বেবি কুইন,পর্ব_৪

0
1617

বেবি কুইন,পর্ব_৪
সুমাইয়া জাহান

এই পৃথিবীর যা কিছু সুন্দর তার থেকে অন্যতম হলো শিশুরা। তাদের একজন যেন একটা ফুটন্ত তাজা গোলাপ!ঠিক তেমনই ভাবে রিশিতার কাছে মনে হচ্ছে সে কোনো এক গোলাপ বাগানে ঢুকে পরেছে।যেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক গুলো তাজা ফুটন্ত গোলাম। তাদের মুগ্ধ হয়ে দেখছে বারংবার! তবুও যেন মন ভরছে না তার!তার ইচ্ছে হচ্ছে সময়টা এখানেই থমকে যাক আর সে মন ভরে তাদের এই মুগ্ধতায় নিজেকে বিলিন করে দিতে চায়!আজ শুক্রবার। সাপ্তাহে এইদিন টা যেমন বেবি কুইনের জন্য খুব আনন্দের তেমনই রিশিতার জন্যও।কেননা সাপ্তাহের এই দিনটাতে অনাথ আশ্রমের বাচ্চা গুলোকে আসে।রিশিতা যখন মা হতে পারছিলো না তখন একদম ভেঙ্গে পরেছিলো সেই সময়ই এই বাচ্চা গুলোর সাথে মিশে ওদের ভালোবাসায় নিজেকে নতুন ভাবে সৃষ্টি করে।ওদের মাঝেই মাতৃত্বের প্রথম স্বাদ পেয়েছে।তার কয়েক বছর পরেই তার শূন্য কোল জুড়ে বেবি কুইন আসে।সেই দিন গুলো কি করে ভুলবে রিশিতা! ভুলার তো প্রশ্নই আসে না।একদিকে সংসার সামলে আবার বেবি কুইনের দেখাশোনা দরুন এখন আর আশ্রমে গিয়ে ওদের সাথে দেখা করা হয়ে ওঠে না রিশিতার। তাই ও সাপ্তাহে একদিন ওদের বাড়িতেই নিয়ে আসে।এতে ওরাও আনন্দ পায় আর বেবি কুইনও তার খেলার সঙ্গী পায়।

এইসবের মাঝেই ডুবে ছিলো রিশতা। হাঠাৎ করে কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেতেই চমকে সেদিকে তাকায়।কিন্তু সেই হাতের অধিকারীকে দেখে আবার আর কোনো রিয়াকশন করলো না আগের ন্যায় বাচ্চাদের দেখতে লাগলো। পুরোনো স্মৃতিতে ডুবতে গিয়ে পুরোনো কষ্ট গুলো ভাবতে গিয়ে কখন যে তার চোখের কোনায় অশ্রুবিন্দু এসে জমাট বেঁধেছে তা খেয়ালই করেনি রিশিতা। কিন্তু তার পাশের মানুষ টার চোখ সেই অশ্রুবিন্দু গুলো থেকে এড়ায়নি। তার চোখে ঠিক ধরা দিয়েছে।নুয়াস আংগুলের এক কোনা দিয়ে রিশিতার সেই চোখের কোনে জমাট বাঁধা অশ্রুবিন্দু গুলো সযত্নে মুছিয়ে দিলো।রিশিতা এতোক্ষণ কোনো প্রতিক্রিয়া না জানালেও নুয়াসের এহেন কান্ডে চমকে উঠে ওর দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকায়!নুয়াস তা দেখে একটা মুচকি হাসি দেয়।

—– চোখের কোনায় যে অশ্রুবিন্দুর জমাট বেঁধেছে তার কোনো খবর না রাখলে তো অন্য জনকেই সেই দায়িত্ব নিতে হবে।আচ্ছা সবসময় কি আমি থাকবো তোমার চোখের পানি মোছানোর জন্য!আমি যখন থাকবো না তখন কে এসব করবে?কে………

কথা গুলো বলতে বলতে রিশিতার দিকে তাকাতেই নুয়াসের মুখ বন্ধ হয়ে গেলো।কারণ অগ্নিমূর্তি ধারণ করে আছে রিশিতা।যা দেখে নুয়াস একটা শুকনো ডোক গিললো।নুয়াসের শেষের কথা গুলো শুনে এতোটা রেগে গেছে।

—– ওএমজি ভুল জায়গায় ভুল ডায়ালগ হয়ে গেছে মনে হয়!আমি কি করে ভুলে গেলাম রিশিতা এই কথা গুলো ভিষণ ভাবে অপছন্দ করে।শুধু অপছন্দ বলছি কেন এগুলো শুনলেই তো শান্তশিষ্ট অতিমাত্রায় ভদ্রমতো রিশিতা ঠিক তার বিপরীত চরিত্র ধারণ করে।ঠিক যেন বরফের টুকরো জলন্ত কয়লার টুকরে পরিনত হয়!এরজন্য এখন আমায় কোনো না কোনো শাস্তি ঠিক দিবে।যেমন বেবি কুইন ঠিক তেমনই তার মা!একটু কিছু বলতে পারিনা এদের জ্বালায়! পুরাই প্যারাময় জীবন আমার!নুুয়াস এগুলো নিয়ে পরে অনেক গবেষণা করার সময় পাবি এখন এখান থেকে মানে মানে কেটে পর!

কথাগুলো মনে মনে বললো নুয়াস এবার একটা বোকা হাসি দিয়ে একটু একটু করে পিছতে পিছতে বললো,

—– রিশিতা আমি কিন্তু তোমায় আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্য কথাগুলো বলেছি।ওহ্ শীট আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম অফিস দশটায় একটা মিটিং আছে।এখন তো দশটা বাজতে আর মাত্র দশ মিনিট আছে।আচ্ছা আমায় এখুনি বেরোতে হবে।পরে দেখা হবে ওকে বাই…….

কথাগুলো বলে কোনোরকমে কেটে পরতে চেয়েছিলো নুয়াস।কিন্তু পারলো আর কই তার আগেই তো রিশিতা ওর কান টেনে ধরে আটকে দিলো।

—– হ্যাঁ কি বলছিলে যেন অফিসে মিটিং তাই না তা তোমার অফিসে শুক্রবারেও মিটিং হয় আগে জানতাম না তো!

কান টেনে ধরে থাকা অবস্থায়ই কথাগুলো বললো রিশিতা। নুয়াস পারেনা এখন নিজের মাথা নিজে ফাটায়! একবারও জন্য মনে এলো না আজ যে শুক্রবার! ইশশশশ কি মিস্টেক টাই না করে ফেললো।নুয়াস নিজের এই ভাবনায় হঠাতই ব্রেক কষলো। তারপর আবার নিজেকে বললো,

—– দোষ টা তো আমার নয়!যতো দোষ সব তো এই শুক্রবার টার!কেনো দেখে দেখে আজকেই শুক্রবার হতে গেলো রবি সোম মঙ্গলবারও তো হতে পারতো।তা না হয়ে আজকে শুক্রবারকেই আসতে হলো কেন?তাই এখানে শুধু শুধু আমার বেচারা মাথা টাকে ফাটাতে যাবো কেন?আমার মাথাটা কি এতোটাই মূল্যহীন নাকি??

নুয়াস তো শুধু এক ধ্যানে এইসব উল্টো পাল্টা ভাবনায় ডুবে আছে।এটা দেখে রিশিতার রাগ টা আরো দ্বিগুণ হয়ে গেলো।রাগে ফুঁসতে ফুঁসতেই বললো,

—– ভেবেছিলাম তোমায় শুধু একটা হালকা পাতলা শাস্তি দিয়ে ছেড়ে দিবো কিন্তু তুমি তা হতে দিলে না! আজকের সব রান্না আমি তোমায় দিয়েই করিয়ে নিবো।

—– নেহি এ মেনে কেয়া শুনলিয়া!

মাথায় হাত দিয়ে প্রচন্ড রকম ভেঙে পড়ার ভান করে কথাটা বললো নুয়াস।রিশিতা ওর এহেন কান্ডে চোখ গরম করে আবার বললো,

—– তোমার শাস্তি কিন্তু দ্বিগুণ করে দিবো।

কাঁদো কাঁদো কন্ঠে নুয়াস বলে উঠলো,

—– বউ গো আমার সাথে এমন অন্যায় করো না ধর্মে সইবে না!

রিশিতা ?

নুয়াস —– হে হে হে কিছু বলেনি! চলো চলো রান্না করতে দেড়ি হয়ে যাচ্ছে। তোমার থেকে শিখে আবার আমাকে তো সবার জন্য রান্না করতে হবে। ?

_________________________

নুয়াস আর রিশিতা বাগান থেকে চলে যেতেই গাছের আড়াল থেকে বেড়িয়ে এলো নিলয়।এতোক্ষণ ওদের এখান থেকে যাওয়ারই অপেক্ষা করেছিলো নিলয়।তাই গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিলো।বাড়ির গেইটে কড়া পাহারাদার আছে একটা মাছিও এখান দিয়ে গলতে পারবে না। চারিপাশেই নানারকম পাহারা বসানো।শুধু বাগানের এইদিকটায় বাচ্চাদের খেলার জায়গাটাতে তেমন কেউ নেই। রিশিতা ভিতরে গিয়েছে নিশ্চয়ই এখন ভেতর থেকে লোক পাাঠাবে ওদের জন্য। কিন্তু তার আগে কিছুটা হলেও এখানে বাচ্চা গুলো একা থাকবে।আর নিলয় এই সুযোগ টারই সদব্যবহার করতে চাইছে।তাই বাচ্চাদের দিকে এগিয়ে গেলো নিলয়।

বেবি কুইন তো আজ মহা খুশি সে তার এতোগুলা বন্ধু পেলো খেলার জন্য। এইদিনটার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে। অনাথ আশ্রমের বাচ্চা গুলো কিন্তু সমান বয়সের না এমনকি একজনও বেবি কুইনের সমবয়সী নয় কেউ পাঁচ বছরের কেউ সাত বছরের আবার কেউ দশ বছরেরও আছে।বেবি কুইনের ওদের এই দিকটাই বেশি ভালো লাগে।ওদের সাথে ওর দারুণ মিল।আর এতোটাই মিল যে ওরা ওর চোখের ভাষায়ই বুঝে যায় ও কি বলতে চায়!

সবাই একসাথে এখন একটা বড়ো বল নিয়ে ছোড়াছুড়ি খেলছে বেবি কুইন কে মাঝে রেখে সবাই গোল হয়ে দাড়িয়ে খেলছে।বেবি কুইন যেহেতু সবার ছোটো তাই ওকে ওরা মাঝে রেখেছে।একজন ওপরজন কে বলটা ছুঁড়ে মারছে ওপর জনও তা আবার আরেক জনের দিকে মারছে।এসবই হচ্ছে বেবি কুইনের মাথার উপর দিয়ে।আর যতোবারই ওর মাথার উপর দিয়ে বল টা যাচ্ছে ও লাফিয়ে সেটা ছোঁয়ার চেষ্টা করছে।একবার ছুঁতে পারলেই খিলখিল করে হাসতে থাকে বেবি কুইন। বাকিরা তা দেখে মুখ টিপে টিপে হাসে।ওরা যখন খেলায় মেতে আছে তখনই পিছন থেকে নিলয় ডেকে উঠলো।

—– কুইন আফা তোমাকে তোমার দিদিমা ডাকছে।আর এখুনি যেতে বলেছে আমার সাথে!

মুখে চওড়া হাসির রেখা টেনেই কথা গুলো বললো।সবাই খেলা বন্ধ করে নিলয়ের দিকে তাকালো।নিলয় সম্পর্কে বেবি কুইনের ওদেরও ভালো ধারণা আছে।তাই ওরা ওকে পছন্দ করে না।কেই ভালো চোখে দেখছে না ওকে!বেবি কুইন তো ওর দিকে এক ভ্রু উঁচু করে তাকিয়ে আছে।ওদের মধ্যে একটা মেয়ে বলে উঠলো,

—– কুইন তো এখন আমাদের সাথে এখানে খেলে এটা তো দিদিমা জানে তাহলে কেন ডাকবে কুইনকে দিদিমা!

ওর সাথে তাল মিলিয়ে পাস থেকে আরেকটা মেয়ে বললো,

—– হুম তাই তো!দিদিমা তো কখনো এমন করে না!তুমি মিথ্যে বলছো কেন আংকেল!

নিলয় তো পরেছে মহা বিপদ। এই বাচ্চা গুলো যে ওকে এইভাবে ঝেকে ধরবে ও বুঝতেই পারেনি।ভেবেছিলো মিসেস নাফিসার কথা বললে হয়তো খুব সহজেই নেওয়া যাবে।কিন্তু এই বিচ্ছু বাহিনী এমন করবে কে জানতো!তাও এখন নিলয় কে টা বুঝতে দেওয়া যাবে না কথাটা মিথ্যে!

—– সেটা তো আমি জানি না!সেটা তো তোমার দিদিমাই বলতে পারবো।আচ্ছা চলো আমার সাথে তার পর দিদিমাকেই জিজ্ঞেস করে নিবে কুইন আফা।তাড়াতাড়ি এসো কুইন আফা বড়ো মেডাম অনেক পর্যন্ত বসে আছে।

নিলয় তাড়া দিয়ে কোনোরকমে নিয়ে যেতে চায় বেবি কুইন কে এই বিচ্ছুদলের কাছ থেকে।কিন্তু ওরা যথেষ্ট বুদ্ধিমান তাই ওরা কিছুতেই নিলয়কে বিশ্বাস করলো না। ওদের মধ্য থেকে আবারও একজন বলে উঠলো,

—– কুইন কোথাও যাবে না তুমি চলে যাও আংকেল আর দিদিমা যদি ডাকে তাহলে রিশিতামাই কুইনকে ডেকে নিবো তোমাকে লাগবে না।আমরা তোমাকে বিশ্বাস করি না।তুমি এখান থেকে চলে যাও কুইন যাবে না তোমার সাথে!

মেয়েটা কথাগুলো বলতে না বলতেই বেবি কুইন ওদের পাশ থেকে নিলয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো আর ওর হাত ধরে বললো,

—– ডিডি যাবো!

সবাই অবাক হয়ে ওকে দেখছে।এমনকি নিলয়ও কম অবাক হয়নি বেবি কুইনের এহেন কান্ডে! কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে মনে মনে একটা শয়তানি হাসি দিলো।আগের মেয়েটা চরম অবাক হয়ে বলে উঠলো,

—– কি করছিস কুইন এই আংকেল টা ভালো না! তোর ক্ষতি করতে পারে।তুই আমাদের কাছে চলে আয়!যাস না আংকেল টার সাথে!

বেবি কুইন একবার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আবার নিলয়ের হাত ঝাঁকিয়ে বললো,

—— তলো (চলো)

চলবে,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here