বেবি কুইন,6 অন্তিম পর্ব

0
3866

বেবি কুইন,6 অন্তিম পর্ব
সুমাইয়া জাহান

তখনকার সেই অচেনা লোকটা ছিলো নুয়াস।আসলে রান্না ঘরে গিয়ে নিজের এই হাল বানিয়েছিলো।এইভাবেই হাসি খুশির মধ্য দিয়ে দিন যাচ্ছিলো সবার।তবে এর মধ্যে কিন্তু বারবার নিলয় বেবি কুইনের ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে কিন্তু কখনোই সফল হতে পারেনি।বারংবার হেরে গেছে ও!এতে করে ওর মনের মধ্যে আরো বেশি রাগ জমতে থাকলো নিলয়ের বেবি কুইনের উপর।

চারবছর পর……..

বেবি কুইন বসয় এখন সাড়ে পাঁচ বছর চলে!এখন ও ভালোভাবেই কথা বলতে পারে।তবে আগে যেমন বয়সের থেকেও অনেক বেশি মানসিক বিকাশ ছিলো এখন তা একটু একটু করে স্বাভাবিক অবস্থায় আসছে।আর পাঁচ টা স্বাভাবিক বাচ্চার মতোই আচরণ করে। কিন্তু এখন ওর মন টা ভিশন নরম বলতে গেলে একটু বিশ নরম মনের হয়ে যাচ্ছে বেবি কুইন। যার সাথে দেখা হবে তাকেই বন্ধু বানিয়ে ফেলবে।তারপর রাস্তায় কোনো অসহায় মানুষ দেখলেই সোজা বাড়ি নিয়ে আসবে।এতে অবশ্য রিশিতা নুয়াস বা মিসেস নাফিসার কোনো মাথা ব্যাথাই নেই। বরং এইসব অসহায় মানুষ দের জন্য একটা বৃদ্ধা আশ্রয়ও বানিয়ে দিয়েছেন ওরা!এইসবের কারনে বেবি কুইনের বন্ধুমহল অনেক লম্বা গুনে শেষ করা যাবে না ছোটো থেকে বড়ো সবাই ওর বন্ধু। এইতো কয়দিন আগে ওকে স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে।এই কয়েকদিনের মধ্যেই স্কুলের সবাই কে বন্ধু বানিয়ে ফেলছে।স্কুলে এমন কোনো বাচ্চা নেই যে ওর বন্ধু না শুধু তারাই না টিচারও সবাই বেবি কুইন কে খুব ভালোবাসে ইভেন ওর খুব ভালো বন্ধু সবাই!

বেবি কুইন স্কুলে ছিলো।আজ একটু তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি হয়ে গেলো।কিন্তু রিশতা নুয়াস বা বাড়ির কেউই এখনো এসে পৌঁছায়নি। কারণ তাদের জানামতে স্কুল ছুটি হতে এখনো ঘন্টা খানেক বাকি আছে।আজ কোনো এক কারণে ঘন্টাখানেক আগেই ছুটি হলো।কিন্তু এখন বেবি কইনের ভাববার বিষয় হলো সে কি এখন স্কুলের গেইটের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি একা একাই বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিবে।সে বাড়ির রাস্তা চেনে যদিওবা কখনো একা যায়নি বলতে গেলে যাওয়ার প্রয়োজন পরেনি।কিন্তু আজ কি করবে সে?বিবেক বলছে এখানেই অপেক্ষা করতে কিন্তু মন বলছে আজ নাহয় একা একাই বাড়ি গিয়ে সবাই কে অবাক করে দিবে।কিন্তু একা গেলে সবাই খুব বকবে তাই ইচ্ছে থাকা সত্বেও আর বাড়ির উদ্দেশ্য পা বাড়ায়নি বেবি কুইন। গেটের সামনেই মুখ ভার করে নিচের দিকে মাথাটা ঝুলিয়ে রেখেই দাঁড়িয়ে রইলো।

রাস্তার ওপারে এক বৃদ্ধ কোনো রকমে লাঠি ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।হঠাৎই সেইদিকে মন গেলো বেবি কুইনের।লোকটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো! একটা জীর্ণ শীর্ণ পুরোনো চাদর মোড়াবো লোকটার গায়ে।মুখটাও অনেক খানি চাদর দিয়ে ঢাকা তাই মুখের আকৃতি টা ঠিক বোঝা গেলো না।লোকটা অনেকক্ষণ যাবতই দাঁড়িয়ে আছে একই জায়গায়।আর মাঝে মাঝেই খুকখুক করে কেশে উঠছে।লোকটার জন্য খুব মায়া হলো বেবি কুইনের মনে।তাই সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না ছুটে চলে গেলো সেদিক পানে।মাঝখানে বেশ চওড়া রাস্তাও ছিলো সেদিকে কোনোরকম ভ্রুক্ষেপই করলো না বেবি কুইন। ভাগ্যিস তখন রাস্তা ফাঁকা ছিলো নয়তো কই থেকে কি হয়ে যেতো।

বৃদ্ধ লোকটির কাছে গিয়ে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই লোকটার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,

—– দাদু তুমি কি অসুস্থ?তাহলে আমার সাথে চলো আমাদের একটা আশ্রয় আছে ওখানে তুমি থাকতে পারবে!

হাঁপাতে হাঁপাতে কথা গুলো বলে শেষ করার আগেই বেবি কুইনের নাকে কেমন টা গন্ধ এলো।তারপর আর হুস নেই ওর।

___________________________

চোখ খুলতেই নিজেকে একটা বদ্ধ জায়গাতে আবদ্ধ দেখে চমকে উঠলো বেবি কুইন! আরো বেশি অবাক হলো যখন উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে নিজেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় আবিষ্কার করলো।যখন কোনো দুষ্টু লোকেরা বাচ্চাদের অপহরণ করে তখন এইরকম একটা জায়গায় এইরকম ভাবে আবদ্ধ করে রাখে এটা টিভিতে দেখেছিলো একবার! কিন্তু সে তো কাউকে কিচ্ছুটি করেনি!তাহলে কেনো তাকেও এমনভাবে বেঁধে রাখলো।বুড়ো দাদুকে সাহায্য করা কি খারাপ?সে তো শুধু একটু বুড়ো দাদুকেই সাহায্য করতে চেয়েছিলো এতো দোষের কি হলো?হঠাৎ করেই দরজা খোলার খটখট আওয়াজ হলো! বেবি কুইন তাকাতেই দেখতে পেলো দুইজন লোক খাবার নিয়ে ভিতরে ঢুকছে।এটা দেখে ওর মুখে হাসি ফুটে ওঠলো। হাত পা বাঁধা না থাকলে দৌড়ে গিয়ে আংকেল টাকে জিগ্যেস করতো কিন্তু এখন তো আর তা করতে পারবে না!তাই বলে সে কিন্তু দমে যাবে না।

—— শোনো আংকেল!

পাঁচ বছর বয়সী একটা বাচ্চা মেয়েকে কিডন্যাপ করার পর আবদ্ধ করে রাখার পর যখন ভয় পাওয়ার বদলে সেই মেয়েই এমনভাবে ডাকে তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই অবাক হওয়ার বিষয়।নিশ্চয়ই এখন বলবে ছেরে দিতে।

—– শোনো মেয়ে তোমাকে আমরা এমনি এমনি ছেড়ে দিতে আনিনি।বলে লাভ নেই তোমাকে আমরা ছারবো না।

—– তুমি তো দেখি খুব বোকা আংকেল!আমি কি বলছি তোমায় আমাকে ছেড়ে দেও?আমি জানি তোমরা এখন আমায় ছাড়বে না।কিডন্যাপ করেছো তো তোমরা ভুলে গেলে নাকি?

বেবি কুইনের মুখে এরকম কথা শুনে লোকগুলো একে অপরের দিকে তাকিয়ে আবার ওর দিকে তাকালো।

—– তাহলে কেন ডাকছো কেন?

খুব অভিমান নিয়ে বেবি কুইন জবাব দিলো।

—– তোমরা কি আমায় একটু পর কিডন্যাপ করতে পারলে না?

—– কেন একটু পর করলে কি হতো?

—— কি আবার হতো আমি দাদু টাকে আমাদের আশ্রয়ে দিয়ে আসতে পারতাম।তোমরা এতো পঁচা অংকেল!কথা বলবো না তোমাদের সাথে হুম!

ওর কথা শুনে দুজন লোকই হু হা করে হেঁসে দিলো।ওদের হাসি দেখে ভ্রু কুঁচকে আবার জিজ্ঞেস করলো,

—– তোমরা হাসছো কেন?তোমরা তো খুব পঁচা আংকেল!জানো দাদু টা না অসুস্থ ছিলো।কেমন খুকখুক করে কাশিও হচ্ছিলো দাদু টার!কিন্তু তোমাদের জন্য দাদু টাকে আশ্রয়ে দিয়ে আসতে পালাম না!

কথা গুলো বলতে বলতেই ভ্যা ভ্যা কেঁদে দিলো বেবি কুইন।ওর এমন কান্না দেখে লোকগুলো হতভম্ব হয়ে গেলো।

—– আরে মেয়ে কেঁদো না!ওই লোক কোনো দাদু ছিলো না ও তো বুড়ো লোক সেজেছিলো….

কে শোনে কার কথা!বেবি কুইন তো ওর মতোই কেঁদে যাচ্ছে।কোনো কিছুই কানে নিচ্ছে না সে।তাঁর শুধু একটাই কথা দাদুকে এনে দিতে হবে।ওর কান্না একদম অসহ্য হয়ে গিয়ে ওকে থামানোর জন্য বলে উঠলো,

—– দাদুকে এনে দিবো মা এবার চুপ কর দয়া করে!

দাদুকে এনে দিবে শুনেই কান্না মুহূর্তেই গায়েব হয়ে সেই মুখেই খুশীর জ্বলক ফুটে উঠলো।

—– সত্যি বলছো আংকেল?তাহলে তোমাকে আর পঁচা আংকেল বলে ডাকবো না ভালো আংকেল বলবো।কই তোমরা যাচ্ছো না কেন দাদুকে আনতে!এখুনি যাও বলছি!শুধু কাজে ফাঁকি দেওয়া ধান্দা করছো!এখুনি যাও!

ওকে যে এখানে কিডন্যাপ করে আনা হয়েছে তা যেন বোঝায়ই যাচ্ছে না বরং মনে হচ্ছে কোনো রানী তার প্রজাদের হুকুম দিচ্ছে। ওদের মধ্যে একটা লোক বেরিয়ে পরলো।কারণ জানে এই মেয়ে ওই দাদুকে না পেলে ওদেরই দাদু বানিয়ে দিবে!কিন্তু এখন মহা বিপদের মধ্যে রয়েছে যে বেবি কুইনের সাথে ছিলো তার।বেবি কুইন তো ওকে পুরো জ্বালিয়ে খাচ্ছে।

—— আংকেল বল না কখন আসবে দাদু!এখনো আসছে না কেন?ওই আংকেল টা এতো দরি করছে কেন?তুমি একটু যাও তো দেখে আসো কেন আসছে না!দাদুকে আনতে গিয়েছে তো!নাকি দাদুর বাড়ি ভুলে গেছে?কি হবে এখন! ও দাদু তুমি কই!এখনো আসছে না কেন?

এরকম আরো কতো কি যে বলছে তার ঠিক নেই। লোকটা ওর প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে অবস্থা নাজেহাল! ওর সামনে মাফ চাওয়ার ভঙ্গিমায় হাটু গেড়ে বসে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললো,

—– মা ছাইড়া দে কাইন্দা বাঁচি!

—– ওমা আমি তোমায় কখন ধরছিলাম?

অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো লোকটার দিকে। লোকটা পারে না এবার নিজের মাথা নিজে ফাটায়।এমন বাচ্চা জীবনে কোনোদিন দেখেনি সে!হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে লোকটা যেন হাফ ছেড়ে বাচলো!
আগের লোকটা আর নিলয় ডুকছে এই ঘরে।নিলয় কে দেখে বেবি কুইন রেগে গিয়ে বললো,

—– কোথায় আমার দাদু!এটা তো আমাদেরকে বাড়ির পঁচা আংকেল টা!

আবার তার কান্না শুরু হয়ে গেলো।এখন আর ওর হাত পা বাঁধা নেই।তাই হাত পা ছুড়েই কান্না জুড়ে দিলো।ওর এমন কান্নায় তিনজনই দৌড়ে আসলো।

—– আরে কাঁদছো কেন এটাই তো তোমার সেই দাদু!

—– মিথ্যে বলছো কেন?

কান্না থামিয়ে এক ভ্রু উঁচু করে প্রশ্ন টা ছুড়লো বেবি কুইন।ওরা জানে ওদের কথা ও বিশ্বাস করবে না তাই একটা লোক গিয়ে জীর্ণ শীর্ণ পুরোনো চাদর আর লাঠি নিয়ে এসে নিলয়ের গায়ে পেচিয়ে আগের মতো সেই বুড়ো দাদু বানিয়ে দিলো।আবার ধমক দিয়ে আগের মতো খুকখুক করে কাশতেও বললো।যাতে পুরো পুরি ভাবে বিশ্বাস করে।এটা দেখে আরো জোরে কান্না জুড়ে দিলো বেবি কুইন।

—– এ্যায়য়য়য়য়া তুমি মিথ্যে দাদু!!

ওর কান্না শব্দ অনেক জোরে হচ্ছেছিলো।ঠিক তখন আচমকা দরজায় কারো লাথির শব্দে সবাই চমকে সদিক পানে তাকায়!!

—– কি হইতাছে ডা কি এইনে!এইডা কোনো অনাথ আশ্রম না যে তোরা বাচ্চা পালবি এইনে!ওই তোরা ওই পোলারে ধর!

লোকটার কথায় সাথে সাথেই অনেক গুলো লোক এসে নিলয়কে ধরে বেঁধে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলো।নিলয় তো অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আসে।কারণ ওই ওদের হাতে বেবি কুইন কে তুলে দিছে ওর কোনো একটা ক্ষতি করে দেওয়ার জন্য।

—— বস এটা কি করছেন আমাকে কেন ধরছেন?আমি তো আপনাদের এই মেয়ের সন্ধান দিলাম।

চেয়ারে হাত পা বাঁধা অবস্থায় অবাক চোখে কথা গুলো বললো নিলয়।বিনিময়ে বস লোকটা হু হা করে হাসতে লাগলো।

—– তুই চালাকি কইরা আমাগো পুলিশে ধরানোর জন্য এই মাইয়ারে আমাগো কাছে পাঠাইছোস কি মনে করছ আমরা কিছুই বুঝি না।পুলিশ আমাগো এই ডেরার খবর পাইয়া গেছে।তার আগেই তোরে আমরা শেষ কইরা এই মাইয়ারে নিয়ে পগারপার হইয়া যামু!তোরা খাড়াইয়া দেখস কি মার শালারে!

—– না তুমি আমার পঁচা আংকেল কে কিছু করবে না…………

কথা গুলো বলতে বলতেই নিলয়ের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরলো বেবি কুইন! ঠিক তখনই পিস্তল তাক করা ছিলো নিলয়ের দিকে।হঠাৎই একটা চাপা চিৎকারে আওয়াজ ভেসে আসলো সেখান থেকে!কেউ ঠিকভাবে বুঝতেই পারলো না এখানে কি হচ্ছে। যখন নুয়াসকে মাটিতে লুটিয়ে পরতে দেখলো বেবি কুইনের চিৎকারে সবার হুস ফিরলো।

—— বাবায়য়য়য়য়য়য়য়য়া!!!

আর কিছুই বলতে পারলো না ওখানেই নিজেও লুটিয়ে পরলো।তবে মাটিতে পরে যাওয়ার আগেই রিশিতা ওকে ধরে ফেললো।গুলি চলার সময় বেবি কুইন যখন নিলয়ের সামনে দাঁড়ালো তখনই রিশিতা নুয়াস সহ পুলিশরা এসে পরে নুয়াস সবার সামনে থাকার কারনে বেবি কুইনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় ওকে বাঁচানোর জন্য! আর গুলিটা ওর গায়েই লাগে।একদম হার্টে গুলিটা লাগাতে সাথে সাথেই মৃত্যু ঘটে ওর।নিলয় এখন ভিষণ অনুতপ্ত হলো।তাই সে নিজেই পুলিশেী কাছে ধরা দিলো।আর এই পর্যন্ত করা সব অপরাধই শিকার করে নিলো।

রিশিতা একদিকে অজ্ঞান হয়ে যওয়া মেয়েকে কোলে নিয়ে মৃত্যু স্বামীর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।কথায় আছে না অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথর!ঠিক তেমনই রিশিতা এখন কাঁদতেই ভুলে গেছে শুধু এক দৃষ্টিতে নুয়াসের দিকে তাকিয়ে রইলো।

তিনদিন পর………

হাসপাতালে অনেকক্ষণ যাবত মেয়ের পাশে বসে আছে রিশিতা!পাশেই একটা শীটে বসেছে মিসেস নাফিসা!সেদিন পর থেকে এখনো পর্যন্ত হসপিটালে ভর্তি আছে বেবি কুইন এখনো জ্ঞান ফিরেনি তার।সেই যে জ্ঞান হারিয়েছে এখনো সেইভাবেই আছে।সবার অবস্থা এখনো খুব খারাপ!মিসেস নাফিসা ভিশন ভাবে ভেঙ্গে পরেছিলেন।উনার অবস্থাও খুব খারাপ ছিলো।তবে রিশিতা এক ফোঁটাও চোখের পানি তো দূরের ব্যাপার মুখ থেকে একটা শব্দ বের করেনি সে!একজন নার্স ঢুকে একটা কাগজ হাতে নিয়ে রিশিতার সামনে গিয়ে বললো,

—– আপনি তামসীর মা!

মিসেস নাফিসা মনে করেছেন হয়তো ভুল কেবিনে এসেছে নার্স টা তাই বিরক্ত নিয়ে বলতে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই পাশ থেকে রিশিতা জবাব দিলো,

—— হ্যাঁ আমিই তামসীর মা বলুন!

মিসেস নাফিসা অবাক চোখে রিশিতার দিকে তাকিয়ে বললো,

—– কি বলছো কি রিশিতা?তামসী???

—– হ্যাঁ মা আমি ঠিকই বলছি ও আজ থেকে তামসী! বেবি কুইনের অস্তিত্ব সেদিন নুয়াসের সাথেই কবরে চলে গেছে।আজ থেকে নতুন এক তামসীর জন্ম হলো।যার কোনো বন্ধু নেই যে কারো কথা ভাববে না।কারো সাথে মিশবে না।সম্পুর্ন একলা জগৎ হবে ওর! যেই জগৎ ও বিহীন দ্বিতীয় কেউ থাকবে না।আজ থেকে ও শুধু চারদেয়ালে মধ্যেই থাকবে।এমন কি সূর্যও পৌঁছাতে পারবে না ওর কাছে।আমি আর হারাতে পারবো না কাউকে?

বলতে বলতেই কেঁদে ভেঙ্গে পরলো রিশিতা।এই তিনদিন পর আজ প্রথম কথা বললো আর প্রথম কান্না করলো।

তারপর থেকে একটু একটু করে বেবি কুইন কে গড়ে তুললো তামসী রুমে। যে চার দেয়ালের বাইরে বের হয় না।এমনকি পড়াশোনাও চার দেয়ালের মধ্যে থেকেই করেছে তামসী।একদম একঘেয়ে হয়ে উঠলো।যে কারো সাথে মিশে না কারো সামনে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে না।নিজের কষ্ট নিজের হাসি সব কিছুই নিজের মধ্যেই রেখে দিলো।কখনো কারো সামনে প্রকাশ করে না।তবে ধীরে ধীরে রিশিতার ভুলটা রিশিতা নিজেই বুঝতে পারে।নিজের জেদ কে ধরে রাখতে গিয়ে মেয়েটার জীবন শেষ করে দিচ্ছে না তো!তাই তামসী যখন কলেজ শেষ করে ভার্সিটিতে উঠলো তখন আর চার দেয়ালেই তার পড়াশোনা আবদ্ধ রাখলো না।হাজার হাজার স্টুডেন্টের সাথে একসাথে ভার্সিটিতে পড়তে লাগলো তামসী। কিন্তু কাউকেই বন্ধু হিসেবে মেনে নিতে পারলো না সে!আস্তে আস্তে আনানের সাথে ওর পরিচয় হতে লাগলো।আনান ঠিক ওর মনের মতোই ছিলো।ওদের পরিচয় টা ধীরে ধীরে খুব ভালো বন্ধুত্বে পরিনত হলো।তবে আনান কিন্তু তামসী কে একজন বন্ধুর থেকেও বেশি কিছু সোজাসাপটা বলতে গেলে তামসী সে ভিশন ভাবে ভালোবেসে ফেলে।তাই ও নিজেই তামসীর বাড়ি বিয়ের প্রস্তাব দেয়।তামসীরও যেহেতু আনান ছাড়া আর কারো৷ সাথেই মিশতো না তাই ওদের পরিবারের সবাই খুব সহজেই রাজি হয়ে গেলো।আর তামসীকে ও প্রতিনিয়ত স্বাভাবিক করে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে ও এখন অনেক খানিই সফল! তামসী এখন অনেক টাই স্বাভাবিক আচরণ করে।সেটা শুধুমাত্র আনানের জন্যই।

—— এই ছিলো বেবি কুইন থেকে তামসী হয়ে উঠার গল্প!

মিসেস নাফিসা চোখের চশমাটা শাড়ীর আঁচলের এক কোনা দিয়ে মুছতে মুছতেই কথাটা বললেন।তখন ঘড়িতে ঠিক বিকেল পাঁচ টা বাজতে লাগলো।তামমী তো অবাক হয়ে তার দিদিমার দিকে তাকিয়ে ছিলো এতোক্ষণ। আনানোর অবস্থাও তাই ছিলো।

—— দিদিমা আমি ছোটো বেলায় এমন ছিলাম?

—— তোকে এতোদিন সামনে থেকেও বুঝতে পারলাম না পেতনী তুই এমন ছিলি!

তামসীর কথার জবাবে আনান ফোঁড়ন কেটে কথা টা বললো তামসীকে রাগানোর জন্য। ব্যাস শুরু হয়ে গেলো ওদের টম এন্ড জেরির দৌড়াদৌড়ি!

_______________________

তামসীকে অপারেশন থিয়েটার ঢোকানো হয়েছে সেই তিন ঘন্টা আগে কিন্তু এখনো কেউ বের হচ্ছে না।তাই দেখে আনানের চোখ মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠলো।শুধু তার না রিশিতারও একই অবস্থা। দেড় বছর আগেই অনেক ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে যায় তামসী আর আনানের।দুমাস পর তামসীর ডেলিভারিতে ডেড ছিলো।কিন্তু আজ হঠাৎ করে প্রচন্ড রকম ভাবে অসুস্থ হয়ে পরে তামসী!হসপিটালে আনার কিছুক্ষণ পরই তাকে ওটিতে ঢোকানো হয়।কিন্তু এখনো কোনো খবর পাওয়া যায়নি কারো।হঠাৎ করে দরজার উপর থাকা লাল বাতিটা নিভে গেলো আর তাতেই সবাই দরজার সামনে ভীর জমালো।একজন ডক্টর বের হয়ে এসে আনাকে বললো,

—— কংগ্রাচুলেশনস আপনি কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছেন।

সাথে সাথেই কাউকে ঢুকতে দিলো না মা মেয়ের কাছে! দুমাস আগে জন্ম নেয়ার জন্য নানারকম সমস্যা দেখা দিয়েছে বাচ্চার মধ্যে।চারপাঁচ ঘন্টা পর সবাইকে ঢুকতে দেয়া হলো তামসীর কেবিনে।সবার আগে আনান কোলে নিতে চাইলো তার মেয়েকে তাই সবাইও রাজি হয়ে গেলো।একজন এসে বাচ্চা টাকে আনানের কোলে তু্লে দিলো।বাচ্চা টাকে কোলে নিতে না নিতেই এক নাম্বার সেরে ফেললো তার কোলে।আনানের তো চোখ কপালে এখন!সবাই অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।রিশিতা আনমনেই বলে উঠলো,

—– বেবি কুইন!!

__________________সমাপ্ত _____________________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here