হেলাল সাহেব প্রশ্ন করলেন,” তোরা কি শুরু করেছিস? কি চাইছিস?”
উত্তর দিল না তুলি। চোখ মুছল একহাত দিয়ে। হেলাল সাহেব গজগজ করে বললেন,” প্রথমে সামিরের সাথে তোর বিয়ে দিতে চাইলাম। তারপর তুই ওর সঙ্গে পালিয়ে গেলি। গ্রামে আমার মান-সম্মান ধূলোয় গড়াগড়ি খাওয়ালি। মানুষের কত অপমান আর কটাক্ষ সহ্য করতে হয়েছে তা তোর মামীকে জিজ্ঞেস কর। তারপর তন্বির সাথে সামিরের বিয়ে হলো। এই নিয়েও কম সমালোচনা হয়নি। মানুষের অনেক আজে-বাজে কথা শুনেও সামির-তন্বি ভালো আছে দেখে আমি সব এড়িয়ে গেছি। কিন্তু তোদের নিয়ে যে বদনাম রটে গেছে, সেটা কিভাবে মুছবো? ভেবেছিলাম তোদের বিয়েটা দিয়ে সবার মুখ একবারে বন্ধ করে দিবো। কিন্তু তোরা এমন শুরু করেছিস যেন বিয়ে একটা অপরাধমূলক কাজ। তোদের বিয়ে করার সাহস নেই তাহলে প্রেম করতে গেলি কেন? আমাদের মুখে চুনকালি মাখিয়ে বিয়ের আসর থেকে পালালি কেন? উত্তর দে আগে। উত্তর না দিয়ে খবরদার নড়বি না।”
তুলির কান্নার বেগ বৃদ্ধি পেল। প্রণয় কেন এমন করছে? কেন? তুলি এবার মনে-প্রাণে চাইল যাতে প্রণয় ফিরে আসে। এসে যেন তুলিকে বিয়ে করে এই বিপদ থেকে বাঁচায়। এই বিয়ে না হলে তুলি মুখ তুলে তাকাতেও পারবে না মামার সামনে।
চলবে