#বেদনার_রঙ_নীল
একুশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz
সন্ধ্যায় চায়ের আসরে অনেক দিন পর বন্ধুরা একত্রিত হয়েছে। সেমিস্টার ফাইনালের চাপ শেষ করে মাত্র হাঁফ ছাড়ল সকলে। অনেকদিন পর একটি মজার বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু প্রণয়। সামনে তার জন্মদিন। আজমীর আর প্রিয়ন্তী প্রণয়ের সবচেয়ে কাছের। তবে বেশ কিছুদিন হলো আজমীরের সাথে প্রণয়ের ঝামেলা চলছে। বন্ধুত্বে সচরাচর এতোদিন ধরে ঝামেলা থাকে না। তবে আজমীর আর প্রণয় একে-অন্যের মুখ দেখতেও অনিচ্ছুক। বন্ধুরা বুঝতে পারছে এটা যে কোনো মেয়েঘটিত ব্যাপার। প্রণয়ের অনুপস্থিতিতে এই নিয়ে আলোচনাও হয় ব্যাপক। আজমীরের হবু ভাবীকে বিয়ে থেকে ভাগিয়ে আনতে গিয়ে এখন প্রণয় নিজেই মেয়েটির প্রেমে পড়ে গেছে। খুবই মুখরোচক আলোচনা। প্রণয়ের সামনে অবশ্য কেউ এই বিষয়ে কথা বলার সাহস পায় না। তবে আগে-পিছে এসব নিয়ে হাসি-তামাশা নিশ্চয়ই হয়। আজকে প্রণয় আড্ডামহলে উপস্থিত হতেই আজমীর ঠুনকো একটি বাহানা দেখিয়ে উঠে যেতে চাইল। জুবায়ের তাকে থামিয়ে বলল,” আরে বোস, আর কতদিন চলবে তোদের মধ্যে এসব? এবার একটু সমঝোতা কর। সামনে প্রণয়ের বার্থডে।”
আজমীর আঁড়চোখে প্রণয়ের দিকে তাকাল। প্রিয়ন্তী বলল,” তুইও কিন্তু কম না প্রণয়। এখানে আসার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলি আজমীর আছে কি-না! অর্থাৎ আজমীর থাকলে তুই আসবি না? এটা কোনো কথা? একটা মেয়ের জন্য তোরা টিন এইজের মতো ঝগড়া করছিস।”
প্রণয় শান্ত ভঙ্গিতে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,” আমি কারো সাথে ঝগড়া করিনি। কথা বলাও বন্ধ করিনি। আমার দিক থেকে সব নরমাল।”
সবাই এবার আজমীরের দিকে চাইল৷ আজমীর অপ্রস্তুত হয়ে বলল,” তাহলে কি সব দোষ আমার? যে আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল সে স্যরি না। অথচ আমাকে স্যরি হতে হবে?”
প্রণয় চোয়াল শক্ত করে তাকাল। ভারী আওয়াজে বলল,” আমি কোনো বিশ্বাসঘাতকতা করিনি।”
” তুই বিশ্বাসঘাতকতা করেছিস।” আজমীর প্রণয়ের কাছে এগিয়ে এলো। প্রণয়ও চায়ের কাপ রেখে শার্টের হাতা গুটিয়ে নিতে লাগল। পরিস্থিতি অনুকূলের বাইরে যাওয়ার আশঙ্কায় বন্ধুরা তাদের সামলানোর চেষ্টা করল। প্রিয়ন্তী প্রণয়ের হাত টেনে বলল,” এদিকে আয় দোস্ত।”
রাফি আর অয়ন আজমীরকে অন্যদিকে নিয়ে গেলো। প্রিয়ন্তী ফিসফিসিয়ে বলল,” এখানে কোনো হাঙ্গামা করিস না প্লিজ। আজমীর তোর কত ভালো ফ্রেন্ড ছিল৷ একটা সামান্য মেয়ের জন্য ওর সাথে তুই এমন করতে পারছিস?”
প্রণয় ইস্পাতের মতো কঠিন মুখ করে বলল,” সে কোনো সামান্য মেয়ে না। কথা বলার আগে বুঝে শুনে বলবি।”
প্রিয়ন্তী একটু হকচকিয়ে গেল। আমতা-আমতা করে বলল,” আচ্ছা স্যরি।”
প্রণয় প্রিয়ন্তীর হাত ছেড়ে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। তার মেজাজ হয়ে উঠেছে তিরিক্ষ। প্রিয়ন্তী একটু কাছে এসে ফোঁড়ন কেটে বলল,” আমি তো ভুলেই গেছিলাম। ও এখন তোর গার্লফ্রেন্ড!”
প্রণয় অকপটে বলল,” গার্লফ্রেন্ড হয়নি এখনও। ”
প্রিয়ন্তী চমকালো। কৌতুহল নিয়ে বলল,” কি? তাহলে আমি যে শুনেছিলাম তোদের রিলেশন হয়ে গেছে? আজমীর তাহলে তোর উপর কেন রেগে আছে?”
প্রণয় সমস্ত ঘটনা বিস্তারিত বর্ণনা করল। প্রিয়ন্তী শ্রান্ত কণ্ঠে বলল,” ওহ মাই গড! আমার তো মনে হয় মেয়েটা তোদের দু’জনের সঙ্গেই খেলছে..”
” কি বললি তুই?” প্রণয় ধারালো দৃষ্টিতে চাইল। প্রিয়ন্তী সংশোধন করার জন্য ত্বরিতে বলল,” মানে সে হঠাৎ এমন কেন করবে? আজমীরের থেকে বাঁচার জন্য তোর হেল্প নিয়েছিল। আর এখন তুই ওর পেছনে পড়ে গেছিস তাই তোর থেকে বাঁচার জন্য উল্টা-পাল্টা রিজন দেখাচ্ছে। টিন এইজ মেয়েরা এমনই হয়। ওরা ফিলিংসের কি বুঝে? রিলেশনশীপ নিয়ে কখনও সিরিয়াস থাকে না।”
” তুলি ওই ধরণের মেয়ে না।”
” কি জানি সে কেমন মেয়ে! আমি তো ওকে সামনা-সামনি দেখিওনি।”
হঠাৎ দূর থেকে আজমীর ছুটে এলো। তার ভাব-গতিক দেখে মনে হচ্ছে মূল উদ্দেশ্য প্রণয়কে আক্রমণ করা। সেজন্য প্রণয়ও প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়ালো। প্রিয়ন্তী এই অবস্থা দেখে দ্রুত তাদের মাঝখানে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। আজমীর খিটমিট করে বলল,” সামনে থেকে সর প্রিয়ু।”
প্রিয়ন্তী রেগে আজমীরকে জোরে ধাক্কা মেরে বলল,” তোর সাহস তো কম না! কি করতে চাইছিস? প্রণয়ের গায়ে যেন একটা আঁচও না লাগে।”
আজমীর হিংস্রভাবে প্রিয়ন্তীকে ধাক্কা দিল। প্রিয়ন্তি উল্টো হয়ে ব্যস্ত সড়কের মাঝে পড়ে যেতে নিচ্ছিল। প্রণয় তাকে দুইহাতে আগলে ধরল। সবাই এই ঘটনায় বিচলিত হয়ে উঠল। ক্ষীপ্ত দৃষ্টিতে তাকালো আজমীরের দিকে। ফায়েজ হৈ হৈ করে বলল,” ওই, এটা কি করলি তুই? যদি ওর কিছু হয়ে যেতো?”
আজমীরের ধ্বংসাত্মক দৃষ্টি তখনও প্রণয়ের দিকে স্থির। প্রণয় আচমকা এসে আজমীরকে প্রচন্ড বেগে একটা ঘুষি মারল। আজমীর উল্টে পড়ল মেঝেতে। বন্ধুরা আতঙ্কিত হয়ে উঠল। মীম ভয় পেয়ে বলল,” প্লিজ তোরা থাম। ফোর গড সেইক!”
কয়েকজন প্রণয়কে দূরে নিয়ে যেতে লাগল। আর বাকিরা আজমীরকে তুলতে ব্যস্ত হলো।
ঘটনা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু রাতে আজমীর প্রণয়কে ম্যাসেজ করল,” যদি সাহস থাকে তাহলে আজকে এগারোটার পর আমার এলাকায় আসবি গাড়ি নিয়ে। আধাঘণ্টার একটা রেইস হবে। তোকে চ্যালেঞ্জ করছি।”
প্রিয়ন্তী এবং বাকি বন্ধুরা তখন প্রণয়ের সাথেই ছিল। তার জন্মদিন নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। তখন এই ম্যাসেজটি দেখে প্রিয়ন্তী অস্থির হয়ে বলল,” খবরদার প্রণয়, তুই কিন্তু যাবি না। ও তোকে ট্র্যাপে ফেলতে পারে।”
প্রণয় ত্যাড়া গলায় বলল,” আমি অবশ্যই যাবো। ও কি মনে করেছে?”
প্রিয়ন্তী শক্ত করে প্রণয়ের হাত চেপে ধরল। দৃঢ়চিত্তে বলল,” আমি তোকে জীবনেও যেতে দিবো না।”
” তুই আমাকে যেতে না দেওয়ার কে?” ঝারি মেরে হাত ছাড়াল প্রণয়। প্রিয়ন্তী কোমল দৃষ্টিতে বলল,” আমার দোহাই, তুই যাবি না।”
প্রণয় সবার থেকে দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। প্রিয়ন্তীও তার পিছু এলো। অনুরোধ মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,” তুই প্রমিস করে বল যে যাবি না! আর গেলেও আমাকে নিয়ে যেতে হবে।”
প্রণয় এবার অধৈর্য্য হলো। ক্রুদ্ধ হয়ে বলল,” তুই এসব কি শুরু করেছিস? সবাই তোকে আর আমাকে নিয়ে উল্টা-পাল্টা ভাবে তোর এমন আচরণের জন্য।”
প্রিয়ন্তী থতমত খেয়ে বলল,” মানে? আমি কি এমন করলাম? ফ্রেন্ড হিসেবে কি আমি তোর টেইক কেয়ার করতে পারি না?”
প্রিয়ন্তী আলতো স্পর্শে তার গালে হাত রাখল। প্রণয় হাতটা সরিয়ে হতাশ কণ্ঠে বলল,” এটাকে টেইক কেয়ার বলে না।”
” তাহলে কি বলে?”
” বাড়াবাড়ি করা বলে।”
প্রিয়ন্তী বোকার মতো তাকিয়ে রইল। প্রণয় তার কথাটা বলেই চলে যাচ্ছে। নিঃসঙ্গ প্রিয়ন্তী চিন্তা করতে লাগল, আসলেই কি বাড়াবাড়ি করছে? অল্প-স্বল্প বাড়াবাড়িতে ক্ষতি নেই তবে!
এগারোটার মধ্যে আজমীরের বলা জায়গায় পৌঁছে গেল প্রণয়। আজমীরও সেখানেই অপেক্ষারত ছিল। ঠিক এগারোটা দশমিনিটে তাদের মধ্যে শুরু হলো হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। গাড়ি নিয়ে কে কার আগে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে সেই প্রতিযোগিতা। যথারীতি আজমীর মাঝপথে থেমে গেল। আর প্রণয়ের গাড়ির এক্সিডেন্ট হয়ে গেল।
তুলিরা একত্রে কার্ড খেলছিল। তাদের সঙ্গে টিনা, অবনী আর মীরাও আছে। পরিকল্পনা ছিল সারারাত গ্রুপ স্টাডি করবে। সামনে পরীক্ষা। কিন্তু পড়াশুনা বাদ দিয়ে কার্ড খেলা চলছে। তুলি সবার আগে জিতে গেল। এবার সে ক্লান্ত কণ্ঠে বলল,” তোরা খেল। আমি যাই।”
রাইফা প্রশ্ন করল ঝটিতে,” কই যাস?”
তুলি হাই তুলে বলল,” ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু আমি এখন কফি খেয়ে পড়তে বসবো।”
তন্বি পরামর্শ দেওয়ার উদ্দেশ্যে বলল,” রাতে কফি খেয়ে ঘুম তাড়ানো ঠিক না। এখন ঘুমিয়ে নে। সকালে পড়িস।”
রাইফার মোবাইলটা তখনি বাজল। সে মোবাইল রিসিভ করে বারান্দায় চলে গেল। তুলি বিছানা বালিশ গুছিয়ে শোয়ার জন্য প্রস্তুত। ঠিক সেই সময় রাইফা বারান্দা থেকে বের হলো একটি দুঃসংবাদ নিয়ে। প্রণয় এক্সিডেন্ট করেছে।
টিনা আৎকে উঠে বলল,” প্রণয় মানে? কোন প্রণয়? আমাদের কোচিং-এর ভাইয়া?”
রাইফা ইচ্ছাকৃতই মিথ্যা বলল,” না। তুই চিনবি না। আমাদের প্রতিবেশী। তুলির সাথে ভালো সম্পর্ক। তুলি, যাবি নাকি তুই?”
তুলির হাত থেকে মশা মারার ইলেকট্রিক ব্যাটটা অনায়াসে পড়ে গেল। স্থবির হয়ে যাওয়া কণ্ঠে প্রশ্ন করল সে,” কোথায়?”
” হসপিটালে।”
তুলি ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল। তার হাত-পা কাঁপছে ভীষণভাবে। রাইফা নিচু হয়ে তুলিকে ধরে বলল,” মিষ্টি আপু ফোন করেছিল। তোকে নিয়ে যেতে বলেছে।”
চলবে