বেদনার_রঙ_নীল উনিশতম পর্ব

0
312

#বেদনার_রঙ_নীল
উনিশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz

” আমি নামবো। গাড়ি থামান।”

প্রণয় হু-হা করে হাসল। যেন তুলি কোনো মজার কথা বলেছে। তার এই হাসির মাত্রা তুলির ভয়ের মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে তুলল। তুলি প্রসারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ক্রোধপূর্ণ কণ্ঠে বলল,” আপনি হাসছেন কেন? ”

প্রণয় জবাব দিল না। হাসি বজায় রাখল। তুলি বলল,” যদি গাড়ি না থামান তাহলে আমি চিৎকার করবো।”

প্রণয়ের হাসির বেগ বাড়ল। আরও জোরে হাসতে লাগল সে। তুলি এই অবস্থা দেখে বড় বড় নিশ্বাস ছেড়ে পেছনে মাথা ঠেঁকালো। স্বগতোক্তি করল,” হে আল্লাহ, এসব কি হচ্ছে?”

প্রণয় হঠাৎ গাড়ি ব্রেক করল। খুব জোরে ধাক্কা লাগায় তুলি সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল অনেকটা। প্রণয় তার সামনে ব্যারিকেডের মতো হাত বাড়িয়ে দিল যাতে সে আঘাত না পায়। তুলি ঝলসানো দৃষ্টিতে তাকাল। প্রণয়ের হাত ঝটিতে সরিয়ে বলল,” আমি আপনার সঙ্গে যেতে চাই না। এর চেয়ে একা যাওয়া অনেক ভালো। ”

তারপর সে অস্থির হয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু অবাক কান্ড, দরজা কিছুতেই খোলা যাচ্ছে না। তুলি কয়েকবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। তারপর ক্লান্ত কণ্ঠে বলল,” কি করেছেন আপনি? দরজা কেন খুলছে না? প্লিজ এসব বন্ধ করুন। আমার অসহ্য লাগছে।”

প্রণয় তুলির কান্ড-কারখানা দেখে বেশ মজা পাচ্ছিল। সপ্রতিভ হেসে বলল, ” আপনি কি শুরু করেছেন সেটাও আমি বুঝতে পারছি না মিস তুলি। আপনার কি হয়েছে? আগে আমাকে আপনার ব্যাপারটা বুঝতে দিন।”

” মানে? আমি কিছুই শুরু করিনি।”

” তাই? তাহলে হঠাৎ আপনার এই রূপ বদলের কারণ কি?”

” আপনি আমাকে অন্য সব মেয়েদের মতো ভাববেন না। আমি কারো টাইম পাসের অংশ হতে চাই না। দামী ফোন গিফট করলে, মিষ্টি করে দু’টো কথা বললেই আমি পটে যাবো এসব আপনি ভাবলেন কি করে? প্লিজ, স্টে অ্যাওয়ে ফ্রম মি। আমি আপনার চেহারাও দেখতে ইচ্ছুক না।”

প্রণয় ভ্রু নাচিয়ে বলল,” আচ্ছা তাই? তাহলে সেদিন আজমীরদের সামনে ওই কথা কেন বললেন যে আপনি আমাকে ভালোবাসেন?”

” আমি বাঁচার জন্য বলেছিলাম। সেটা আপনি জানেন।”

প্রণয় এবার গম্ভীর হয়ে বলল,” আমাকে আপনার কি মনে হয়? যখন প্রয়োজন হবে ইউজ করবেন আর যখন দরকার নেই তখন ছুঁড়ে ফেলে দিবেন? মানে আমি কি কোনো টিস্যু পেপার? ”

তুলি উত্তর দিল না৷ চোয়াল শক্ত করে সামনে তাকাল। আরেকবার গাড়ির দরজা খোলার চেষ্টায় মত্ত হলো। প্রণয় ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলল। সামান্য রেগে বলল,” এইযে লুক এট মি। আপনাকে তো আজকে জবাব দিতেই হবে। আপনি কি করতে চান আমার সাথে?”

তুলি ফুঁসে উঠে বলল,” সেইম কুয়েশ্চন আমারও। কি করতে চান আপনি আমার সাথে?”

” আমি কিছুই করিনি। আপনি জানেন, আমাদের একটা নরমাল রিলেশন ছিল। যেটা আপনার কারণে এবনরমাল হয়ে যাচ্ছে।”

” আমাদের রিলেশন শুরু থেকেই এবনরমাল ছিল। বরং আমারই ভুল হয়েছে। প্রথম ভুল আপনার ফোন নাম্বার মুখস্ত করা। দ্বিতীয় ভুল আপনার দেওয়া মোবাইল এক্সেপ্ট করা। আর তৃতীয় ভুল আপনাকে ফোন করা। আমি প্রত্যেকটি ভুলের জন্য ক্ষমা চাইছি। এক্সট্রিমলি স্যরি।”

প্রণয় হাত তালি বাজালো। ঠোঁট উল্টে বলল,” ওয়ান্ডারফুল। স্যরি বলে দিলেই সব সোলভ হয়ে গেল? তাহলে আপনি এসব কেন করলেন তুলি? প্রথম দিনই যদি আপনি বলে দিতেন যে আপনার এসবে কোনো ইন্টারেস্ট নেই তাহলে আমি আপনাকে বিরক্ত করতামও না। কিন্তু আপনি প্রথমে আমাকে রেসপন্স করেছেন। আর এখন এমন ভাণ করছেন যেন কিছুই হয়নি আমাদের মধ্যে। স্ট্রেইঞ্জ!”

প্রণয় বিরক্তিতে গাড়ির স্টেয়ারিং-এ আঘাত করল। তুলি আক্ষেপ ঝরা কণ্ঠে বলল, ” কারণ প্রথমে আমি আপনার উদ্দেশ্য বুঝতে পারিনি।”

প্রণয় দাঁতে দাঁত পিষে জিজ্ঞেস করল,” কোন উদ্দেশ্যের কথা বলছেন আপনি?”

” এতো কথা বলে কি হবে? আমাকে যেতে দিন। এটা আমাদের দু’জনের জন্যই ভালো। ”

প্রণয় গাড়ির লক খুলে দিল। কিন্তু তুলি যখন গাড়ি থেকে নামতে যাবে তখনি সে দেখল নীল রঙের একটি মাঁকড়সা ঝুপ করে পড়ল উপর থেকে। তুলি বিকট শব্দে চেঁচিয়ে প্রণয়ের টি-শার্ট খামচে ধরল। প্রণয় হেসে ফেলল। এবার সে শানের কৌশল অবলম্বন করেছে তুলিকে আটকানোর জন্য। তুলি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,” এইটা এইখানে কি করছে? প্লিজ এইটাকে সরান৷ আমার ভীষণ ভয় হয়। আপনি এতো জঘন্য!”

প্রণয় জবাবে বলল,” আমি কিছুই করিনি৷ শান প্রতিদিন এই গাড়ি দিয়ে স্কুলে যায়। হয়তো সে-ই রেখেছে।”

” আমি বিশ্বাস করি না। এই সবকিছু আপনার প্ল্যান। মিথ্যা বলবেন না। আমাকে ভয় দেখানোর জন্য করছেন তাই না? আমার মাঁকড়সা নিয়ে অ্যালার্জি আছে। আপনি জানেন আমি কত ভয় পাই? প্লিজ এটা সরান। নয়তো খুব খারাপ হবে।”

তুলি রীতিমতো আতঙ্কে কাঁপছে। প্রণয়ের টি-শার্ট খামচে ধরে চোখ বন্ধ করে নিরবচ্ছিন্ন বকবক করেই যাচ্ছে। ঠিক এই অবস্থায় প্রণয় একদমে বলে ফেলল,” আই লভ ইউ।”

তুলির কণ্ঠ থেমে গেল সাথে সাথে। কাঁপাকাঁপিও থেমে গেল এক নিমেষে। সে ঝটিতে চোখ মেলে চাইল প্রণয়ের দিকে। অবাক বিস্ময়ে উচ্চারণ করল,” মানে?”

প্রণয় নির্লিপ্তে বলল,” এর মানে একটাই।ভালোবাসি৷ এর তো দ্বিতীয় কোনো মানে নেই!”

তুলি চমক সামলাতে না পেরে স্রেফ তাকিয়েই রইল। প্রণয়ও নিশ্চুপ। নীরবতায় কাটল কিছু সময়। একটু পর তুলি বিষাক্ত কণ্ঠে বলল,” এটাও কি আপনার টাইম পাসের অংশ?”

প্রণয় ধৈর্য্যহারা হয়ে কপালে হাত রাখল। বড় করে নিশ্বাস ছেড়ে যথেষ্ট বিরক্তি নিয়ে বলল,” তুলি আমি সেটা মজা করে বলেছিলাম সেদিন।”

তুলি চিৎকার করে বলল,” কিন্তু আমি আপনার মজা করার বস্তু না। রাইফার সাথে সম্পর্ক থাকার পরেও আপনি কোন সাহসে আমাকে এসব বলছেন? আপনার কি লজ্জা নেই?”

এইটুকু শুনেই থমকে গেল প্রণয়। তুলি ঢোক গিলে নিজেকে শান্ত করতে লাগল। প্রণয় কঠিন দৃষ্টিতে বলল,” রাইফার সাথে সম্পর্ক মানে? এইখানে আমাদের মাঝে রাইফা কোথ-থেকে এলো?”

তুলি সংশোধন করার মতো বলল,” স্যরি, ভুল হয়েছে। রাইফা আসেনি। বরং আমিই আপনার আর রাইফার মাঝে চলে এসেছিলাম।”

” রাইফার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই তুলি। শী ইজ জাস্ট মাই ফ্রেন্ড!”

তুলি এমনভাবে হাসল যেন কথাটা বিশ্বাসই করল না। সে শুধু বলল,” আমাকে যেতে দিন। আমি নেমে যেতে চাই।”

প্রণয় নির্ণিমেষ কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল,” আমার উত্তর এখনও আমি পাইনি।”

” আপনি কোনো উত্তর ডিজার্ভই করেন না।”

তুলির কটমট দৃষ্টির সামনে হার মানতে হলো প্রণয়কে। সে এক পর্যায় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” ওকে। আপনার যেমন ইচ্ছা।”

তারপর সে মাঁকড়সাটা দরজা থেকে সরিয়ে নিজের পকেটে রাখল। তুলি নিশ্বাস বন্ধ করে দৃশ্যটা দেখল। তারপরেই ফটাফট ব্যাগ নিয়ে নেমে গেল গাড়ি থেকে। প্রণয় একবারও বাঁধা দিল না। ফাঁকা রাস্তায় রিকশা খুঁজে পেতে খুব একটা অসুবিধা হলো না তুলির। সে রিকশায় চড়ে বসল। প্রণয় গাড়ি নিয়ে সম্পূর্ণ রাস্তা তুলির রিকশাকে অনুসরণ করল। তুলি সেটা বুঝেও কিছু বলল না।

বাড়ি ফিরে দেখা গেল রাইফা আর তন্বি তুলির অপেক্ষায় না খেয়ে বসে আছে। তন্বি বলল,” ফ্রেশ হয়ে আয়। আমার খুব জোরে ক্ষিদে পেয়েছে৷ তিনজন একসাথে খেতে বসবো।”

তুলি হাসল। তন্বি রান্নাঘরে চলে গেল। রাইফা বারান্দা থেকে প্রণয়ের গাড়িটা দেখে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,” তোকে প্রণয় পৌঁছে দিয়েছে তাই না?”

তুলি মৃদু হেসে বলল,” না। আমি ওর সঙ্গে আসিনি। রিকশায় করে এসেছি।”

” তাহলে প্রণয়ের গাড়ি এইখানে কেন?”

” কি জানি? সে হয়তো তোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে!” তুলি ফোঁড়ন কাটার উদ্দেশ্যে কথাটা বলল।

” আমার সঙ্গে?” রাইফা বিভ্রান্ত হলো। তারপর গায়ে একটা ওরনা জড়িয়ে চটজলদি বেরিয়ে পড়ল। তুলি সতর্কবাণী দেওয়ার জন্যে বলল,” এই ছেলেটা ভালো না রাইফা। তোর ভালোর জন্যই বলছি।”

রাইফা রাগ নিয়ে বলল,” কচু জানিস তুই।”

সে লিফটে উঠে গেল। প্রণয় কি কাজে এইখানে এসেছে সেটা জানা দরকার। তন্বি রান্নাঘর থেকে খাবার এনে ডাইনিং টেবিলে সাজালো। তুলি এসে বসতেই তন্বি প্রশ্ন করল,” রাইফা কোথায়?”

তুলি প্লেটে খাবার নিতে নিতে বলল,” বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে গেছে।”

” কি? রাইফার বয়ফ্রেন্ডও আছে? আমি তো জানতাম না!”

” আমিও জানতাম না। এইতো কিছুদিন হলো জেনেছি।”

” তাহলে তুই আমাকে জানালি না কেন? কে ওর বয়ফ্রেন্ড?”

” আমি যে ছেলেটাকে পড়াই, তার বড়ভাই।”

তন্বি ফিচেল হেসে বলল,” ও। এইবার বুঝতে পেরেছি। এজন্যই ওই বাড়িতে যাওয়ার জন্য রাইফার এতো আগ্রহ!”

তুলি বিষাক্ত নিশ্বাস ছেড়ে বলল,” হুম। ঠিক।”

প্রণয় গাড়ির সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ তাকে খুব এলোমেলো আর বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। রাইফাকে নামতে দেখেই সে হাসল। সোজা হয়ে বলল,” হায়।”

রাইফা কৌতুহলী দৃষ্টিতে জানতে চাইল,” তুমি হঠাৎ এখানে কেন প্রণয়?”

” মিষ্টি আপু বলেছিল তুলিকে পৌঁছে দিতে। তাই এসেছিলাম।”

” কিন্তু তুলি যে বলল সে তোমার সঙ্গে আসেনি? আর তুমি নাকি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছো?”

প্রণয় হেসে অন্যদিকে তাকাল। রাইফা অবাক হয়ে বলল,” কি হচ্ছে?”

” তুলি ভাবছে আমাদের মধ্যে রিলেশন আছে।”

” বাহ, এটাই তো আমরা চেয়েছিলাম। কিন্তু ও এতো ইজিলি বিশ্বাস করে নিল?”

” জানি না। ও বলেছে আমি যাতে ওর থেকে দূরে থাকি।”

রাইফা হতাশ নিশ্বাস ছাড়ল। প্রণয়কে আশ্বস্ত করতে বলল,” ডন্ট ওরি। আমি ওর সঙ্গে কথা বলবো।”

” দরকার নেই।”

” কেন?”

প্রণয় উপরে তাকালো। জানালা থেকে তুলি তাদের উপর নজর রাখছে। রাইফা সরাসরি তাকাতেই তুলি দ্রুত পর্দা টেনে সরে গেল। রাইফা সন্দিহান গলায় বলল,” সে কি জেলাস?”

প্রণয় কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,” জানি না। কিন্তু সে আমাকে বিশ্বাস করছে না।”

ভার্সিটির ভর্তি কোচিং-এ ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। তন্বির ভর্তির জন্য হেলাল সাহেব টাকা পাঠিয়েছেন। তুলি ভেবেছিল তার জন্যেও টাকা পাঠানো হবে। কিন্তু হলো না৷ তুলি অবশ্য এই নিয়ে একদম মনখারাপ করেনি। সে জানতো এটাই হবে৷ রাইফা আর তন্বিকে বলে দিল,” তোরা ভর্তি হয়ে যা। আমি এমনিই পড়বো। কোচিং-এ ভর্তি হলেই যে চান্স হবে এমন তো কোনো কথা নেই। আমি কোচিং ছাড়াই ভর্তি পরীক্ষা দিবো।”

রাইফা এই কথা শুনে রেগে গেল। সে বলল,” অসম্ভব। আমরা তিনজন একসঙ্গে ভর্তি হবো। তুলি, তুই টাকার জন্য এই কথা বলছিস তাই না? প্রয়োজনে তুই আমার থেকে ধার নে। তবুও ভর্তি হয়ে যা প্লিজ!”

তুলি হেসে বলল,” লাগবে না। কোচিং ছাড়াই দেখবি আমি ভালো রেজাল্ট করেছি। আর তুই তো ভর্তি হচ্ছিসই। আমি না হয় তোর থেকেই নোটস নিয়ে নিবো।”

” নোটস নেওয়া আর স্ব-শরীরে ক্লাস করার মাঝে অনেক পার্থক্য আছে তুলি। তুই ভর্তি না হলে আমিও হবো না, যা।”

রাইফার জেদের কাছে হার মানতে হলো৷ তুলি বলল,” আচ্ছা যা, আমি ভর্তি হবো। কিন্তু প্রথম মাসের বেতন পেতেই তোর ধার শোধ করে দিবো কিন্তু।”

” আচ্ছা দিস।”

তিনজন একসঙ্গে হাসল। তন্বির বিভাগ আলাদা ছিল। সে মানবিক শাখা থেকে আলাদা কোচিং-এ ভর্তি হয়ে গেল৷ তার ক্লাসও ভিন্ন ভিন্ন সময়ে। এদিকে তুলি আর রাইফা বিজ্ঞান বিভাগ থেকে। তাই তাদের প্রায় নিয়মিত ক্লাস থাকে। প্রতিদিন পরীক্ষা হয়৷ আজ-কাল শানকে পড়ানোর সময় কমিয়ে এনেছে তুলি। আগে সে দুইঘণ্টার বেশি সময় ধরে পড়াতো। এখন ঘড়ি ধরে দেড়ঘণ্টা পড়ায়। এর মাঝে প্রণয়ের সঙ্গে একবারও দেখা হয় না। প্রণয়কে ইদানিং বাড়িতেই পাওয়া যায় না। তুলির সময় ব্যস্ততায় কেটে যাচ্ছে।

কোচিং-এ এই কয়দিনে তাদের অনেক ভালো ভালো বন্ধু জুটে গেছে। টিনা, অবনী, মীরা, রাইফা আর তুলি পাঁচ জনের সুন্দর একটা গ্রুপ তৈরী হয়েছে। তারা প্রতিদিন একসঙ্গে বসে ক্লাস করে। সবারই কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। তুলি খুব পড়াশুনা করে। তার অন্যকোনো দিকে মনোযোগ নেই। টিনা শুধু সবার ভুল ধরে। কে কি বলল, কিভাবে তাকাল, কি পোশাক পরল এসব নিয়ে মাথা ঘামানোই তার মূল কাজ। অবনীর কাজ শুধু কোচিং-এর হ্যান্ডসাম ভাইয়াদের উপর ক্রাশ খাওয়া। সে তো পারলে ফুচকাওয়ালার উপরেও ক্রাশ খেয়ে বসে থাকে। মীরা তাকে এসবে শাসন করে। সে কিছুটা মুরব্বি ধরণের। রাইফা খুবই হেল্পফুল। কারো কলম প্রয়োজন হলে কিংবা খাতা, ক্যালকুলেটর, পানি প্রয়োজন হলে সব তার কাছে পাওয়া যায়। এমনকি কারো ক্ষিদে পেলে খাবারও পাওয়া যায় রাইফার কাছে।

একদিন একটা মজার ঘটনা ঘটল। সেদিন ছিল পদার্থবিজ্ঞান ক্লাস। এর পরে রসায়ন পরীক্ষা। তুলি পড়াশুনা করছিল মন দিয়ে। বাকিরা আড্ডায় মত্ত। হঠাৎ সময়মতো ক্লাসে লেকচারার ঢুকে পড়ল। সবাই তড়িঘড়ি করে জায়গামতো দাঁড়ালো লেকচারারকে স্বাগতম জানাতে। তুলিও দাঁড়িয়েছে কিন্তু তার দৃষ্টি বইয়ের দিকে। লেকচারার বলল,” বসো সবাই। কেমন আছো?

সবাই একসঙ্গে উত্তর দিল৷ কিন্তু তুলি তখনও পড়ছে৷ এটাই তার কাজ। নতুন কোনো লেকচারার ক্লাসে এলে প্রথম দশমিনিট কথা বলে সময় নষ্ট করে। ওইটুকু সময় তুলি পড়ার মধ্যেই থাকে। তারপর মূল লেকচার শুরু হলে সে ক্লাসে মনোযোগী হয়। তবে আজকের ব্যাপার ভিন্ন। রাইফা চাপা স্বরে বলল,” তুলি, দ্যাখ কে এসেছে!”

তুলি ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,” পরে দেখবো।”

তখনি পেছন থেকে অবনী বলল,” শেষ! আমি শেষ! এতো সুন্দর টিচার কেন দেয় বলতো?আমরা কি হার্ট অ্যাটাক করবো নাকি পড়াশুনা করবো? নাকি পড়াশুনা করতে কর‍তে হার্ট অ্যাটাক করবো?”

তুলি কথাটা শুনতে পেয়ে মজা করে বলল,” হার্ট এতো দূর্বল হলে চলে?”

” বাট হি ইজ ড্যাম হট।”

মীরা বলল,” চান্স পাওয়ার ইচ্ছে থাকলে পড়াশুনা কর। তাহলে এমন কত ড্যাম হট পেছনে ঘুরবে!”

তুলি তাদের কথা শুনে হাসছিল। রাইফা তুলির কানে কানে বলল,” তুই কি একবার দেখবি না ভাইয়াকে?”

” যত সুন্দরই হোক, আমার কাছে ভালো লাগবে না। তাহলে দেখে কি লাভ? শুধু শুনলে আর পড়া বুঝলেই হলো।”

তখন টিনা বলল,” নারে, আজকের ভাইয়াটা আসলেই জোস। দেখার মতোই জোস। হয়তো তুইও ক্রাশ খাবি।”

টিনা মোবাইল বের করে লুকিয়ে ছবি তুলতে লাগল। তার এই আচরণে বোকা হয়ে গেল তুলি। তারা একদম পেছনে বসে আছে। ক্লাসরুম অনেক বড়। পেছন থেকে লেকচারারের কথা স্পষ্ট শোনা যায়। কারণ স্পিকার ব্যবহার করা হয়। আর তুলি যেখানে বসেছে সেখান থেকে স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছে না। তবে টিনার কান্ডে তুলির দেখতে খুব ইচ্ছে হলো। টিনা খুব নাক উঁচু মেয়ে। তার সহজে কাউকে পছন্দ হয় না। অথচ এইবার সে একদম ফোন বের করে ছবি তুলতে শুরু করেছে। এর মানে কিছু তো আছেই। তুলি সামনের মানুষটিকে দেখার কৌতুহল দমাতে না পেরে দাঁড়িয়ে পড়ল। তখনি তার আত্মা ছলাৎ করে উঠল। রাইফা মৃদু হেসে বলল,” চিনতে পেরেছিস?”

তুলি হতভম্ব হয়ে বলল,” আমি কি ভুল দেখছি নাকি আসলেই ভুল দেখছি?”

” তুই একদম ঠিক দেখছিস।”

প্রণয় মুচকি হেসে তুলিকে উদ্দেশ্য করে বলল,” যদি কোনো প্রবলেম না থাকে তাহলে কি আমরা সবাই বসতে পারি?”

সবার মাঝে একমাত্র তুলিই দাঁড়িয়ে আছে। তাই কারো বুঝতে অসুবিধা হলো না যে কথাটা তুলির উদ্দেশ্যেই বলা হয়েছে। প্রত্যেকের দৃষ্টি এবার তুলির দিকে স্থির হলো। তুলি তখনও হাঁ করে প্রণয়কে দেখছিল। তার বিস্ময় কাটছিলই না। প্রণয় বলল,” বসো।”

তুলি বিস্মিত কণ্ঠে বলল,” কি?”

সবাই হেসে উঠল৷ সামনে থেকে একটি মেয়ে বলল,” ভাইয়া তোমাকে বসতে বলেছে। বসো।”

এই কথার পর সবাই আরও এক দফা হাসল। চারদিকে হাসির রোল পড়ে গেল। একজন তো বিড়বিড় করে বলেই উঠল,” ভাইয়াকে দেখে হ্যাং মেরে গেলে যে? ক্রাশ খেয়েছো নাকি?”

তুলি লজ্জায় বসে পড়তে নিচ্ছিল তখন প্রণয়ই আবার বলল,” তোমার পেছন থেকে দেখতে অসুবিধা হলে সামনে এসে বসতে পারো।”

তুলি মনে মনে প্রণয়কে খুব গালি দিয়ে বলল,” নো থ্যাংকস। আমি এখানেই ঠিকাছি।”

তারপর সে বসে পড়ল নিজের জায়গায়। রাইফা হাসতে লাগল। তুলি ফিসফিস করে বলল,” আর কোনো জায়গা ছিল না? এখানেই কেন মরতে আসতে হবে তাকে?”

প্রণয় সবার উদ্দেশ্যে বলল,” ওয়েল, আমি এখন আমার পরিচয়টা দেই। আমি প্রণয় আহসান ফ্রম নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি। কম্পিউটার সাইন্স ইঞ্জিনিয়ারিং(সিএসই) ফোর্থ ইয়ার।”

তুলি মুখ ভেংচিয়ে বলল,” ম্যা, ম্যা, ম্যা! আমি এই ছাগলের ক্লাস করবো না।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here