বেদনার_রঙ_নীল চুয়াল্লিশতম পর্ব

0
215

#বেদনার_রঙ_নীল
চুয়াল্লিশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz

তুলি বারান্দার গাছগুলোয় পানি দিচ্ছিল আর সকালের কথাগুলো ভাবছিল। অজান্তেই তার চোখ থেকে গড়গড় করে পানি পড়ছে। মিষ্টি যে কখন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তা সে টেরও পায়নি। হঠাৎ মিষ্টি সশব্দে বলল,” কাঁদছো কেন তুলি?”

থতমত খেয়ে ঘুরে তাকাল তুলি। মিষ্টির কাছে ধরা পড়ে যাওয়ায় একটু লজ্জাই পেল। দ্রুত চোখের জল মুছতে মুছতে বলল,” কিছু না।”

” একদম মিথ্যা কথা বলবে না। কিছু একটা তো হয়েছেই। প্রণয়ের সাথে ঝগড়া করেছো নাকি?”

তুলি চিন্তা করল, ধরাই যেহেতু পড়েছে মিথ্যা বলে আর লাভ কি? সত্যিটাই বলা উচিৎ। তাই মাথা নাড়ল। মিষ্টি আগ্রহ দেখিয়ে প্রশ্ন করল,” কি নিয়ে ঝগড়া হয়েছে শুনি?”

তুলি নাক টেনে বলল,” বাচ্চা নিয়ে।”

” বাচ্চা নিয়ে আবার কিসের ঝগড়া?”

” আচ্ছা আপু তুমিই বলো, বাচ্চাটা নষ্ট হয়েছে এটা কি আমার দোষ? আমি তো ইচ্ছে করে আর ওকে মেরে ফেলিনি।”

মিষ্টি জীভ কাটল। তুলির গালে হাত রেখে বলল,” ছি, ছি, একদম না। প্রণয় কি এজন্য তোমাকে দোষ দিচ্ছে?”

” হ্যাঁ। সে বলছে আমি সতর্ক থাকিনি বলেই নাকি এমন হয়েছে।”

” উফ, ভাগ্য খারাপ হলে হাজার সতর্ক থাকলেও লাভ হয় না। তুমি ওর কথায় মনখারাপ কোরো না।”

” কিভাবে মনখারাপ না করে থাকবো বলো? ও তো আমাকে ডিভোর্সের কথাও বলে ফেলেছে!”

মিষ্টি বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে বলল,” কি? এই কারণে ও তোমাকে ডিভোর্সের কথা বলেছে? এটা আবার কেমন কথা? অদ্ভুত! তুমি এসো আমার সাথে।”

তুলি ব্যস্ত হয়ে বলল,” কোথায় যাবো?”

” এসো তুমি আগে।”

মিষ্টি তুলিকে টেনে অজান্তার ঘরে নিয়ে এলো। প্রণয়ের কান্ড-কারখানা সব নালিশের মতো অজান্তাকে জানাতেই তিনি খুব রেগে গেলেন। মোবাইল হাতে নিলেন প্রণয়কে ফোন করে ঝাড়ার জন্য৷ তুলি ভয়ে বলল,” থাক ছোটমা, কিছু বলতে হবে না। ”

অজান্তা রাগী কণ্ঠে বললেন,” কেন বলতে হবে না? ও তো শুধু শুধুই তোমাকে দোষ দিচ্ছে। এমন এক্সিডেন্টে কি কারো হাত থাকে? ডিভোর্সের কথা ও কিভাবে বলল?”

প্রণয় ফোন রিসিভ করতেই আরও দিগুণ তেজ নিয়ে ঝেঁঝে উঠলেন অজান্তা,” হ্যালো প্রণয়, কোথায় আছিস তুই?”

” বাইরে আছি। কেন?”

” তুই এই মুহূর্তে বাড়ি আসবি।”

” হঠাৎ বাড়ি আসবো কেন? আবার কিছু হয়েছে নাকি?”

” অনেক বড় ঘটনা ঘটেছে। তুই বাড়ি এসে তুলিকে স্যরি বলবি। তুই নাকি ওকে ডিভোর্সের হুমকি দিয়েছিস?”

প্রণয় একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল,” এসব তোমাকে কে বলেছে? তুলি?”

” কে বলেছে সেটা কোনো বিষয় না৷ তুই ওকে এই কথা বলেছিস কি-না সেটা বল।”

প্রণয় চুপ রইল। অজান্তা হুংকার ছেড়ে বললেন,” যদি আসলেই বলে থাকিস তাহলে খুব খারাপ কাজ করেছিস। অবশ্যই ওর কাছে ক্ষমা চাইবি তুই। মেয়েটা এমনিই কষ্ট পাচ্ছে দিন-রাত। তার উপর তুই শুরু করেছিস অশান্তি। পেয়েছিসটা কি? সন্তান হারানোর কষ্ট কি ওর থেকে কি তোর বেশি?”

প্রণয় কিছুই বলল না। চুপচাপ বকা হজম করল। একটু পর তুলি রুমে আসতেই দেখল প্রণয় তাকে ফোন করেছে। মুখে হাসি ফুটল তুলির। ছোটমায়ের ধমকে কাজ হয়েছে তাহলে! তুলি ফোন রিসিভ করেই হাস্যজ্জ্বল কণ্ঠে বলল,” হ্যালো।”

ওই পাশ থেকে প্রণয়ের ঠান্ডা গলা শোনা গেল,” কি ভেবেছো? ছোটমায়ের কাছে আমার নামে বিচার দিলেই আমি ভয় পেয়ে যাবো? যেটা হওয়ার সেটা হবেই। তাই এসব করে কোনো লাভ নেই।”

তুলি থতমত খেয়ে বলল,” মানে? আমি কারো কাছে বিচার দেইনি। মিষ্টি আপু আমার…”

তুলি কথা শেষ করার আগেই প্রণয় ফোন কেটে দিল। বিস্ময় নিয়ে মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে রইল তুলি। এমন কেন করছে প্রণয় তার সাথে? হুট করে বুঝি মানুষ এভাবে বদলে যায়? একবার তুলির ইচ্ছে হলো ব্যাগপত্র গুছিয়ে রাইফার বাড়িতে চলে যেতে। তখন যদি প্রণয়ের একটু শিক্ষা হয়! তারপর আবার সে ভাবল, এটা করতে গেলে যদি আরও ঝামেলা হয়? প্রণয় আরও রেগে যদি ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেয়? এই কথা ভাবতেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল তুলির। ডিভোর্স শব্দটা তার দুঃস্বপ্নের মতো লাগছে। বিয়েটা যত তাড়াহুড়োয় হয়েছিল ডিভোর্সটাও কি সেভাবে হয়ে যাবে তাদের? তুলি মানতে পারছে না। ডিভোর্স আটকানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা সে করবে। কিন্তু কিভাবে? আজ হঠাৎ তাদের বিয়ের প্রথম রাতের কথাগুলো খুব মনে পড়ছে তুলির। কি সুন্দর সময় ছিল তখন।

________
সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে বিয়েটা হয়ে যাওয়ার পর রাইফা আর আশা খুব আগ্রহ নিয়ে বিছানা- বালিশ গুছিয়ে বাসর ঘর সাজিয়েছিল। এতোরাতে হুট করে ফুল কেনা সম্ভব নয়। তাই রাইফা বুদ্ধি করে বাইরে থেকে বুনোফুল এনে পাপড়ি ছিঁড়ে বিছানায় ছড়িয়ে দিল। তুলি জড়োসড়ো হয়ে সেই বিছানায় বসল। প্রণয় দরজা বন্ধ করেই হাঁফ ছাড়ল। বিয়ের ঝামেলা মিটে যাওয়ায় তার শান্তি লাগছিল। তুলি ফিসফিস করে বলল,” বিয়েটা না হলে মামা হয়তো আর কোনোদিন আমার সাথে কথাই বলতো না।আমার অনুরোধ রাখার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। ”

প্রণয় হেসে বলল,” আমি কারো অনুরোধ রাখার জন্য তো বিয়ে করিনি! যাকে ভালোবাসি তাকে বিয়ে করেছি। তোমার জায়গায় অন্যকেউ হলে গলায় ছুরি ধরলেও বিয়ে করতাম না।”

” তাই বুঝি? আচ্ছা দেখুন, বিয়ে হয়েছে মানেই ভাববেন না যে আমি আপনার বউ।”

এই কথা শুনে প্রণয় বিষম খেল। অদ্ভুত দৃষ্টিতে বলল,” মানে? বিয়ের পর বউ না ভাবলে কি ভাববো তোমাকে?”

তুলি আমতা-আমতা করে বলল,” মানে আমি বলতে চাইছি…. আমাদের বিয়ের খবরটা গোপন রাখতে হবে। শুধু মামাকে সন্তুষ্ট করার জন্য আমি বিয়ে করেছি। নাহলে পাঁচ বছরের আগে বিয়ের কথাও ভাবতাম না। এতো দ্রুত সংসারী হওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। আপনি বাড়িতে বিয়ের ব্যাপারে কিছু জানাবেন না। আমরা আগে যেভাবে ছিলাম সেভাবেই থাকবো। সবকিছু আগের নিয়মেই চলবে। ঢাকায় ফিরে বিয়ের কথা আমরা দু’জনেই ভুলে যাবো। ওকে?”

প্রণয়ের উজ্জ্বল মুখ অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে গেল এসব শুনে। বিরস কণ্ঠে সে আওড়ালো,” আগে জানলে বিয়েই করতাম না। এমন বিয়ে করে লাভ কি?”

তুলি মুচকি হেসে বলল,” একটা আঙুল ধরুন।”

এই বলে সে দু’টো আঙুল বাড়িয়ে দিল। প্রণয় একটু ভেবে ডানপাশের আঙুলটি ধরল। তুলি বলল,” ঠিকাছে। তাহলে আমি নিচে শোব। আর আপনি বিছানায়।”

প্রণয় আৎকে উঠল,” এই ঠান্ডার মধ্যে নিচে কেনো শুবে তুমি? কোনো দরকার নেই। আমার পাশে শুলে নিশ্চয়ই তোমার জাত চলে যাবে না!”

তুলি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” শুতে পারি। কিন্তু আপনি যদি ভরসা দেন লিমিট ক্রস করবেন না, তাহলে!”

” লিমিট ক্রস মানে? ও আচ্ছা বুঝেছি। জানতাম এই কথাই বলবে। ভয়ের কিছু নেই। একসাথে শোয়ার জন্যই তো বিয়েটা হলো। এখন তাহলে আলাদা শোবো কেন?”

তুলি বিষম খেয়ে বলল,” কি? একসাথে শোয়ার জন্য বিয়ে হলো মানে?”

প্রণয় হেসে উত্তর দিল,” মানে গতকাল যদি তোমার মামা আমাদের একসাথে শুতে না দেখতেন তাহলে তো এইভাবে বিয়ে দিতেন না। তাই না?”

” ও আচ্ছা। হ্যাঁ তাইতো।”

” আমি লিমিট ক্রস করবো না। তুমি নিশ্চিন্তে শুতে পারো।”

” থ্যাঙ্কিউ। ”

” লাইট কি বন্ধ করবো?”

তুলি খানিক আতঙ্কিত গলায় বলল,” একদম না!”

” ওকে, ওকে, কুল।”

তুলি গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ল। প্রণয় তার থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরত্ব বজায় রেখে শুয়ে রইল। তুলি যখন নিশ্চিন্ত হয়ে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে ঠিক তখন অনুভব করল ঘাড়ে ঠোঁটের স্পর্শ। আৎকে উঠল তুলি। ঝটিতে পেছন ফিরতেই প্রণয় শক্ত করে তার কোমর চেপে ধরল। গলায় মুখ গুজল। তুলির শরীর কেঁপে উঠল উষ্ণ শীহরণে। মৃদু কম্পন জড়ানো কণ্ঠে সে বলল,” আপনি কিন্তু লিমিট ক্রস করছেন।”

প্রণয় ফিসফিস করে বলল,” আমি তো ফেরেশতা না। মানুষ। এতটুকু লিমিট ক্রস করা আমার জন্য জায়েজ। আজকে আমি খুব লিমিট ক্রস করবো তুলি। তোমাকে কিন্তু আমার এই লিমিট ক্রস করাটা ক্ষমা করতেই হবে।”

তুলি কিছু বলার আগেই প্রণয় তার মুখ বন্ধ করে দিল ঠোঁটে চুমু দিয়ে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here