বেদনার_রঙ_নীল বিশতম পর্ব

0
350

#বেদনার_রঙ_নীল
বিশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz

এতো দূর থেকে তুলির ফিসফিস কণ্ঠে বলা শব্দ প্রণয়ের কানে পৌঁছানোর কথা না৷ কিন্তু প্রণয় এদিকেই এগিয়ে আসছে। তুলি কিছুটা জড়োসড়ো হয়ে বসল৷ ঘটনা আঁচ করা যাচ্ছে না। প্রণয় যদি সবার সামনে তাকে কিছু বলে তাহলে ভারী লজ্জার ব্যাপার হবে!

প্রণয় একদম পেছনে তুলিদের বেঞ্চের সামনেই এসে দাঁড়াল। তুলি আতঙ্কবোধ করছে। প্রণয় কণ্ঠে গম্ভীরতা ঢেলে বলল,” তুমি দাঁড়াও।”

তুলি ঘাবড়ে গিয়ে বলল,” আমি?”

প্রণয় জবাব দিল না। তুলি খেয়াল করল তার দৃষ্টি টিনার উপর। টিনা ঠিক তুলির পাশেই বসে আছে। সে ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। প্রণয় ভারিক্কি মেজাজে বলল,” তোমার ফোনটা দেখি।”

টিনা অস্বচ্ছন্দে ফোন দিল। প্রণয় এবার মুখে হাসি টেনে বলল,” আমার সাথে ছবি তুলতে চাও? তাহলে বাইরে এসো। একসাথে অনেকগুলো তুলে নেই। নয়তো পুরো ক্লাস লুকিয়ে ছবি তুলতে তুলতে তুমি টায়ার্ড হয়ে যাবে৷ এতোদূর থেকে একটা ছবিও ভালো আসবে না।”

সবাই হেসে উঠল। টিনার মুখ লজ্জায় সংকুচিত হয়ে গেল। নিম্ন স্বরে বলল,” স্যরি ভাইয়া।”

প্রণয় ফোনটা ফেরত দিয়ে চলে গেল। তুলি রাগে কটমট করে বলল,” খুব ভালো হয়েছে। তোকে কে বলেছিল লুকিয়ে ছবি তুলতে? এখন দিল না একটা আচ্ছামতো বাঁশ? ভালো লাগছে?”

টিনা জবাব দিল না। মুখ ফুলিয়ে বসে রইল। তার মনটা একদম খারাপ হয়ে গেল। রাইফা হাসির চোটে কথাই বলতে পারছিল না। ক্লাস শেষ হওয়ার পর বাড়ি ফেরার সময় তুলি তার মনের কৌতুহল মেটাতে প্রশ্ন করল,” যার বাপের এতো টাকা সে কেন কোচিং সেন্টারে চাকরি করতে এলো? আমি বুঝতে পারছি না।”

রাইফা হাসি মুখে বলল,” প্রণয়ের কথা বলছিস?”

” অফকোর্স। আর কার কথা বলবো?”

রাইফা শ্রুতিমধুর কণ্ঠে বলল,” হয়তো ও তোর জন্য এসেছে।”

” হোয়াট?” তুলির চেহারায় অবিশ্বাস। রাইফা নিরাশ কণ্ঠে বলল,” জানি বিশ্বাস করবি না। কিন্তু এটা সত্যি হতেও পারে।”

” ও আমার জন্য কেন আসবে?”

” সেটা ও জানে।”

” অদ্ভুত!”

তুলি এই নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করল না। রাইফাও আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে চাইল না। প্রণয় নিষেধ করেছিল। ঠিক পরের সপ্তাহে আবার একটি পদার্থবিজ্ঞান ক্লাসে দেখা হলো প্রণয়ের সঙ্গে।এই রকম খুবই কম হয়। ভর্তি কোচিং-এর নিয়ম হলো একবার যেই স্যার ক্লাস নিয়ে চলে যাবেন তিনি আর দ্বিতীয়বার কখনও আসবেন না। তার জায়গায় নতুন কেউ আসবেন। একই স্যার দ্বিতীয়বার আসা খুবই বিরল একটি ঘটনা। ছাত্রীরা প্রশ্নবাণ ছুঁড়তে লাগল৷ সামনের বেঞ্চিতে বসা কয়েকজন মেয়ে জিজ্ঞেস করল,” ভাইয়া এটা কিভাবে হলো? আপনি আবার কিভাবে আমাদের ক্লাসে এলেন?”

” আসলেই। এটা কি কো-ইন্সিডেন্ট ছিল?”

প্রণয় আন্তরিক ভঙ্গিতে সবার প্রশ্নের উত্তর দিল,” এটা কোনো কো-ইন্সিডেন্ট না। আমিই ইনটেনশনালি আবার তোমাদের ক্লাসে এসেছি। আর এখন থেকে তোমাদের সব ফিজিক্স ক্লাস আমিই নিবো। হেড অফিসের সাথে ডিল করা আছে।”

প্রণয়ের এমন কথায় সবাই অবাক বনে গেল। অবনী বলল,” ভাইয়া মনে হয় আমাদের মায়ায় পড়ে গেছেন, তাই না? এজন্য আমাদের ছাড়তেই চাইছেন না।”

সামনে থেকে একটি মেয়ে বলল,” এর একটা রিজন অবশ্যই আছে ভাইয়া। আপনি নিশ্চয়ই আপনার সুবিধার জন্য এইটা করেছেন ঠিক না?”

প্রণয় সরাসরি বলল,” ইন্টেলিজেন্ট। তোমাদের ব্যাচে কেউ আছে যে আমার কাছে অনেক স্পেশাল। তার জন্যই আমি এইটা করেছি। সুতরাং বলতে পারো আমার সুবিধার জন্যই।”

সবাই খুব জোরে চেঁচালো। মেয়েটির নাম জানার জন্য কৌতুহল উপচে পড়তে লাগল প্রত্যেকের চেহারায়। প্রণয় প্রসঙ্গ পাল্টে পড়াশুনার ব্যাপারে আলোচনা শুরু করল৷ সবাই আশাহত হলো। মেয়েটির নাম জানার কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারছিল না কেউই। কিন্তু প্রশ্ন করার সাহসও হচ্ছিল না কারো। রাইফা আঁড়চোখে তুলির দিকে তাকাল। তুলি রেগে বলল,” আমার দিকে তাকাচ্ছিস কেন? ওই স্পেশাল গার্ল তো তুই।”

রাইফা ক্ষীপ্ত হয়ে বলল,” গাঁধী। আমি কেন হবো? ওই স্পেশাল গার্ল তুই।”

তুলির বিশ্বাস হলো না। ক্লাসের মাঝে প্রণয় একটা গাণিতিক সমস্যা দিয়েছিল। যারা সবার আগে সমাধান করবে তাদের মধ্য থেকে প্রথম তিনজন পাবে খাতায় সিগনেচার। রাইফা, তুলি আর অচেনা একটি মেয়ে খুব দ্রুত সমস্যাটা সমাধান করে ফেলল। প্রণয় বাকি দুইজনের খাতায় সিগনেচার করল। শুধু তুলির খাতায় লিখল,” ম্যাথের এন্সার ঠিকাছে। কিন্তু আমার এন্সার এখনও পাইনি।”

লিখাটা পড়ে তুলি অপ্রস্তুত হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে নিজের খাতা বন্ধ করে ফেলল; যাতে কেউ দেখতে না পারে। ক্লাস শেষেই শুরু হলো অবনী আর টিনার হা-হুতাশ। সেই স্পেশাল গার্লের নাম তারা জানতে পারল না। কিভাবে মেয়েটিকে শনাক্ত করা যায় তা নিয়ে চলতে লাগল পরিকল্পনা। মীরারও যে আগ্রহ কম হচ্ছে তা না। তবে সে টিনা আর অবনীর মতো অস্থিরতা দেখাচ্ছে না। রাইফা বলল,” আমাকে একটা জায়গায় আর্জেন্ট যেতে হবে তুলি। আমি গাড়ি নিয়ে চলে যাচ্ছি। তুই রিকশা দিয়ে চলে যাস।”

তুলি একটু চমকে বলল,” কোথায় যাবি তুই এইসময়? চল আমিও তোর সঙ্গে যাই?”

” লাগবে না। আমি একাই যেতে পারবো।”

রাইফা বের হয়ে গেল। তুলি বিস্মিত। এর আগে কখনও রাইফা তাকে একা ফেলে চলে যায়নি। আজকে মেয়েটার কি হলো?

ভরা রাস্তায় ওই পারে যাওয়ার জন্য দাঁড়ালো তুলি। এই পার থেকে রিকশা যাবে না। ওই পারে গিয়েই উঠতে হবে। কিন্তু রাস্তা খুবই ব্যস্ত। ব্রীজেও ওঠা সম্ভব নয়। কারণ ব্রীজ খুব নিরিবিলি। আর অনেকটা দূরে। এতো হাঁটার শক্তি তুলির নেই। হঠাৎ প্রণয় গাড়ি নিয়ে সামনে এসে থামলো। জানালা দিয়ে মাথা বের করে বলল,” হেল্প লাগবে?”

তুলি ভদ্রভাবে হেসে জবাব দিল,” নো থ্যাংকস। ”

প্রণয় গাড়ির দরজা খুলে দিল। তুলি হতভম্ব হয়ে বলল,” আমি বলেছি লাগবে না।”

প্রণয় অবিচল কণ্ঠে বলল ” উঠে এসো। নাহলে যদি জোর করে তোমাকে গাড়িতে তুলি তাহলে মানুষ আমাকে কিডন্যাপার ভাববে।”

তুলি আশেপাশে একবার দেখে দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ল৷ তারপর বাধ্য হয়েই গাড়িতে উঠল। প্রণয় আর কোনো কথা না বলে গাড়ি চালু করল। দু’জনই নিশ্চুপ ছিল। একসময় তুলিই বলল,” আপনি কোচিং-এ এসব কি শুরু করেছেন? ”

” মানে?”

” আমার খাতায় ওগুলো লেখার মানে কি? যদি কেউ দেখতো?”

” কিন্তু দেখেনি তো!”

তুলি বিরক্ত গলায় বলল,” উফ, আপনার সেই স্পেশাল গার্লটা কে? তার খাতায় গিয়ে লিখুন যা ইচ্ছা। আমার খাতায় না।”

প্রণয় হাসল। তুলি গরম দৃষ্টিতে বলল,” ডন্ট ফ্লার্ট। এখন আবার বলবেন না যে আমিই সেই স্পেশাল গার্ল!”

” আমি বললেও তো তুমি বিশ্বাস করবে না। তাহলে বলেও লাভ কি?”

” আচ্ছা আপনি আমাকে তুমি করে বলতে লাগলেন কবে থেকে?”

” এখন স্টুডেন্টকে আপনি করে ডাকতে হবে?”

” স্টুডেন্টকে প্রপোজ করাও কোনো ভালো টিচারের কাজ না।”

তুলি এই কথাটা বলল অন্যদিকে চেয়ে। প্রণয় মুচকি হাসল। কৈফিয়ৎ দেওয়ার জন্যে বলল,” ওইসময় তো তুমি আমার স্টুডেন্ট ছিলে না।”

তুলি বাঁকা হেসে বলল,” এখন তো স্টুডেন্ট হয়েছি!”

” কি আসে-যায়?”

তুলি তার ব্যাগ থেকে একটা রঙিন ওরনা বের করল। প্রণয়ের দিকে ওরনাটা বাড়িয়ে বলল,” এটা শান আমাকে দিয়েছিল। সে নাকি আপনার আলমারিতে পেয়েছে।”

প্রণয় ভ্রু কুচকে কিছুটা রেগে বলল,” হোয়াট রাবিশ! আমার আলমারিতে মেয়েদের ওরনা থাকবে কেন?”

” নাটক করবেন না। এটা রাইফার ওরনা। আপনার আলমারিতে ছিল। আপনি এই ওরনার অনেক যত্ন নেন। শান আমাকে সবই বলেছে। তখন থেকে ওরনাটা আমি নিজের কাছে রেখেছি। এজ আ প্রুফ। এখনও কি অস্বীকার করবেন যে আপনি রাইফাকে ভালোবাসেন না?”

প্রণয় চোয়াল শক্ত করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,” আমি এই ওরনার ব্যাপারে কিছুই জানি না। স্ট্রাস্ট মি।”

তুলি অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে হেসে উঠল। প্রণয়ের মেজাজ অত্যন্ত খারাপ হয়ে গেল। শান কি উল্টা-পাল্টা লাগিয়েছে কে জানে? সে বাড়ি ফিরেই শানের খোঁজ করল। কিন্তু শান নিরুদ্দেশ। আজকে তার স্কুল বন্ধ থাকার কথা। তাহলে সে কোথায় যেতে পারে? প্রণয় মিষ্টিকে বলল,” শান বাড়িতে এলে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলবে।”

মিষ্টি আর অজান্তা দু’জনেই ঘাবড়ে গেল।

শান প্রণয়ের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। প্রণয় মাত্র গোসল সেরে বেরিয়েছে। চোখ-মুখ গম্ভীর,লাল। দেখে বোঝাই যায় যথেষ্ট রেগে আছে। প্রণয়ের এমন চেহারা দেখলে শানের বুকে ধুকধুক শব্দ শুরু হয়। যা এখনও হচ্ছে। শান কিছুতেই এই ধুকপুকানি থামাতে পারছে না। মুখ শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে গেছে। গলাও শুকাচ্ছে। ঢোক গিলতে কসরত হচ্ছে। শান এক পা ভিতরে নিয়েও আবার বের করে ফেলছে। ঘরে প্রবেশ করার সাহস পাচ্ছে না। প্রণয় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলের পানি ঝারতে ঝারতে বলল,” আয়।”

শান রীতিমতো কেঁপে উঠল। ঘন পল্লবযুক্ত অপূর্ব অক্ষিযুগল প্রণয়ের দিকে তাঁক করে ভেতরে ঢুকল। ভয়ে শানের বৃহৎ চোখ আরও বৃহতাকৃতি ধারণ করেছে। প্রণয় আয়নায় শানের মুখের দিকে একবার তাকাল। তারপর গলায় টাই বাঁধতে বাঁধতে বলল,
” কোথায় গিয়েছিলি সকাল সকাল?”

শান নির্বিঘ্নে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করল,” তাইতিদের বাড়ি। নোট আনতে।”

প্রণয় আবার তাকাল শানের দিকে। শান মাথা নুইয়ে ফেলল। প্রণয় ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে ব্যাগটা তুলে শানের দিকে ঘুরে তাকাল। পূর্ণ মনোযোগের সাথে জিজ্ঞেস করল, ” তাইতি কে?”

শান মাথা নিচু রেখেই বলল,” ফ্রেন্ড।”

” তোকে গার্লস স্কুলে পড়াই?”

শান আশ্চর্য হয়ে তাকাল,” না তো।”

প্রণয় কঠিন গলায় বলল,” তাহলে এতো মেয়ে ফ্রেন্ড আসে কোথ থেকে? তোর সব ফ্রেন্ড মেয়ে হয় কি করে? তোর ক্লাসে ছেলে নেই?”

শান অসহায়ত্ব নিয়ে বলল,” আছে। তবে আমাদের ক্লাসে মেয়ের সংখ্যা বেশি। এটা কি আমার দোষ? আর সব ফ্রেন্ড মেয়ে না তো। মাত্র ছয়জন মেয়ে।”

” কাল স্কুলে গিয়ে তোর প্রধান কাজ কি জানিস?সব মেয়ে ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকাপ করা। এতো মেয়ে ফেন্ড থাকা যাবে না। ছেলেদের সাথে মিশবি। ফ্রেন্ড হিসেবে মেয়েদের থেকে ছেলেরা বেশি হেল্পফুল হয়। মেয়েদের থেকে পাঁচ ফুট দূরে থাকবি। মনে থাকবে?”

শান মাথা নুইয়ে মাথা নাড়ল। প্রণয় বিরবির করল,
” মেয়েদের সাথে মিশতে মিশতে তোর স্বভাব-চরিত্রও দিন দিন মেয়েদের মতো হয়ে যাচ্ছে।”

” মানে?”

” মেয়েদের মতো গোয়েন্দাগিরি শুরু করেছিস। রিসবের আলমারি থেকে ওরনা চুরি করেছিস কেন? তুই কি ওরনা গায়ে দিবি? নাকি তোর কোনো মেয়ে বান্ধবীকে উপহার দিবি?”

শান ভ্রু কুচকে লজ্জিত গলায় বলল,” আমি মেয়েদের সাথে মিশি না। মেয়েরাই যদি আমার সাথে নিজ থেকে কথা বলতে আসে, টিফিন শেয়ার করে,নোট শেয়ার করে, এটা কি আমার দোষ? আমি কি করবো? আই ফাইন্ড দেম হেল্পফুল ফোর মি। সো আই কিপ দেম।”

” দে আর নট হেল্পফুল ফোর ইউ। দে আর জাস্ট হার্মফুল ফোর ইউ।”

” বাট তাইতি ইজ নট হার্মফুল। শী ইজ বিউটিফুল।”

” বিউটিফুল? এখন সবই বিউটিফুল লাগবে। পরে বুঝবি প্যারা কি জিনিস। তোর মতো বয়সে আমারও এমন মনে হতো।”

” মিস কিউটিপাই কি হার্মফুল?”

প্রণয় চোখ ছোট করে তাকাল। শান জড়োসড়ো হয়ে বলল,” ওকে। আমি এখন যাই। শিনচ্যান শুরু হবে।”

শানের পড়ার টেবিলে অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে তুলি। কিন্তু শান এখনও আসছে না। বসে থাকতে থাকতে চোখে ঘুম এসে গেছে। ক্রমাগত হাই তুলতে হচ্ছে। আজ সকাল আটটা নাগাদ শানকে পড়াতে চলে এসেছে সে। শানকে পড়িয়ে রাইফার সাথে যাবে কোচিং-এ।

শান ভিতরে ঢুকেই একটা কাশি দিল। কাশির শব্দ শুনে পেছনে তাকাল তুলি। এই কাশিটাকে বলা হয় মনোযোগ আকর্ষণের জন্য কাশি দেওয়া। শান তার পেছনে কি একটা লুকিয়ে রেখেছে। তার অঙ্গভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তুলিকে খুব জরুরি কিছু বলার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। তুলি শানকে ভেতরে আসতে বলল। শান নির্বিকার ভঙ্গিতে ভিতরে ঢুকে চেয়ার টেনে বসল। পেছনের জিনিসটা এখনও আড়াল করে রেখেছে।

তুলি বলল,” তুমি কি কিছু বলবে?”

শান মাথা নাড়ল।

তুলি ঠান্ডা কণ্ঠে অনুমতি দিল,” হ্যাঁ বলো?”

শান এবার পেছনে লুকিয়ে রাখা খাতা আর কলমটা টেবিলের উপর রাখল। তুলি দেখল খাতাটার প্রথম পেইজে লেখা– “I am donkey. Please forgive me.”

এই একটা লাইন পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে বারবার লেখা। তুলি ভ্রু কুচকে শানের দিকে তাকাল।

” এগুলো কি?”

“পানিশমেন্ট।”

“কিসের পানিশমেন্ট? কে দিয়েছে এমন পানিশমেন্ট? ”

” রেডলাইট!”

” কেনো? আবার কি কুরুক্ষেত্র ঘটিয়েছো শুনি!”

” তেমন কিছুই করিনি। শুধু ছোট্ট একটা মিসটেক হয়ে গেছে। তিন হাজার বার এই লাইনটা আমাকে লিখে রেডলাইটকে জমা দিতে হবে।”

তুলি চোখ বড় করে বলল,” তিন হাজার বার? কিন্তু এতোবার কেনো?”

” ভাইয়ার পারমিশন ছাড়া তার আলমারি ঘেঁটেছি। সেইজন্য এক হাজার। আলমারি থেকে ওরনা চুরি করেছি। সেইজন্য আরো এক হাজার । চুরি করা ওরনাটা আপনার হাতে দিয়েছি। সেইজন্য আরো এক্সট্রা এক হাজার । মোট তিন হাজারবার।”

তুলি বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। এইটা কি ধরনের পানিশমেন্ট? তিন হাজার বার এতোবড় একটা লাইন লিখতে হবে? ব্যাপারটা একটু বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না?

তুলি বলল,” কিন্তু শান, তুমি যদি সারাদিন এসব লেখো তাহলে পড়াশোনা করবে কখন?আর এতো লিখতে গিয়ে হাত ব্যথা হয়ে যাবে না?”

শান মুচকি হাসল,” হুম সেইজন্যই তো আপনাকে দিচ্ছি। আপনি লিখে দেবেন আমাকে। আর আমি পড়ব।”

কথাটা শুনে তুলির চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম।
” মানে? আমি কেনো লিখতে যাবো? পানিশমেন্টটা তো তোমার।”

” কিন্তু অর্ধেক দোষ আপনারও। আপনি যদি কাল রেডলাইটকে ওরনাটা না দেখাতেন তাহলে এসব কিছুই হতো না। আমি চুপি চুপি গিয়ে ঠিক জায়গা মতো ওরনাটা রেখে আসতাম। কিন্তু আপনিই ঝামেলা বাঁধিয়েছেন। তাই এখন আপনাকেই পানিশমেন্ট পেতে হবে। আমি সারারাত ধরে বারোশো বার লিখেছি। এখন বাকিটা আপনি লিখবেন।”

” ইম্পসিবল! আমি এসব লিখতে পারবো না। আর তাছাড়া তোমার হ্যান্ড রাইটিং আর আমার হ্যান্ড রাইটিং এ আকাশ-পাতাল পার্থক্য। তোমার ভাইয়া বুঝে ফেলবে।”

” সেইটা আপনার প্রবলেম। আপনাকে এমন ভাবেই লিখতে হবে যেন রেডলাইট না বুঝতে পারে। আদারওয়াইজ…..”

” আদার ওয়াইজ কি?”

” আমি আপনার ভিডিও ভাইরাল করে দিব।”

তুলি যেন আকাশ থেকে পড়ল। হত বিস্মিত গলায় উচ্চারণ করল,” হোয়াট?আমার আবার কিসের ভিডিও?”

” আছে। ”

শান রহস্যের ভঙ্গিতে হাসল। তারপর পকেট থেকে তার ফোনটা বের করে একটা ভিডিও চালু করল। ভিডিওটায় তুলি খুবই এলোমেলো অবস্থায় চেয়ারের উপর পা তুলে বসে আছে। চোখমুখ বন্ধ করে মনে মনে কি যেন বিরবির করছে। তার হাত-পা কাঁপছে আর শরীর থেকে ঘাম ছুটছে। খুবই বাজে একটা অবস্থা। তুলি কিছুক্ষণ ভিডিওটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠল,” এটা কি শান? তুমি এমন জঘন্য কাজ করতে পারলে?”

” এটা আপনি মিস। মাঁকড়সা দেখে একটা মানুষ এতো ভয় পায়, ব্যাপারটা অনেক ফানি! আপনি যদি আমাকে হেল্প না করেন তাহলে এই ভিডিও আমি ভাইরাল করব। আমার ইউটিউব চ্যানেলে আপ্লোড করে দিবো। ভালোই ভিউজ হবে। কিছু ইনকামও হবে।”

শানের কথা শুনে তুলির চোখ রসগোল্লার মতো বড় হয়ে গেল। এই মিলিমিটার সাইজের ছেলে বলে কি? তার আবার ইউটিউব চ্যানেলও আছে? আবার বলছে সেখানে ভিডিও ভাইরাল করবে? তুলি ভাবতেই পারছে না শান এই ধরণের ভিডিও কখন করল? না জানি আর কি কি আছে এই ছেলের কাছে! ভয়ে বুক ধুকধুক করতে লাগল তুলির। সে খাতা আর কলম হাতে নিয়ে বলল,” ঠিকাছে, বাকি লেখা আমি লিখে দিবো। ”

” থ্যাংকস। ” শান মিষ্টি করে হেসে পড়তে বসল।

তুলি বিরবির করে বলতে লাগল,” কি ডেঞ্জারাস ছেলে! এখনো দুধের দাত পড়েছে কি-না সন্দেহ। অথচ এমনভাবে ব্ল্যাকমেইল করছে যেন কোনো বড়সড় মাফিয়া। এই ছেলে ফিউচারে কি হবে আল্লাহ মালুম। বড়সড় কোনো গ্যাংস্টার কিংবা কোনো রাজনীতিবিদ। মাথাভর্তি যতসব কূটনৈতিক বুদ্ধি!”

শান গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,” আপনি চাইলে খাতাটা বাসায়ও নিয়ে যেতে পারেন। রেডলাইট আমাকে কাল সকাল বারোটার পর্যন্ত টাইম দিয়েছে। এর মধ্যেই আপনাকে শেষ করে আমার কাছে জমা দিতে হবে। যদি এক সেকেন্ডও লেইট হয়, ভিডিও উইল বি আপ্লোডেড দেন।”

তুলি কটমট দৃষ্টিতে তাকাল। না পারল কিছু বলতে আর না পারল সহ্য করতে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here