বেদনার_রঙ_নীল ছত্রিশতম পর্ব

0
354

#বেদনার_রঙ_নীল
ছত্রিশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz

বাড়ি থেকে বের হয়েই হেলাল সাহেব বললেন,” তুমি ঘরে ফিরে যাও বাবা। তুলি আর যাবে কোথায়? বকুলদের বাড়ি আছে হয়তো৷ আমি ডেকে আনছি।”

” বকুলটা কে?” সামির জিজ্ঞেস করল কৌতুহল নিয়ে। হেলাল সাহেব উত্তরে বললেন,” আমাদের প্রতিবেশী। দুপুরে এলো যে! এইতো সামনেই তাদের বাড়িটা।”

সামির সামান্য বিভ্রান্তিবোধ নিয়ে বলল,” কিন্তু তন্বি যে বলছিল তুলি রাগ করে বের হয়ে গেছে?”

” রাগ করে বকুলদের বাড়িতেই বোধহয় গেছে।”

” আমিও যাই আপনার সাথে চাচা। চলেন।”

” আচ্ছা চলো।”

প্রণয় দৌড়ে এদিকে এলো। অস্থিরতা আর কৌতুহল মেশানো গলায় জিজ্ঞেস করল,” তুলিকে পাওয়া গেছে?”

হেলাল সাহেব পুনরায় একই উত্তর দিলেন,” বকুলদের বাড়িতেই বোধহয় গেছে। আমরাও সেখানে যাচ্ছি। ”

প্রণয় আর কিছু না বলে দৌড়ে বকুলদের বাড়িতে ঢুকল। দুপুরে তুলির সাথে সে এই বাড়িতে এসেছিল বলে বাড়িটা তার চেনা। বকুল রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়েছিল। প্রণয়কে দেখতে পেয়েই সে হাসল। সালাম দিল,” আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।”

প্রণয় ভেতরের ঘরে উঁকি দিয়ে বলল,” তুলি এসেছে নাকি?”

” এসেছিল। মাত্রই চলে গেল।”

” কোথায় গেছে?”

” তা বলতে পারবো না। কিন্তু কাঁদতে কাঁদতে গেছে।”

” কাঁদছিল কেন?” প্রণয় উদ্বিগ্ন, ব্যাকুল। বকুল ছোট্ট করে বলল,” জানি না।”

একটু পর আবার বলল,” ওর সাথে নাকি সবাই প্রতারণা করেছে। আমি নুডলস রেঁধেছিলাম। খেল না। কয়েকবার সাঁধলাম। সে শুধু কেঁদেই যাচ্ছিল। আপনাদের মধ্যে কি কিছু হয়েছে? প্রতারণার ব্যাপারটা কি বলে গেল বুঝলাম না..”

প্রণয় দ্রুত পায়ে বের হয়ে যেতে নিল। দরজার সামনে দাঁড়ানো সামির এবং হেলাল সাহেব। সামির প্রশ্ন করল,” তুলি নেই?”

প্রণয় মাথা নাড়ল কেবল। মুখ দিয়ে কিছুই বলল না। তার এলোমেলো লাগছে সব। তুলি নিশ্চিত তাদের কথা শুনেছে। নাহলে প্রতারণার কথা বলবে কেন?

দিঘীর সামনে একটি সিমেন্টের আসনে বসে কাঁদছে তুলি। তার চোখে টর্চের আলো পড়ল। কেউ দূর থেকে টর্চ মারছে। দুইহাতে চোখ ঢেকে আবার তাকাল সে। এখন আর টর্চের আলো আসছে না। হুট করে কিছু একটা ছুটে গেল। কি হচ্ছে এখানে? তুলি দেখার জন্য পা বাড়াতে নিলেই পেছন থেকে ডাকল প্রণয়। তুলি ত্বরিতে পেছনে চাইল। প্রণয়কে ছুটে আসতে দেখেই সবেগে জমিন থেকে পাথর কুঁড়িয়ে নিল সে। প্রণয় আরও কাছে আসতেই ছুঁড়তে লাগল একের পর এক পাথর। প্রণয় নিজেকে বাঁচাতে সরে সরে যাচ্ছিল। এক ফাঁকে বলল,” প্লিজ তুলি থামো। আমাকে এক্সপ্লেইন করার সুযোগ দাও প্লিজ?”

তুলি চিৎকার করল ক্রোধসিক্ত কণ্ঠে,” আপনার থেকে কোনো এক্সপ্লেনেশন শুনতে চাই না আমি। এখান থেকে চলে যান। আজকে আজমীর ভাইয়ের কথা বিশ্বাস না করে আমি সত্যিই ভুল করেছি। আপনাকে এতো বিশ্বাস করলাম আর আপনি এই প্রতিদান দিলেন?”

প্রণয় অসহায়ভাবে তাকিয়ে করুণ কণ্ঠে বোঝানোর চেষ্টা করল,” বিশ্বাস করো আমি শুধু তোমাকে খুশি দেখতে চেয়েছিলাম। আমার এই চাওয়াটা কি অন্যায়? তুমি একটু বোঝো আমাকে। কোনো খারাপ ইনটেনশন ছিল না আমার।”

তুলি বজ্রকণ্ঠ ধমকালো,” এখনও কাছে আসছেন আপনি? খবরদার, চলে যান বলছি। আমি আপনাকে দেখতেও চাই না আর আপনার কোনো কথা শুনতেও চাই না।”

” তোমাকে অবশ্যই আমার কথা শুনতে হবে তুলি। আর শুনতে না চাইলেও আমি বলবো।”

তুলি দুই হাতে কান চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলল। এখন আর প্রণয়কে দেখতেও হবে না আর তার কথাও শুনতে হবে না। সে প্রণয়ের উপস্থিতিটুকুও সহ্য করতে পারছে না এই মুহূর্তে। কিন্তু প্রণয় হলো নাছোড়বান্দা। সে ঠিকই তুলির কাছে এলো। তুলি তাকে অগ্রাহ্য করতে চোখ বন্ধরত অবস্থাতেই আরও পিছিয়ে গেল। তখনি পা হলকে ফট করে উল্টে পড়ল দিঘীর জলে। প্রণয় চিৎকার করে ডাকল,” তুলি!”

তুলি চিৎকার করল আরও জোরে,” সাপ, সাপ! এখানে সাপ আছে, আমাকে বাঁচান প্লিজ।”

” আমার হাত ধরে উঠে এসো।”

প্রণয় বাড়িয়ে দিল তার হাতটা। তুলি ধরতে নিয়েও থেমে গেল। প্রণয় সহাস্যে বলল,” এখন অন্তত সব ভুলে যাও। পাঁচ সেকেন্ডের জন্য!”

তুলি আড়ষ্টভাবে হাত বাড়ালো। প্রণয় তাকে ইচ্ছে করেই হেঁচকা টান দিল। তুলি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আছড়ে পড়ল প্রণয়ের গায়ে। প্রণয় তাকে শক্ত করে ধরতেই সে রেগেমেগে প্রায় লাফিয়ে উঠল। ধাক্কা মেরে প্রণয়কে সরিয়ে দূরত্বে গিয়ে দাঁড়ালো। প্রণয়ের টি-শার্ট ভিজে গেছে তুলির চুলের পানিতে।সে টি-শার্ট ঝাড়তে ঝাড়তে আঁড়চোখে তুলির দিকে চাইল। তুলির মুখ থমথমে। কিন্তু ভেজা চুল আর ভেজা গায়ে তাকে অসম্ভব আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে। প্রণয় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তুলির কাছে গেল। তার মুখটা নিজের আঁজলায় নিয়ে কোমনীয় কণ্ঠে বলল,” প্লিজ তুলি, এইরকম কোরো না। আমি যদি বুঝতাম তাহলে এটা করতাম না। ভুল হয়েছে আমার। অনেক বড় ভুল। স্যরি।”

তুলি চোখ মেলে তাকিয়ে ক্লান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করল,” কিভাবে এতো সহজে ক্ষমা করে দেই আপনাকে? আপনি হলে পারতেন?”

প্রণয় থমকে গেল। তৎক্ষণাৎ দেওয়ার মতো কোনো উত্তর খুঁজে পেল না বলে জীভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো। তুলি অবজ্ঞাসূচক হাসি দিয়ে আবার একই প্রশ্ন করল,” আমার জায়গায় আপনি হলে কি করতেন? বলুন এখন!”

প্রণয় দুই পাশে মাথা নেড়ে বলল,” জানি না আমি। কিন্তু তোমাকে আমি প্রচন্ড ভালোবাসি, বিশ্বাস করো।”

তুলি নির্মম কণ্ঠে বলল, ” আমার চোখের দিকে চেয়ে বার-বার মিথ্যা বলেছেন আপনি। আর এখন ভালোবাসার দোহাই দিচ্ছেন? ভাবছেন আপনাকে আমি ক্ষমা করে দিবো? স্যরি, এতো মহান আমি না। আমি পারবো না আপনাকে এতো সহজে ক্ষমা করতে। আমার চোখের সামনে থেকে আপনি চলে যান। প্লিজ চলে যান!”

” আচ্ছা, যাবো। তার আগে তুমি ঘরে চলো। ভেজা শরীরে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। আমাকে তোমার দেখতে ইচ্ছে না হলে আমি ঘরে ঢুকবো না।”

” আমার ঘরেও যেতে ইচ্ছে করছে না। রাইফার চেহারাও আমি দেখতে চাই না। সে একটা বিভীষণ! ও যেন কখনও আমার সামনে না আসে।”

” আচ্ছা আসবে না। তুমি ঘরে চলো।”

প্রণয় হাত ধরতে নিলেই তুলি চোখ রাঙিয়ে বলল,” যান এখান থেকে। গেট লস্ট!”

প্রণয় হার মেনে চলে যেতে লাগল। তুলি কিছুটা স্বস্তি নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়তেই না ছাড়তেই আবার ফিরে এলো প্রণয়। এবার তুলি কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে কোলে উঠিয়ে নিল তুলিকে। ডাঙায় তোলা মাছের মতো অবিরাম চার হাত-পা ঝাপটাতে লাগল তুলি। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,” এসব কি করছেন আপনি?”

প্রণয় নির্বিকার কণ্ঠে বলল,” কথা না শুনলে তো এসবই করতে হবে।”

” পাগল আপনি। এখনি ছাড়ুন আমাকে।”

” ঠিক বলেছো। আমি পাগল। এজন্যই ছাড়বো না।”

” মামা-মামী দেখলে কি ভাববে? আচ্ছা, ঘরে যাচ্ছি আমি। দয়া করে আমাকে নিচে নামান।”

প্রণয় এই কথা শুনে তাকে ছাড়ল। কোল থেকে নামিয়ে বলল,” গুড গার্ল।”

তুলি গটগট করে হেঁটে যেতে লাগল। এমনভাবে জমিনে পা ফেলছে যেন মাটি ফেঁটেই যাবে। প্রণয় হাসিমুখে মাথা নিচু করে তার পিছু হাঁটছে। দরজার কাছে আসতেই আশা জিজ্ঞেস করল,” হনহন করে কই গেছিলি?”

তুলি খিটমিট করে বলল,” জাহান্নামে।”

” ওমা, ভিজলি কিভাবে?”

তুলি মামীর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে রাগী দৃষ্টিতে প্রণয়ের দিকে চাইল। প্রণয় হাসি চাপিয়ে বলল,” দিঘীতে ঝাঁপ দিয়েছিল আন্টি।”

” হঠাৎ ঝাঁপ দিতে গেল কেন?”

” রাগ একটু বেশি তো, তাই!”

” কার উপর এতো রাগল?”

প্রণয় অভাগার মতো বলল,” আমার উপর।”

” তুমি আবার কি করলে?”

” সেটা তো ও জানে!”

আশা এবার উত্তরের আশায় তাকাল তুলির দিকে। তুলি গজগজ করে বলে উঠল,” গরম পানি দাও। গোসল করবো। উনার ফালতু কথা শোনার দরকার নাই।”

এই শীতল সন্ধ্যায় গোসল করতেই হলো তুলিকে। সে গোসল শেষ করে দরজা আটকে ঘরে ঢুকে পড়ল। রাতে খাওয়ার জন্যে তাকে যখন ডাকা হলো, সে জবাব দিল না। রাইফা ভয়ে ভয়ে গেল। দরজার কাছে এসে ঠকঠক করে বলল,” তুলি, দরজা খোল প্লিজ।”

তুলি নীরবতা ভেঙে খেঁকিয়ে উঠল,” তুই এখান থেকে যা হারামি। তোর এই বিশ্বাসঘাতকতা আমি সারাজীবন মনে রাখবো।”

” প্লিজ অন্তত আমার সাথে এমন করিস না। আমি জাস্ট তোকে হ্যাপি দেখতে চেয়েছিলাম।”

” কেন চাইবি তুই? প্রণয়ও একই এক্সকিউজ দিল।পৃথিবীর সব মানুষ খালি আমাকে হ্যাপি দেখতে চায়। বাহ, ওয়ান্ডারফুল! হ্যাপি করার জন্য আমাকে তোরা ধোঁকা পর্যন্ত দিয়ে ফেললি। কেন আমাকে হ্যাপি দেখার এতো শখ তোদের? আমি কি আনহ্যাপি ছিলাম?”

” তুলি তুই দরজাটা খোল! আমাকে একবার কথা বলার সুযোগ দে!”

” এই দরজা আমি সকালের আগে খুলবো না। তুই বেশি বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু আমি উনিশ-বিশ কিছু একটা করে ফেলবো। তখন বুঝবি। যা এখান থেকে।”

রাইফার ফোন বেজে উঠল। নাম্বারটা দেখেই সে উত্তেজিত হয়ে পড়ল। তার ফোনে রিসবের অনেকগুলো নাম্বার সেইভ করা। সে দরজা থেকে সরে ফোনটা রিসিভ করল আগে। তবে এই মুহূর্তে তার মনটা একদম ভালো ন্য। তাই বিরস গলায় শুধু বলল,” হ্যালো।”

ওই পাশ থেকে ভেসে এলো রিসবের উদ্বিগ্ন কণ্ঠ,” তুমি কোথায় রাইফা? দেখা করতে পারবে?”

আচমকা এমন প্রশ্নে চমকালো রাইফা।

” দেখা করবো মানে? কোথায়?”

” আমি ফরাজগঞ্জ এসেছি। তোমাদের জায়গার নাম কি? বলো?”

রাইফা হত বিস্ময়ের সুরে বলল,” এই রাতে আপনি ফরাজগঞ্জ চলে এসেছেন? আনবিলিভেবল! কোথায় আছেন আপনি?”

” এইতো, এটা একটা ঘাঁট। যেখানে লঞ্চ থামে। ঘাঁটের নামটা ঠিক মনে করতে পারছি না। কি যেন! ”

” বুঝেছি, বুঝেছি। আপনি ওখানেই থাকুন আমি দ্রুত আসছি।”

রাইফা ফোন রেখেই কয়েকবার অযথা লাফ দিল। তারপর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল সে। এতো খুশিতে গদগদ হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। রিসব কফিশপে তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিল৷ সে কি ওই কথা এতো সহজে ভুলে যাবে? কিন্তু রাইফা নিজের আবেগকে দমাতে পারছে না। তার এতো ভালো লাগছে কেন? তুলির দরজায় আবার করাঘাত করল সে।

” তুলি, দরজাটা খোল প্লিজ। জানিস কি হয়েছে?”

ওই পাশ থেকে কোনো জবাব এলো না। রাইফা কিছুক্ষণ একাই বকবক করে থেমে গেল৷ তন্বিকে ব্যালকনিতে যেতে দেখে সে ডাকল,” এই তন্বি দাঁড়া। আমার সঙ্গে একটা জায়গায় যাবি?”

” এইরাতে? কোথায় যাবি?”

রাইফা লাজুক কণ্ঠে বলল,” রিসব এসেছে।”

অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরেও কেউ আর ডাকতে আসছে না। দরজাতেও চপোটাঘাত পাওয়া যাচ্ছে না। তুলি ঘড়ির দিকে চাইল। রাত এগারোটা বাজে। সবাই কি ঘুমিয়ে পড়েছে? তুলি ধীরে ধীরে দরজা খুলে বাইরে তাকাল। আশেপাশে কেউ নেই। বাড়ি পিনপতন নীরবতায় খাঁ খাঁ করছে। তুলি নিশ্চিত হলো যে সবাই শুয়ে পড়েছে। তার বাথরুমে যাওয়া প্রয়োজন। তাই সে বাথরুমে চলে গেল। দশমিনিট পর ফিরে আসতেই দেখল প্রণয় শুয়ে আছে তার বিছানায়। তাকে দেখেই আৎকে উঠল তুলি। ইচ্ছে করল জোরে চেঁচাতে। কিন্তু মামা-মামী দেখলে কি ভাববে? এই কথা চিন্তা করে আর চেঁচালো না। বিছানার কাছে গিয়ে কটমটে দৃষ্টিতে ফিসফিস করল,” এখানে কি করছেন আপনি?”

প্রণয় চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর ভং ধরে আছে। তুলি তাকে ধাক্কা দিল। প্রণয় কোনো সাড়া প্রদান করছে না৷ তুলি রেগে এবার ঘুষি মারল তার বুকে। প্রণয়ের হাসি চলে এলো। চোখ খুলেই তুলির হাত দু’টো চেপে ধরে বলল,” আই এম স্যরি।”

তুলি ইস্পাতের মতো কঠিন মুখভঙ্গি নিয়ে বলল,” বের হয়ে যান।”

” না গেলে কি করবে?”

তুলি চোখ বড় করে চাইল। ডানপাশে তাকিয়ে মশা মারার ব্যাটটা দেখিয়ে বলল,” ওটা দিয়ে মাথা ফাঁটিয়ে দিবো আপনার।”

প্রণয় হেসে উঠল। তুলি গম্ভীর গলায় নিষেধ করল,” হাসবেন না।”

হাসি থামিয়ে প্রণয় সিরিয়াস গলায় বলল,” আচ্ছা, মানলাম আমি একটা ভুল করেছি। তাই বলে তুমি এমন করবে? আমরা দু’জন চুপচাপ বসে আলোচনা করলেই কিন্তু ঝামেলাটা ফিক্স করে নিতে পারি। ”

” আপনার সাথে বসার কোনো ইচ্ছা নেই আমার।”

” তাহলে কি শুয়ে পড়বে?”

তুলি গরম চোখে তাকাল। প্রণয় হাসি মুখে বলল,” বিছানাটা খুব আরামদায়ক। উই শ্যুড ট্রাই।”

তুলি এবার মশার ব্যাটটা উঠিয়ে প্রণয়ের পিঠে আঘাত করতে লাগল। প্রণয় ব্যথা সূচক শব্দ উচ্চারণ করেই উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ” স্যরি, স্যরি, আচ্ছা দাঁড়িয়ে কথা বলবো। শোয়া ক্যান্সেল।”

তুলি প্রণয়ের হাত ধরে দরজা পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল,” আমি আপনার সাথে কোনো কথা বলবো না। আপনি এখনি এই ঘর থেকে বের হবেন। নাহলে আমি এমন চিৎকার করবো যে গ্রামবাসী এসে আপনাকে পেটাবে।”

প্রণয় বেশ অবাক হয়ে বলল,” তাই নাকি?”

” আপনি যাবেন না?”

আচমকা হেলাল সাহেবের কাশির শব্দ ভেসে এলো। সাথে দরজা খোলার খটমট। নিশ্চয়ই হেলাল সাহেব ঘর থেকে বের হচ্ছেন। তুলি দ্রুত প্রণয়কে টেনে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা আটকে দিল। তারপর ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখল মামা সত্যিই বের হচ্ছে কি-না। প্রণয় খুশি খুশি কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,” তোমার মামা দেখলে কি হতো? আমাকে বাঁচালে কেন?”

” আমি আপনার কথা ভাবিনি। নিজের কথা ভেবে আপনাকে বাঁচিয়েছি৷ মামা এইসময় আপনাকে আমার রুমে দেখলে আমাকেই জেরা করবে। আপনাকে কিছু বলবে না।”

হেলাল সাহেব জড়ানো কণ্ঠে ডাকলেন,” তুলি, তন্বি, তুলিরে…”

তুলি ঘরের ভেতর থেকে জবাব দিল না। আশা বের হয়ে বলল,” কাদের খুঁজছো? ওরা তো ঘুমিয়ে পড়েছে। ”

হেলাল সাহেব বিচলিত কণ্ঠে আওড়ালেন,” তন্বি আর সামির তো ঘরে নেই। এইতো ঘরের দরজা খোলা। ওরা কি তুলির ঘরে শুয়েছে?”

আশা বলল,” মনে হয়।”

” তুলির ঘরের দরজা তো আটকানো। ওরা তুলির ঘরে শুয়ে থাকলে তুলি কই গেল?”

” আমি তো জানি না। আচ্ছা, তুমি ঘরে চলো। আমি দেখছি।

” আরে থামো, আমি ঘরে যাবো কেন? মেয়েগুলো কই গেল দেখতে হবে না? রাইফাকেও তো পাওয়া যাচ্ছে না। প্রণয়ই বা কোথায়?”

প্রণয় তুলির হাত ধরে বলল,” তুলি চলো আমরা বরং কাঁথার নিচে ঢুকে ঝামেলাটা ফিক্স করি।”

তুলি ঝারি মেরে হাত ছাড়িয়ে বজ্রকণ্ঠে বলল,” খবরদার আমাকে আরেকবার শোয়ার কথা বললে আপনাকে মার্ডার করে দিবো।”

হেলাল সাহেব তখনি দরজা ধাক্কাতে লাগলেন। এতো জোরে দরজা ধাক্কাচ্ছেন যে না খুলেও উপায় নেই। তুলি তার মামাকে চেনে। সে ঘুমের ভাণ ধরে পড়ে থাকলে মামা দরজাই ভেঙে ফেলবেন। আর প্রণয়কেও লুকানোর জায়গা নেই এই ঘরে। ঘরটা খুব ছোট। খাট আর ড্রেসিংটেবিল ছাড়া কিছু নেই। এগুলোর মাঝে প্রণয়কে লুকানো সম্ভব না। তুলি ভাবছিল কি করবে কিন্তু এর আগেই দেখা গেল প্রণয় নিজেই বিছানায় শুয়ে পুরো শরীর কাঁথা দিয়ে ঢেকে ফেলছে। তুলির দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে সে একবার বলল,” এজন্যই শোয়ার কথা বলেছিলাম। দেখলে তো, এখন শুতেই হচ্ছে!”

তুলি বিরবির করে বলল,” আপনি এই ঝামেলা ফিক্স করার কথা বলেছেন?”

” তুমি কি ভেবেছো?”

তুলি মনে মনে সূরা ইখলাস পড়ে দরজা খুলে দিল। হেলাল সাহেব হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে বললেন,” তোরা কি মরার ঘুম দিয়েছিস?”

তুলি ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল,” কি হয়েছে হঠাৎ? ”

আশা মলিন মুখে বলল,” তন্বি, সামির, প্রণয়, এদের কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”

হেলাল সাহেব জহুরী চোখে বিছানার দিকে চেয়ে বললেন,” এটা কে?”

তুলি জবাব দিতে গিয়ে হিঁচকি তুলে ফেলল,” রাইফা।”

হেলাল সাহেব ভ্রু কুঁচকে স্বগতোক্তি করলেন,” এতো লম্বা লাগছে কেন রাইফাকে?”

তুলি প্রশ্ন করল,” কোথায় লম্বা? ঠিকই তো আছে। ও আবার সাথে কোলবালিশও নিয়েছে।”

” নাক-মুখ ঢেকে ঘুমাচ্ছে কেন? ওকে বল মুখ থেকে কাঁথা সরাতে।”

তুলির কলিজার পানি শুঁকিয়ে এলো।

” ও তো ঘুমাচ্ছে মামা! বললেও শুনবে না।”

হেলাল সাহেব স্ত্রীর দিকে চেয়ে বললেন,” আশা, কাঁথাটা সরাও তো দেখি।”

তুলি সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় শুয়ে পড়ল আর বলল,” আমরা ঘুমাচ্ছি। প্লিজ আমাদের বিরক্ত কোরো না। যাও তোমরা এখান থেকে। ধ্যাত!”

” তুই কার সাথে ঘুমাচ্ছিস? ওইটা তো রাইফা নাও হতে পারে।”

তুলি চোখ বড় বড় করে তাকাল। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বলল,” তোমাকে কে বলল যে এটা রাইফা না?”

আশা হেসে বলল,” ধূর, তোর মামার মাথার ঠিক নাই। এই চলো তো তুমি। তন্বিরা কই গেল দেখি। ওরা ঘুমাক।”

হেলাল সাহেব বের হতে নিলেই প্রণয় হাঁচি দিল। তুলির আত্মা ছলাৎ করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে হেলাল সাহেব তাকালেন।

” রাইফা জেগে আছে নাকি? এই রাইফা তুমি কথা বলছো না কেন?”

তুলি তড়িঘড়ি করে বলল,” ওর ঠান্ডা লেগেছে মামা। ঘুমের মধ্যেই কাশছে।”

” আরে আগে বলবি না? কাশির ঔষধ ছিল তো।”

” ঔষধ লাগবে না।”

” কেন লাগবে না? সর্দি আছে নাকি? একটা ড্রপ দিয়ে দে। আশা, আমার ঘরে যে নাকের ড্রপটা আছে ওইটা এনে দাও। কাশির ঔষধও এনো।”

” এখনি আনছি।”

তুলি মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যে বলল,” তন্বিরা কোথায় মামা? ওদের খুঁজতে যাচ্ছো না কেন?”

তখনি দেখা গেল তন্বি আর সামির হাসিমুখে গল্প করতে করতে ঢুকছে। হেলাল সাহেব তুলির ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকেই তাদের প্রশ্ন করলেন,” এই, তোমরা এই রাতে কই গিয়েছিলে?”

সামির জবাব দিল,” তন্বির একটু হাঁটতে ইচ্ছে করছিল। তাই ওকে নিয়ে হেঁটে এলাম।”

” বাইরে অনেক ঠান্ডা। এতো হাঁটাহাঁটির দরকার নেই। একজন তো জ্বর বাঁধিয়ে বসে আছে।”

তন্বি জিজ্ঞেস করল,” কে জ্বর বাঁধিয়েছে? তুলি?”

” না। রাইফা।”

তন্বি প্রস্তুরীভূত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। সে তো রাইফাকে রিসবের সাথে বাইরে রেখে এসেছে। সে তো সুস্থই আছে! তন্বি তুলির ঘরে ঢুকেই হতভম্ব হয়ে গেল। সত্যিই তুলির পাশে কাঁথা গায়ে কে যেন শুয়ে আছে! এটা রাইফা হতে পারে না। তাহলে কে? তুলি করুণ দৃষ্টিতে তন্বির দিকে তাকাল। আশা ঔষধ আর কুসুম গরম পানি নিয়ে ঘরে ঢুকল। শান্ত গলায় বলল,” রাইফাকে ডাক, ঔষধটা খেয়ে নিক।”

তুলি অনুরোধের স্বরে বলল,” আমি পরে খাইয়ে দিবো। রেখে যাও।”

হেলাল সাহেব সরু দৃষ্টিতে বললেন,” এখনি খাওয়াও। ওকে ডাকতে সমস্যা কি? আর এই মেয়ে বয়রা নাকি? এতো চিৎকার-চেঁচামেচি হচ্ছে তাও ঘুম ভাঙে না!”

তুলি সামান্য রেগে বলল,” উফ, তোমরা এমন করছো কেন? সামান্য একটা হাঁচিই তো দিয়েছে ও৷ এজন্য একদম ঘুম থেকে তুলে ঔষধ খাওয়াতে হবে? আদিখ্যেতারও শেষ নেই একদম। যাও আমার ঘর থেকে প্লিজ। আমি ওকে পরে ঔষধ খাওয়াবো।”

তুলি সবাইকে ঠেলে-ঠুলে বের করে দিতে লাগল। তন্বি এতোক্ষণে সব বুঝে গেছে। হেলাল সাহেব আশ্চর্য গলায় বললেন,” তুই এতো ক্ষ্যাপছিস কেন?”

” আমার ভালো লাগছে না তাই। সরো তোমরা।”

তুলি সবাইকে বের করে দরজা আটকে দিতেই শেষ অঘটনটা ঘটল। রাইফা সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল। সবাইকে বসার ঘরে দাঁড়ানো দেখে সে চিন্তিত মুখে বলল,” কি হয়েছে?”

রাইফার উপস্থিতি সবাইকে বিমূঢ় বানিয়ে দিল। হেলাল সাহেব বড় বড় চোখে রাইফার দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ গর্জন করলেন,” তুমি এখানে মানে? তাহলে তুলির ঘরে কে? এই তুলি, দরজা খোল!”

গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে দরজা ধাক্কাতে লাগলেন হেলাল সাহেব। তুলির প্রাণ তখন ঠোঁটের আগায়। প্রণয় উঠে বসেছে। চোখে হাত রেখে হাসছে। তুলি বিরবির করে বলল,” সব দোষ আপনার। তবুও কিভাবে হাসছেন? লজ্জা করে না?”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here