বেদনার_রঙ_নীল ছেচল্লিশ পর্ব

0
327

#বেদনার_রঙ_নীল
ছেচল্লিশ পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz

” আচ্ছা, দরজা তো ভেতর থেকে লক ছিল। তাহলে আপনি ঢুকলেন কিভাবে?”

তুলি এই প্রশ্নটি করা মাত্রই শানের মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। সে কৌতুহলী হয়ে বলল,” হ্যাঁ সেটাই তো। আঙ্কেল আপনি ঢুকলেন কিভাবে? পেছনের বাগানের দরজা দিয়ে ঢুকেছেন নাকি?”

ভ্রু কুচকে কথাটি জিজ্ঞেস করে পরমুহূর্তেই আবার পেশি শক্ত করে বলল,” এই আপনি কি চোর নাকি?”

তৈমুর তাড়াহুড়ো করে বলল,” মনে পড়েছে। ওয়াই-ফাইয়ের বিল নিতে এসেছিলাম।”

তুলি সন্দিহান কণ্ঠে বলল,” সত্যি?”

” হ্যাঁ। ”

শান মাথা চুলকালো। একটু চালাকি করে বলল,” কিন্তু আমাদের ওয়াই-ফাইয়ের বিল তো অনলাইনে পেমেন্ট করি।”

তৈমুর রীতিমতো থতমত খেয়ে তাকিয়ে আছে। গলা শুকিয়ে আসছে। বলল,” আরও এক গ্লাস পানি খাবো আমি।”

তুলির মোবাইল বাজছে। রাইফা ফোন করেছে। সে ফোন রিসিভ করার আগে শানকে টেনে দরজার কাছে এনে ফিসফিস করে বলল,” লোকটাকে সুবিধার মনে হচ্ছে না সাইক্লোন। নিশ্চিত কোনো কু-মতলব আছে৷ তুমি উনার উপর নজর রাখো। আমি ফোনে কথা বলে আসছি।”

শান বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলল,” ওকে, ডান।”

তুলি চলে যাওয়ার পরেই তৈমুর রুমের ভেতর থেকে বলল,” বাবু, একটু শুনে যাও।”

‘ বাবু’ বলে ডাকায় শানের মেজাজ গরম হলো। তাকে দেখতে কি বাবুর মতো লাগে? তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,” কি হয়েছে?”

তৈমুর উঠে দাঁড়ালো। আলতো পায়ে শানের কাছে এসে তার কাঁধে হাত রাখল। দূর্বলচিত্তে বলল,” শোনো।”

” দূর থেকে কথা বলুন।”

তৈমুর সরে যাওয়ার ভঙ্গি করে আচমকা শানের মুখ চেপে ধরল। শান ছটফট করার সুযোগটুকুও পেল না।

তুলি ঘরে এসে মোবাইল রিসিভ করল,” হ্যালো রাইফা।”

রাইফা উত্তেজিত গলায় বলল,” সারপ্রাইজ পছন্দ হয়েছে?”

” সারপ্রাইজ মানে? কোন সারপ্রাইজ আবার?”

রাইফা একটু রাগী গলায় বলল,” আরে, তুই এখনও দেখিসনি? শপিং ব্যাগগুলো খুলেছিস? নাকি এখনও খুলিসনি?”

তুলি মোবাইল কানে রেখেই শপিং ব্যাগ খুলতে লাগল। বড় প্যাকেটটি থেকে বের হলো শাড়ি। তুলি চমকে উঠল।

” রাইফা, তুই এই শাড়িটা সত্যি সত্যি কিনে ফেলেছিস?”

” অবশ্যই। যদি আমি এটা না কিনতাম তাহলে অন্যকেউ কিনে ফেলতো। কিন্তু এই শাড়িতে তোকে এতো ভালো মানাবে যে অন্যকেউ এটা পরলে আমি হিংসায় মরে যাবো৷ তাই কিনেই ফেলেছি। প্লিজ তুলি, এটা তুই পর। তোকে দারুণ লাগবে।”

তুলি নিপাট বিরক্তি নিয়ে বলল,” পাগল নাকি তুই? আমি ট্রান্সপারেন্ট শাড়ি পরবো? তুই জীবনে দেখেছিস আমাকে? ফালতু একটা কাজ করলি।”

” আচ্ছা এই শাড়ি পরে কি তোকে আমি ট্যুরে যেতে বলেছি? তুই বাসায় পরবি। শাড়িটা পরে প্রণয়ের সামনে ঘুরঘুর করলে সে একদম ফিট হয়ে যাবে। গ্যারান্টি দিচ্ছি।”

তুলির চেহারা লাল হয়ে গেল। প্রতিবাদ করতে নিয়েও করল না। শাড়িটার দিকে তাকাতেই এখন লজ্জা লাগছে৷ রাইফা যে কি করে! ফোনের ওই পাশ থেকে খিলখিল করে হেসেই চলেছে। তুলি কোনো কথা বলতে পারল না। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ এসে তার মুখে রুমাল চেপে ধরল। গুঙিয়ে উঠল তুলি। হঠাৎ খুব ধস্তাধস্তির আওয়াজ শুনে রাইফা ভয় পেয়ে গেল। জোরালো শব্দে ‘হ্যালো, হ্যালো’ করতে লাগল। কিন্তু ওই পাশ থেকে কোনো সাড়া নেই। হঠাৎ ভীষণ জোরে কিছু একটা ভেঙে পড়ার শব্দ হলো। তুলি তৈমুরকে ধাক্কা মারায় সে চেয়ারসহ উল্টে পড়ে গেছে। তুলি দৌড়ে পালাতে নিলেই একহাতে তার পা টেনে ধরে ফেলল তৈমুর। তুলি চিৎকার করতে লাগল। সেই চিৎকার শুনে রাইফা অস্থির হয়ে উঠল। তুলির পায়ে সজোরে টান মেরে তাকে চিৎপটাং করে মেঝেতে শুইয়ে দিল তৈমুর। তুলি মাথায় আঘাত পেয়েই কেঁদে ফেলল। চিৎকার করে ডাকতে লাগল শানকে।

এদিকে শানের হাত-পা বাঁধা। তাকে চেয়ারের সাথে বেঁধে রেখে বাইরে থেকে দরজা আটকে দিয়েছে তৈমুর। তুলির চিৎকার কানে আসতেই শান মরিয়া হয়ে উঠল। হাতের বাঁধন খোলার চেষ্টা করতে লাগল প্রাণপণে। কিছুক্ষণের মধ্যে খুলেও ফেলল। এগুলো তার জন্য খুব কঠিন ব্যাপার না। আগে অনেক বেশি দুষ্টমি করলে প্রণয় এভাবেই চেয়ারের সাথে তার হাত-পা বেঁধে রাখতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তারপর শান বুদ্ধি করে তার চেয়ারের নিচে একটা কাটার সেট করেছিল। যতবার প্রণয় তাকে বেঁধে চলে যেতো, ততবার কাটারের সাহায্যে সে হাত-পায়ের বাঁধন খুলে নিতে পারতো। আজকে যে এই পদ্ধতিটা এইভাবে কাজে লাগবে সে ভাবেনি। দরজার ছিটকিনি খুলতেও শানের বেশি অসুবিধা হলো না। সে লক হয়ে যাওয়া দরজাও এক চুটকিতে খুলে ফেলতে পারে। নিজেকে মুক্ত করে রুম থেকে বের হওয়ার আগে ক্রিকেট ব্যাটটা হাতে নিল শান।

লোকটি তুলির হাত-পা বাঁধার চেষ্টা করছে। শান কোনোকিছু না ভেবেই চোখ বন্ধ করে পেছন থেকে ব্যাট দিয়ে আঘাত করল তৈমুরের মাথায়। ব্যথার জায়গায় আবার ব্যথা পেয়ে তৈমুর গগনবিদারী একটা চিৎকার দিয়েই মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। তৈমুরের হাত থেকে ছাড়া পেতেই তুলি দৌড়ে এসে শানকে জড়িয়ে ধরল। শান অনেকটাই ঘেমে গেছে। বুক ধুকপুক করছে তার। কিন্তু ভালো লাগছে এই ভেবে যে, শেষ মুহূর্তে চূড়ান্ত সাহসটা সে দেখাতে পেরেছে। তুলির হাত-পা কাঁপছে ভয়ে। শানের মুখে মালিশ করে সে বলল,” তুমি ঠিকাছো শান?”

শান মাথা নাড়ল। লোকটি যদি আবার উঠে যায়? এই ভেবে শান আরেকবার ব্যাট হাতে নিল আঘাত করার উদ্দেশ্যে। তুলি বাঁধা দিল তাকে। চেঁচিয়ে বলল,” আর না প্লিজ। পরে মরে গেলে কি হবে?”

সে শানকে টেনে বের করে রুমের বাইরে এনেই দরজা আটকে দিল। শান হাঁফ ছাড়া কণ্ঠে বলল,” মনে হয় ডাকাতি করতে এসেছিল লোকটা। আমাদের এখনি পুলিশকে ফোন করা উচিৎ। ”

তুলি মাথা নাড়ল। তারপর হঠাৎই খেয়াল করল তার মাথাটা চক্কর দিচ্ছে। শান সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতে নিলেই তুলি চাপা স্বরে ডাকল,” শান।”
শান কিছু বোঝার আগেই তুলি জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পড়ে গেল।
____________
তুলির যতক্ষণে জ্ঞান ফিরল ততক্ষণে মিষ্টি আর অজান্তা বাড়ি ফিরে এসেছে৷ তারা সুপারশপে গিয়েছিল মাত্র আধঘণ্টার জন্য৷ এতটুকু সময়েই যে এতোবড় কান্ড ঘটবে তাও দিনে- দুপুরে তা কে জানতো? রাইফাও এসেছে এক প্রকার ছুটতে ছুটতে৷ আসার আগে সে পুলিশ খবর দিয়েছিল। পুলিশ এলে তৈমুরকে ধরানোর ব্যবস্থা করা হয়। তৈমুর হাঁটু গেঁড়ে কাঁদতে কাঁদতে ক্ষমা চায়। কিন্তু তাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তুলি বুঝতে পারে তৈমুর তাকে ক্লোরোফরম শুঁকিয়েছিল বলেই সে জ্ঞান হারিয়েছিল। কিন্তু আজকে শান না থাকলে অনেক বড় সর্বনাশ হতো। রাইফা শানের পিঠ চাপড়ে বলল,” ছোটে রুস্তম, কেয়া বাত! তুমি তো সবাইকে চমকে দিলে। এতো সাহস কিভাবে হলো তোমার?”

শান কলার উঁচিয়ে বলল,” আমি তো আগে থেকেই সাহসী। তোমার মতো তেলাপোকা দেখে লাফ মেরে সোফায় উঠি না।”

রাইফা প্রথমে চোখ সরু করে তাকালো। তারপর হেসে ফেলল। অজান্তা একটুও নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। তিনি আসার পর থেকে শানকে জড়িয়ে ধরে বসে আছেন। যদি আজ কারো কিছু হয়ে যেতো! মিষ্টি সিদ্ধান্ত নিল জীবনে আর কখনও বাড়ি ফাঁকা রেখে কোথাও যাবে না। আর প্রণয় এলে তাকে বলে বাগানের পেছনের রাস্তাটা বন্ধ করার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে এরকম আর কোনো আগন্তুক ঢুকতে না পারে। কিন্তু আজকে এতো কান্ড ঘটে যাচ্ছে অথচ প্রণয়ের কোনো হদিশই নেই। কোথায় আছে সে? তুলি অনবরত প্রণয়কে ফোন করতে থাকে। কিন্তু তাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। নতুন করে আবারও দুশ্চিন্তা শুরু হয় মনে।

________
প্রিয়ন্তী কফি নিয়ে ঘরে আসতেই দেখল প্রণয় ঘুমিয়ে পড়েছে। কফিটা টেবিলের একপাশে রেখে প্রণয়ের কাছাকাছি বসল সে। ঘুমন্ত অবস্থাতেও প্রণয়ের মুখ বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। প্রিয়ন্তীর মায়া লাগল। প্রণয়কে দেখে মনে হচ্ছে, কতদিন ধরে যেন সে ঘুমায় না! একবার ভাবল প্রণয়ের চুলে হাত বুলিয়ে দিবে। তারপর নিজেকে সংযত করল। প্রণয় এখন বিবাহিত। সে অনেক দূরের মানুষ হয়ে গেছে। তাকে নিয়ে এতোটা বাড়াবাড়ি মানায় না। আজমীরের সাথে ঝগড়ার পর প্রণয় আহত হয়। প্রিয়ন্তী তাকে এক প্রকার জোর করেই নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছে। প্রণয়ের পকেটের মোবাইল ভাইব্রেট হচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে। প্রিয়ন্তী বিছানায় বসতেই টের পেল হঠাৎ। পাছে আবার প্রণয়ের ঘুমটা না ভেঙে যায়, তাই সে দ্রুত মোবাইলটি হাতে নিল সাইলেন্ট করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু দেখল এই পর্যন্ত অনেকগুলো মিসডকল এসেছে। আর সবকয়টি এসেছে তুলির নাম্বার থেকে। এতোবার ফোন দিতে দেখে প্রিয়ন্তী একটু চিন্তিত হলো। নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। নাহলে বার-বার ফোন কেন দিবে? এই ভেবে প্রিয়ন্তী ফোন রিসিভ করল,” হ্যালো।”

মেয়েলী কণ্ঠ শুনে প্রথমেই একটা ধাক্কা খেল তুলি। অবাক হয়ে বলল,” আপনি কে? প্রণয় কোথায়?”

প্রিয়ন্তী আন্তরিকতার সাথে বলল,” তুলি, আমি প্রিয়ন্তী বলছি। তুমি কেমন আছো? ”

” ও আচ্ছা। প্রিয়ন্তী আপু,আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”

” আলহামদুলিল্লাহ। ভালো আছি। প্রণয়কে কি তোমার খুব বেশি দরকার? সে তো এখন ঘুমাচ্ছে।”

তুলির কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ সৃষ্টি হলো। অন্তর বিষিয়ে উঠল। কি আশ্চর্য! প্রণয় ঘুমাচ্ছে আর তার ফোন ধরছে প্রিয়ন্তী। ব্যাপারটা কি একটুও স্বাভাবিক? তুলি শক্ত কণ্ঠে বলল,” প্রণয় ঘুমাচ্ছে মানে? কোথায় ঘুমাচ্ছে?”

” আমার বাড়িতে। আসলে ও একটু টায়ার্ড ছিল তো তাই রেস্ট করতে এসেছিল৷ বিছানায় শুতেই ঘুমিয়ে পড়ল। আর এমনভাবে ঘুমাচ্ছে যে আমারও ডাকতে ইচ্ছে হয়নি। তুমি চিন্তা কোরো না। ও উঠলে আমি তোমাকে ফোন করতে বলবো। ঠিকাছে?”

তুলি স্তব্ধ হলো। ক্ষুব্ধ গলায় বলল,” ঠিকাছে।”

তারপর নিজে থেকেই লাইন কেটে দিল। অভিমানে তার বাম চোখ থেকে টুপ করে গড়িয়ে পড়ল জল। প্রণয়ের রেস্ট নেওয়ার জন্য কি জায়গার অভাব? প্রিয়ন্তীর বাড়িতেই কেন যেতে হবে? সেখানেই কেন ঘুমাতে হবে? কি আজব! তুলি ব্যাপারটা মানতে পারল না কোনোভাবেই।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here