বেবি কুইন,পর্ব_২

0
1723

বেবি কুইন,পর্ব_২
সুমাইয়া জাহান

ব্যাথায় না পারছে দাঁড়াতে না পারছে বসতে আর না পারছে শুতে!হাত পা একে বারে ব্যাথায় অপশ হয়ে আছে আরে পিঠের কথা তো বাদই দিলাম।পুরো বারো ঘন্টা গোড়া হয়ে বেবি কুইনের খেলনা হয়েছিলো।তবে বেবি কুইন যে সারাক্ষণই ওদের পিঠে চড়ে পুরো বাড়ি ঘুরেছে এমন টা নয়!প্রথমে উঠলেও কিছুক্ষণ পরও নিজে থেকেই নেমে গেছে তাই বলে ওদের ছেড়ে দিয়েছে এটা ভাববেন না!কারণ ও ছোটো হলেও নিজের প্রতিশোধ নিতে ভুলে না!আসলে এই স্টাফ গুলো কেউ সামনে না থাকলে মাঝে মাঝেই ওর সাথে বকা ঝকা করে। তাই আজ তার প্রতিশোধ নিলো।বেবি কুইনের সাথে পাঙ্গা নিবে আর বেবি কুইন এতো সহজে ছেড়ে দেবে এটা তো হবে না!তার যোগ্য শাস্তি তো পেতেই হবে!

সেই স্টাফ ছেলে গুলো নিজেদের রুমে কোনো রকমে শুয়ে বসে আছে।ওদের মধ্যে রতন নামের একটা ছেলে মেজাজ দেখিয়ে বলে উঠলো,

—– দেখেছিস কি বাচ্চা টা কি বদমাশ!

—– তা আর বলতে! আমার তো ব্যাথা হাত পা সব টনটন করছে!এখন যদি সামনে পাইতাম তাহলে সত্যি বলছি ছাঁদ থেকে একদম নিচে ফেলে দিতাম!

রাগে গজগজ করতে করতে পাশ থেকে নিলয় নামের ছেলে টা বললো।আরেক ওদের কথা শুনে সতর্কতা সহিত চারিদিকে কয়েকবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে নিচু সুরে বললো,

—- এই কি বলছিস কি কেউ শুনে নিলে কিন্তু নিজেতো জেলে যাবিই সঙ্গে আমাদেরও নিয়ে যায়!

কথাটা শুনে নিলয় ছেলেটা মুখ দিয়ে বিরক্তি সূচক একটা শব্দ বের করলো তারপর বিরক্তি চোখ সামনের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললো,

—– ওদের রাগ হচ্ছে না বদমাশ বাচ্চার উপর! আজকে আমাদের কি অবস্থা টাই না করলো বাচ্চা টা!তোরা কিছু না করলেও আমি বাচ্চারে শিক্ষা না দিয়ে শান্তি পামু না।আগুন জ্বলতাছে আমার মাথা!

কথা গুলো বলে পিছনে ঘুরেতেই ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো নিলয়!কারণ তার সামনে ভুতের থেকেও ভয়ংকর কেউ দাঁড়িয়ে আছে। বেবি কুইন!ওদের রুমের দরজার সামনেই কোমরে দুই হাত রেখে মুখ ফুলিয়ে ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে বেবি কুইন। দৃষ্টি তার প্রখর!এই দৃষ্টি দিয়ে সামনের মানুষ গুলোকে ভস্ম দেওয়ার মতোই! বেবি কুইন ঠিক ভাবে কথা বলতে না পারলেও ওর বুঝতে বাকি নেই ওরা ওকে নিয়েই বাজে কথা বলছে!বিশেষ করে নিলয় ছেলে টা বেবি কুইন কে সেই প্রথম থেকেই পছন্দ করে না এটা বেবি কুইনের ওই ছোট্ট মাথা অনেক দিন আগেই গেঁথে গেছে।

বেবি কুইন মাত্র দেড় বছরের বাচ্চা হলেও ওর ব্রেইন কিন্তু চার পাঁচ বছরের বাচ্চার মতোই!কিন্তু ও গর্ভে থাকাকালীন ওর মা মানে রিশিতার কিছু সমস্যা হয় তখন ডক্টর বলেছিলো বাচ্চা টা সুস্থ থাকলেও জন্মের পর অস্বাভাবিক হবে!কিন্তু ওর জন্মের পর অন্য অন্য কোনো সমস্যা দেখা গেলেও তার মানসিক বিকাশ স্বাভাবিক হয়নি বরং তার বয়সের তুলনায় অতিরিক্ত বেশিই মানসিক বিকাশ ঘটেছে।চার পাঁচ বছর বয়সে বাচ্চারা যতটুকু বোঝার ক্ষমতা হয় সেরকমই বোধ শক্তি কাজ করে বেবি কুইনের মধ্যে।তাই তো বেবি কুইনের আচরণ সবার থেকে আলাদা!তার আরো একটা ক্ষমতা আছে কারো মুখ দেখলেই বুঝতে পারে কে ভালো আর কে খারাপ।যেমন নিলয় কে সে দেখেই বুঝে ফেলছিলো সে খারাপ লোক। সব কিছু বোঝার ক্ষমতা আল্লাহ তায়ালা তার মধ্যে এইটুকু বয়সেই ভরপুর করে দিয়েছে।তবে সবার সাথেই যে ও দুষ্টুমি করে এমন টা কিন্তু না দুষ্টুদের জন্য যেমন যম তেমনই ভালো দের জন্যও তেমনি ভিষণ ভালো।শুধু বাবাকে জ্বালাতে ওর সেই ছোটো থেকেই ভিষণ ভালো লাগে তাই বাবাকে সামনে পেলেই তার দুষ্টুমি শতগুণ বেড়ে যায়।তাই তো নুয়াস ওর থেকে সময় দূরেই থাকার চেষ্টা করে।তাই বলে এই নয় যে মেয়েকে সে ভালোবাসে না!সেও মেয়েকে ভিষণ ভালোবাসে বলতে গেলে মেয়ে তার প্রাণ! আসলে ওদের বাবা মেয়ের সম্পর্ক টা ঠিক টম এন্ড জেরির মতো।যদিও বা নুয়াস ওর থেকে পালানো ছাড়া আর কিছুই করে না তাও ওইরকম টাইপেরই! বেবি কুইনের আরেকজন মানুষের সঙ্গেও এমন দুষ্টুমি করে আপনারা বুঝতেই পারছেন কার কথা বলছি হ্যাঁ একদম ঠিক ধরেছেন রিশিতা!তবে নুয়াসের মতো তো টা বাজে রকম দুষ্টুমি করে না কিন্তু সারাদিন দৌড়ের উপর রাখে রিশিতাকে!

এখন আসা যাক গল্পে নিলয় তো বেবি কুইনের দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলছে বার বার!গলা শুকিয়ে আসছে তার।এই বেবি কুইন যদি কিছু শুনে ফেলে তাহলে তার জন্য যে খুব একটা ভালো কিছু অপেক্ষা করছে না তা নিয়ের খুব ভালোভাবেই জানা!এমনিতে বেবি কুইনের আড়ালে ওকে নিয়ে যা খুশি বলতে পারলেও এই ধরনের কথা বেবি কুইনের সামনে বলার সাহস নেই কারণ ওরও বেবি কুইনের বুদ্ধি সম্পর্কে অজানা নয়।

—– অবশেষে পেলাম তোমায়!চলো কুইন অনেক হয়েছে দৌড়ঝাঁপ! এবার ঘুমাতে হবে!

দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে বেবি কুইনকে কথা বললো রিশিতা।রিশিতা আসতেই যেন নিলয় হাফ ছেড়ে বাচঁলো।আড়ালে ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেলে নিলো।কারণ এতোক্ষণ ওর দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা ছিলো।নিলয় কে সামনে দেখে রিশিতা কপালে ভাজ ফেলে বললো,

—– তোমাদের আবার জ্বালায়নি তো!

—– আপনার ওই এক ইঞ্চি মেয়ে আমাদের জীবন ডা তেজপাতা বানাইয়া ফেলছে আর আপনি জিগাইতাছেন জ্বালাইছে কিনা!এই বদমাশ টারে ঘরে বাইন্দা রাখতে পারেন না!

খুব ইচ্ছা ছিলো রিশিতার মুখের উপর এই কথা গুলো বলার কিন্তু আফসোস বলতে পারলো না।মনের কথা মনে রেখেই মুখে মিথ্যে হাসি ফুটিয়ে বললো,

—– কি বলেন ছোটো মেডাম! আমাদের কুইন আফা কি কখনো আমাদের জ্বালাইতে পারে?ওই মাঝে মাঝে একটু আকটু দুষ্টুমি করে এইটুকুই! আমাদের তো খুব ভালো লাগে কুইন আফার এই দুষ্টুমি গুলা।কি রে তোরা চুপ করে আছোস কেন?বল ছোটো মেডাম কে আমাদের কুইন আফার কথা!

শেষের কথা গুলো ওর বাকি সঙ্গীদের উদ্দেশ্য করে বললো নিলয়।নিলয়ের সাথে তাল মিলিয়ে ওরা মুখে জোরপূর্বক হাসির রেখা টেনে সমসুরে বলে উঠলো,

—– হ্যাঁ ছোটো মেডাম নিলয় ঠিকিই বলছে সত্যি কুইন আফা খুব ভালো!

রিশিতা একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললো সবার কথা শুনে।

—– সত্যি তোমরা খুব ভালো আমার মেয়েটা তোমাদের এতো জ্বালানোর পরও তোমরা ওকেই ভালো বলছো।তোমাদের মতো মানুষ পেয়ে সত্যি কুইন খুব লাকী!

বেবি কুইনের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে কথাটা বলে একটা মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলো রিশিতার মুখে। রিশিতা তো জানেই না তার মেয়ের কতোবড় ক্ষতি চায় সামনের লোক টা! ভুল লোককে বিশ্বাস করছে রিশিতা!কিন্তু বেবি কুইন তো আর সবার মতো না সে ঠিকই বুঝতে পারছে সামনের লোকটা মুখে মধু অন্তরে বিষ ঠিক সেই রকম।নিলয় কে আবারো একবার পর্যবেক্ষন করে ঘাড় কাত করে একটা দুষ্টু হাসি দিলো সবার অগোচরে! এই হাসির আড়ালে কি লুকিয়ে আছে তা শুধু বেবি কুইনই জানে!

_______________________

বেবি কুইন কোলে নিয়ে রিশিতা ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে প্রায় আদা ঘন্টা হলো।কিন্তু কিছুতেই সে সফল হচ্ছে না।ঘড়ির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো দশ টা পয়তাল্লিশ বাজছে ঘড়িতে।একটু পর এগারো টা বাজবে!কিন্তু মেয়ের মুখে একটুও ঘুম নেই! শুধু মুখে আংগুল দিয়ে কি যেনো ভেবে চলেছে।রিশিতা ভেবে পায় না এই এতটুকু বাচ্চা কি এতো ভাবে?পরমুহূর্তেই মনে পরে ও তো আর পাঁচ টা বাচ্চার মতো না! অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী সে!মাঝে মাঝে রিশিতার খুব জানতে ইচ্ছা করে কি এতো ভাবনা তার এই ছোট্ট মাথায়!

~~~লক্ষী সোনা ঘুমিয়ে পড়ো রাত হয়েছে বেশ
স্বপ্নে তবে দেখতে পাবে লাল পরীদের দেশ।

তোমার দু’চোখ বুজবে যখন
ঝিঝিরা সব ডাকবে তখন
চুপি চুপি চাঁদটা এসে লাগিয়ে দেবে চুম
ঘুম পাড়ানি মাসি-পিসি পাড়িয়ে দেবে ঘুম।

ঘুম এসে এই দু’চোখ পেতে
উঠবে যখন গল্পে মেতে
তুমিও তখন কল্পে যাবে নীল পরীদের বাগে
ভোমরা যেথায় গুন গুনিয়ে গান করে যায় ফাগে।

ফুল সেখানে পাপড়ি মেলে
প্রজাপতি বেড়ায় খেলে
মৌমাছিরা এ ফুল ও ফুল খুঁজতে থাকে মৌ
এখন তুমি চোখটি বুজে চুপটি করে শৌ।~~~

মায়ের এই মধুর কন্ঠের কবিতা শুনতে শুনতেই ঘুমের দেশে পাড়ি দিলো ছোট্ট বেবি কুইন! ঘুমন্ত এই বেবি কুইনের মুখটা এতোই মায়াবী লাগছে যে রিশিতার মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব মায়া এই মুখটাতেই এসে জমা হয়েছে এখন।এই মায়াবী মুখের দিকে পলকহীন ভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আলতো করে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দোলনায় শুইয়ে দিলো রিশিতা।বেবি কুইন দোলনার উপর একদম উপুড় হয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে।এটা ওর নিত্য দিনের অভ্যাস!ওকে যেভাবেই শোয়ানো হয় না কেন ঘুরেফিরে ঠিক ও এইভাবেই শুবে।রিশিতা প্রথম প্রথম খুব ভয় পেতে নাক ডেভে গিয়ে আবার না নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়!কিন্তু পরে পরে ও বেবি কুইনের এই অভ্যাসের সাথে এক হয়ে গেলো।একটা মুচকি হাসি দিয়ে উঠতেই নুয়াস কে বিছানায় বেবি কুইনের মতোই উপুড় হয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকতে দেখে কাপালে হাত দিয়ে হতাশ শুরে বলে উঠলো,

—— এদের নিয়ে কই যাবো আমি! যেমন মেয়ে তেমনই বাপ!বাপ বেটি দুইটাই এক!

সকালে………..

—— আয়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়া……….

রিশিতা কিচেনে রান্না করছিলো হাঠাৎ এক বিকট চিৎকার ভেসে আছে উপরে ঘর থেকে।কপালে ভাজ ফেলে একবার উপরের ঘরের দিকে তাকালো রিশিতা।তারপর আর কিছু না ভেবেই দ্রুত পায়ে হাঁটা ধরলো।

_________________________

ঘড়ির কাটায় পাঁচ টা বাজতেই চরম বিরক্ত হলো তামসী!কেনো এতো তাড়াতাড়ি পাঁচ টা বেজে গেলো? ইশশশ এখন যদি ম্যাজিক জানতো তাহলে ঘড়ির কাটা টা ম্যাজিক করে আটকে রাখা যেতো।এসব উদ্ভট ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে এখন তামসির মাথায়!আনানও যে পাঁচ টা বাজার কারণে বিরক্ত লাগছে না এমন টা নয় সেও খুব বিরক্ত!কিন্তু তামসীর অবস্থা দেখে বেশ মজা পেলো আনান।তাই ওকে রাগানোর জন্য হু হা করে ঘর কাঁপানো হাসিতে ফেটে পরলো আনান! তামসী একে তো এতো বিরক্ত তার উপর আনানের এমন গা জ্বালানো হাসি দেখে রেগে গেলো।

—– ওই সমস্যা কি তোর?এমন পাগলের মতো হাসছিস কেন?

কমোরে দুই হাত রেখে গরম চোখের আনানের দিয়ে তাকিয়ে উক্ত কথা গুলো বললো তামসী। আনান ওর রাগ টা আরেকটু বাড়ানোর জন্য বললো,

—– আমার হাসি আমার মুখ আমার যখন ইচ্ছা তখনই হাসবো তাতে তোর কি?

—– হাঁস তোর যতো ইচ্ছা কিন্তু আমার বাড়িতে থেকে এমন অকারণে হাসতে পারবি না নিজের বাড়ি গিয়ে হাঁস!

কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো তামসী।কিন্তু আনান তো আনানই তামসীর কথা শুনে হাসির মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিলো।তামসী ওর এই গা জ্বালানো হাসি আর নিতে পারলো না তাই আসে পাশে খুঁজে একটা ক্রিকেট ব্যাট খুঁজে পেলো।ওইটা হাতে নিয়ে আনানের দিকে তেড়ে আসতেই আনান উধাও! এক দৌড়ে পালিয়ে গেছে তামসীর হাতে কাঠের ওই মোটা ক্রিকেট ব্যাট টা দেখে!এতোক্ষণ রেগে থাকলেও আনানের এই কান্ড দেখে ফিক করে হেঁসে দিলো তামসী।

চলবে,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here