বেদনার_রঙ_নীল পঁয়ত্রিশতম পর্ব

0
308

#বেদনার_রঙ_নীল
পঁয়ত্রিশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz

সকালেই ব্যাগপ্যাক গুছিয়ে নিল রিসব। আজই চলে যাচ্ছে সে। শান তার সঙ্গে দেখা করবে না বলে ছাদে গিয়ে বসে আছে। তার খুব অভিমান হচ্ছে। ভাইয়া বলেছিল এবার নাকি একমাস থাকবে। কিন্তু এক সপ্তাহ না হতেই চলে যাচ্ছে। শানের কি মনখারাপ হওয়া সাজে না? রিসব নাস্তা করতে বসে মিষ্টির কাছে জানতে পারল শান ঘরে নেই। সে নাস্তা খেতেও আসবে না৷ রাগ করে বের হয়ে গেছে। মিষ্টি নিশ্চিত কণ্ঠে বলল,” ছাদেই গেছে।”

রিসব খাওয়া ছেড়ে বের হলো। শানকে মানাতে হবে। ছেলেটা ইদানিং বড্ড জ্বালাতন করে!দরজা থেকে বের হতেই গায়েবী শব্দ শুনে পা থেমে গেল রিসবের। কাঁদো কাঁদো স্বরে কেউ বলছে,” আমাকে একবার জড়িয়ে ধরবেন, প্লিজ?”

রিসব একটু ভড়কালো। হকচকিয়ে পেছনে চাইলো। কেউ তো নেই! কিন্তু কণ্ঠ অবিকল রাইফার মতো। আবারও আওয়াজ শোনা গেল,” আমার ভয় লাগছে। আপনাকে হারানোর ভয়।”

রিসব এবার নিজেই ভয় পেয়ে যায়। পাঁচ বছর ধরে নানান পর্বত শৃঙ্গ জয় করা যুদ্ধময় এই জীবনে এবার প্রথম সে ভয় পাচ্ছে। চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠল রাইফার মায়াবী সেই মুখ। কিন্নর কণ্ঠে বলা শব্দ,” আপনি খুব রুড।”

গতরাতে কফিশপে রাইফা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,” আপনি আমার ওরনা কেন নিয়েছেন?”

রিসব অবাক হয়ে বলল,” মানে? কোন ওরনা?”

” আমি আমার একটা রঙিন ওরনা তুলির কাছে পেয়েছি। তুলিকে ওরনাটা শান দিয়েছিল। সে নাকি পেয়েছে আপনার আলমারিতে।”

রিসব জবাব দিল না। নিশ্চুপ হয়ে গেল। রাইফা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল উত্তরের আশায়। রিসব অনেক ক্ষণ পরে বলল,” হয়তো মিষ্টি আপু ভুল করে রেখেছিল৷ আমি তো নিজের ঘরে থাকিই না। আমার ঘর-দোর মিষ্টি আপু গুছায়।”

রাইফা অভিমানী কণ্ঠে বলল,” আপনি মিথ্যা বলছেন। শান নাকি ওরনাটা আপনার হাতেও দেখেছে।”

রিসব সরাসরি প্রশ্ন করল,” তুমি কি বলতে চাও রাইফা?”

রাইফা চুপসে গিয়ে বলল,” আমি আবার কি বলতে চাইবো? কিছু না!”

” তুমি কিছু একটার ইঙ্গিত দিতে চাইছো।”

” হ্যাঁ। আমার জন্য কি আপনার কোনো ফিলিংস নেই? সত্যি কথা বলুন।”

রিসবের জানি কি হলো। সে খুব শক্তভাবে বলে দিল,” একদম নেই। এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।”

রাইফা আশ্চর্য হয়ে তাকাল। আহত হয়ে উঠল তার চেহারা। রক্তিম হলো মুখমণ্ডল। রিসব গম্ভীর হয়ে বলল,” আমাকে নিয়ে তুমি বেশি চিন্তা করো বলেই তোমার এইসব মনে হয়।”

রাইফা প্রায় স্তব্ধীভূত হয়ে যাওয়ার আগে জানতে চাইল,” আপনি বলতে চান, আমাকে আপনার কখনোই পছন্দ হয়নি?”

” তোমাকে পছন্দ হবে কেন? এইসব তোমার চিন্তাই করা উচিৎ না।”

রাইফা মাথা নিচু করে কয়েক মুহূর্ত বসে থেকে হঠাৎ উঠে চলে গেল। কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে বেরিয়ে গেল কফিশপ থেকে। এর কিছুক্ষণ পরেই প্রণয় এসে জিজ্ঞেস করল,” কি হয়েছে রিসব?”

রিসব তখনি তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিল, এখানে সে আর থাকবে না। রাইফার সামনেই আর থাকা যাবে না। তাই প্রণয়কে ট্রেনিং-এর মিথ্যা বাহানা দিয়ে চলে এসেছিল। কিন্তু বাড়ি ফেরার পর থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও সে স্বস্তি পাচ্ছে না। স্থির হয়ে কোথাও বসতে পারছে না। তার কেমন দমবন্ধ লাগছে।

শান ছাদে দাঁড়িয়ে তুলির নাম্বারে ফোন করল। এই নাম্বারটা সকালে মিষ্টির কাছে পেয়েছে সে। তুলি নাকি তাকে কিছুদিন পড়াতে আসবে না৷ সে গেছে গ্রামের বাড়ি। তাই শান ফোন করেছে খোঁজ নিতে। কিন্তু ফোনটা রিসিভ করল রাইফা,” হ্যালো, কে বলছেন?”

শান যান্ত্রিক স্বরে বলল,” মিস কিউটিপাই কোথায়?”

রাইফা নাম্বারটা একবার দেখে নিয়ে বলল,” কে তুমি? শান?”

” এটা তো মিস কিউটিপাইয়ের নাম্বার। কিন্তু তুমি ধরলে কেন? তার ফোনের কাছে তুমি কি করছো স্টুপিড?”

রাইফা হতভম্ব বনে গিয়ে বলল,” আমি স্টুপিড? আমি তোমার কয়বছরের বড় জানো? তুমি আমাকে স্টুপিড কিভাবে বললে?”

” আমি রাখছি। মিস কিউটিপাই এলে বলবে আমি ফোন করেছিলাম।”

” তোমার মিস কিউটিপাই এখানে নেই। সে রান্নাঘরে কাজ করছে। আর আমি মোটেও কিছু বলতে পারবো না।”

” প্রবলেম নেই। আমি আবার ফোন করবো।”

রাইফা মজা করে বলল,” মাত্র একদিন পড়াতে আসেনি। আর তাতেই এতো ফোন? মিস কিউটিপাইয়ের প্রেমে পড়েছো নাকি?”

শান মৃদু হেসে বলল,” তুমি সবসময় এমন স্টুপিড কথা-বার্তা বলো। আমি কেন তোমাকে স্টুপিড বলি.. এবার বুঝতে পেরেছো?”

অপমানে নাকের ডগা ফুলে লাল হয়ে গেল রাইফার। সে কটমট করে বলল,” তুমি আমার দেখা সবচেয়ে ফাজিল ছেলে!”

ফোনের ওই পাশ থেকে এবার শব্দ এলো,” শান, কি করছিস এখানে?”

কণ্ঠটা রিসবের৷ তা বুঝতে পেরেই রাইফার বুকের ভেতর খচ করে উঠল। শান ততক্ষণে ফোন কেটে দিয়েছে। রাইফার চোখ অশ্রুতে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। সে প্রণয়ের থেকে শুনেছিল রিসব নাকি ট্রেনিং-এ চলে গেছে। অথচ সে বাড়িতেই আছে! মিথ্যা বলেছিল তাহলে। রাইফাকে সহ্য করতে পারছিল না বলেই কি মিথ্যা বলে চলে গিয়েছিল?

প্রণয় দিঘীর সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। তুলির তো আসার কথা এখানে। এখনও সে কেন আসছে না? নিচে থেকে একটা পাথর তুলে পানিতে ছুঁড়ল প্রণয়। মাটি অনেক পিচ্ছিল। পাথর ছোঁড়ার সময় পা পিছলে গেল। আরেকটু হলেই পড়ে যাচ্ছিল প্রণয় তখনি কেউ হাত চেপে ধরল পেছন থেকে। প্রণয় কৃতজ্ঞ হেসে উচ্চারণ করল,” থ্যাংকস।”

তারপর মানুষটির মুখের দিকে চাইতেই সে বিস্মিত হলো। আজমীর!

আজমীর প্রণয়ের হাতটা ধরে থেকে বলল,” ছেড়ে দিলেই পড়ে যাবি। তুই তো সাঁতারও জানিস না। তোর বাঁচা-মরা এখন আমার হাতে।”

প্রণয়ের দৃষ্টি কঠিন হয়ে গেল। চোয়াল হলো শক্ত। আজমীর এখানে কি করছে? তার তো জেল থেকে বের হতে পারার কথা নয়। অবশ্য এটা বাংলাদেশ। ক্ষমতাশীল বাবা থাকলে কি-না সম্ভব! প্রণয় ধিক্কারের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,” তোর হাতে বাঁচার থেকে মরে যাওয়া আমার জন্য ভালো। ”

আজমীর বাঁকা হেসে বলল,” তাহলে মরে যা!”

প্রণয়ের হাত ছেড়ে দিল সে। তাল সামলাতে না পেরে প্রণয় উল্টে পড়ে গেল দিঘীর জলে। এতো অল্প পানিতে ডুবে যাওয়ার কারণ নেই। প্রণয় কয়েক ঢোক পানি খেয়ে ভেসে উঠল। একহাতে চুল আর মুখ মুছে গরম দৃষ্টিতে আজমীরের দিকে চাইল। আজমীর পকেটে দু’হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে শয়তানি হাসি। প্রণয় আস্তে-ধীরে পাড়ে উঠে এলো। ঠান্ডায় গা কাটা দিচ্ছে। সকাল সকাল ভিজতে হলো। রাগ উঠছে প্রচন্ড। তুলি তখনি এলো দিঘীর সামনে। তাদের দু’জনকে একসঙ্গে দেখে সে অবাক হয়ে বলল,” এখানে কি হয়েছে?”

আজমীর হাস্য মুখে তাকাল তুলির দিকে।

” কি অবস্থা? ভালো আছো?”

তুলি রাগী গলায় বলল,” আপনি প্রণয়কে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিয়েছেন তাই না?”

আজমীর এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে টুশকি মারতে বলল,” তোমার মুখ দেখার জন্য কত যুদ্ধ করে এখানে এসেছি জানো? এইভাবে কথা বলছো কেন আমার সাথে? প্লিজ, একটু সুন্দর করে কথা বলো!”

তুলির মেজাজ খারাপ হচ্ছে। দাঁত খিঁচে বলল,

” আপনি এখানে কিভাবে এলেন? আপনার তো জেলে থাকার কথা।”

” তোমার টানে চলে এসেছি ডার্লিং….”

কথা শেষ করার আগেই চোয়ালে ঘুঁষি খেয়ে আজমীর উল্টে পড়ল। তুলি আতঙ্কগ্রস্ত গলায় বলল,” প্রণয়, কি করলেন এটা?”

আজমীর উঠে প্রণয়ের দিকে তেড়ে আসতে নিচ্ছিল। তুলি সঙ্গে সঙ্গে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো। প্রণয়কে নিজের পেছনে আড়াল করে বলল,” খবরদার আসবেন না।”

প্রণয় সজোরে তুলিকে সরিয়ে বলল,” এখান থেকে যাও তুলি, প্লিজ।”

” আমি যাবো না। আজমীর ভাই আপনি চলে যান। খবরদার আর কখনও আমাদের বাড়ির আশেপাশে আসবেন না।”

আজমীর হিংস্র কণ্ঠে বলল,” তুমি ওকে বিশ্বাস করলে ভুল করবে তুলি। ওকে তুমি একটুও চেনো না। ও কত মেয়ের লাইফ নষ্ট করেছে, জানো? তোমার লাইফও হেল করবে। ও একটা ক্যারেক্টারলেস।”

এবার প্রণয় তেড়ে যেতে নিচ্ছিল। তুলি তাকে থামিয়ে আজমীরের দিকে চেয়ে বলল, ” একদম চুপ। আমি আপনার কাছে প্রণয়ের ক্যারেক্টর সার্টিফিকেট জানতে চাইনি। আপনি বরং নিজের চরকায় তেল দিন। প্রণয়কে আমি অবশ্যই আপনার চেয়ে অনেক বেশি বিশ্বাস করি। ”

প্রণয়ের ঠোঁট হেসে উঠল। হৃদয়ে যেন কেউ শীতলতা ঢেলে দিল। শান্তি! আজমীর ক্রোধসিক্ত কণ্ঠে আওড়ালো,” ভুল করছো তুলি, বিরাট বড় ভুল।”

” আপনি যান প্লিজ। আপনাকে সহ্য করতে পারছি না এই মুহূর্তে। ”

আজমীর কাছে এসে কিছু বলতে নিলেই তুলি নিচে থেকে পাথর কুঁড়িয়ে নিল। সতর্ক করে বলল,” সাবধান, কাছে এলেই মেরে দিবো কিন্তু।”

তুলির দেখাদেখি প্রণয়ও পাথর কুঁড়িয়ে নিল এবং সে কোনোরূপ সতর্ক বাণী না দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছুঁড়ে মারল। পাথর আজমীরের কপালে গিয়ে ঠেঁকলে সে চিৎকার করল, ” আহ!”

তুলি বলল,” যান এখান থেকে । নয়তো আমিও মারবো।”

আজমীর উপায়ন্তর না দেখে চলে গেল। কিন্তু দমে গেল না। সে এখানে এসেছেই একটি কু-মতলব নিয়ে। কয়েক দিন ধরেই পরিকল্পনা আঁটছিল। আজ সে তা বাস্তবায়ন করবে। তুলিকে অপহরণ করবে। কিন্তু প্রণয়ও এখানে আছে। তাই তার কাজ কিছুটা কঠিন হয়ে গেল।

আজমীর যেতেই তুলি প্রণয়ের দিকে চেয়ে সামান্য বিচলিত গলায় বলল,” দেখি ভেতরে চলুন। আপনার ঠান্ডা লেগে যাবে তো! মাথা মুছতে হবে।”

প্রণয় তৃপ্ত কণ্ঠে বলল,” সত্যি আমাকে এতো বিশ্বাস করো তুমি?”

” আপনাকে অবিশ্বাস করবো কেন?”

প্রণয় অকপটে বলল,” আমরা যাকে ভালোবাসি তাকেই বিশ্বাস কর‍তে পারি।”

তুলি অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,” এটা কি আপনার আবিষ্কৃত থিউরি? মানে পৃথিবীতে যত মানুষকে আমরা বিশ্বাস করি সবাইকেই ভালোবাসি?”

” তুমি একটু ভেবে দেখো। কথাটা কিন্তু সঠিক।”

” এতো ভাবাভাবির সময় নেই। আপনি ভেতরে চলুন নাহলে ঠান্ডা লাগবে।”

তুলি এতোক্ষণ রান্নাঘরে ছিল। তাই তার শরীর অনেকটাই উষ্ণ। মুখ লাগছে তৈলাক্ত আর মায়াবী। প্রণয় স্থির দৃষ্টিতে তুলির ঠোঁটের দিকে চেয়ে বলল,” আমি একটা জিনিস চাইবো। যদি দাও তাহলে ভেতরে যাবো নাহলে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো।”

তুলির মুখ লাল হয়ে গেল লজ্জায়। সে সচকিত দৃষ্টিতে এপাশ-ওপাশ দেখে বলল,” এই খোলা জায়গায় এসব? ছিঃ!”

প্রণয় হেসে ফেলে জিজ্ঞেস করল,” তুমি কি করে বুঝলে যে আমি যেটা চাইবো সেটা খোলা জায়গায় দেওয়া যাবে না?”

তুলি হতচকিত হয়ে তাকাল। তৎক্ষণাৎ কি বলবে বুঝতে পারল না। প্রণয় খুব জোরে হাসতে লাগল৷ তুলি অস্বস্তি মেশানো কণ্ঠে বলল,” আপনি আসলে আসুন। না আসলে নেই। আমি যাচ্ছি।”

প্রণয় এবার হাসি থামিয়ে তুলির হাত চেপে ধরল। তুলিকে থামতেই হলো। কিন্তু মাথা নুইয়ে রাখল সে। প্রণয় তার চিবুক উপরে তুলে বলল,” তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে তুলি।”

তুলি প্রণয়ের চোখের দিকে চাইল না। যথাসম্ভব দৃষ্টি নিচু রেখে বলল,” থ্যাংকস।”

প্রণয় মনের আবেগকে প্রশ্রয় দিল। তুলির সম্মতি আছে জেনেই তার টসটসে মিষ্টি ঠোঁটে টুপ করে এঁকে দিল প্রলম্বিত গভীর চুমু। তুলি একহাত দিয়ে নিজের কামিজের কাপড় খামচে ধরল। তার কপাল ঘেমে গেল। ঠকঠক করে কাঁপছে শরীর।

সন্ধ্যায় উঠানের সামনের ব্যালকনিতে জমল চায়ের আসর। সামিরও এসেছে। তন্বি চা ঢালতে ঢালতে হাসিমুখে বলল,” আপনার এখন দুইজন বড়লোক শালি, জানেন? তুলি কিন্তু অনেক টাকার মালিক হয়ে গেছে।”

হেলাল সাহেব আর আশা আগেই সব শুনেছেন। তাই তন্বির কথায় অবাক হলেন না তারা। সামির চোখ বড় বড় করে চাইল,” কিভাবে?”

তুলি মিষ্টি হেসে বলল,” লটারী পেয়েছি সামির ভাই।”

সামির উল্লাসী কণ্ঠে চিৎকার করল,” দারুণ ব্যাপার! কিভাবে পেলে? কত?”

তুলি আগ্রহ নিয়ে গল্প শুরু করল৷ লটারীর গল্প বলার সময় তার চোখের দৃষ্টি হয়ে উঠল চকচকে, মুখে উপচে পড়তে লাগল খুশির ঝিলিক। তার এই আনন্দ দেখে প্রণয়ের ভালো লাগছে খুব। রাইফা ইশারায় প্রণয়কে ডাকছিল। তার অবস্থান ভেতরের ঘরে। প্রণয় আধ খাওয়া চায়ের কাপ রেখে ভেতরের রুমে গেল। সবাই তুলির গল্প শুনছিল তাই কেউ খেয়াল করল না ব্যাপারটা। রাইফা প্রণয়কে নিয়ে আলমারির আড়ালে এসে বলল,” আমাকে একটা হেল্প করতে পারবে?”

প্রণয় হতাশ গলায় বলল,” রিসবের ব্যাপারে?”

” হ্যাঁ।”

” তার আগে বলো কি হয়েছিল কালরাতে? তুমি তো ওই ব্যাপারে কিছুই বললে না। কিভাবে বুঝবো যে তোমাদের মধ্যে কি চলছে?”

” তেমন কিছু না। জাস্ট তোমার ভাই আমাকে রিজেক্ট করেছে।”

রাইফা তার কথা শেষ করে ব্যথিত দৃষ্টিতে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। প্রণয় বিস্মিত হয়ে বলল,” হোয়াট? তুমি প্রপোজ করেছিলে নাকি?”

” প্রপোজ করার তো প্রয়োজন নেই। তোমার ভাইয়া ভালো করেই বোঝে আমার ফিলিংস। তাই আকার-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছে যে সে আমার প্রতি একদম ইন্টারেস্টেড না।”

” কিন্তু মিষ্টি আপু আর ছোটমা তো তোমাদের বিয়ের কথা ভাবছে!”

রাইফা আক্ষেপ নিয়ে বলল,” লাভ কি? তোমার ভাই তো আমাকে পছন্দ করে না।”

প্রণয়ের বিশ্বাস হচ্ছে না। সে নিজের ভাইকে চেনে। রিসবের আচরণটাই এমন রুক্ষ। কিন্তু সে অবশ্যই রাইফাকে পছন্দ করে। এই ব্যাপারে প্রণয় নিশ্চিত। সে বলল,” কি হেল্প চাও বলো।”

” রিসবকে ফোন করে বলো আমি মরে গেছি।”

প্রণয় হেসে ফেলল। রাইফা রেগেমেগে বলল,” হাসবে না। আমি সিরিয়াস।”

” মানে?”

” ওকে বলো আমি প্রচন্ড অসুস্থ। ডাক্তার বলেছে বেশিদিন বাঁচবো না। শেষ ইচ্ছা হিসেবে ওকে দেখতে চাইছি। তারপর যদি ও এখানে আসে।”

” সত্যি? এই কথা বলবো?”

” অবশ্যই।”

” আচ্ছা, বলবো। সেজন্য আমাকে অনেক অভিনয় করতে হবে। কাজটা সহজ না।”

” একটু অভিনয়ও করতে পারবে না? তোমার জন্য তো আমি দিন-রাত অভিনয় করছি তুলির সামনে।

তুলি হঠাৎ ঘরে ঢুকে পড়ল। রাইফা আর প্রণয়কে একসাথে দাঁড়ানো দেখেই সন্দেহী কণ্ঠে প্রশ্ন করল,” কি ব্যাপার? তোরা এখানে কি করছিস?”

রাইফা আর প্রণয় দু’জনেই একটু থতমত খেল। রাইফা তড়িঘড়ি করে জবাব দিল,” কিছুই না। তুই কি কিছু বলবি?”

” মামী ডালের বড়া বানিয়েছে। তোদের খাওয়ার জন্য ডাকছে।”

” আচ্ছা যা। আমরা আসছি।”

তুলি ঘর থেকে বের হলো। তারপর তার ইচ্ছে করল রাইফা আর প্রণয়ের কথাগুলো শুনতে। কারণ তুলি খেয়াল করেছিল, রাইফা তার বিষয়েই কিছু বলছে। কি বলছে? এই ভেবে সে আবার ভেতরে ঢুকল। প্রণয় তখন বলছিল,” আচ্ছা রাইফা, তোমার কি মনে হয় আমরা ভুল করেছি?”

” কোন ব্যাপারে বলছো? লটারীর ব্যাপারে?”

” হুম।”

” একদমই সেটা মনে হচ্ছে না। আমরা যা করেছি সব তুলির খুশির জন্য। তুমি দেখছো না লটারী পেয়ে সে কত খুশি হয়েছে?”

” এইটা দেখেই তো ভয় বেশি লাগছে। লটারী পেয়ে সে এত্তো খুশি হয়ে গেছে কিন্তু যখন জানবে সব আমি করেছি তখন আবার দুঃখী হয়ে যাবে নাতো?”

” আমরা ওকে সত্যিটা কখনও জানতেই দিবো না প্রণয়। এটা ঠিক যে সত্যিটা জানলে তুলি অনেক কষ্ট পাবে। তার সব খুশি এক নিমেষে শেষ হয়ে যাবে। ”

তুলি এতটুকু শোনার পর আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। এক দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ব্যালকনি পেরিয়ে যাওয়ার সময় আশা তাকে ডাকলেন,” আরে, আরে, কই যাচ্ছিস?”

তুলি জবাব দিল না। রাইফা বিরস মুখে প্রণয়কে বলল,

” আচ্ছা প্রণয়, তুলি কেন বড়লোক হতে চায় সেটা কি তুমি জানো?”

” জানি। কারণ সে আমাকে টেক্কা দিতে চায়।” এই কথা বলে প্রণয় হাসল। রাইফা বলল, ” একদমই না। তোমাকে টক্কর দিতে সে বড়লোক হতে চায় এটা ভুল। সে আসলে তার বাবাকে টক্কর দিতে চায়। তার বাবার থেকেও বেশি বড়লোক হতে চায়।”

প্রণয় হালকা বিস্মিত গলায় উচ্চারণ করল,” তুলির বাবা?”

” হুম। ওর বাবা অনেক বড় ব্যবসায়ী, অনেক টাকার মালিক। কিন্তু এই কথা তুলি কাউকে বলে না। সবাই জানে তার বাবা মৃত। কিন্তু আমাকে সে সত্যিটা বলেছে। তার বাবার সাথে তার মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেছিল টাকার জন্য। তুলির মা গরীবের মেয়ে ছিল। তাদের বিয়েটা ছিল প্রেমের। তুলির মা তার বাবার সাথে পালিয়েছিল। জন্মের পর থেকেই তুলি দেখতো তার বাবা বিভিন্ন কথায় তার মাকে অপমান করে, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। তুলির যখন বয়স মাত্র চার তখন তুলির মা জানতে পারে তুলির বাবার আরেক জায়গায় সংসার আছে। তিনি এসব নিয়ে ঝামেলা শুরু করলে তুলির বাবা আগের সংসার ঘরে এনে তুলি আর তুলির মাকে ত্যাগ করে দেয়। কিন্তু তুলির মা পালিয়ে এসেছিল তাই ফিরে যাওয়ার উপায় ছিল না। তাদের যাওয়ারও কোনো জায়গা ছিল না। কাজের লোকের মতো ওই বাড়িতেই থাকতে হতো। তারপর একদিন তার মা মারা গেল। আর তুলিকে তার মামা নিয়ে এলো। ছোটবেলা থেকে অনেক কষ্টের জীবন দেখেছে মেয়েটা। এজন্যই তার ভাগ্যের প্রতি এতো জেদ। সে বড়লোক হয়ে একদিন তার বাবাকে জবাব দিতে চায়। কিন্তু সে যদি কখনও বুঝতে পারে তুমি তাকে লটারী জিতিয়ে দিয়েছো তাহলে হয়তো তোমাকেও সে তার বাবার মতোই ঘৃণা করতে শুরু করবে। ভাববে তুমি তাকে দয়া দেখিয়েছো কিংবা অবমূল্যায়ন করেছো। এজন্য বলছি, কখনও তাকে এটা জানিয়ে দিও না। ও এখন যেভাবে খুশি আছে, সারাজীবন এভাবেই খুশি থাকুক।”

প্রণয় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে বলল,” চিন্তা কোরো না। আমি কখনও ওকে এটা বুঝতেই দিবো না।”

তন্বি হঠাৎ ঘরে ঢুকল। রাইফাকে দেখতে পেয়েই বলল,” আচ্ছা, তুলির সাথে কি তোর কিছু হয়েছে রাইফা?”

রাইফা ভ্রু কুচকে বলল,” নাতো,কেন?”

” তুলি হঠাৎ দৌড়ে কোথায় জানি চলে গেল। তাকে এখন কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”

” হোয়াট?” প্রণয় গর্জন করল। তন্বি ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল,” মামা আর সামির বের হয়েছে খুঁজতে…”

প্রণয় বিনাবাক্যে বড় বড় কদম ফেলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। কোথায় আছে তুলি? এই অন্ধকার রাতে সে কোথায় যেতে পারে? অশান্ত মনটা প্রণয়কে ভাবাচ্ছে খুব।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here